গতকালই বর্ষা টের পেলো বিষ্ণুপ্রিয়া।
এরকম ঘনঘোর বাদলধারা প্রথম নয় ওর জীবনে। তবু প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে চমকে ওঠার স্বভাব ওর, মনে হয়, জীবনে এই প্রথম। এই এক অদ্ভুত প্রণয় বর্ষার সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার।
মনের ভেতরকার শুকনো পাতায়, দেহের অভ্যন্তরে খরখরে আলে-ঢালে সবখানে এর অনুরণন। এর রূপ বিষ্ণুপ্রিয়ার অন্তরকে জাগায়, ক্ষণিকের জন্যে হলেও আলোময় করে রাখে ওর অতীত-বর্তমান সব।
টিনের চালে সাইকেলের অবিরাম ঘণ্টিধ্বনি। মনে হচ্ছিল একমাত্র ছেলে সোমশংকরের সাইকেলটা বাড়ির আঙিনার ঢুকে পড়েছে। ছেলের যা স্বভাব, বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই একনাগাড়ে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া চাই। ঠিক ওর বাপের মতো। বৃষ্টি বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ খুলে দিচ্ছে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সব।
গতকাল রাত থেকেই অঝোর বৃষ্টির ঝুমঝুমি বাজছে—যেন সোমশংকরের সেই সাইকেল-ঘণ্টিটা ঝুমঝুমি হয়ে গেছে। কানের কাছে নিরন্তর বাজিয়েই চলেছে, রুমঝুম, রুমঝুম, রুমঝুম—কোনো থামাথামি নেই। এসময় পুরনো দিন সাকার হয় বিষ্ণুপ্রিয়ার অন্তরে। ছন্দোময় মধুর এ শব্দসাম্রাজ্যে স্বস্তি আর আরাম বোধ করে বিকল হওয়া ওর মন ও শরীর।
একটা সময় ছিল—যখন ঘণ্টির শব্দ কানে এলে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যেতো সবার ভেতর। বিষ্ণুপ্রিয়া চেঁচাতো—‘কই গেলা বউ? কানে শব্দ যায় না?’ বাড়ির যেখানেই থাকতো, সুরেলা ছুটে এসে দরজা খুলে দাঁড়াতো ঘণ্টিওলার সামানে। স্বামীর দিকে কোনোদিনই সরাসরি তাকাতে পারতো না সে; মাথায় ঘোমটা আর আঁচলের খুঁট দাঁতের খাজে; তবু ফিক করে হেসে ফেলতো। হাসিটা ওর দুর্বাঘাসের মতো চোখে-মুখে লেগে থাকতো বেশ কিছুক্ষণ। মুখে কিছু বলতো না। তবু সঙ্গে সঙ্গে সোমশংকরের সাইকেলের ঘণ্টি থেমে যেতো। বিছে-গোঁফের তলায় প্রত্যুত্তর হিসেবে একটা পুরুষালি হাসি ভীমরুল হয়ে ঘুরে বেড়াতো সুরেলার চারপাশে—বিষ্ণুপ্রিয়া ছেলের এ হাসিটা খুব চেনে, সেই কৈশোর থেকে। মুখের হাসি গোঁফের ভাঁজে ভাঁজে কী করে চলে যায়—তা দেখে একসময় খুব হাসি পেতো ওর; আজও গোঁফওলা ছেলের সেই হাসিটা বিষ্ণুপ্রিয়া দেখতে চাইছে বৃষ্টির তানে নিজেকে ডুবিয়ে-ভিজিয়ে।
যদি আশেপাশের সব ঠিকঠাক থাকে তো সোমশংকরের গোঁফটা বিলম্বিত হাসি হাসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবশেষে কোনো কথা না বলে সাইকেলটা ঘাড়ে করে এনে ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে রেখে মায়ের বিছানার দিকে তাকাবে। মাকে ছাড়া ওর চলে না, মা ওর চোখের মণি। ‘মা, কিতা কর, তুমার লাইগা পান আনছি, লও’—আহা শুনলেই মনটা ভরে যেতো ওর। বৃষ্টিটা যেন এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যাচ্ছে ঘণ্টি বাজিয়ে, কী যে মিঠা এ ধ্বনি !
সেরকমই একটা ঘোর এ বৃষ্টিবেলায় টের পাচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া। বারবার তন্দ্রাচ্ছন্ন বোজা চোখ দুটির দরজার পাট খুলে যাচ্ছে। তাতে ঘুমের যেটুকু হালকা ঘোর, সেটুকু কেটে যাচ্ছে। পাশ ফিরে শুয়ে ভাবে, একমাত্র ছেলে সোমশংকরের মুখটা অত ঝাপসা লাগে কেন আজকাল?
