বয়স যখন কৈশোর, সকালটা ভীষণ সুন্দর দেখায়। বিকেলে বালুর রাজ্য আর স্বপ্নে রাজ্য গড়া। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়ার মুহূর্তে স্বপ্নের রাজ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। কৈশোর থেকে যৌবনে উৎরানোর সময়টুকু নেহাৎ বেশি নয়। তবে সীমাহীন স্বপ্নের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে অনেকেই হয়তো তলিয়ে যায়। কেউ সে সমুদ্র সাঁতরে পেরিয়ে যেতে পারে; কেউ কোনোমতে খড়কুটো অবলম্বন করে ধুঁকে ধুঁকে ভেসে থাকে।
যৌবন থেকে পৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলার আগে বিশাল সময় থাকলেও তা যেন এক বিরানভূমি। কারণ যে সমুদ্রে তার ভেসে চলা, তার হেরফেরও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সবখানে সমুদ্র একরকম নয়। সেজন্যই তো মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর নামে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখা পৃথিবীর জলভাগ। জলের বৈচিত্র্য আছে বলেই হয়তো একসময় সমুদ্রের একঘেয়েমির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই অনেকের সাধ হতো। সেসব সময় আধুনিক সময়ে ভাবা যায় না। কিন্তু মানুষ এখনো ভেসে বেড়ায়। অন্তত সেই স্রোতটা সে ধরতে পারে। এই ধরতে পারার সময়টাই যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলার দীর্ঘ সময়। যেমনটা বলেছিলাম, সমুদ্রের ওপরও অনেকখানি নির্ভর করে মানুষের চরিত্র, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা কতটা রূপ পাবে।
আধুনিক মানুষের কাছে সমাজ তেমন এক সমুদ্র। এখনো আমাদের সমাজে, এই আধুনিক সময়েও একটি ধারণা বেশ প্রচলিত, বয়স ত্রিশ পেরোলেই আর কিছু করা সম্ভব না। নিজেকে বিকশিত করার সব পথ রুদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে আলাভোলা, একটু ভিন্ন ধরনের যুবক চরিত্রের অভাব নেই। আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে চরিত্রেরও অভাব নেই। এবার ত্রিশোর্ধ্ব যুবকের খোয়াব নিয়ে ইমতিয়ার শামীম লিখলেন ‘খোয়াব রন্ধন সংবাদ’।
‘খোয়াব রন্ধন সংবাদ’ উপন্যাসটি আয়তনে বিশাল নয়। হয়তো অনেকে লেখার আয়তন বিবেচনায় একে উপন্যাসিকা হিসেবেই বলবেন। কিন্তু বিষয়বস্তুর বিশালতা বিচারে একে উপন্যাস বলেই মানতে হবে। ‘খোয়াব রন্ধন সংবাদ’ প্রথম বণিকবার্তার ইদসংখ্যা ‘সিল্করুট’-এ প্রকাশিত হয়। এর ২০২৩ সালের বইমেলায় এটি বই আকারে আসতে চলেছে ‘প্রসিদ্ধ’ প্রকাশনী থেকে। তাই এখনই বইটি নিয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। সব মহৎ উপন্যাসই মোটাদাগে তিনটি চেনা ছকে এগোয়। প্রথম ছক যে ধরনের গল্প বলে, সেখানে কোনো জনপদে নতুন ব্যক্তি কিংবা অচেনা ব্যক্তি কিংবা আগন্তুকের আগমন ঘটে, যেমনটা আমরা দেখি ব্রাদার কারামাজভে। দ্বিতীয় ছকে দেখা যায় দুটো পরস্পর বিরোধী শক্তি একে অন্যের মুখোমুখি হচ্ছে; যেমনটা ঘটেছে তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসে। তৃতীয় ঘরানায় আমরা দেখি কখনো ব্যক্তি কিংবা সমষ্টির দিগ্বিজয় যেখানে যাত্রাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এই যাত্রা হতে পারে ডন কিহোতের মতো দ্বিগ্বিজয়ের অথবা অপুর মতো যুগ যুগ ধরে অপরাজিত জীবন মহিমার সঙ্গে সাক্ষাতের।
এই ভাবনাগুলোই তো অসংখ্য খোয়াবের জন্ম দেয়। রাবেয়াদের বাড়ি গেলে মাঝেমধ্যে রাবেয়ার হাসির শব্দ বা টুকরো কথা থেকেই সে ধরে নেয়, রাবেয়া তাকে স্বামী হিসেবে মনে মনে চায়। অথচ আহসান যেন রাবেয়াকে সাবলম্বী ও শিক্ষিতা এক মেয়ে হিসেবে ভাবতে পারেনি।
বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই তিনটি ছকই সম্ভবত অধিক প্রচলিত। ইমতিয়ার শামীম অবশ্য এই পরিচিত ছকে এগোলেন না। বইটির নামের মতোই তিনি টুকরো টুকরো খবর দিয়ে গেলেন। উপন্যাসের শুরুতে অবশ্য খবরটি জেনে একটু জল্পনা কল্পনা করতে হয়। শুরুতে আমরা দেখি, এক ক্ষুদ্র মফস্বল শহরের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি চান মিয়া মারা গেছেন। তাকে দাফন করা হয়ে গেছে। কিন্তু উপন্যাসের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু চানমিয়া নন। এমনকি চানমিয়ার জীবনের গোপন অধ্যায়ও সেখানে আবিষ্কৃত হয়নি।
বরং গল্পের প্রাণকেন্দ্রে বিক্ষিপ্তভাবে চলে আসে আহসান। মফস্বল শহরটিতে একজন সরকারি চাকুরে। বয়স তার ত্রিশ পার হয়ে গেছে। শিক্ষাজীবনে যৌবনের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা-মনন সবকিছু এখন তার মনের ভেতর চেপে রাখা। এখন সময় থিতু হওয়ার। সরকারি চাকুরে এবং এমএ পাস ছেলে হিসেবে এই ছোট শহরে তার কিছুটা সম্মান আছে। বিশেষত এলাকার মুরব্বী, বিশেষত চান মিয়ার স্নেহ সে কিছুটা পায়। ঠিক এসময় আহসান যেন সমাজের কাঠামোবদ্ধ রূপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। এখনকার প্রজন্মের কয়েক প্রজন্ম আগের বয়োবৃদ্ধরা এখনও আটকে আছেন পুরোনো সংস্কারে। সেসব সংস্কারকে আকড়ে সমাজকে তারা নিয়ন্ত্রণ করেন বা হয়ে যায়। আহসান সেই দৃঢ় কাঠামোকে অস্বীকার করতে পারে না। তাই সে থিতু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মুরব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবি হবে এমন কাজ সে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। এমনকি তাদের কোনো ভুল ভাঙানোর বিষয়েও সে আগ্রহী নয়। তবে সমাজে তরুণ প্রজন্মই বদল আনে। তাদের মননই সমাজে বদল আনতে শুরু করে। যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে আহসান যেন এই প্রজন্মের ওপর কিছুটা বিরক্ত। ঠিক এখানেই আমরা বুঝতে পারি, সমাজ ব্যক্তির চরিত্রে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। সে প্রভাবই বিভিন্ন বয়সে ব্যক্তির মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আপাত বিচারে ‘খোয়াব রন্ধন সংবাদ’—এর বর্ণনায় গল্প এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যে, বর্ণনা আর গল্প সমান্তরালে চলতে থাকে। গল্পের মাধ্যমে আহসানের মানসিক দ্বন্দ্বগুলো প্রকট হতে শুরু করে। আর আস্তে আস্তে এক শঙ্কাময় প্রেমের গল্প রূপ পেতে থাকে। আহসান, বাঙালি যেকোনো চাকরিজীবী তরুণের মতোই গোড়া। এমএ পাসের অহম থেকেই শুরু এবং সবখানেই নিজেকে জাহিরের প্রচেষ্টা। কিন্তু সামাজিকভাবেই সে হীনণ্মন্যতায় ভোগে। তার মনে হয় সে নিজেই নিজের সুখের পথ বিসর্জন দিতে বসেছে। মধ্যবয়সে তো আর ছন্নছাড়া থাকার ফুরসত নেই। জাহিদ ছোকড়াটা ময়মুরব্বি মানে না। বাজে চুটকি মারে। অথচ তাদের সঙ্গেই আড্ডা দেওয়া হয়। চান মিয়া তাকে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। জাহিদ যাকে কিনা চান মিয়ার অপছন্দ বা গোটা ভদ্রসমাজ তাকে বেয়াদপ ভেবে নেবে, সেই ছেলেই চান মিয়ার শেষকৃত্যে বেশ সুনাম কামিয়ে নেয়।
চান মিয়ার তৃতীয় মেয়েটি মানে রেবেকার পাণিপ্রার্থী আরেকটি জুটলো। এক মানসিক অস্থিরতা, শঙ্কা তাকে ছেয়ে ফেলে। আহসান তখন মনের ভেতর আঁতিপাতি খোয়াব বোনে। হয়তো চান মিয়া মৃত্যুর আগে নির্দেশ দিয়ে গেছেন রেবেকার সঙ্গে তার বিয়ে যেন দেয়। অন্তত মৃত্যুর আগে তো সে বুড়োকে সঙ্গ দিয়েছে। মানসিক অপূর্ণতা খোয়াবের জালে তাকে আটকে ফেলে। আহসান নিজেকে শুধু মানিয়ে নেয়। প্রতিনিয়ত তাকে ভয়ে থাকতে হয় সমাজ কোনটিকে মন্দ ভাবে, কোন দৃষ্টিকোণ আদপে ক্ষতি করবে, ধর্ম পালনে তার মন নেই; তবু তাকে শুধু পালন করতে হয় নিয়ম। এভাবেই আস্তে আস্তে গল্পটি আহসানের মানসিক অস্থিরতার দোলাচলের সংবাদ পরিবেশন করে। এমনকি শেষটুকুও তার নিজের হীনণ্মন্যতার মধ্যেই শেষ হয়। আহসান আশ্রয় খোঁজে আল্লাহর নাম ছাপানো লিফলেট বিলানোর আশায়। তার নিজের সংকটে সে ভর করে।
