অবলোকনের সার্বিক গুণ চূড়ান্তভাবে কবির দৃষ্টিতেই পূর্ণতা লাভ করে। এই দৃষ্টির মধ্যে একইসঙ্গে সক্রিয় থাকে চিত্ত, চক্ষু, রূপচিত্র, আলোক ও ভাবরাশি। এরপর সেই অভিজ্ঞতার সঞ্চিত স্ফূর্তি ভাষার মাধ্যমে বিমুক্ত হয় এবং পাঠের মাধ্যমে ঋদ্ধ চেতনার সেই মনন-কৃত্য আমাদের উপলব্ধিকে স্পর্শ করে ভাবে-বেদনায়, বিবিধ উদ্ভাসনে।
আমার সব কথা প্রস্তুত ছিল ভালোবাসার মঞ্চে যৌথ
ঘোষণা হওয়ার মুগ্ধ প্রতীক্ষায়
তারা আহত বলাকা হয়ে পড়ে আছে বারান্দায়
তাদের ডানায় বিদ্ধ হচ্ছে নীরবতার বুলেট
অথচ আর্তধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে না
তারা স্বপক্ষীয় ফায়ারে বিদ্ধ সৈনিক-হতাশ ও হতবাক।
(দাঁতাল স্তব্ধতা)
উদ্ধৃত অংশটুকু আমিনুল ইসলামের ‘দাঁতাল স্তব্ধতা’ কবিতা থেকে নেওয়া। এতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিবিশেষের আর্তি বা রোদনের সঞ্চার ঘটলেও, সমষ্টিকে ছুঁতে চায় না যেন। কিন্তু যখন তা প্রাত্যহিকতাকে মারাত্মকভাবে মেরে যায়, তখনই তা সবাক রোদনের সঙ্গে ছুঁয়ে যায় সমগ্র পরিধি। এই হানা হাঙরের মতো নীরব ঘাতক। কবির চোখ তাকে উদ্ভাবনে নিয়ে আসে শিল্পের সূক্ষ্ম বুননে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, কবিতায় শিল্পের দৃশ্যরূপ বা প্রকাশ কেমন? অনুভূতি প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেই সক্রিয় থাকে। এমনকি কিছু অনুভূতি জীব-জন্তুও অনুধাবনে সক্ষম। আসলে এখানে পার্থক্যটা হচ্ছে বর্ণনা বা উপস্থাপনগত। হাসি, কান্না, বিষাদ, বিসম্বাদ, বিরহ, বিয়োগ, উচ্ছ্বাস ও প্রাপ্তির অনুভূতি চূড়ান্ত অভিব্যক্তি লাভ করে তার দৃশ্যায়ন বা শব্দ সজ্জার মধ্যেই শিল্পের বিস্তার ও প্রকাশ; এর মধ্যে ধ্বনি এবং শব্দ-বিন্যাসের নৈপুণ্য ভাব ও বক্তব্যের আবেশকে পরম রূপ শক্তি দেয়। যখন সেই পঠন-ভাবনাকে আকর্ষণ করে, সেটাই কবিতার শিল্পকীর্তি।
সাহিত্য শব্দের সমষ্টি। এর উদ্দেশ্য অনুভূতিশীল বক্তব্য পরিবেশন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাব এতই অন্তরীণ, নির্বেদ ও অণুআঙ্গিকে ধরা দেয়, সেক্ষেত্রে কবি তার শব্দসজ্জার প্রতিফলে একটা রূপকল্প তৈরি করেন। সেখানে অর্থ বা বক্তব্যের অনুগামী না হয়ে পাঠকও অনুভূতিকে কাজে লাগান। তবে এই প্রেক্ষিত সর্বময় নয়। শিল্প-সাহিত্য নানাবিধ মূল্যমান বজায় রেখে যেহেতু সৃজিত, সেহেতু এর অর্থ ও বক্তব্যর প্রয়োজন আবশ্যক।
আমিনুল ইসলাম ‘স্বচ্ছন্দ এবং স্বতঃস্ফূর্ত’- প্রকাশের অনুগামী। তার ‘ভালোবাসার সুপ্রিমকোর্টে দাঁড়িয়ে’ শিরোনামের কবিতা থেকে পাঠ,
মানুষ কত প্রাণীকে হিংস্র, কত প্রাণীকে ইতর এবং
কত প্রাণীকে আরও কত বাজে বিশেষণে বিদ্ধ করে
কিন্তু রোদসত্য এই যে, মানুষের সমান নিষ্ঠুর নয় অন্য কোন প্রাণী
সুমির স্কুল থেকে উড়ে যাওয়া শিশুপাঠ্যের
সেদিনের সেই বক সাক্ষী
মানুষের মতো কৃতঘ্ন ছিল না গলায়-হাড়-বিঁধে যাওয়া বাঘটি।’
