প্রেম কী? এই প্রশ্নে মানুষ খুব একটা বিভ্রান্ত হয় না। প্রত্যেক মানুষই কম বেশি প্রেম বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখে এবং একেক জন তার রুচিমাফিক প্রেমাস্পদের আকাঙ্ক্ষা করে। নিজের মতো করেই প্রেমের প্রতিদান কিংবা প্রেমের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সচেষ্ট থাকে। বলা যেতে পারে, মানুষের মন যতটা জটিল প্রেম বিষয়টি ততটা জটিল নয়, এই কথারই রেশ ধরে বলা যেতে পারে আজকের যুগে প্রেমের কবিতা প্রেমের মতো সহজ সূত্র ধরে এগোয় না, আধুনিক কবিতা অর্থই ক্রমাগত এক গভীর জটিলতার মর্মে প্রবেশের প্রচেষ্টা, সে কারণে প্রেমের কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
বর্তমানের কবিতার প্রেম পল্লবিত হয়েছে নানাভাবে কিন্তু কখনোই গদগদকণ্ঠে শুধুই প্রেমের বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে নিজেকে নিবেদনের মধ্যে প্রেমের কবিতা বন্দি হয়ে নেই বরং কবিতার সমস্ত সম্ভাবনা ও শিল্পরূপকে অক্ষুণ্ন রাখতেই প্রেমের পাশাপাশি নানা বাস্তবতা ও বহুস্তরবিশিষ্ট জটিলতার জালকে বিস্তার করেছে কবি তার প্রেমের কবিতাতে। প্রেম শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানান রূপ পরিগ্রহ করে, প্রেম বলতে যেমন নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম কিংবা পুরুষের প্রতি নারীর প্রেম বুঝি তেমনি দেশপ্রেম প্রকৃতিপ্রেম, মানব প্রেম প্রভৃতি শব্দগুলোও প্রেমের গতিপথকে বিভিন্ন দিকে নির্দেশনা দেয় এই ধারণাও আমরা রাখি। কিন্তু প্রেমের কবিতা বলতে আমরা মূলত নারী বা পুরুষের প্রতি প্রেমের নিবেদন কিংবা এর সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনুসন্ধানমূলক কবিতাই আমরা বুঝে থাকি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমকে প্রকারান্তরে ঈশ্বরের প্রতি নিজস্ব সত্তার নিবেদন হিসেবে ব্যবহারে অভ্যন্ত ছিলেন, তাকে প্রভাবিত করেছিল বৈষ্ণব পদাবলী, ইরানি কবি হাফিজ-রুমী, বাউল সংগীত এবং সর্বোপরি গীতা ও মহাভারতের নানান উপাখ্যান, তিনি হয়তো বুঝেছিলেন মানুষের দেহ যেহেতু বিলীন হতে বাধ্য সেহেতু আকাঙ্ক্ষার শেষ সীমা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন এমনটা হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। ঈশ্বরের কাছে নিবেদিত হওয়ার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ হয়তো তার কবিতায় প্রেমকে অমরত্ব দেওয়ার অভিলাষী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তার স্বকীয় ভঙ্গিতে স্বস্থানেই অধিষ্ঠিত আছে, আজকের কবি তাকে প্রত্যাখ্যান করে না, আবার সেভাবে তার পথ অনুসন্ধান করে না। আজকের কবিতার কণ্ঠস্বর মানুষেরই হৃদয়স্পর্শ করতে আগ্রহী এবং অনেক সময়ই ঈশ্বরকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দ্বিধা করে না আজকের কবি। মানুষের দেখার চোখ অনেকটাই বদলে গেছে এবং কবিতায় তার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট।
আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উপরোক্ত কথাগুলোকে উপক্রমণিকা হিসেবে ধরলে তার কবিতার আলোচনা অনুধাবন সহজতর হবে বলে মনে করি। কবি আমিনুল ইসলামের এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৫টি। শুধুই প্রেমের কবিতা হিসেবে তার কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, অসংখ্য কবিতার সঙ্গে মিলেমিশে আছে তার প্রেমের কবিতাগুলো, আবার প্রেমের কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না, এমন অনেক কবিতাতেও প্রেম তার উপস্থিতির জানান দিয়েছে।
আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠে যে বিষয়টি বেশি মনোযোগ কেড়ে নেয়, তা হলো তার বহুমুখিতার দিকে যাত্রার প্রবণতা। যেকোনো একটি বিষয়ে গিয়েও কবি প্রায়শই নানা অভিজ্ঞানকে টেনে আনেন। দেখা যায় তার কাব্য কল্পনার সঙ্গে জোড় বেঁধে থাকে বাস্তবতার বোধ। নদী তার সবচেয়ে প্রিয় অনুষঙ্গ, প্রকৃতির নিবিড় পাঠ থেকে বঞ্চিত নন তিনি, নারীকে কামনা করেন দ্বিধাহীনভাবেই—এইসব বৈশিষ্ট্যের বাইরে তার কাব্যভাষা স্বতন্ত্রভঙ্গি অর্জন করেছে যার মূলে আছে অবলোকনের আলোকময় রেখা। যতটা না শিল্পের কৃত্রিমতা তার চেয়ে বেশি উপলব্ধির গাঢ়তা ধরা পড়ে তার কবিতায়। এই উপলদ্ধির জন্য যে মন দরকার তা গড়ে উঠেনি কারও কাব্যভঙ্গিমা থেকে ঋণ করে, তিনি সতত, নিজ হৃদয়কেই রূপায়িত করতে চেয়েছেন তার কবিতায়।
এখানে পরিবেশ ও পরিস্থিতি প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে, তা এড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা তিনি সে রকমভাবে করেছেন বলে দেখা যায় না। ঠিক এরই সমান্তরালে তার কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’-র ফ্ল্যাপের লেখা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করা যাক, ‘আধুনিকতা পেরিয়ে উত্তরাধুনিকতার ধাক্কায় যখন সৃষ্টিশীলতার ভুবন হতে হৃদয়িক প্রেমভাবনা বিতাড়িত প্রায়, তখন অসম সাহসে আমিনুল ইসলাম তাঁর হৃদয়ে রেখে দেন স্বপ্নচিহিৃত একটি শূন্য আসন।’ সে আসন প্রেমের জন্য, প্রেমিকার জন্য। সে পরস্পরায় একদিন নিশুতিরাতে ঘুমভাঙানিয়া অনুভরের স্পর্শে জেগে উঠে দেখতে পান, ‘দক্ষিণের একটি নদী তার গোপন ঢেউয়ের আঁচল বাড়িয়ে আমার স্বপ্নের উঠোন ভিজিয়ে দিতে চায়।’ তিনি প্রেমিকার গাবের আঠার মতো মন দেখে যেমন মুগ্ধ দোটানায় অভিভূত হন, তেমনি তার অপ্রেমধর্মী আচরণে ব্যথিত হয়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘ও আমার জন্মসখা নদী, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠশালায় এ কেমন ভালোবাসার ব্যাকরণ।’
সেখানে কবি দেখিয়েছেন প্রকৃতির রঙ কী রকম গভীর ও ধূসর হয়ে মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে থাকে , আর তারই মধ্যে দুদন্ড শান্তি হয়ে বিরাজ করে বনলতা সেন নামের মেয়েটি: ‘সব পাখি ঘরে আসে- সবনদী ফুরায় এ- জীবনের সব লেনদেন; /থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে কবি এরকমই বাস্তবতামুখী। তিনি যেভাবে যখন প্রেমিকাকে দেখতে পেরেছেন, সেই পরিবেশকে তুলে ধরেছেন দ্বিধাহীনভাবে। প্রেম যে আবেগ নিবিড় ও অবুঝ, দড়িছেঁড়া গরুর মতো সে যে ছুঁয়ে যেতে উদগ্রীব, বিশেষত প্রথম য়ৌবনের সময়ে, সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় নিচের কটি পঙ্ক্তিতে:
