আকবর হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত। পঞ্চাশ থেকে সত্তর; এই তিন দশক বাংলাদেশের পাঠকদের তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রেখেছিলেন। প্রথিতযশা এই কথাসাহিত্যিক ১৯১৭ সালের ১ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের ২ জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর উপন্যাস অবাঞ্ছিত, কী পাইনি, মোহমুক্তি, ঢেউজাগে, দুদিনের খেলাঘরে, মেঘ বিজলি বাদল, নতুন পৃথিবী, দুষ্টক্ষত, আভা ও তার প্রথম পুরুষ এবং গল্পগ্রন্থ আলোছায়া।
একজন ব্যক্তিমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে নানা আলোড়ন। এ আলোড়ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি বহুধা সংজ্ঞায় সজ্ঞায়িত। বাংলা কথাসাহিত্যের সৃষ্টিমূলে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে এ অভিজ্ঞতাগুলো। আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব হিসেবে। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে সরকারি চাকরি করতে গিয়ে তিনি রাজনীতির নানা আয়তন লক্ষ করেছিলেন, ব্যক্তিবোধের সাথে না মেলা বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন, আর সে কারণে চাকরি জীবনে বিব্রত ও বিপর্যস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা দেখেছি কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশি আন্দোলন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সরব থেকেছেন—নিজের বৌদ্ধিক চেতনায়ে সেগুলোকে জারিত করে প্রকাশ করেছেন শিল্পের আসরে। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, শওকত ওসমান প্রমুখ বাংলা উপন্যাসের প্রথিতযশারাও রাজনীতি বিমুখ নন। বরং রাজনীতিকে তাঁরা কেউ কেউ সেসময় শিল্পের ভিত্তিভূমি হিসেবে দেখেছিলেন।
শুধু রাজনীতি নয়, একজন কথাসাহিত্যিকের কাছে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি এমনকি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এবং তার প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর প্রতিটি ভাবনায় তিনি তৈরি করেন মানবমূর্তি। যে মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতিক সর্বোপরি বৈশ্বিক—অন্তত একজন আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে এ কথা সর্বোত প্রযোজ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এক হাতে রাজনীতি অন্য হাতে সমাজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ ‘চোখের বালি’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, ‘গৃহদাহ’ শেষপ্রশ্ন, মানিকের বকুলপুরে যাত্রী, তারাশঙ্করের জলসাঘরের নট-নটী কিংবা শহীদুল্লার ‘সংশপ্তকে’র প্রধান চরিত্রগুলো শুধু সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবেশিরই ফসল নয়, তারা ব্যক্তি থেকে শিল্পী হয়ে ওঠা সেসব ঋদ্ধ সত্তারও বহিঃপ্রকাশ। তাই সমাজ থেকেই শিল্পীর জন্ম আর শিল্পের জন্ম শিল্পী থেকে। শিল্পীমনটি নিকষিত ও বিকশিত হয় সেখানেই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে ক্ষুধার যন্ত্রণার অভুক্ত নর-নারীর যে আহাজারি সৃষ্টি হয়েছিল, গ্রাম-গঞ্জে-শহরে-রাজধানীতে বুভুক্ষু মানুষের মৃতদেহ যে ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল আকবর হোসেনের ‘আভা ও তার প্রথম পুরুষ’উপন্যাসে উঠে এসেছে।
ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের বেশ কিছু সময় পূর্ববাংলার নদীয়া জেলায় (বর্তমানে কুষ্টিয়া ও পাবনা) কেটেছে। জন্মস্থান কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে শৈশব কৈশোর-জীবন কাটিয়েছেন। কুষ্টিয়া থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কৈশোর থেকেই তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। সমাজ জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে ঘিরে তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে এ সময় তাঁর সচেতনতা লক্ষ করা যায় না। মূলত ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৩৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজে বি.এ. অধ্যয়নকালে কলকাতার রাজনৈতিক অবস্থা তাঁর মনে প্রভাব ফেলে। তবে কোন দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন না। ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তাঁর উপন্যাসে তা প্রতিফলিত হয়েছে।
