পর্ব-৩
আদি
কাঁঠের কতগুলো টুকরোর ওপর শুয়ে আছি আমি। চারদিকে ভাঙা দেয়াল। মাথার ওপর আধাভাঙা ছাদ, মেঝেতে ইটের স্তূপ। সম্ভবত গাঘেঁষা দেয়ালে ঘুমের তালে ছুড়ে দেওয়া হাতটা লেগেছে। নুনছাল উঠে জ্বলছে বড়। ডানদিকে দুহাত দূরে অপর একটা কাঠে শুয়ে ঘুমাচ্ছে নীল নয়না সালিমা।
তার নাক ডাকার শব্দ থেকে থেকে বেড়ে যাচ্ছে, তখনই সে নড়ে উঠছে। কতগুলো শেয়াল ডেকে উঠলো রাতের তৃতীয় প্রহরের ঘোষণা দিয়ে। ঘরের কোণে বাদুড়দের স্থান বদলের মৃদু গুঞ্জন।
বিধস্ত নগরীর রাত যে কতটা প্রেতময় সেদিনই প্রথম জানলাম। থেকে থেকে অচেনা প্রাণী ডেকে উঠছে, কোথাও বিকট শব্দে ধসে পড়ছে। যাও একটু আশ্বস্ত করে সলিমার গভীর ঘুমের নাকের ডাক—সেই শব্দ ছাপিয়ে ওঠে সাপের শীৎকার, বাজের চিৎকার, মৃত আত্মাদের বুকের আটকে থাকা আহত হাহাকার। (পরে সালিমা বলে ছিল, এই হাহাকারময় চিৎকার আসলে বিধস্ত দেয়ালের ফাঁকেফুকে ঢুকে পড়া বাতাস থেকে।)
আকাশময় তারা মিটমিট করছে। এই আকাশও আমার অচেনা। আমার চেনা আকাশে ছিল না কোনো তারা। এখানে সংখ্যার চেয়ে তারা বেশি। রাতের পলে পলে তারা অশ্রুপাত করে অন্ধকার আদ্র করে তুলে।
এই অনন্ত নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, পৃথিবীতে আমার এমন কেউ থাকতেই পারত; যাব বুক থেকে ওঠে আতরের গন্ধ। এই দুর্বোধ্য পৃথিবীর সহজিয়া আকাশের নক্ষত্রের মতো একফোঁটা চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দীর পিপাসার্ত নগরী লোভীর মতো তা গিলে ফেললো।
এই বিধস্ত নগরীরর নিষাদ নিঃশ্বাসের ভেতর রাতের শেষ প্রহরে আমার চোখ লেগে এলো। আমি ঘুমের দুচারটা স্তর ভেদ করে এসে সবে মাত্র গুছিয়ে বসেছি। কে যেন কথা বলে উঠলো—ও বাবা ভালো আছিস? সবুজ একটা লাল আলো ভেসে ওঠে ঝলসে গিয়ে লালচে হয়ে এলো। রক্তিম প্রজাপতিওয়লা ক্লিব কারও চুলের ঝুটিতে পাখা নাড়াল। কেউ আমাকে ডাকল, যাবেন?
: কোথায়?
: শিকারে?
: কখন? আসলে ঘুর আর জাগরণের মাঝের দেয়ালটা তখনো শক্তপোক্ত গেড়ে আছে। আমি ঘুমের ওই পাড় থেকে জানতে চাইলাম।
: এখনই, এখন না গেলে পাবেন কিছু?