মানুষই সবচেয়ে ভয়ংকর এবং আগ্রাসী; মানুষ ব্যতিরেকে প্রাণী জগতের অন্য কোনো প্রাণী বা জন্তু তার নিজের সগোত্র বা স্বজাতির জন্য এতটা ভীতিকর বা রুক্ষ নয়। কবিতাংশে যেমন শিল্পের স্বচ্ছন্দ আছে, তেমনি আছে বক্তব্যের দৃঢ়তা। বিদেশে মার্শেল প্রুস্ত, জেমস্ জয়েস, এজরা পাউন্ড, এলিয়ট, ফকনার আধুনিক সাহিত্যে সময় ও অনুভূতির সম্মিলিত গতিধারায় এক নতুন সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন।
আধুনিক সাহিত্যে কাল, শিল্প ও স্মরণ সংক্রান্ত এই লক্ষণ থেকে আমরা পাই, কবির অনুভূত কাল, অতীতের প্রভাব, স্মৃতি ও আত্মব্যাখ্যা ও নিরন্তর পরিবর্তন। এসব অনুষঙ্গ ও প্রকরণ প্রভৃতি যখন কবির মধ্যে স্বত্বঃস্ফূর্তভাবে সংক্রামিত হয়, তখনই তিনি উচ্চারণ করতে পারেন, মহার্ঘ্য বাক্যবন্ধ; যার গভীরে থাকে বোধ। বক্তব্য ও চৈতন্য এবং বহিঃপার্শ্ব সজ্জিত থাকে শিল্পের নিবিড় কুশলতায়। কবিতার শীর্ষনাম ‘অপ্রস্ফুটিত দুপুর’:
হাতের তালুতে সূর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়
অর্ধ-আবৃত পৈথানে
ছোঁয়ামাত্র রাজকুমারীর চোখ মেলে জেগে উঠবেন পরী
জেগে উঠেই হয়ে যাবেন স্রোত-ঢেউ-বাঁক
কিন্তু কোথাও কোন নৌকার ছায়া নেই
ভীরু সকাল হয়ে কাঁপছে অপ্রস্ফুটিত দুপুর।
কবি কালিদাস পঞ্চম শতকে শিল্পের চারটি প্রমাণ-লক্ষ্য স্থির করেন। সেগুলো হচ্ছে, বন্দনা, শিল্পীর পরিপার্শ্ব, জীবন থেকে সৃজিত চিত্রকলা ও নান্দনিক ইন্দ্রিয়বোধ বা রস। প্রতিটি শিল্প বা সৃজনকর্ম নির্ধারিত হয় শিল্পীর নান্দনিক দক্ষতার ওপর। শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টির সূক্ষ্মতাই মানুষকে নিত্য উপলব্ধির প্রতি আকাঙ্ক্ষিত ও ভাবনাশীল করে তোলে। নন্দন ও শৈল্পিকতার মধ্যে এক নিবিড় অন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। তবে শিল্পের পরিধিতেই এর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে।
অবশ্য কবিতা যে সর্বদা নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করবে এমনও কিন্তু নয়। অনুভূতির অবোধ্য সংবেদ থেকে এমন উচ্চারণও হতে পারে যেখানে অর্থ বা বক্তব্য সন্ধানের চেয়ে সৌন্দর্যই মুখ্য, স্তব্ধ হয়ে শ্রবণ বা পঠনই যেখানে এককভাবে কাঙ্ক্ষিত।
শিল্পের সীমা আজ কেবল চারু, লিখন ও প্রদর্শনক্রিয়ার মধ্যেই সীমিত নয়; পণ্যায়ন প্রক্রিয়ার এই যুগে শিল্পের বাণিজ্যিক মূল্যের পাশাপাশি এর ব্যপ্তি বহুদূর সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে পণ্যায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিল্পের এই সম্প্রীতির সবটাই যে নেতিবাচক, তা কিন্তু নয়। কারণ এর সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জীবিকা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যের যোগসূত্র থাকে। ইংরেজি Aesthetics এর পরিভাষা নন্দনতত্ত্ব; যেখানে সৌন্দর্য, শিল্প, স্বাদ, উপভোগ, মনোজগতের চিত্র ও সৌন্দর্য সৃষ্টি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয় নন্দন শব্দের সঙ্গে আনন্দের যোগ থাকলেও সাহিত্যে আনন্দ বলতে কেবল উচ্ছ্বাস, আবাহন, উল্লাস ও প্রাপ্তি নয়; এখানে আনন্দের অর্থ বেদনা, আকুতি, আর্তি এবং বিষাদের অর্থকেও ব্যাপকভাবে তুলে ধরে।