১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর মনে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আকবর হোসেনের শিল্পমানসে এ সব রাজনৈতিক ঘটনা এবং সমসাময়িক সমাজজীবন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি তাঁর উপন্যাসে নির্যাতিত মানুষের কথাই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শোষিত মানুষের মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি গণতন্ত্রকেই অধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। আবার তিনি লক্ষ করেছেন একশ্রেণির মানুষ ‘নেতা’ নামে খ্যাত হলেও তারা প্রকৃত অর্থে ব্যক্তিস্বার্থলোভী মানুষ।এ ধরণের নেতারালাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, সর্বহারা মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণসংগ্রাম গড়ে তোলার কথা বলে মূলত নিজেদেরস্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। মানুষের মুক্তির উপায় হিসেবে কায়েম করতে চায় গণতন্ত্র কিন্তু তারা জানে সাধারণ মানুষের সাথে তারা কতোটা দূরত্ব রেখে চলে। এ ধরণের নেতাদেও আত্ম-অহংকার প্রকাশ পেয়েছে এভাবে ‘আমার অভিজাত রক্ত ধারায় কোনো নিকৃষ্ট রক্ত এসে তরঙ্গ সৃষ্টি করুক তা আমি চাই না।’ সাধারণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামী নেতা যিনি সাধারণ মানুষের রক্তকেই তিনি জানেন নিকৃষ্ট হিসেবে। সুতরাং সেই মানুষটি যিনি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র আর গণসংগ্রামের নেতা নন, সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করেই যে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান তা তাঁর ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে।
আকবর হোসেন ছিলেন সমাজ সচেতন শিল্পী। সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সমাজে নারী-পুরুষের অবৈধ জৈবিক মিলনে নারীরা যুগ যুগ ধরে যে লাঞ্ছিত তারই চিত্র এঁকেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে। গ্রামেরঅশিক্ষিত সহজ সরল মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর অর্থপিশাচ স্বার্থান্বেষীরাযে ধোঁকাবাজির রাজত্ব চালায় এবং সে সঙ্গে নগরজীবনে উচ্চাভিলাষীতার নামে যে নষ্টসভ্যতা, তার অনুকরণে শিক্ষিতসমাজ ভ্রান্ত প্রগতির নামে কতোটা অধঃপতনে নিমজ্জিত— তার স্বরূপ এঁকেছেন তিনি ‘ পাইনি’ উপন্যাসে। এ অধঃপাতটিই আকবর হোসেনের শিল্পীমনকে সংযুক্ত করেছিল।
আকবর হোসেনের কালচেতনা তাঁর উপন্যাসে লক্ষ করা যায়। তাঁর সাহিত্যজীবন মূলত ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত। জমিদারী আমলে জমিদার তথা তাঁদের নায়েবদের অত্যাচারের কাহিনিও লক্ষ করা যায় তাঁর রচনাতে। ‘অবাঞ্ছিত’তে জমিদারের অত্যাচারে দুর্যোগের কালোমেঘ নেমে এসেছিল গোমস্তা ওসমানের নাতনি রোকেয়ার জীবনে। ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে জমিদার এনায়েত খানের অত্যাচারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে প্রতিবাদী ও আদর্শবান ওমর মাস্টার এবং লাঞ্ছিতা হয়েছে তাঁর স্ত্রী রাঙা বউ। গ্রামের সাধারণ সহজ-সরল নারীরাজমিদারের লালসার শিকার হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মান-সম্মান নিয়ে যেমন বেঁচে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে ছিল, তেমনি অত্যাচারের শিকার হয়ে মৃত্যৃবরণ করেছ অসংখ্য মানুষ। জমিদারের নায়েব জামসেদ অত্যাচারের যে স্টিম রোলার চালিয়েছিল সাধারণ মানুষের ওপর, সে চিত্র অঙ্কনে আকবর হোসেন সমাজজীবনে জমিদারদের প্রকৃত স্বরূপ অত্যন্ত দক্ষ শিল্পীর মতো তুলে ধরেছেন। বিভাগপূর্ব বাংলার সামাজিক সঙ্কটের অন্যতম প্রসঙ্গ ছিল হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। উপমহাদেশে এই ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে নোংরা হানাহানি নতুন নয়। ১৭৩০ সালে মোঘল সম্রাট ফররুক শিয়রের রাজত্বকালে ছেলেখেলা উপলক্ষে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর রক্ত ক্ষয় হয়েছিল।
ইতিহাসের বহমান ধারায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতিহীনতা ও জিঘাংসাবৃত্তি চলে এসেছে। ১৯২০ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে বাংলার নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষোদ্গার লক্ষ করা গেছে। সাধারণত আর্থিক অসমতা বিধানের বাস্তবতা থেকেই এহেন দাঙ্গার কালোহাত বার বার বাঙালি সমাজ পরিবেশে আঘাত হানে। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ছোটখাটো হাঙ্গামা বাদ দিয়েও ১১২টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। ১৯২৭ সালে ভারতে ৩১টির মতো দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে থাকে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই এই দাঙ্গা ঢাকায় নানাভাবে সংঘটিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য অলক্ষ্যে থেকে একশ্রেণির নেতারা এমন ঘটনার সূত্রপাত করেন। কখনো বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সংরক্ষণের তাগিদেই এরূপ দাঙ্গা বাঁধায়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল আকবর হোসেনের ‘মোহমুক্তি’ উপন্যাসে তা তুলে ধরেছেন।