উপন্যাসে আহসান কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তার চারপাশের চরিত্রগুলোও টুকরো টুকরো খবরের মতো আমাদের সামনে আসে। আহসান এই গল্পে একাধিক বয়সের ও একাধিক প্রজন্মের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মানসিকভাবে সে বয়োবৃদ্ধ বা সমাজে যাদের শ্রদ্ধা করা হয়, সেই মানুষদের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। এর কারণ তার খোয়াব। হ্যাঁ, স্বপ্ন নয়, খোয়াব। আহসান নিজের মনে মনে ভবিষৎগামী হয়ে ওঠে। সে ভবিষ্যৎ সামনে কী হবে, তা না হয়ে হয়ে ওঠে, যা হবে। চান মিয়ার ছোট মেয়ে রাবেয়াকে নিয়ে তার অনেক খোয়াব। তবে তা প্রেমের গল্প নয়। বলা যায়, সমাজে ব্যক্তি তার চরিত্রের পূর্ণতা পেতে যা চাইতে পারে তা থেকে সৃষ্ট এক ধরনের কামনা। রাবেয়া কলেজে পড়ে। চান মিয়ার বাড়িতে প্রায়ই তাকে যেতে হয়। বৃদ্ধের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। আবার অনেক সময় রাবেয়াকে দেখার, বা একটু তার কণ্ঠ শোনার আকাঙ্ক্ষা নিয়েও যাওয়া হয়।
একসময় আহসানের মনে হয়, সে যেহেতু সরকারি চাকরি করে, সেহেতু হয়তো রাবেয়ার সঙ্গে তার বিয়ে দিতেই চান মিয়া তাকে এমন গুরুত্ব দেন। বলা বাহুল্য, এটি তার মনের ভ্রম এবং এই ভ্রমকে ঘিরেই সে নানা খোয়াব দেখতে শুরু করে। আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতিটি যুবকই ত্রিশ পেরোলেই সমাজকাঠামোর মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেন। তারা নিজেদের অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন। আহসান ঠিক তেমনই একজন। লেখাপড়া করার সময় নতুন কিছু করার ভাবনা তার ছিল। এই সমাজের স্তব্ধতা, সংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কারকে সেও অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে। কিন্তু কাঠামোর বিশালতা যখন সে উপলব্ধি করতে পারে, তখন সেই সমাজকাঠামোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া যেন আর গত্যন্তর থাকে না।
ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণের বিচারে, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে অবদমিত রাখে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে, মানুষ এই প্রবৃত্তিকে অবদমন করলেও সমাজে নানা আচার-ব্যবহার ও চিহ্নের তৈরি হয়। সমাজকাঠামোতেই মানুষ এই প্রবৃত্তি পূরণের নানা পদ্ধতি তৈরি করে ফেলে। এই যেমন আহসানের বিয়ে করার বিষয়টি নির্ধারিত হচ্ছে তার সরকারি চাকুরে হওয়ার শর্তে। আহসান কি পুরোপুরি বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতো যদি সে সরকারি চাকুরে না হতো? যেহেতু সরকারি চাকরি সে করছেই, তাই তাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু যেমন তেমন জায়গায় বিয়ে করলে তো হবে না। সে সরকারি চাকরি করে, তাই তাকে অবশ্যই ভালো জায়গায় বিয়ে করতে হবে। শুধু তাই নয়, রাবেয়া তাকে পছন্দ করে; তাও সে কেন ভেবে নেয়? এই ভাবনাগুলোই তো অসংখ্য খোয়াবের জন্ম দেয়। রাবেয়াদের বাড়ি গেলে মাঝেমধ্যে রাবেয়ার হাসির শব্দ বা টুকরো কথা থেকেই সে ধরে নেয়, রাবেয়া তাকে স্বামী হিসেবে মনে মনে চায়। অথচ আহসান যেন রাবেয়াকে সাবলম্বী ও শিক্ষিতা এক মেয়ে হিসেবে ভাবতে পারেনি।
এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংবাদের মাধ্যমে ইমতিয়ার শামীম আমাদের সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর অবস্থাই তুলে ধরেন। প্রথমেই যেমনটা বলেছি, আয়তনের বিচারে একে অনেকেই উপন্যাস না বললেও এর বিষয়বস্তুর বিশালতা ও কাঠামো একে উপন্যাস হিসেবেই দাঁড় করাবে।
এই যে যুবক থেকে পৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলা, তার মানসিক টানাপড়েন, সংকট, সম্ভাবনার ভাবনা, জটিল ঘটনাবৃত্ত ইত্যাদি বিষয় সহজাতভাবেই আলোচিত হয় না।
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব বিচারের ক্ষেত্রে প্রায়শই ফর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। ইমতিয়ার শামীমের এই উপন্যাসে ফর্মের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কিছুটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। আপাতদৃষ্টে আহসানের এই গল্প অনেকের কাছে সামান্য মনে হতেই পারে। কিন্তু ইমতিয়ার শামীম গল্পটিকে ঝুঁকিয়ে নেন অন্যদিকে। গল্পটি সামগ্রিকভাবে সমাজের চিত্র তুলে ধরলেও গল্পটির প্রাণকেন্দ্র হয়ে থাকে ব্যক্তি। বলা বাহুল্য, সে ব্যক্তি আহসান। একজন ব্যক্তি, যার অমিত সম্ভাবনা, যার বুকের ভেতর লালিত স্বপ্নের সীমা হতে পারে সীমাহীন—সেই ব্যক্তিই কিনা সমাজের সংস্কার ও কাঠামোর রোষের কথা ভেবেই জড়িয়ে পড়ে এক ক্ষুদ্র গণ্ডিতে। আহসান খোয়াব দেখে। সে খোয়াবের সঙ্গে আমরাও সহানুভূতিপ্রবণভাবে সামিল হই। আহসান চরিত্রটি যেন বলতে চায়, প্রতিটি মানুষই চায় সমাজে নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা হিসেবে দেখাতে। কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয় না।
ভিক্টোরিয়ান আমলের উপন্যাসে যেমন দেখা যায়, উপন্যাসে নায়ক প্রকৃতপক্ষেই নায়কোচিত। কিন্তু আধুনিক সময়ে নায়কোচিত মানুষ উপন্যাসে ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। উপন্যাস বাদেই সমাজে নায়োকোচিত চরিত্রের অভাব তো রয়েছেই। তবে মানুষ খোয়াব দেখে। স্বপ্ন দেখার ফুরসত তার কম। তাকে খোয়াব দেখতে হয়। খোয়াব প্রায়শই পাওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে না। বরং খোয়াব ভবিষ্যতের দৃশ্য নির্মাণে ব্যস্ত। অনেকটা মরুভূমির মরিচীকার মতো। সেই খোয়াবে আক্রান্ত একটি প্রজন্ম। আহসান সে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।
একদম প্রথম থেকেই আহসান অপরাধমিশ্রিত দর্পে আক্রান্ত। সরকারি চাকরি এবং উচশিক্ষিত হওয়ার কারণে সে সমীহ পাবে, এমন ভাবনা তার মনজুড়ে। সেজন্যই সে বাস্তবের বাইরেও নিজের পছন্দসই এক জগৎ নির্মাণ করেছে। সে জগতের চরিত্র বাস্তব, ঘটনাগুলো নয়। এমনটা হওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ তরুণ সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। বয়স ত্রিশ পার হলেই তাদের সম্ভাবনার সব দুয়ার বন্ধ। চাকরি পেতে হবে, সংসার করতে হবে, মুখরক্ষা করতে হবে, নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে মুরব্বি হিসেবে। এই যে যুবক থেকে পৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলা, তার মানসিক টানাপড়েন, সংকট, সম্ভাবনার ভাবনা, জটিল ঘটনাবৃত্ত ইত্যাদি বিষয় সহজাতভাবেই আলোচিত হয় না।
‘খোয়াব রন্ধন সংবাদ’ উপন্যাসটি যেন মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের বিভিন্ন কৌণিক বিশ্লেষণ। অন্তত এমনটাই আমার ধারণা। পড়ার সময় নিজেকে বর্তমান সময়ের বিসিএস প্রজন্মের হতাশার দিকে মিলিয়ে কল্পনা করি। অন্তত ঝরে পড়াদের কথা তো মনে পড়েই। আসন্ন ২০২৩ বইমেলার আগেই সম্ভবত উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হবে। এক অস্থির সংকটময় মুহূর্তে, যখন কাগজের দাম বাড়তি, তখন প্রজন্মের এক সংকট নিয়ে লেখা গল্প যুৎসই বলেই মনে হচ্ছে।