আমরা প্রমথ চৌধুরীর কাছে শুনেছি, ‘কাব্য জগতে যার নাম আনন্দ তার নামই বেদনা।’ তবে এই আনন্দ বা বেদনা যখন গভীরভাবে পাঠক মনকে স্পর্শ করবে তবেই সেই সাহিত্যকর্মের সার্থকতা। ইংরেজ রোমান্টিক কবি শেলীর কাছেও আমরা খুব সংশ্লিষ্ট একটি মন্তব্য পাই, ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’. কিছু মহৎ কবিতার মধ্যে বিষয় অন্তরীণ থেকে এমন প্রকাশ ফুটে ওঠে; যা স্পষ্টত না আনন্দের, না বেদনার। তবু কোথাও যেন সেখানে জীবনের আশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায়। কবি আমিনুল ইসলামের শিল্পসম্মত তেমন একটি স্তবক তুলে ধরছি। কবিতার শিরোনাম, ‘কাঁটা ভরা আলো ক্ষতবিক্ষত হাওয়া’:
হোমারে পাশে বসে বন্ধ দুটি চোখ দেখে
আলোর কাঁটা মেলে সূর্য এক মাতাল সজারু
নগ্ন পায়ে নেচে যায় আর
ভাঁজ খোলা হৃদয়ের দুই পাশে
ছড়িয়ে পড়ে ছিন্ন ভিন্ন শান্তিকামী সবুজের চারা।’
০২.
আমিনুল ইসলাম—বাক্বিন্যাসে শিল্প-রক্ষণের পাশাপাশি সমকালীন ও চিরকালীন অনুষঙ্গগুলোর সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট। এটা যেমন তার শব্দ ব্যবহারে স্পষ্ট, তেমনি বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। আত্মগত ব্যাষ্টিক পরিধির চেয়ে তিনি সামষ্টিক সমন্বয় বোধের প্রতি অধিক তাড়িত, যা তার বক্তব্যকে স্পষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে সময়ের অন্য কবিদের চেয়ে তাকে বিশেষভাবে প্রকাশ করে। শিল্প ও বাক্-প্রবাহকে সমুন্নত রেখেই তিনি কাব্যশ্রমে নিয়োজিত হন। তবে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার বিশেষ মার্গভেদ নেই। প্রাত্যহিক কথ্য শব্দ থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত শব্দ, ধর্মীয় থেকে আরম্ভ করে দাপ্তরিক শব্দ—সবই তিনি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। আর এই প্রয়োগের মাধ্যমে তার মুন্সিয়ানা ফুটে উঠেছে। এযাবৎ তার প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা এগারোটি। যার মধ্যে নিজস্ব বক্তব্য ও শিল্পঋদ্ধ ভাষা নির্মাণের দক্ষতা যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট হয়েছে একান্ত যুগ-বীক্ষণের সূক্ষ্ম কারুকাজও। তার কবিতার মূল সুর প্রেম হলেও এ প্রেমের মধ্যে গভীর প্রচ্ছন্নতায় যুক্ত আছে রাজনীতি-সচেতনতা। এখানে প্রেমিকার রূপ কেবল সৌম্য ও সুন্দরে আবৃত থাকে না; কখনো তাদের দেখা যায় স্বৈরিণী, ঘাতিনী কিংবা দ্বিচারিণী রূপে। তবে এসব নেতিবাচকতার মূলে যে বক্তব্য আছে, তার পুরোভাগে যে কোনো নারী নেই, তা সচেতন পাঠক ঠিকই টের পাবেন। কবিতায় তিনি রাজনীতিকে প্রেমের আবহে নবায়িত করে, উত্থাপন করতে চেয়েছেন নিজস্ব সমাজ-বীক্ষণ।
চলছি তখন থেকেই মাথায় সোনালি বোঝা
চিনি-আতপের গন্ধে সুবাসিত ঘামের শরীর
কে যেন পেছন হতে ডাক দেয়।
ফিরে দেখি কেউ নেই
আমার মাড়ানো পথ মুছে দিচ্ছে উচ্ছেদের চাররঙ হাত।