বিভাগ-পূর্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য ও কৃষকের দুর্গতির জন্য যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আংশিকভাবে দায়ী, তেমনিই কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিকারী বণিক সমাজ ও হৃদয়হীন শাসক গোষ্ঠীর হঠকারী ভূমিকাও কম নয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশে বহুবার দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছে। যেমন— ১৭৮০, ১৮৬৬, ১৮৭৩-৭৪, ১৮৭৫-৭৬, ১৮৯১-৯২, ১৮৭৯ ও ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কথা আমরা বলতে পারি। প্রতিবারই ক্ষুধার ঘাতকের কাছে এদেশের বহুলোক আত্মাহুতি দিয়েছে। সবচেয়ে ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে। এ শতকের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর এই দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেখানে খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব এতো তীব্ররূপ ধারণ করেছিল যে, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাও একমুঠো ভাত আর পরিধানের একটু কাপড়ের জন্য নিরুপায় হয়ে শরীর বেঁচতে বাধ্য হয়েছিল। ক্ষুধার জন্য দেহদানের ব্যাপক চিত্র পাওয়া যায় ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়কালে। কলকাতায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত নারীরা যেন দেহ ব্যবসা করতে না পারে এজন্য বেশ্যাবৃত্তি প্রতিরোধ কমিটি ও গঠিত হয়েছিল। নর-নারীর লজ্জা নিবারণ করাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। এমনকি মৃতের সৎকার ও বিবাহের উৎসবে নতুন কাপড়ও জুটতো না। আর এই অভাব থেকেই সমাজে সংঘটিত হতে থাকে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এর ফলে সমাজ ক্রমশই এক মূল্যবোধহীন অন্তঃস্বারতায় পর্যবসিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২)-এ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে। ১৯৪০ সালের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ) এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নমুনা’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’, শওকত ওসমানের ‘বণী আদম’ ও ‘জননী’ ইত্যাদিতে। আকবর হোসেনও সচেতনভাবে দুর্ভিক্ষের ছবি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু কওে সমাজ ও কালসচেতন শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ উল্লেখযোগ্য।তাঁর‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ দেশ-বিভাগের পরে রচিত হলেও এর প্রেক্ষাপট ছিল দেশ-বিভাগের পূর্বকালের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে ক্ষুধার যন্ত্রণার অভুক্ত নর-নারীর যে আহাজারি সৃষ্টি হয়েছিল, গ্রাম-গঞ্জে-শহরে-রাজধানীতে বুভুক্ষু মানুষের মৃতদেহ যে ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল আকবর হোসেনের ‘আভা ও তার প্রথম পুরুষ’উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কাল পর্যন্ত আকবর হোসেনের উপন্যাসে তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
তিনি সমাজ ও কালসচেতন ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিতে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সাবলীলভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আর এ কারণে তাঁর উপন্যাস বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পেরেছে।