কণ্ঠে তোমার উথলায় যেন স্বরস্বতীর ভোর
অন্ধ আড়ালে লুকিয়ে আমি জানালায় কান পাতি
সেলফোনে তুমি বাঁকবহুলা উচ্ছল নদী ঘোর
সাঁতার শুরুর ইহরামে আমি ঢেউয়ের শব্দে কাপি।’
(প্রথম সাঁতার/ কুয়াশার বর্ণমালা)
একই উপস্থাপনায় বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রকৃতি, ধর্মীয় বা আরবি শব্দ ও ইংরেজি শব্দের ব্যবহার উপরের কটি পঙক্তিতে লক্ষণীয়। মূলত এটাই তার কাব্যভাষার অন্যতম প্রধান লক্ষণ। কবি আমিনুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ভূখণ্ডে সেই বরেন্দ্র অঞ্চল—তার মাটি, নদী ও শস্যের দোলায় তার অন্তঃকরণ পরিপুষ্ট । তার কবিতায় হাজার বছরের সাংস্কৃতির আলো হাওয়া খেলা করে, কিংবদন্তীগুলো ঘুরেফিরে আসে, চিত্রকল্পগুলো গঠিত হয় এদেরকেই সাক্ষী রেখে। তার নিজেরই কথায়—
আমার কণ্ঠে বাঁধা আবহমান নিসর্গের সুর
হে বন্ধু, ভোলো না চিনে নিতে, কোনোদিন
নিপাতনে সত্য হলে মুগ্ধকল্প কবির বিশ্বাস’
(তবু প্রেম তবু ঘরবাঁধা/তন্ত্র থেকে দূরে)
পদ্মা, মহানন্দাসহ অসংখ্য নদী শাখানদীর সঙ্গে যার আবাল্য সখ্য, সে তার প্রেমের নারীকে আড়ালে রেখে জলকেই প্রেমের রূপক করে লিখতেই পারে এমন পঙ্ক্তিমালা—
‘বদলায়নি জলনীতি ভালবাসার আজতক
মূলধারায়, জাল যার জলা তার
যতই গভীর হোক চোখের জলের নদী
সে লোনা অতলে কার অধিকার?’
(সীমানা/ তন্ত্র থেকে দূরে)
বরেন্দ্রভূমির কাছে কবির বারবার ফিরে আসার ঘটনা আমরা দেখতে পাই তার অজস্র কবিতায়। ভালোবাসার সরল বিশ্বাাস যখনই আঘাত প্রাপ্ত, তখনই কবি ফিরতে চান প্রকৃতির কাছে, মাটিতে লুকায়িত নিজ হৃদয়ের শেকড়ের কাছে। আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতায় অনেক সময়ই এসেছে বৈশ্বিক পরিমণ্ডল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে তিনি অবলোকন করেছেন, কিন্তু মাইকেল মধূসূদন দত্তের মতোই আবার প্রত্যাবর্তন করেছেন বাংলার নীড়ে।
ভূমধ্যসাগর পাড়ে নগ্নউরু বাদামী—শ্রেতাঙ্গে
বৃথাই খুঁজেছি শান্তি, তৃপ্তিহীন মার্কিনি—নিতম্বে
এমন কথা যে কবিতায় লিখেছেন সে কবিতাই আবার লিখেছেন—
সমস্ত তরলরস কণ্ঠে নিয়ে জমেছে অরুচি
গাঢ়রসে সমাপনী, দাও ঢেলে বরেন্দ্র যুবতী
বারঘাটের কানাকড়ি নষ্টচন্দ্র বলুক সকলে
তুমি আনো রাহুমুক্তি, মুখ যষি পবিত্র আঁচলে।
(জলটুঙি/ তন্ত্র থেকে দূরে)
কবির প্রেমকে এমনতর সরল ব্যাখ্যায় ধরে রাখা সকল ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয় না—যেরকম সরলতায় মাইকেল বঙ্গভাষার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এদেশের সমাজে, গ্রামেগঞ্জেও আজ বিশ্বায়নের হাওয়া লেগেছে। বদলে গেছে কিংবা বদলে যাচ্ছে সংস্কৃতি। গ্রাম থেকে শহর এখন অল্প সময়ের পথÑ নদীগুলো যেমন শুকিয়ে মরতে বসেছে তেমনি মানুষের মনের সবুজ সরলতাও শহরের বিষাক্ত বাতাসে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রেমকে শুধুই বিলের মাঠে হিজলের তলায় বাঁশির মুগ্ধতা হিসেবে পাওয়ার উপায় নেই- এখন এখানে ক্রিয়া করছে কম্পিউটারের মনিটরের পর্দায় ভেসে ওঠা নানা রেখাচিত্র, হিসাব নিকাশ।
