কোথায় যেন হারিয়ে গেল সোনামুখ সুন্দর মানুষগুলো
ধুলোমাখা কাদামাটি মমতাভরা আঁকাবাঁকা পথ খুঁজে
পাই না তাদের—উড়ে গেছে রঙধনু আসমানে
ফুল-পাখি প্রজাপতি উৎসবে তাদের দেখি না আর
অনুষ্ঠান মিটিং মিছিল নদীঘাট স্কুলমাঠ
বাড়ির উঠোন কোথাও না
একদিন তারা এই মাটিতে পাখিদের মতো উড়ে বেড়াত
ছড়াত সৌরভ ফুলের মতোন—ঘুরত দু চোখে বুনে উদারতা
তারা এখন নক্ষত্র—আলো জ্বলজ্বল জোনাকি আকাশ
কোথায় হারিয়ে গেল সোনারঙ পাখিরা আমার
খুঁজি আমি কেঁদে কেঁদে পথে পথে
নদীঘাটে দাঁড়িয়ে দুর্গা ঠাকুরের সাথে এখনো তো কথা বলছেন
কথার শিল্পী আকবর হোসেন—দত্তপাড়ার পথে
এখনো তো দেখি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন ব্রজেন বিশ্বাস
কারিকর পাড়ায় হাঁটতেই জলা বিশ্বাস
‘কিরে কেমন আচিস? কবে আইচিস’?
মণ্ডলপাড়ার দিকে পা বাড়াতেই কণ্ঠ হোসেন মণ্ডলের
‘কি নানা চাকরি-বাকরি হলো?’ আমি তো দিব্যি দেখি বাড়ি বাড়ি
খবর নিয়ে ফিরছেন ছাতা মাথায় লাচন আলি মেম্বার
আমি তো দৌড়াচ্ছি এখনো খেলার মাঠে নুরাচাচা চিৎকার করে
দুহাত মাথার ’পর তুলে বলছেন, আরো জোরে আরো জোরে…
রাজসিক চেহারার আজিজ টাণ্ডেল দারুণ দাপটে ঘুরছেন
বাজারের এ-মাথা সে-মাথা—চায়ের দোকানে শুদ্ধ উচ্চারণে
গল্প করছেন আবদুল জলিল—সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি
চলে যাই নদীর ঘাটে নৌকোর ছৈয়ে
মালিথাপাড়ার বটগাছের কাছে দাঁড়িয়ে আমি তো এখনো শুনি
সাদেক মালিথা বলছেন, ‘কী গো শ্বশুর…’ সুরত আলি চাচা
কাস্তে হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন ফসলি জমির দিকে
আনসার আলি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে এখনি
বললেন, ভার্সিটি তো কাল খুলেছে, রাজশাহী যাওনি?
তারপর তার একটি দীর্ঘশ্বাস ভেসে গেল নদীর দিকে
হিসাবের খাতায় মগ্ন ব্যাংকার আনছার আলি
তার সামনে যেতেই বললেন, ‘পড়ালেখা ঠিকমতো করছ তো’?
আমাকে দেখেই কাছে ডাকলেন অসুস্থ আফতাব দোকানদার
মসজিদের এককোণে তসবি হাতে বসে আছেন কাঞ্চন বিশ্বাস
অনুজতুল্য রায়ডাঙার আবুল বিমর্ষ পাখি এক—কেঁদে কেঁদে
উড়ছে গাঁয়ের পথে—জবাফুলে ছেয়ে থাকা ঘরের পোটনিতে হঠাৎ
আমাকে দেখেই কী যে খুশি হয়ে পাশে এসে বসে অনুজা শিরিন
জুঁইফুলের মতো হেসে বলল, ‘মেজোভাই কেমন আছেন’?
আমি তো এখনো হাঁটি হানেফ ভাইয়ের হাত ধরে
বিদঘুটে অন্ধকার লেপা আঁকাবাঁকা সব পথ,
জোড়াবেঁধে ঘুরে বেড়ানো আদুরী ফরিদা বোন উঠোনে বসে
এখনি বলল, ‘মাজিভাই আমাক তো একদিনও দেখতি
গেলিনি’ অভিমানে ভিজে ওঠে পাখিটির দু চোখ
প্রাণের পাখিরা কাঁদি আমি তোমাদের জন্যে
স্মৃতিভরা এইসব পথে
জবাফুলের গাছের নিচে বসে পড়ছি গুরুপদ দত্তের কবিতা আর
ও বসে আছে জড়োসড়োভাবে আমার গাও ঘেঁষে,
উত্তরভিটের বারান্দায় শুয়ে আছেন অসুস্থ জুব্বার মিস্ত্রি
‘দাদা কেমন আছেন’?—জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ফেললেন
হাত ধরে—তার দু চোখে সমুদ্র
আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন বিষ্টু ঘোষ
করিম তাঐ মানা ফুপা বিনোদ আলি… মাথা নুয়ে
ভেজা পাখির মতো আমি তো দাঁড়িয়ে আছি এখনো
মিশে গেল মাটিতে এসব সোনার মানুষ
এই মাটিতেই বুক পেতে কাঁদি তোমাদের খুঁজে
বড় চাচা হাকিম শেখ ডালির ভেতর আমাকে বসিয়ে মই দিচ্ছেন
চারা ধানের জমিতে—ভয়ে ডালি ধরে কাঁপছি এখনো
পিতামহ গণি শেখ ফিরছেন মাঠ থেকে বৃষ্টিতে জবুথবু সাহসী পাখি
জনিরুদ্দিন আয়নুদ্দিন দাদার কাঁধে চড়ে এখনো
ঘুরে বেড়াচ্ছি সবুজ গ্রাম আর শস্য ফুলের গন্ধমাখা মাঠের পর মাঠ
সবুজ ফসল ফুল-পাখি রোদ বৃষ্টির সাথে ঢেউ খেলছে রঙিন সময়
ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে পেট তবু ঘরে ফেরার সময় নেই
মা ব্যাকুল হয়ে খুঁজছেন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো এই আমাকে
আমি তো দিব্যি শুনতে পাচ্ছি, ‘বাপ, আর কত জ্বালাবি?
আসি ভাত খ্যায়া নে কচ্চি’
কোথায় হারিয়ে গেল জননী আমার—কোথায় হারিয়ে গেল
সোনাপাখি উৎসব—খুঁজি আমি কেঁদে কেঁদে পথে পথে