১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮)। আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র, বাংলাকে ইসলামিকরণের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য পূর্ববাংলায় ১৯৪৮ সালের গোড়া থেকেই আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন ক্রমশ কঠিন রূপ ধারণ করে। অবশেষে ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি সংগ্রামী জনতার বুকে গুলি চালানো হয়। এর ফলে— ঢলে পড়ে রফিক, আবুল বরকত, জব্বার, সালাম, শফিউর সহ অসংখ্য তরুণের রক্তে অর্জিত হয় বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিকতন্ত্র পূর্ব বাংলার সামগ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করে দেয়। মাঝখানে ’৬২-৬৩ সালের ছাত্র আন্দোলন, ’৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ’৬৫ সালের শ্রমিক আন্দোলন, ’৬৬ সালের স্বায়ত্তশাসন তথা ছয় দফার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব এদেশের মানুষের মনে দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন ও প্রতিরোধের মুখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জন করলেও তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালির আত্মজাগরণের এই মহান দেয়ালীকে চিরতরে নির্বাপিত করার জন্যে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে অনুষ্ঠিত হয় ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার বর্বরতম যুদ্ধ। তার পরেই রক্তপিপাসু শাসকের সমস্ত মুখোশ খুলে, সমস্ত ধনীর জিগির সাম্প্রদায়িকতা এবং ভারত বিদ্বেষের সমস্ত টালবাহানা অপনোদন করে এদেশবাসী এক অনমনীয় সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন পাকিস্তানি শাসনপর্বের এই সাড়ে তেইশ বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সমালোচক ও পর্যবেক্ষক। পাকিস্তানি শাসন পর্বের নানা অত্যাচার, বৈষম্য ও ভারত বিভক্তি এসব তিনি তাঁর ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসে আলোচনা করেছেন।
১৯৬০-এর দশকে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম যতই তুঙ্গে উঠেছে, পশ্চিমা শাসকচক্র ততই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয়দফা পেশ করেন। ছয়দফার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবসহ অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। অধিকন্তু ছয়দফার স্বপ্নকে বানচাল করার জন্য আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় তাঁকে জড়িয়ে ফেলেন। ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে শুরু হয় বিচারের নামে প্রহসন। ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে গণঅসন্তোষ। ঘাতক শক্তির বুলেটে ১৯৬৯ সালের ২০শে জানুয়ারি শহিদ হন ছাত্র নেতা আসাদ। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন। গণআন্দোলনের প্রচণ্ডতায় ২৫শে মার্চ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান আইয়ুব খান। নতুন সামরিক শাসক হন ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে নারীরা কিভাবে নির্যাতিত হয়েছিল এবং নির্যাতিত হতে হতে তারা কিভাবে বীরাঙ্গনা নারীতে পরিণত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল পাক বাহিনীর পশুশক্তির বিরুদ্ধে তারই বাস্তবরূপ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসের চামেলী চরিত্র। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা হয়। নতুন দেশে যুক্ত হয় ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক নির্দেশনা।
স্বাধীন বাংলাদেশে আকবর হোসেন যে আশা ব্যক্ত করেছিলেন তা হলো :
‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যা, লুণ্ঠন, নারীধর্ষণ আর অকথ্য লাঞ্ছনা-নির্যাতনর পর সংগ্রামী জনগণ বিশেষ করে আমাদের যোদ্ধারা দেশকে মুক্ত করেছে পশুশক্তির কবল থেকে। সন্ত্রাসের রাজত্ব শেষ— এবারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নতুন করে গড়তে হবে দেশকে। আর সে গড়ন-গঠন শুধু আঙ্গিনার নয়— মনেরও। …সেই বিবেকবান মাটির মানুষদের জীবনকথা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সৃজনশীল সাহিত্যে তাদের চিন্তার বিকাশ-প্রকাশ, গতিশীল পৃথিবীতে তাদের উন্নত জীবনের গতিময়তা সবকিছুর মাঝে থাকবে বাংলার বাঙ্গালিত্ব।’
এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দেশকালের পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন যথেষ্ট গভীরভাবে অনুধাবন সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে তাঁর উপন্যাসে দেশ-কাল-সমাজ নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সমাজ ও কালসচেতন ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিতে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সাবলীলভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আর এ কারণে তাঁর উপন্যাস বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পেরেছে। আকবর হোসেন এক্ষেত্রে একজন দক্ষ-শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন।