চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহেদ কায়েস : এবারের বইমেলায় আমার দুইটি কবিতার বই এবং আড়াই ফর্মার একটি কবিতা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। চৈতন্য প্রকাশনী (স্টল নম্বর ৪৭-৪৮, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’, ভাষাচিত্র প্রকাশনী (প্যাভিলিয়ন নম্বর ৩২, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ এবং বেহুলাবাংলা প্রকাশনী (স্টল নম্বর ৩৮৪― ৮৫, ৮৬, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেহুলাবাংলা কবিতা সিরিজের পুস্তিকা ‘বেহুলাবাংলা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠকবিতা’।
‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ বইটি এ বছর প্রকাশিত হয়েছে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানের তিনটি প্রকাশনী থেকে― ভারতের আগরতলা থেকে ‘নীহারিকা’, কলকাতা থেকে ‘কবিতা আশ্রম’ এবং ঢাকা থেকে ‘ভাষাচিত্র’ বইটি প্রকাশ করেছে। ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’ এবং ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’র প্রচ্ছদ করেছেন কবি ও চিত্রশিল্পী রাজীব দত্ত। ‘বেহুলাবাংলা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠকবিতা’র প্রচ্ছদ করেছেন কবি চন্দন চৌধুরী।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
শাহেদ কায়েস: মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের একটি সংস্কৃতি দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে আমাদের দেশে। প্রতিবছর বইমেলাকে ঘিরে লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। আমার মনে আছে স্কুল-কলেজে থাকতে সারা বছর আমি মাটির ব্যাংকে পয়সা জমাতাম বইমেলায় বই কিনবো বলে। এই মেলাকে উপলক্ষ্য করে ঢাকা, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও অনেক লেখক, পাঠক আসেন বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায়। সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়, আড্ডা হয়, ধারণা, মতামত বিনিময় হয়। এটি একটি দারুণ গেট-টুগেদার। আমি মনে করি, একুশে বইমেলা আমাদের একটি দারুণ উদ্যোগ। তবে, পাশাপাশি এও সত্য যে, শুধুমাত্র একটি মাসে একই সঙ্গে এতো-এতো বই প্রকাশের কারণে প্রকাশকদের ওপর বড় চাপ পড়ে যায়। যেহেতু প্রকাশনা একটি শিল্প, এর সঙ্গে অনেক মেধা-শ্রম-ঘাম জড়িত―পাণ্ডুলিপি তৈরি করা, সম্পাদনা করা, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ তৈরি করা, প্রিন্টিং, বাঁধাই এমন অনেকগুলো বিষয় জড়িত। তাই এখানে তাড়াহুড়া করতে গেলে ভালো, সুসম্পাদিত, মুদ্রণপ্রমাদহীন একটি বই প্রকাশ সব সময় সম্ভব হয় না। আমরা জানি, সভ্যতার একটি বড় বাহন হচ্ছে বই। বই প্রকাশের মত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সময় নিয়ে ভালোভাবে করা উচিত। কাজেই আমি মনে করি, শুধুই বইমেলার সময় বই প্রকাশ না করে, সারা বছরই বই প্রকাশের একটি সংস্কৃতি আমাদের গড়ে তোলা উচিত।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
শাহেদ কায়েস : একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কিছুটা প্রভাব তো ফেলেই। আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে, অসুস্থ দৌড়-প্রতিযোগিতার করপোরেট সংস্কৃতির যুগে, যেখানে মানুষের নিজের দিকে তাকানোরও সুযোগ থাকে না, সেখানে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে প্রতিবছর একুশে বইমেলার যে আয়োজন, বইকে ঘিরে যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। মাসব্যাপী এই বইমেলার আয়োজন আমাদের বাংলাদেশের বাঙালি জীবনে একটি বড় ঘটনা। আর সাহিত্য তো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কাজেই সাহিত্যে এর প্রভাব পড়বেই।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
শাহেদ কায়েস : আমি মনে করি একুশে বইমেলা আয়োজন প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে বড় একটি ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর মাসব্যাপী এই মেলায় অসংখ্য দর্শক-পাঠক আসেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের। দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রতিদিনই বই সম্পর্কে, লেখক সম্পর্কে, বইমেলা সম্পর্কে সংবাদ ছাপা হচ্ছে, সম্প্রচার হচ্ছে। তরুণদের যারা বইমেলায় আসছেন, সবাই হয়তো বই কিনছেন না― অনেকেই বন্ধুদের সঙ্গে স্রেফ আড্ডা দিতে, সময় কাটাতে কিংবা প্রেম করতে বইমেলায় আসছেন। এটাকেও আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। বই দেখতে দেখতেও তো বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, বই পাঠের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
শাহেদ কায়েস: বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা অবশ্যই থাকা উচিত। আমাদের দেশে এটি একটি বাজে প্রবণতা যে, টাকা হলেই যে কেউ বই প্রকাশ করে ফেলতে পারছে। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি। আর সাহিত্যের বইয়ের কথা যদি বলেন, তাহলে আমি বলবো সাহিত্যকর্ম যেহেতু একজন লেখকের জীবন-ব্যাপী একটি সাধনা, কাজেই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েই বই প্রকাশ করা উচিত। আমি আগেই বলেছি ‘বই’ সভ্যতার অন্যতম প্রধান একটি বাহন। কাজেই, একে হেলাফেলা করা উচিত নয়।