(বিড়ম্বিত কিষাণ: তন্ত্র থেকে দূরে)
আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রেম ও রাজনীতির এই পরম্পরাকে চমৎকার কিছু মন্তব্যে তুলে এনেছেন প্রাবন্ধিক সরকার আব্দুল মান্নান। প্রসঙ্গ বিবেচনায় তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি:
‘আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবন প্রেমিকের বিস্ময়কর অন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়- বরং এসব কিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন তৃষ্ণা। প্রচন্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে উঠে। এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনায় অবয়বে। ফলে পাল্টে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবি ভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে উঠে আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র্য এক গঠনসৌষ্ঠব। জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি। ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায় আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে উঠে জীবনসমগ্র- আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান।’
কবির ‘প্রেম’ শীর্ষক কবিতা থেকে সামান্য পাঠ, ‘হায় ফিরে গেছে কত সঙ্গত সহস্য দাবি/ অপঠিত আধমেলা কত নেত্রঠার আজো/ কিশোরী মনের মতোন অজস্র আহ্বান/ চাপা পড়ে গেছে কত উদাসীন মধ্যাহ্নে।’ সাহিত্যের মূল্যায়ন হয় ভ্যালুর ভিত্তিতে। Pleasure Value এবং Aesthetic Value পাশাপাশি শিল্প মূল্যায়নের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ Values রয়েছে। এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মান Social Value। এই মূল্যমানে ধরা পড়ে কবির বা শিল্পীর সমাজ বীক্ষণ; কেউ কেউ কলাকৈবল্যবাদের এই ধারণা পোষণ করেন যে, ‘শিল্পকলা সর্বপ্রকার উপযোগিতা বর্জিত’ অর্থাৎ শিল্পের বা সাহিত্যের জন্য কোনো ভিন্ন উপলক্ষ বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না শিল্পশর্ত ছাড়া। এই মতকে অবশ্য সবাই অবলম্বন করে না। কেননা সমাজবদ্ধ মানুষের প্রয়োজনেই যাবতীয় সৌন্দর্য চর্চা। আর এসব ভাবনা না থাকলেও কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সামগ্রিক একটি দায়বোধ প্রচ্ছন্নভাবে থেকেই যায়। আমিনুল ইসলাম মানবিক উপলক্ষ বা উপযোগকে সঙ্গে রেখেই শিল্পশ্রমিক এবং এখানেই তার নিষ্ঠার প্রকৃত উদ্ভাস। কবিতার শিরোনাম ‘ফণা গুটানো চিত্রকল্প’।
দালানের নিচে মৃত্তিকায় মিশে যায় ফোঁটা ফোঁটা
দষ্ট ঘাম রক্ত অশ্রুপ্রাণ
রাজা যায় রাজা আসে
এই দৃশ্য সর্বদর্শী টিকটিকির নজরে পড়ে না।
নদীর গন্তব্য যেমন এঁকে বেঁকে সমুদ্রে বিলীন হওয়া, তেমনি সব শিল্প ও সাহিত্যের মূল আকর্ষণ অনিঃশেষ ব্যঞ্জনার মাধ্যমে লোকমনে অনাবিল চৈতন্য ও আনন্দ সঞ্চারণ। আর এই চৈতন্য ও আনন্দবোধ কেবল হর্ষ-বিলোল বা তৃপ্তির নয়। বরং চিরকালীন দুঃখবোধ ও বেদনারও। আমিনুল ইসলামের কবিতা তেমনি আনন্দ সঞ্চারী উপচারে ভরা, যা কেবল ছুঁয়ে দেয় না, স্তব্ধও করে। এখানে কবির শিল্পসম্মত কিছু কবিতা থেকে উপস্থাপন করছি:
ক)
হে বেহুলা, আর ঘুম নয়,
এইবার জেগে উঠো হাঙরমোহনা থেকে
ফিরিয়ে আনো লখিন্দরের ভুলের ভাসান।
(ভুলের ভাসান)খ)
অথচ অনড় তুমি—লেলিয়ে রেখেছো
রাতের জানালা আর দিনের দুয়ারে
আঁধারের রঙমাখা একগুঁয়ে কতিপয় নিষেধের র্যাব।
(নিষেধাজ্ঞার মুখে)।গ)
তুমি ন্যাংটা চাঁদকে ছুঁয়েছো বলে
পূর্ণিমায় আর সাগর হয়ে উঠতে পারো না
তুমি অসুখী
কারণ, তোমার চাওয়ার কিছু নেই
আসলে গন্তব্যে একটি ভুল ঠিকানার নাম।
(গন্তব্য একটি ভুল ঠিকানার নাম)ঘ)
তোমার বুকে পড়েছিল- জানে সবাই
তথাপি তো উঠেনি অংকুর,
(বীজ না ভূমি)ঙ)
যে বেদনা ভেসে যায় গোপন জোয়ারে
আমি লিখে যাবো তার স্রোতের স্লোগান
হে বন্ধু, তুমিও খোলো চিরায়ত মন
অধিগম্য অন্ধকারে উঠুক সবিতা।
(খুলে দাও মন)চ)
দু’পায়ে জড়িয়ে শস্যময়ী মাটির মমতা
আঁচলে বিছানো সবুজের নিবিড় আসন
আর দুচোখে উদ্ভাসিত একগুচ্ছ শুভকামনা
ওই তো আমার মা,
আমার ফেরার পথে লক্ষ কোটি চোখ মেলে উঠোনে।
(জননী আমার)ছ)
আমিও তেমনই এক ভূগোল
তৃষ্ণাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে ছুঁয়ে যেও মাঝে মাঝে
আর বুক উপচানো বন্যায়
যদি পারো
ভাসিয়ে দিও একটি বার নৈমিত্তিক ছুটি নেয়া রাতে।
(প্রণয়ী নদীর কাছে)।জ)
গুলিতে মরেছে বাঘ, সিংহ লুপ্তনাম
হরিণেরা দৃশ্যচ্যুত যেহেতু হালাল
পোষ মেনে ঐরাবত শেখে ভুল কাম
বাঘছাল পরে হাসে বাঘের দালাল।
(ক্ষমতার দৃশ্যপট)ঝ)
দেখে যেও—সোনালী দানায় ভরে
গেছে ঘরদোর। তবু জুমে আছে
কতিপয় বেয়াড়া বিচালিত গোড়া
চৈত্রের খৈলানে এবার বহ্নোৎসব।
(স্রোতের ভাঙন চরের উৎসব)ঞ)
শুধু তুমি জেনে রেখো—ইউরোপের নানা ক্লাবে খেলেও
মেসি যেমন আর্জেন্টিনার,
আইপিএলে কাউন্টিতে খেলেও সাবিক যেমন বাংলাদেশের,
বিজয় সেনের রাজধানী বিজয়নগরের ধূসর ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে থাকা
হে অনার্য রাজকন্যা, প্রণয়ের পতাকা হাতে আমিও তেমনি তোমার।—
(বিজয় সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা)
‘কাব্য রহস্য সৃষ্টি করতে পারে, মানব মনে অনুপ্রেরণা আনতে পারে, সাধারণের উপভোগের অতিরিক্ত একটা আনন্দবোধ জাগাতে পারে, কিন্তু কবিতা প্রধানত এবং মূলত- ভাষার সম্ভাবনা নির্ণয় করে থাকে। এভাবে ভাষার সম্ভাবনা নির্ণয়ের মধ্যেই কবিতার ঐতিহ্য নিহিত থাকে।’ কবিতার শিল্প ও সম্পন্নতা সম্পর্কে এই মন্তব্য সৈয়দ আলী আহসানের। এই নিক্তি মোতাবেক এবং ধ্বনিগত সৌকর্য বিবেচনায় আমিনুল ইসলামের কবিতা নানাস্থলে ও নানান ভাব-রূপ মর্মে উন্নত হয়ে উঠেছে। ভাব ও বক্তব্যের সাথে শব্দ ব্যবহারের যে ঐক্য প্রয়োজন তা রক্ষায় কবি গভীর নিষ্ঠা বজায় রেখেছেন। স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে তিনি যোগ করেছেন শিল্পের নিত্য-অনুষঙ্গ, বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতার সারাৎসার; যা তার কবিতাকে স্বতন্ত্র আলো দিয়েছে।
০৩.
কবির সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে অবহিতির প্রয়োজনে তার কবিতায় শব্দরূপ, বাক ও নির্মিতির দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। কারণ শব্দবিন্যাস ও ধ্বনিমাধুর্যের যথার্থ মিশেলেই কবিতার সম্পন্নতা। শিল্প মূলত মানবদৃষ্টি, কল্পনা ও অন্তকরণের প্রতিরূপ। যেখানে আকার, আঙ্গিক ও বস্তুগত সুন্দরের দৃঢ়-অবস্থান রয়েছে। মনের মিল হওয়া সত্ত্বেও প্রেমিক হৃদয় তার প্রেয়সীর মুখ দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে চায়। এভাবে সর্বত্রই আকার ও আঙ্গিকের মাহত্ম্য রয়েছে। ওয়াল্টার পেটার, যিনি Aestheticism-কে ইংলেন্ডে প্রচার করেন, তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন শিল্পের আঙ্গিক ও কৌশলের ওপর, নিটোল নিখুঁত সৌন্দর্য সৃষ্টির ওপর। শিল্পসৃষ্টির প্রতি তার পরামর্শ ছিল—জীবনকে তীব্রতম তীক্ষ্মতম অনুভূতিতে পূর্ণায়ণের বাস্তবতায় শিল্পীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্পর্কিত। কবিতার শিল্প ও নন্দন বিচারের প্রশ্নে আঙ্গিক ও দৃষ্টিরূপ সংক্রান্ত বিষয়টি তাই অনিবার্য পাঠ। কবিতার বাহ্যিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিবিধ মান ও নিক্তি। যার মধ্যে প্রতীক, চিত্রকল্প, উপমা, অনুপ্রাস, ছন্দ, রূপক, নতুন শব্দবন্ধ, বাক্য-বিন্যাস, ধ্বনি মাধুর্য ও বাক-প্রবাহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব অনুষঙ্গ ও মাত্রামানের আলোকে আমিনুল ইসলামের কবিতায় সন্ধান চালানো যাক। উত্তীর্ণ কাব্যবস্তুকে উপস্থাপনপূর্বক সঙ্গত মন্তব্য করা যাক:
শুধু এতুটুকু সবুজ আড়াল শুধু এতটুকু শুদ্ধ ছায়া।
আড়ালে থাবার দাগ—দৃষ্টিতে বিধ্বস্ত-ছায়া
শুধু এতুটুকু তৃণভূমি—শুধু এতটুকু জলাশয়
তৃণভূমি রেঙে যায় লালে—খুলিতে—কংকালে ভরে ওঠে জলাশয়।’
(বাঘ-হরিণের সংসার)
কবিতাংশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, শব্দের অপূর্ব খেলা। ‘তৃণভূমি রেঙে যায় লালে’—যদিও এটুকুতেই খুনের প্রতিরূপ মিলে কিন্তু শব্দের নন্দন বজায় রেখেই কবি এখানে সার্বিক বিপন্নতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন পরের শব্দবন্ধ ‘খুলিতে-কংকালে ভরে ওঠে জলাশয়’। ‘বাঘ-হরিণের সংসার’ শিরোনামের এই কবিতাটির মাঝে আমরা পেয়ে যাবো খুবই চমৎকার একটি চরণ: ‘জলের অথই নিয়ে সমুদ্র কি হতে পারে শান্ত জলের সোনাদিঘি !’ এ কবিতাটির শেষ দুটি বাক্য এমন: ‘অতএব-জাতিসংঘ না মানুক, তুলে রাখুন সেমিনার/ একথা শোণিতসত্য-বাঘ ও হরিণের সংসার ঘ্রাণ-তফাতে।’
যুগের চলার সঙ্গে অভিনবত্ব বজায় রেখে যে সব কবিতা হাজার বছর অতিক্রম করে আমাদের হাতে পৌঁছেছে, আমিনুল ইসলামের কবিতা সেই ধারাবাহিকতারই সমকালীন স্বতন্ত্র সংস্করণ। এই শিল্পগুণই তার কবিতাকে কালোত্তরে পৌঁছে দেবে বলে ধারণা করছি।
বাঘ ও হরিণের রাজ্যে যতই শ্যামল থাকুক যেহেতু অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই আগ্রাসন অনিবার্য সেহেতু এখানে সহাবস্থানকালে রক্তপাতহীনতাই বরং অস্বাভাবিক। বাক্য-বিন্যাস কৌশল ও আঙ্গিকের সৌষ্ঠব বজায়ের পাশাপাশি যখন দৃঢ়তার সাথে বক্তব্য এভাবে স্পষ্ট হয় তখন সে কবিতার স্বার্থকতা সম্পর্কে প্রশ্ন থাকে না। অবশ্য কবিতা যে সর্বদা নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করবে এমনও কিন্তু নয়। অনুভূতির অবোধ্য সংবেদ থেকে এমন উচ্চারণও হতে পারে যেখানে অর্থ বা বক্তব্য সন্ধানের চেয়ে সৌন্দর্যই মুখ্য, স্তব্ধ হয়ে শ্রবণ বা পঠনই যেখানে এককভাবে কাঙ্ক্ষিত।
গন্তব্য উজানে জেনে
ঢেউয়ের পিঠে সওয়ার হওয়া
গন্তব্যের কাছাকাছি যখন
থেমে গেছে হাওয়া
এখন একান্ত অনুনয় শুনে
হেসে ওঠে স্রোত।’
(স্রোতে ও ঢেউ: তিন)
স্রোতের এই হেসে ওঠার মধ্যে সামান্য বিদ্রূপ থাকলেও কিন্তু বিজিতের প্রতি বিরুদ্ধাচার নেই। ভাবনার এমন সংগঠিত রূপ ও পরিমিত শব্দের যথার্থ প্রয়োগ দারুণ শিল্প সফলতাকেই তুলে ধরে। নান্দনিক চিত্রকল্প তৈরি ও উপস্থাপনা আধুনিক কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ; চিত্রকল্পের অভিনবত্বের ফলে পাঠক কেবল তাকাতেই বাধ্য হয় না, কখনো কখনো বিস্ময়ে থমকেও যায়। গতানুগতিক বিষয়ের মধ্যেও কবিরা শিল্প চাতুর্যের ছোঁয়ায় এমন বাক-প্রবাহ তৈরিতে সক্ষম হন, যা থেকে দৃশ্যের আবহের চেয়ে অভিব্যক্তির অস্তিত্বই মহার্ঘ হয়ে ওঠে। কবিতার শিরোনাম ‘মঞ্চ এবং প্রতিমঞ্চ’:
পরগাছা-ছায়া ছেড়ে সূর্যের সাথি হলে
ঘামের স্রোতে ভেসে যায়
করোটিতে জমে ওঠে সোনালি দুর্বলতা
অতএব ক্ষতি কী যদি শিরা উপশিরা হয়ে ওঠে ধনুকের ছিলা !
