[কবি ও কথাশিল্পী রাহেল রাজিব কলকাতা থেকে সুবীর মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার পাচ্ছেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশের দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার নাড়িমাটি কাঁটাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নেপাল, ভুটান ও ভারত ছাড়াও ঘুরেছেন ইউরোপের ৯টি দেশসহ মিশর ও তুরস্ক। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও এখন সমান্তরালে গল্প ও গদ্য লিখছেন। তিনি জি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ফুলবাড়ি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবনের শুরু হলেও বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তার কবিতার বই—অবচেতন মনে আগুনের ছোঁয়া, রাত্রিহর্ষক, জুঁইদি ও মাতাল প্রেমিক, বালিঘর, কাকতাড়ুয়াদের গোপন গ্রাম, পাকাপাকি (ছড়া), মুক্তগদ্য—সহজ কথা, অনুমেয় আঘাতের ক্ষত, নানাকথা, প্রবন্ধের বই—কথাশিল্পের করণকৌশল, রহু চণ্ডালের হাড় ও অন্যান্য প্রবন্ধ, পাঠ উন্মোচনের খসড়া, গবেষণাগ্রন্থ—শওকত আলীর ছোটগল্প : বিষয় উন্মোচন ও ভাষার অন্তর্দেশ, কাহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট : বিষয় ও শিল্পরূপ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : জীবনের ধ্রুবপদ দিয়েছে বাঁধি, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ—গুণিন কথা, ষষ্ঠ বাহাস, গুণিনে অনুনয় প্রভৃতি।
এর আগে তিনি গ্লোব সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৯, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার-২০১৮, সৈয়দ শামসুল হক চর্চা কেন্দ্র সম্মাননা-২০১৮ ও কফি হাউসের চারপাশে সম্মাননা, কলকাতা-২০১৯ পেয়েছেন। সম্প্রতি পুরস্কারপ্রাপ্তি ও লেখালেখির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন চিন্তাসূত্রের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।]
চিন্তাসূত্র: আপনার ‘কফিসূত্রে’ কাব্য পাণ্ডুলিপির জন্য কলকাতা থেকে ‘সুবীর মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার’ পাচ্ছেন। এ প্রাপ্তির অনুভূতি জানতে চাই।
রাহেল রাজিব: যেকোনো স্বীকৃতি একধরনের আনন্দ উদযাপনের মাত্রা যোগ করে। তবে স্বীকৃতির সমান্তরালে এক প্রকার চাপও তৈরি হয় লেখক হিসেবে এবং সেটা নিজের সাথে—নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার প্রচেষ্টা জারি রাখা। সেটা যতক্ষণ নিজের ভেতরে অনুভব করবো; ততক্ষণই হয়তো শিল্পের সাথে থাকা হবে—নতুবা প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মাণের যে চেষ্টা সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
পৃথিবী বিখ্যাত ধ্রুপদি সাহিত্য হিসেবে যেসব স্বীকৃত; সেগুলো যেমন তার প্রমাণ রাখে—একই সঙ্গে একজন লেখকের সময়কালে খুব কম সংখ্যক লেখকের পক্ষেই নিজের চূড়ান্ত মূল্যায়ন দেখার সুযোগ মেলে। আর পুরস্কার সম্মান সম্মাননা এসব তো পালক মাত্র।
চিন্তাসূত্র: ‘কফিসূত্রে’ কাব্য নিয়ে আমাদের কিছু বলুন।
রাহেল রাজিব: ‘কফিসূত্রে’ কাব্য ২০২১ সালে প্রায় চার মাস ধরে লেখা—বিশেষ একটা কারণও ছিল। এ কাব্যে কফিসূত্রে এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, যা আগে চাইলেও করতে পারিনি। বিষয় ও কাঠামো দুটোতেই ‘কফিসূত্রে’ পাঠান্তে পাঠক প্রকৃত বিচার করতে পারবেন।
চিন্তাসূত্র: আমাদের দেশে পুরস্কার নিয়ে অনেক রকম কথা শোনা যায়। যদিও আপনি পুরস্কার পাচ্ছেন কলকাতা থেকে; তবুও এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
রাহেল রাজিব: আমাদের দেশের পুরস্কার বিষয়ে আপনারা কী শুনেছেন, সেটা আপনারা ভালো জানেন। তবে আমি মনে করি, পুরস্কার প্রদান একটা পদ্ধতি বা কাঠামো—ফলে পুরস্কার প্রদান যে প্রক্রিয়ায় হয়, সেটাই হয় সবখানে—সেটা নোবেল, বুকার, সার্ক সাহিত্য পুরস্কার, ম্যাগসেসেসহ দেশ-বিদেশের সকল পুরস্কারের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। কেউ যদি সেটাকে অস্বীকার করে মহিমান্বিত ও বিমূর্ত করে তোলার চেষ্টা করে—সেটা যে হাস্যকর মনে হয়; সেটা বোধের মধ্যে থাকা উচিত। একটি পদ্ধতি বা কাঠামোকে স্বীকার করেই স্বীকৃতি।
চিন্তাসূত্র: বাংলাদেশের সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী বলে?
রাহেল রাজিব: সমসাময়িক যেকোনো কিছুকে সমকাল একটু উপেক্ষাই করে। ক্রিয়েটিভ সেক্টরে সেটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তবে সুশিক্ষিত সমাজব্যবস্থা এবং এর সংকটই একটি সমাজে শিল্পের সৃষ্টি করে। পৃথিবী বিখ্যাত ধ্রুপদি সাহিত্য হিসেবে যেসব স্বীকৃত; সেগুলো যেমন তার প্রমাণ রাখে—একই সঙ্গে একজন লেখকের সময়কালে খুব কম সংখ্যক লেখকের পক্ষেই নিজের চূড়ান্ত মূল্যায়ন দেখার সুযোগ মেলে। আর পুরস্কার সম্মান সম্মাননা এসব তো পালক মাত্র। লেখকের মৌলিক পর্যবেক্ষণ-দৃষ্টিভঙ্গি ও পঠন-পাঠনের গভীরতা তার লেখার পথ তৈরি করে। আমাদের সমসাময়িক সাহিত্য অনেকটা ‘জাহির সাহিত্য’—সময় গহ্বরে যা লীন হয়।
চিন্তাসূত্র: একজন লেখক ও গবেষক হিসেবে কোনো ঘাটতি কি চোখে পড়ে?
রাহেল রাজিব: ঘাটতি একটাই ‘মৌলিক পর্যবেক্ষণ-দৃষ্টিভঙ্গি ও পঠন-পাঠনের সীমাবদ্ধতা’।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা আপনার লেখকসত্তায় কিভাবে প্রভাব ফেলেছে? কিংবা যেভাবে বাংলা সাহিত্যকে নিজের অভিজ্ঞতায় নিয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাই।
রাহেল রাজিব: আমার প্রথম কাব্য ‘অবচেতন মনে আগুনের ছোঁয়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি! ২০০৩ সালে বাংলা সাহিত্যে একাডেমিক পাঠ শুরু করি—সেটারও গল্প রয়েছে; পড়তে চেয়েছিলাম ফার্মেসিতে। চান্সও মিলেছিল, কিন্তু সময় সায় দেয়নি! সে গল্প অন্যদিন অন্য কোনোখানে হবে।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, উন্নত দেশে নদীকে নদী মনে করে—তারা নদীকে নদীর মতো করে রেখেছে। এ ভূখণ্ডে নদীকে মা মনে করি, নদীর কী বেহাল দশা করে রেখেছি আমরা? তাই ওয়েবম্যাগকে ওয়েবম্যাগ হয়ে উঠতে হবে। ওয়েবম্যাগের নামে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ ধর্মী কাজ করলে হবে না।
বাংলা সাহিত্য পড়তে আসার আগেই কবি মানস (প্রতিষ্ঠা ১৯৯৮) ‘পাঠচক্র রবিবার’ লিটল ম্যাগাজিন করা—সবকিছু মিলে রেজা আহমেদ ও আব্দুল আজিজ বাবু স্যারের নার্সিংয়ে আমার ক্লাস সেভেন থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন বিষয়ক যে পাঠাভিজ্ঞতা তৈরি হয়, সেটা ক্রিয়েটিভ। ফলে মেডিকেলে পড়লে ডাক্তার হয়, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে ইঞ্জিনিয়ার হয়, সাহিত্য পড়লে গবেষক হয়। বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি আমাকে একজন একাডেমিক অ্যাপ্রোচটা শিখিয়েছে এবং সেটা নিতান্তই পেশাগত—সেটার কোনো প্রভাব আমার লেখালেখিতে নেই বলেই আমার মনে হয়। পাঠক-সমালোচক ভালো বলতে পারবেন।
আমি মনে করি, একাডেমিক পঠন-পাঠন বরং আমার ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কের একধরনের প্রতিবন্ধক। কারণ আমার বাবা, প্রণম্য শিক্ষক আব্দুল আজিজ বাবু ও কবি মানস প্রতিষ্ঠাতা রেজা আহমেদের নার্সিংটি ছিল একান্তই ক্রিয়েটিভ। সেখানে শিল্পাস্বাদনই প্রধান ছিল।