পরপর তিন মেয়ের পর ছেলে। আদর যেন বলক তোলা দুধের বাটিতে আমের মিষ্টি একটুকরো ফালি, তাকালেই মন ভরে যায়।
তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। জামাইগুলো বউঅন্ত প্রাণ, শ্বশুরবাড়ির জন্যে পাগল। ডাক পেলে ছুটে আসে পোষা বিড়ালের মতো। ডাক না পেলেও খবর নেয় মোবাইলে। তা সত্ত্বেও ছেলে সোমশংকর ছায়ার মতন, হাওয়ার মতো জুড়ে রয়েছে ওর সমস্ত অস্তিত্বে। ঘরে ঢুকেই সবার আগে, ‘মা, কিতা কর?’ বলে যে সন্তান ভাসিয়ে দিতো সবকিছু, সে এখন কোথায়?
এরকম স্বভাব তো এককালে ওর বাপেরও ছিল। মন্মথপুর বাজারে ওদের পারিবারিক কাপড়ের যে দোকান, সেটার ঝাঁপি বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে তো সেই রাত। ইস্টিশনের রেললাইনের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যায় বাড়ির আঙিনায়। এসে আর তর সয় না। কেবলি ঘণ্টির শব্দ। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়ার গোলগাল মুখজুড়ে চন্দনফোঁটার মতন হাসিটা দেখতে পেলেই ঘণ্টিধ্বনি হাওয়া। কত কথা চোখে-চোখে। এসব কথার কোনো অর্থ নেই কিন্তু বসন্তকালের বাতাসের মতো আবেশ রয়েছে তাতে। সেই আবেশটুকুর জন্যে দুজনারই মন হাউমাউ করতো প্রতিদিন। ছেলে-মেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি ভরা সংসারে সেই আবেশটুকুই ওর সম্বল, বিষ্ণুপ্রিয়ার সোহাগ।
বহুদিন হলো বাতাসে সেই আবেশ আর নেই, কতদিন? আঙুল গুনে-গুনে বোঝার চেষ্টা করে বিষ্ণুপ্রিয়া। পরক্ষণে খেই হারিয়ে যায়। ফিরে আসে নিজের কাছে। ওদের পর একসময় সোমশংকর আর সুরেলার সংসারেও সেই আবেশটুকু ছিল বেশ কিছুদিন। বিছানায় শুয়ে-বসেও ঠিক টের পেতো সে। বাপের মতন সোমশংকরেরও নিত্য অভ্যাস ছিল ঘণ্টিধ্বনি করে নিজের আগমনের জানান দেওয়া। দোকান বন্ধ করে একবার দুপুরবেলায়, আর রাতে আরবার।
বৃষ্টির মাতমের ভেতর চোখ খোলা রাখলেও নিজেকে অবিকল দেখতে পায় বিষ্ণুপ্রিয়া। সেই সাইকেল, সেই সাইকেলের ঘণ্টি আর সঙ্গে মিশে থাকা সেই অনুপম আবেশ। কতদিন হলো সেগুলো নেই। কতদিন?
পাকা দশটা বছর। বুকটা মোচড় দেয়, খরখরে চোখের কোন আপনা-আপনি ভিজে ওঠে, চটচটে লাগে নিজের কাছে। তাহলে সবকিছু কি হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে ষিষ্ণুপ্রিয়ার? বয়সের সঙ্গে যা কিছু মনোরম সব কি দিনেদিনে ফিকে হয়ে পড়ছে?
ভালো লাগে, খুব ভালো লাগছে। সে আশ্রয় চাইছে বৃষ্টির কাছে। সবকিছু সরিয়ে, সবকিছু ভুলে, বিছানায় শুয়ে সাত সকালে অশীতিপর নিঃসঙ্গ এই বিষ্ণুপ্রিয়া এখন পুরনো কথার পান চিবোচ্ছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া বাস্তবে ফিরে আসে। বৃষ্টি ঝরছে টিনের চালে। রাতভর বৃষ্টি আর দমকা বাতাসে হুলস্থুল পুরো প্রকৃতি। বর্ষার আভাস পেয়ে বেশ কটি কুনো ব্যাঙ লাফাতে শুরু করেছে পিছনের ডোবায়। ভিটি উঁচু করতে মাটি তোলা হয়েছিলো সেই আমলে । সেখানে জল জমে ডোবা তৈরি হয়েছে। থালাবাসন ধোয়াধুয়ি চলে। চাপকলে জল না থাকলে স্নানটাও সেরে ফেলা যায়। সোমশংকর শখ করে মাছের পোনা ছেড়েছিলো সেখানে। মাছগুলো বড় হতেই জাল হাতে নিয়ে কদিন জেলে সেজেছিল ছেলে। ভালোই লাগতো। যেদিন জাল ফেলতো, সেদিন রমরমা উৎসবের আমেজে মজে থাকতো বিষ্ণুপ্রিয়া। কখন মাছ আসবে আর বটিতে ফেলে সেগুলো বউ-শাশুড়ি মিলে কুটবে, রান্না হবে—এসব।
সেসব দিন গেছে। এখন ডোবাটা যেন শাকচুন্নির ছায়া। জল শুকিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কতগুলো সাপ-ব্যঙের আস্তানা শুধু। ভালো লাগে না।
হাজামজা ডোবাটা থেকে ব্যাঙগুলোর লম্ফঝম্ফের শব্দ বৃষ্টি ছাপিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার কানে টোকা দিচ্ছে। সোমশংকরের বাপ উদয় শংকর ছিল আস্ত একটা বিটলা। এরকম দিন হলেই দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করে চলে আসতো বাড়ি। বর্ষায় ব্যাঙের ডাক কানে এলে পুংটাটা একটা হাসি দিয়ে বলতো, ‘ওই যে ব্যাং বেটা ব্যাংবেটিরে চাইতাছে। বুঝলানি?’