রোদের বাতাসে ভর রেখে
আপন-স্বপ্নের মেঘ হয়ে তুমিও উঠে যেতে পারো!’
এখানে দৃশ্য পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্যে যেমন শিল্প রয়েছে, তেমনি রয়েছে, ‘আপন-স্বপ্নের মেঘ হয়ে’—ভেসে যাওয়ার উদাত্ত পাঠ। সুন্দর কখনোই নিরাপদ ছত্র-ছায়ায় বেড়ে মহৎ সুন্দর হতে পারে না, এজন্য প্রয়োজন অভিলাষ ও দুরন্ত-দর্গম বাসনার পিছু ধেয়ে চলার—অধিযাত্রা।
আমিনুল ইসলাম কবিতায় শব্দের মালা গেঁথে বাক-কৌশলের চালেই তাঁর কবিতায় ছন্দ স্থাপনে স্বচ্ছন্দ। তিনি বিষয় ও বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি রেখেই তবে ছন্দ-প্রয়োগের বিষয়ে সচেষ্ট। সমকালীন কাব্য প্রবণতার মধ্যেই মূলত এই ভঙ্গি অধিকতরভাবে লক্ষণীয়। অর্থাৎ বক্তব্য বা বাক-প্রবাহগত ভাবনার আগে ছন্দের কৃত্রিম কৌশল প্রয়োগ কবিতার শিল্পকে ক্ষুণ্ন করে। তবে বাংলা কবিতায় এমন অনেক সফল কবিতাও পাওয়া যাবে, যেখানে ভাবের সঙ্গতি রক্ষার পাশাপাশি ছন্দ ও নন্দন মিলেমিশে একাকার অনুপম কাব্যকীর্তি পরিবেশনা। ছন্দের মধ্যে থেকে সফল কবিতা রচনা অবশ্যই কাব্যকীর্তিকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দান করে। গদ্য কবিতার পাশাপাশি কবি আমিনুল ইসলাম নীতিনিষ্ঠভাবে বেশ কিছু- মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সফল কবিতা লিখেছেন; আমরা এখানে তার অক্ষরবৃত্তে কাজ করা ‘অবেলায় আদিতমারী’ কবিতা থেকে কিছু অংশ পাঠ করতে চাই:
বিকেলের রোদ এসে চুমে যায় জলপাইপাতা
ছুঁতে চায় নিজগন্ধে চম্পাসারি অনায়ত্ব মেঘ
বুক দেখে হতাশায় গিরিধারী স্বর্ণমতি তিস্তা
জ্যৈষ্ঠবায়ে বালু ওড়ে, বাড়ে দগ্ধ বিরহের বেগ
লুন্ঠিত যৌবনে। তবু ডাকে পিক যুগলবন্দিশে
পাপিয়া প্রমত্তা। ফন্দি নিয়ে বুকে নগরশকুন
রেকি করে ছায়াকুঞ্জ দূর হতে প্রসারিত শ্বাসে
বগাচরে ফাঁদ পাতে ছদ্মবেশী শিকারী নতুন।
ছন্দরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের অন্তরীণ সম্ভাবনাকে তুলে এনে বিচিত্র ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করাও কবিতার শিল্প-সৌন্দর্যের অন্য এক নমুনা। মৌলিক ভাবনার বিচিত্র ব্যাখ্যা ও প্রকাশ নিয়েই আসলে পৃথিবীতে কথা বেড়ে চলছে, একবারেই নতুন ভাবনা বলে হয়তো নেই কিছু; কিন্তু শব্দের বা প্রকাশ ভঙ্গির বিকল্প আছে, যা ভাষ্যের অভিনবত্বের ফলে পাঠকে সম্মোহিত করে। কবিতার শিরোনাম—‘বীজ না মাটি’
মরুকরণের পায়ে মাথা কুটে সবুজ পরাণ
উত্তরের মাঘমঞ্চে। জলশূন্য বায়ুর দোলায়
ঝুর ঝুর ঝরে পড়ে পর্ণমোচী—ফাল্গুনের দ্বারে
অনুল্লেখ্য দানে চৈত্র যায় শেষ করে পুষ্প সম্ভাবনা।’
সুন্দর, অসুন্দর, মন্দ, তিক্ততা বা মধুরতাকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাদের উপমা প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে—এটা যেমন লেখার ক্ষেত্রে, তেমনি বলার ক্ষেত্রেও। আসলে উপমা প্রয়োগ ছাড়া যেন বিষয়ের তীব্রতা বা যথার্থ অবস্থা প্রকাশ পায় না, এজন্য শিল্পে উপমার প্রয়োগ অনিবার্য।