কবির হৃদয় সংবেদনশীলতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, পারিপার্শ্বিকতাকে অন্ধকারে রেখে তিনি কিছুই লিখতে চান না, তার বেদনা, তার উচ্ছাস, আনন্দ পরিপার্শ্ব ও মানুষের বেদনা ও আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতেই চায়। সেজন্যই দেখা যায় কবি তার প্রেমের নিবেদনের ক্ষেত্রেও এ সকল ভাবনার রঙ থেকে সরতে পারেন না, অনেক সময়ই ক্যানভাসজুড়ে রাজত্ব করে ধূসর বিষণ্নতা, কবি সেখাবে জোর করে অন্য রঙ ঢালতে চান; সেই রঙ হয়ে ওঠে তার হৃদয়েরই রক্তক্ষরণের চিহ্নায়ন। এভাবেই বর্তমান সময়ের প্রেমের কবিতার সুর চিত্র কয়েক দশক আগেকার প্রেমের কবিতার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আমিনুল ইসলামের ক্ষেত্রেও বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবুও অনেক সময়ই তিনি ফিরে যেতে চেয়েছেন পূর্বতন সময়ের স্নিগ্ধতার কাছে, সবুজের কাছে, অবিরাম বর্ষণ সিক্ততা আর নদীদের কাছে। সেখানে হাত পেতেছেন প্রেমিকার সামনে। তার নিচের কবিতাটি সেরকমই:
‘আমিও তেমনি এক প্রশ্নবিদ্ধ নিয়তির মুখোমুখি; তুমি ছুঁতে পারোনি
সমুদ্রমোহনা. নাকি পথের গোলকধাঁধায় খুইয়েছো সব–এ সংক্রান্ত
তথ্য নেই বাতাসের হাতে। মোহনায় ফোন করে জেনেছি যে তোমার
খবর সেখানে জানে না কেউ; আর আমাকে ডাকছে আবার করতোয়ার
একচিলতে ঢেউ; কিন্তু আমি তো ভুলে গেছি বর্ণজ্ঞান; কিভাবে পড়ি
আর জলে লেখা কবিতার পাঠ! ও সর্বনাশা নদী কোনো দাবি নেই;
নালিশেরও ভাষা ভুলে গেছি; শুধু আমাকে ফিরিয়ে দাও পিপাসার ঋতু।
(হারিয়ে যাওয়া পিপাসার ঋতু/ কুয়াশার বর্ণমালা)
আবার বিশ্বায়নের এই যুগে ভালোবাসা ও প্রেম কী রকম কঠিনতর হতে পারে তার চিত্রও এঁকেছেন তিনি:
আর কোকাকোলা লোভ। আর মনজুড়ে
ওয়াল্ডটাইম দিন এবং ওয়ানটাইম রাত।
অধিকন্তু , প্রতিটি কর্ণারে বহুবর্ণ বিজ্ঞাপন;
ঠাঁই নেই! ঠাঁই নেই। কন্দপের দূত ঘোরে,
হাওয়ায় উড়ে গেছে তার হাতের চিরকুট।
(উধাও ঠিকানায় / কুয়াশার বর্ণমালা)
কিংবা,
তিনটি শেয়াল শুধু বুকে নিয়ে অসূয়া- পিপাসা
সে গানের বৈরিতায় বনে বনে ছড়ায় দুর্নাম।
(সুন্দরবনের সুরসভায়/ কুয়াশার বর্ণমালা)
‘ভালোবাসা ডাকে আজো জুয়াড়ি গলায় ’ শিরোনামের কবিতাটিতে কবি প্রেমকে জুয়ার সঙ্গে একাকার করে দেখেছেন। একদা যে নায়ক প্রেমে পড়ে রোমান্টিকতার আকাশে ডানা মেলেছিল বিরহের যন্ত্রণাকে বুকে লুকিয়ে সে অতঃপর সংসারী হয়। কিন্তু তারপরও সে শুনতে পায় প্রেমের হাতছানি। কারো কারো রক্তে যেমন বাসা বাঁধে জুয়ার সর্বনাশা নেশা, কবির কবিতার এই চরিত্রও তেমনি টের পায় সেই সর্বনাশা টান। বৃষ্টিস্রাত পুরোনো জানালায় সে দেখে ইন্দ্রধনুর রঙ, সে শোনে জুয়াড়িগলায় ডাকতে থাকা ভালোবাসার ডাক। এসবেই কবি পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়েও এক ধরনের খেলা করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায় । তিনি প্রেমকে যেমন প্রকৃতির সঙ্গে লীন করে দেখিয়েছেন, তেমনি দেখিয়েছেন শহুরে জীবনধারাতেও প্রেমের নানা সন্ধি অভিসন্ধিকে। বিশেষত তিনি প্রেমের পটভূমি রচনা করেছেন অনেক কবিতাতে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে তার। সেসব ভ্রমণে কখনো কখনো তার মনে লেগেছে রোমান্টিকতার রঙ। সেগুলোকে কবিতার পঙক্তিতে তুলে এনেছেন তিনি। প্রেমকে প্রসংগ করে তিনি সেসব দেশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কিংবা নিদর্শনসমূহের বর্ণনাও দিয়েছেন কম নয়।