চিন্তাসূত্র: আপনি একাধারে কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক। সে হিসেবে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আপনার প্রত্যাশা, অগ্রগতি ও প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু বলুন—
রাহেল রাজিব: আমি একজন শিল্পী হতে চেয়েছি এবং আমৃত্যু সেই চেষ্টাই করেছি—করছি এবং করে যাবো। বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমার প্রত্যাশা-প্রচেষ্টা এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। কারণ শিল্প সাহিত্য এরকম ভেবে হয় না। ‘বোধ যখন তাড়িত হয় তখনই শিল্প জারিত হয়’—আমার বাবার এ কথাটা সবসময় স্মরণে রাখি।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন কবি-লেখকরা কি বাংলা সাহিত্যে কোনো পরিবর্তন বা ভিন্ন সুর আনতে পেরেছেন? নাকি পুরোনো পথেই হাঁটছেন তারা?
রাহেল রাজিব: শিল্পের পথ মৌলিক। যারা হাঁটতে পারবেন; তারাই টিকবেন। যারা মিছিলে স্লোগান দেয়—তাদের কথা ইতিহাসে লেখা থাকে না, লেখা থাকে নেতৃত্বের কথা।
চিন্তাসূত্র: নবীন কবি, লেখক ও গবেষকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হতে পারে? আপনার কোনো অভিজ্ঞতা তাদের কী কাজে লাগতে পারে?
রাহেল রাজিব: নবীনদের জন্য একটাই পরামর্শ—কারো কথা শুনবেন না, শিল্প কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়। শিল্প ব্যক্তির উপলব্ধিজাত, সেটা অনুভব করা জরুরি। স্ব-স্ব-অনুভূতি ও আত্ম-পর্যবেক্ষণ শক্তিকে আবিষ্কারটুকু জরুরি। লেখকদের জন্যে বলার কিছু নাই—তারা তো অলরেডি লেখক! হা হা হা। গবেষকদের জন্য পরামর্শ দিতে গেলে একজন শিক্ষক হিসেবে বলবো—পড়ুন, একাডেমিক পাঠ। সিলেবাস ভালো করে পড়ুন, পরীক্ষা ভালো দিন, গবেষণা ভালো করতে চাইলে পঠন-পাঠন একমাত্র জরুরি।
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন? ওয়েবম্যাগের গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
রাহেল রাজিব: আমাদের সবকিছুই ঠুনকো; উন্নত চিন্তা-রাষ্ট্রের সবকিছুই টেকসই। কেন তাদেরটা টেকসই সেটা অনুধাবন করলেই উত্তর মিলে যাবে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, উন্নত দেশে নদীকে নদী মনে করে—তারা নদীকে নদীর মতো করে রেখেছে। এ ভূখণ্ডে নদীকে মা মনে করি, নদীর কী বেহাল দশা করে রেখেছি আমরা? তাই ওয়েবম্যাগকে ওয়েবম্যাগ হয়ে উঠতে হবে। ওয়েবম্যাগের নামে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ ধর্মী কাজ করলে হবে না।
চিন্তাসূত্র: আমাদের মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
রাহেল রাজিব: আপনাদেরও ধন্যবাদ। আপনারা আমাকে প্রশ্ন করার যোগ্য মনে করেছেন। আপনাদের কল্যাণ হোক।