উপমা প্রয়োগের অভিনবত্ব কবির দৃষ্টি, কল্পনা এবং বুদ্ধির সামর্থকে প্রকাশ করে যে: তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টির দূরত্ব কতদূর, পরে আসে নির্মিতির কথা। উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত ‘মতো’ও ‘সদৃশ’ শব্দদুটিকে বর্তমানে কবিরা প্রায় বিদায় দিয়েছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠে অনেক নান্দনিক উপমা ও উৎপ্রেক্ষা খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা এখানে কেবল তার ‘ধবল মেঘের দিনগুলি’ কবিতা থেকে সামান্য পাঠ নিচ্ছি—‘ঘাটের বাতাসে দোলা সাদা কাশফুলে/ তোমার ওড়নাখানি বেঁধেছিল জুটি।’কবিতায় শিল্প ও নন্দনের প্রয়োগ যথার্থভাবে সম্পাদনা সহজ কাজ নয়। কবিতা একইসঙ্গে দর্শন, পঠন ও শ্রবণের শিল্প-মাধ্যম। প্রদর্শন শিল্প (Performing Art) হিসেবে কবিতার প্রয়োগ বা উপস্থাপনার ইতিহাসও দীর্ঘকালের। সেক্ষেত্রে একইসঙ্গে উন্নত ভাবনা ও শিল্পের যথার্থ অভিনিবেশ রক্ষার জন্য কবিকে ধ্যানী ও বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হয়। বর্তমানে কবিতার নামে যে শব্দ-ভিত্তিক কাঠামো অঙ্কনের মহড়া চলছে, তার মধ্যে থেকে শিল্প বা ভাবনা কোনোটাকেই উদ্ধার করার প্রচেষ্টা বৃথাপ্রায়। এক্ষেত্রে দুই দশকব্যাপী কবিতাচর্চায় নিবিষ্টভাবে নিয়োজিত কবি আমিনুল ইসলামের কবিতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত ও বিশ্লেষিত করা যায়। ভাব, বিষয় ও শিল্পের ঐক্য রক্ষার মাধ্যমে নিজের বাক্যভাষা ও বক্তব্যকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপনে তিনি পারঙ্গমতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। যা তার প্রকাশিত কবিতাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে। চর্চার ধারাবাহিকতা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাকে কৃত্রিমতা, উদ্ভট, অসুন্দর ও অপ্রীতির কবল থেকে মুক্ত রাখার মধ্যেই কবির প্রকৃত সফলতা।
আঁধার বিভানাশক হলেও সৌরালোকের তাৎপর্যে তা যেমন অস্তিত্ব রক্ষায় অপারগ, তেমনি কেবল শিল্প ও সুন্দরের সক্ষমতাই উন্নত শিল্পকারের প্রতি স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেরাতে যথেষ্ট। সেই উচ্চ-শিল্পকীর্তিই আমিনুল ইসলামের কবিতাকে আনন্দ সমাগমে উপযুক্ত স্থান দেবে। যুগের চলার সঙ্গে অভিনবত্ব বজায় রেখে যে সব কবিতা হাজার বছর অতিক্রম করে আমাদের হাতে পৌঁছেছে, আমিনুল ইসলামের কবিতা সেই ধারাবাহিকতারই সমকালীন স্বতন্ত্র সংস্করণ। এই শিল্পগুণই তার কবিতাকে কালোত্তরে পৌঁছে দেবে বলে ধারণা করছি।