গতকাল চামলিজা হিলে কাটিয়ে এসেছি বিস্মিত
দুপুর; নাজিমের কত মগ্নসাঝ কেটেছে এই হিলে। আমি
তার সম্মানে তুরস্কের পেমিক প্রেমিকার জন্য রেখে
এসেছি মর্মর সাগরের বসন্ত-বাতাসের মতো একগুচ্ছ
শুভকামনা। কোন এক দুপুরে নিশ্চয়ই তুমি চাললিজা
হিলে বেড়াতে যাবে, তোমার সাথে থাকবে
বাদামী রঙের কোন তুর্কী যুবক; তুমি জানবে না
সেই হিলে বসে তোমার কথা ভেবেছে বঙ্গের
এক কবি- তার ভালোবাসা কৃষ্ণসাগরের শেওলানিঃসৃত
অক্সিজেন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইস্তাম্বুলের হাওয়ায়।
(তোমাকে দেখার সাধ/ পথ বেঁধে দিলবন্ধনহীনগ্রন্থি)
বিদেশে হঠাৎ ভালো লেগে যাওয়া নারীকে নিয়ে লেখা যেমন কবিতা রয়েছে, তেমনি বিদেশের মাটিতে বসে দেশে ফেলে আসা স্ত্রীর জন্য কাতরতাবিধুর কবিতাও রয়েছে তার প্রকাশিত গ্রন্থে। কিন্তু শেষাবধি নিজদেশে নিজস্ব অস্তিত্ব ও ভালোবাসার কাছে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই যেন স্বস্তি পেয়েছেন তিনি।
স্বদেশের প্রকৃতির কাছেই বারবার স্বস্তি ও অভয় পেয়েছেন তিনি সেজন্য নারীকে প্রায়ই প্রতিস্থাপন করেছেন প্রকৃতির দ্বারা। যে প্রেম একদা হৃদয়কে কাঙাল করেছিল, কিংবা হয়তো দিয়েও ছিল সাতরাজার ধন, অথবা হয়তো সব দিয়ে আবার সব কেড়ে নিয়েছিল, সেই প্রেম অঢেল ঐশ্বর্য নিয়ে প্রকৃতিকে অনুভবের মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রেমের অনেক ছলাকলা ও প্রেমাস্পদের সৌন্দর্যকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে নেওয়া সহজতর হয়েছে কবির ক্ষেত্রে। এতে যেমন সান্ত্বনার পরশ মিলেছে, তেমনি নানা নান্দনিকতায় ভরে তোলা সম্ভব হয়েছে কবিতার উঠোনকে। এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদের কবিতা স্মরণ করা যেতে পারে। তার অনেক কবিতায় প্রকৃতি ও প্রেমকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবৃত হয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশও প্রেমকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিয়েছেন। তবে জীবনানন্দ চেতনার গভীর নীল রঙে এঁকেছেন প্রকৃতিকে, আর সেখানে বিষাদময়তার কারণে ধূসরতার বোধ তৈরি করেছেন পঙক্তির পর পঙক্তি জুড়ে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত একটি প্রেমের কবিতা ‘বনলতা সেন’। সেখানে কবি দেখিয়েছেন প্রকৃতির রঙ কী রকম গভীর ও ধূসর হয়ে মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে থাকে , আর তারই মধ্যে দুদন্ড শান্তি হয়ে বিরাজ করে বনলতা সেন নামের মেয়েটি: ‘সব পাখি ঘরে আসে- সবনদী ফুরায় এ- জীবনের সব লেনদেন; /থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