‘যাঃ, বিটলা নম্বর ওয়ান’—বলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠতো ওর ফর্সা চেহারা।
একসময় সোমশংকর-সুরেলাদের ভেতরও ছিল এরকম হাসিঠাট্টার সম্পর্ক। দুচারবার ওর চোখেও পড়েছে। মনে মনে খুশি হয়েছে, মোটেও হিংসের মরচে মনকে বিকল করেনি। নীরস জীবনে এটুকুই তো প্রাণের মধু। মনে মনে বলেছে,‘ মধু জমিয়ে রাখো গো। একসময় নিংড়ালেও মধু আর ঝরবে না। তখন এগুলোই কথা কইবো। জমাও, যত পারো জমাও।’ বিড়বিড় করে কথা বলছে বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠোঁট।
সকাল হয়ে গেলেও চারপাশে স্তূপ-স্তূপ অন্ধকার। সেমি-পাকা ঘরে এমনিতেই আলো ঢোকে না। এর ওপর আজ বর্ষা। মেঘের আনাগোনা আকাশে । একটু আগে কোথায় যেন বাজ পড়েছে কখানা। ওদের বাড়ির চারপাশে সোমশংকরের বাবা পুঁতে রেখেছে বেশ কখানা এক ঠ্যাং-ওলা তালগাছ। সেগুলো এখন মাথাউঁচু করে দাঁড়ানো, বাজের ভয়কে জয় করতে খালি ভেংচি কাটছে আকাশকে। একবার বাজ পড়েছিল একটার মাথায়। কঠিন বাজ। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল গাছের শরীর। কিন্তু ওদের বাড়িটা বেঁচে গিয়েছিল। সেই স্মৃতিটা আজ খুব মনে পড়ছে।
কিন্তু তালগাছের মতো কোনো পাহারাদার ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত ওদের দোকানটা আর বাঁচেনি। ডাকাতের দল লুট করে দোকানে আগুর ধরিয়ে দিলো। শত্রুতা কি না, তা জানা নেই। শুধু দাউ-দাউ করে জ্বলছে ওদের বাপ-দাদার আমলের কাপড়ের গদি। সেই দুঃখে সোমশংকরের বাবা গেলো। আর সোমশংকর নানা জায়গায় ঢুঁ মেরে এখন মাইল পাঁচেক দূরে একটা কাপড়ের কলে স্বামী-স্ত্রী মিলে চাকরি করছে। পেটের জ্বালা যে বড়ো জ্বালা! বিষ্ণুপ্রিয়া পড়ে থাকে ঘরে। বৃষ্টির শব্দে মাতোয়ারা হয়, গ্রীষ্মের খরতাপে দগ্ধ হয়। নিজের শরীরটাই এখন নিজের কাছে আগাছা লাগে। শক্তি-সাহস তো বহুকাল আগেই গেছে, এখন অনাদরে-অবহেলায় সরিসৃপের মতো বিছানায় শুয়ে থাকে। শুধু মনটা এখনো মাঝে মাঝে কথা কয়ে ওঠে।
যেমনটি আজ হচ্ছে। ছেলের মাতৃপ্রেম বাষ্প হয়ে উবে গেছে কবে, বউয়ের তত্ত্ব-তালাশও আর নেই। ডোবার ধারের ব্যাঙাচি এখন বিষ্ণুপ্রিয়া। তবু বৃষ্টির শব্দ ওর বড় প্রিয়, এর ভেতর সে উচ্ছল জীবনের জলতরঙ্গ শুনতে পায়। ভালো লাগে, খুব ভালো লাগছে। সে আশ্রয় চাইছে বৃষ্টির কাছে। সবকিছু সরিয়ে, সবকিছু ভুলে, বিছানায় শুয়ে সাত সকালে অশীতিপর নিঃসঙ্গ এই বিষ্ণুপ্রিয়া এখন পুরনো কথার পান চিবোচ্ছে।
শরীর গেছে। তবু মনটা এখনো একাকী কথা কইতে চায়। ফসিলের ঠোঁটে একটুকরো ক্যাকটাস যেন বা। শরীরে শুধুই কাঁটা— তবু সবুজের নিরস-নির্দয় একটুখানি পরশ লেগে থাকে কটি পাতায় আর ডালে। তাই বা কম কী!