: সাত সকালেই যাও? ততক্ষণের ঘুমের মায়াবি পর্দা পাতলা হয়ে এসেছে। বুঝতে পারছি আমি স্বপ্নে না, বাস্তবেই আছি।
: হুম।
: চলো। তার আগে…আমি আধা ঘুম, আধা জাগ্রত অবস্থায় উঠে বসলাম। আসলে বিপত্তিটা বাধিয়েছি আমিই। ফলমূল খেতে খেতে মুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে। গতকাল কথায় কথায় বলেছিলাম—মাংস পেলে বেশ হতো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সকালের প্রিয় ঘুমকে হত্যা করে সালিমার এই উদ্যোগ।
অর্ধ ঘুমন্ত হাতে ব্যাগ থেকে নতুন একটা ট্রাউজার্স আর হলুদ গেঞ্জি দিলাম তাকে, পরে নাও।
গতকালই ভেবেছিলাম, তার এই হতশ্রী পোশাকটা পালটানো দরকার। প্রথম সে আপত্তি করলো। পরে অবশ্য পরলো। বললো, ময়লা হয়ে যাবে এটা, কালো রঙের দেখলাম, ওটা দেন।
: হ্যাঁ, অবশ্যই। এই নাও। কষ্ট হলেও আমি তাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় ভি-কলারের পোর্স্ট্রের ৭০ নম্বর লেখা কালো জার্সিটা দিলাম।
যখন ছোট ছিলাম, গ্রামে লিগ খেলতাম, এটা ছিল আমার জার্সি নম্বর। তারপর থেকেই এই নম্বরের প্রতি আমার এক অকারণ দুর্বলতা। সত্তর নম্বর লেখা গেঞ্জি আমি কিনে, বানিয়ে যেভাবে পেরেছি নিজের জন্য রেখেছি এবং পরেছি। এরপর হয়তো আর কোনোদিনই পরা হবে না। ততক্ষণে অবশ্য আমার ঘুম পুরোপুরি উবে গেছে।
আমার প্রিয়তম গেঞ্জিটা তাকে দিলাম আর সে ধন্যবাদ দিলো। শিকারের জন্য কালো রঙ ভালো—বললো সে।
—শিকার বুঝে উঠতে পারে না। আমি ওর চুলে লেগে থাকা কতগুলো ঘাসবিচালি টেনে বের করে দিয়ে বললাম।
ঘাসবিচালি বের করতে দেখে প্রথমে চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সালিমার বাসি মুখের মিষ্টি গন্ধ চুমুর জন্য আমাকে প্রচণ্ডভাবে প্ররোচিত করলো। কিন্তু সংবরণ করলাম। হঠাৎ কে যেন ভেতর থেকে বলে উঠলো—যথেষ্ঠ, এবার থামো।
ততক্ষণে আমি পুরোপুরি জাগরণে এবং চুম্বনেচ্ছার মনবাসনাকে যথারীতি কবর দিয়ে দিয়েছি। সবকিছুর একটা স্থান, কাল আছে। আমি তার অপেক্ষায় রেখে দিলাম এই চুমু। তবু কি মন মানে?
এই বিধস্ত নগরী, হাতের কাছে একটা মেয়ে, তাকে চুমু খেলে কেই-বা ফেরাতো? ভেতরের সেই অচেনা গতিবেগ, যাকে মানুষ হৃদয় বলে, তার উদ্দেশে বললাম—হচ্ছেটা কী? সে বললো, বাছা, ওখানে আগে নিজের একটা তাজমহল গড়ে তোলো। তারপর ঘুরে বেড়াও। আমি বললাম, আচ্ছা।
চিরদিন কারও সমান নাহি যায়। আমি মনে করি, সমান যাওয়া উচিতও না। পরিবর্তন হওয়া দরকার।
সালিমার এত কাছে গিয়ে ওর চুলের ঘাসবিচালি এনে দিলাম, তাতে তাকে এতটুকু বিচলিত দেখা গেলো না। শুধু ওই হাসিটুকোতে তার সেই বিধস্ত নগরীর সম্রাজ্ঞীর বোলচাল খেলা করে গেলো। তারপর এমন নির্বিকারভাবে আমার চোখে চোখ রাখলো—আমিই চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। সে চোখের যে ভাষা, তাতে আমি দেখলাম লেখা—হে পুরুষ! তোমার কী পাষণ্ড জাগ্রত হয়েছে, তাহলে যা খুশি করো। দাঁতে কাটবে কাটো। চোখ উপড়ে নেবে, ধর্ষণ করবে—করো, বাধা নেই। কেনই-বা বাধা দেবো? আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার কী-বা বাকি আছে? এই যে বিধ্বস্ত নগরী দেখছ, এর ধ্বংসস্তূপের তলে আমার সবকিছু সমাধিস্ত হয়ে গেছে। আত্মীয়-পরিজন-প্রেমিক-প্রতিরোধ। তুমি আমার কাছ থেকে আর কী নেবে?
অবশ্য এসবই আমার ঊর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফল মাত্র। আবার কল্পনা নাও হতে পারে। কারণ তার চোখে সেই দৃষ্টির কত অর্থই তো হতে পারে।
সালিমা ঠাণ্ডা গলায় বললো—চলুন, নাকি?
: চলো। সালিমা আমাকে এখনো আপনি করে বলে। আমি তাকে শুরু থেকেই তুমি বলছি। কারণ সে আমার থেকে কমপক্ষে এক যুগের ছোট হবে।
শিকারের উদ্দেশ্যে সালিমার পেছনে হাঁটছি আর ভাবছি, এই জীবনের সমস্ত দুঃখ যদি ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নেওয়া যেতো। আমি আনমনে বললাম—আমি পৃথিবীর ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে চাই, তুমি কি আমাকে একটা পুলটিস লাগিয়ে দেবে আমার ক্ষতগুলো সারাতে? ব্রাকেটে বলে রাখি, এই বাক্যটা ছিল খুব সচেতনভাবে বলা এবং ফিসফিসের চেয়ে একটু উচুস্বরে। কিন্তু অভিনয় ছিল আনমনের। অবশ্য এতে কোনো দোষের কিছু দেখি না আমি। দোষ যদি হয়ে থাকে, সে আমি ভালোবাসা পেতেই করেছি। ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, পৃথিবীর যদি আর সব মিথ্যা হয়ে যায়—তাতে কারও কিচ্ছু আসে-যায় না। এ দোষে যদি আমার মৃত্যুদণ্ড হয়, হোক।
সালিমা হাঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি হুড়মুড় করে তার ওপর গিয়ে পড়লাম। ভাবলাম যাক সে আমার কথা শুনেছে। তাতে বুকটা একটু কেঁপেও উঠলো। হঠাৎ যদি আমার ধারণার উলটো চিত্র দেখা দেয়। রেগে যায়! তখন কী হবে? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বললো—হয়েছে কী আপনার? কী অত ভাবেন? এখানে ভাবনা-চিন্তা করে সারভাইভ করতে পারবেন না তো।
—ভাবছি এখানে তোমার সঙ্গে আজীবন থেকে যাবো।
আমি সাহস করে বললাম, মানুষের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এই বিধস্ত নগরী; যেখানে পদে পদে মানুষের শত শত চিহ্ন, কিন্তু মানুষ নেই। মানুষ বলতে তুমি আর আমি।
আরে হয়েছে। কবিতা-টবিতা লিখতেন নাকি কোনোকালে?
না। লিখি না। তবে মানুষ তো নিজেই একটা কবিতা।
আরে বাপরে… তাই নাকি। কবিতা খুব পছন্দ করলেও কবিদের আমি একচোখেও দেখতে পারি না। এ জীবন কবিতার চেয়ে ভিন্ন জিনিস, বাস্তবতার কংক্রিটে মুখ ঘষে যাওয়ার মতো, এখানে কবিতা পোষায় না।
তাহলে? কবিতা তো আমি লিখি না। কিন্তু অন্তকরণে একজন খাটি কবিতা। আবার যেখানে তুমি আছ—সেখানের সব বাস্তবতা, প্রতিটি ইটের টুকরোই তো কবিতা। ওই যে দেখ, পাষাণের বুক দীর্ণ করে যে লতাগুল্ম গড়িয়েছে—এ তো কবিতার একেকটি স্তবক। আর তুমি তার অন্ত্যমিল।
আহা…মারহাবা…কেয়া বাত…ব্রাভো ব্রাভো। আর বলতে হবে না।
সত্যি কথা হচ্ছে, ভাবছি এখানে যে থাকবো, তার জন্য তো কিছু বন্দোবস্ত করা দরকার, তাই না? তার জন্য ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। প্ল্যান-প্রোগাম। এই মনে করো, কথা-কম্বল, ঘরদোর।
আমি যে এতদিন ধরে এই প্রেতনগরী পাহারা দিয়ে চলেছি, খাবারের চিন্তা ছাড়া তো আমার আর কিছুই করা লাগেনি।
চিরদিন কারও সমান নাহি যায়। আমি মনে করি, সমান যাওয়া উচিতও না। পরিবর্তন হওয়া দরকার।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-২ ॥ রাশেদ সাদী