তার বক্তব্যকে বুঝে ওঠা সহজ, তার কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে নারী, প্রকৃতি, সমাজ ও স্বদেশকেও পড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায়শই আনন্দঘন হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর পিঠে হাজার বছরের পথচলা, প্রকৃতির সব রঙ সব স্বাদকে অবশেষে নিজস্ব অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে তবেই কবি তার প্রেমিকাকে মুখোমুখি পান, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই বোধ চিরকাল বিস্মিত করবে পাঠককে। আমিনুল ইসলাম এর কবিতা জীবননন্দীয় এই গভীর বোধ ও বিষাদময়তার পথ ধরে চলেনি। তিনি নিজস্ব বোধকে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছেন আরো অনেকের সঙ্গে। সেজন্যই তাকে বিচলিত হতে দেখি বিশ্ব রাজনীতির নানা কূটচালে, কিংবা তিনি জনারণ্যে অনুভব করেন আরো অনেক মানুষের মনের যে চাওয়া পাওয়ার উচ্ছাস ও দীর্ঘশ্বাস, তাকেও উঠিয়ে আনতে চান কবিতায়। ফলে তার প্রেমের কবিতা একাকিত্বের বেদনার খুব কমই দীর্ণ হয়েছে। অনেক সহজ আস্তরণে তিনি গেঁথেছেন শব্দমালা।
এখনো আমরা হাতে রেখে আর হাত
বজ্রশপথ করে যাই নবায়ন
মুগ্ধঠোঁটে ভিড়ে যায় শুধু ঠোঁট
পতাকায় চোখ বন্ধুতুপরায়ণ।
আমাদের রাত আমাদের যত দিন
নয়তো কেবলই সময়ের সিলেবাস
প্রতিটি সেকেন্ড মিনিট অথবা ক্ষণ
উষ্ণ করিছে প্রেম প্রণয়ের শ্বাস
(আমাদের ভালোবাসার দিন/ কুয়াশার বর্ণমালা)
ভালেন্টাইন দিবস কে ঘিরে তার এই প্রতিভাবনায় আমাদের বর্তমানের দিনকাল আর পরিবেশই প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়, টি এস সি , বকুলতলার নানা মুখী উৎসব আয়োজন প্রেম কে ঘিরে, এসেছে প্রকৃতির নবসাজের বিররণ, এসেছে মানুষের মনের উপরতলের সাজে অকৃত্রিম চাওয়ার বিবরণ। এর বিপরীতে আবার বাঙ্গালীর আদি সংস্কৃতিকে তিনি অনেক কবিতাতেই তুলে এনেছেন। সেখানে প্রেম এসেছে বিভিন্ন কিংবদন্তীর চরিত্রের সঙ্গে তুল্যমূল্য রচনা করে।
তোমার আঁচলে মাখা প্রত্নঘন ঘ্রাণ
চিরায়ত ক্ষুধা নিয়ে মাতাল আমিও
এ দেহে ধরেছি দ্যাখো লখিন্দর প্রাণ
ভাসি যদি সে ভাসানে তুমিও নামিও।
(তুমি হলে সন্ধ্যাবতী সকলি কবুল/ কুয়াশার বর্ণমালা)
এই সব গভীরতর ভাবব্যঞ্জনার মিথের সন্ধ্যানে তাকে দূরদেশের আশ্রয় নিতে হয়নি। বরেন্দ্রভূমির সন্তান হিসেবে তিনি হাতের কাছে পেয়েছেন অগণিত মিথ, কল্পনা ও পরাবাস্তব মাখা পরিবেশ। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতায তিনি তুলে ধরেছেন নানা অঞ্চলের নানা কিংবদন্তী, নানান ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন, নানান পুরার্কীতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন ভালোবাসার নারীটিকে সঙ্গে রেখে। এসব স্থানের ও ইতিহাসের বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন ভালোবাসার নারীটিকে দেওয়া কথা রাখা না রাখার দৃষ্টান্তলোকে।
তার কবিতায় একটি দুটি শব্দে হঠাৎ হঠাৎ জায়গা করে নিয়েছে বিখ্যাত বিখ্যাত সব ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা আঞ্চলিক ও উপজাতীয় সংস্কৃতির প্রসঙ্গগুলো। সেজন্য তার কবিতা পাঠের জন্য পাঠককে পূর্ব থেকে তৈরি হতে হয়, ইতিহাস, ও লোকজ অনুসঙ্গসমূহ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়।
আমিনুল ইসলামের কবিতায় বহুমাত্রিকার প্রাধান্যের কারণে প্রেমের প্রসঙ্গ অনেক কবিতাতেই প্রচ্ছন্নভাবে থেকে গেছে । কিংবা সেরকম আলো পড়েনি তার শরীরে যা দেখে সহজেই তাকে আলাদা করা যায় প্রেমের কবিতা হিসাবে। আবার কবি অজস্র কবিতায় প্রেমকে প্রধান বিষয় করেছেন অথচ একবারও উচ্চারণ করেননি প্রেম অথবা ভালোবাসা শব্দদুটিকে। লুকানো এই শব্দদুটির অমোঘ মায়া অথচ খেলা করেছে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। এই মায়াবৃত্তে পাঠকের হৃদয়ও অনেক সময়ই ঘুরপাক খায় এবং প্রেমের কবিতা নাকি আসলে অন্য বিষয় আশ্রয়ী কবিতা এই প্রশ্ন নিয়ে পুনঃপাঠের আয়োজনে যেতে হয়। কিন্তু প্রেমকে সরলভাবে বর্ণনা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ এ দুটো বৈশিষ্ট্য তার কবিতাকে অধিকসংখ্যক পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তার চিত্রকল্পে এই সহজতর পাঠ কিন্ত অনেক সময়ই শিখরস্পর্শী হয়ে ওঠে।
সামান্য শিহরে স্রস্ত
শুকনো পাপড়ি হতে
বিনাশব্দে খসে পড়েছে
একটি বিষণ্ন সকাল
একটি উদাস দুপুর
একটি উদ্বেলিত বিকেল
একটি অসম্পূর্ণ রাত;
আমি কুড়িয়ে নিয়েছি
(ডায়েরি ও গোলাপ/ কুয়াশার বর্ণমালা)
কিংবা,
বাতাস শোনায় আজ -বিরহের আসলে কী মানে
বিপ্রতীপ সংখ্যালঘু– আমিও যে মিলনের রাতে
সেদিন বুঝিনি আমি, বুঝি আজ ফিরোজার গানে
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সখন তিমির রাতে।
(আমাকে জাগিয়ে রাখে শ্রাবণের অন্ধপূর্ণিমা/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)
কবি বোঝেন না এমন কী বিষয় আছে পৃথিবীতে! বিশেষত প্রেমের ক্ষেত্রে। কবি প্রেমকে তৈরি করেন কবিতার প্রয়োজনে নিজ হৃদয়ে, সেখানে তিনি প্রেমাষ্পদের মূর্তি ক্রমাগত ভাঙেন ও গড়েন। কিন্তু তার যে বিষাদময়তার স্বভাব, তার যে নিজেরই দিকে বারবার প্রত্যাবর্তনের টান, এই বোধ গড়ে উঠেছে সময়ের পথচলাকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীতে বহু পথে ঘুরে দীর্ঘ সময়ের শেষে মানুষ আজ সময়ের এক জটিলতর ঘরে অবস্থান করছে। বিশ্বরাজনীতির কূটচালে পৃথিবীর একটি গ্রামও আজ আর শোষকগোষ্ঠীর লোভী চোখের বাইরে নয়। মানুষের মন তো আজ ধোয়াশায় পরিকীর্ণই। সুতরাং এ সময়ে রচিত কবিতা তার শিল্পের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েই বদলে ফেলেছে ভাষাভঙ্গি। আবেগের প্রক্ষেপণ আজ বিশ্লিষ্ট হচ্ছে একই সঙ্গের যুক্তির রেখায়। আকাঙ্খা ও প্রাপ্তি প্রায়শই পরস্পরের সঙ্গে মাতছে দ্বৈরথে।
আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা বর্তমান সময়ের কবিতার মূল স্রোতের সঙ্গেই প্রবাহিত হতে আগ্রহী। ফলে একই সঙ্গে তা নিজস্ব হৃদয়বৃত্তির উচ্চারণ এবং পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া অর্ঘ্যও। সেকারণেই তিনি জ্ঞানীয় আবরণের উন্মোচনের অবকাশ যতটা রেখেছেন তার কবিতার শরীরে ততটা পরাতে চাননি দুর্বোধ্যতার পোশাক। তার বক্তব্যকে বুঝে ওঠা সহজ, তার কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে নারী, প্রকৃতি, সমাজ ও স্বদেশকেও পড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায়শই আনন্দঘন হয়ে ওঠে।