মামুন রশীদের বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ, যেমন ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’, ‘আমি তোমার রাফ খাতা’, ‘যা কিছু লিখেছি সব সব প্রেমের কবিতা’, ‘এই বইটির কোন নাম দেবো না’ যতবার পাঠ করছি, ততবার অবাক হচ্ছি, কবিতার শিল্পশৈলী ও কথামালার বুনন দেখে। প্রকৃতি ও প্রকৃত প্রেমের অপরূপ মেলবন্ধনে সৃষ্টি করেছেন তিনি কাব্যগ্রন্থ।
প্রকৃত পাঠক হতে হলে, যেকোনো বিষয়বস্তু পাঠ করা হোক না কেন, সেই পাঠে গভীরভাবে মগ্ন হতে হয়। আর একাগ্রচিত্তে পাঠে তখনোই মনোনিবেশ হয়, যখন সেই পাঠের ভেতরে হৃদয় বসবাসের যোগ্য হয়। কারণ পাঠে যদি ভালোবেসে মনোনিবেশ না করা যায়, তবে সেই পাঠ বৃথা। পাঠে মনোসংযোগ বা পাঠের ভেতরে মনের বসবাস তখনোই হয় যখন লেখাটা প্রাঞ্জল, সহজ, সুন্দর, কাল্পনিক ও রোমান্টিক, প্রেম-বিরহের শৈল্পিক নিখুঁত বুননে ও সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়। হোক গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গদ্য ও পদ্য ইত্যাদি।
মামুন রশীদ তার কবিতায় তেমনই শৈল্পিকতা সৃষ্টি করেছেন, যা পাঠক একবার পাঠ করলে বারবার পাঠ করবে। সহজ ও সাবলীল ভাষায় জাগতিক চিন্তা চেতনার ভেতর সুগভীর কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সুন্দর ও রসবোধক ভাব মাধুর্যে। একটি সুন্দর বাড়ি তৈরিতে যেমন, ইট, বালু, সিমেন্ট, রড, রঙ ইত্যাদি প্রয়োজন এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহারে সুন্দর পাকাপোক্ত বাড়ি নির্মাণ হয়। মামুন রশীদ কবিতার ভেতর অসাধারণ সুন্দর শৈল্পিকতা সৃষ্টি করেছেন, যেখানে পাঠক পাঠ করামাত্রই বসবাস করতে মনোনিবেশ করেন। মস্তিষ্কের সমস্তটা কবিতার রসাত্মক ভাবনার কাল্পনিক সৃষ্টিতে বসবাস করেন কবির কবিতায়।
আবেগ, অনুভুতি, প্রেম-বিরহ, একাকিত্ব, শূন্যতা, ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিরাজমান।
প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন, প্রতিটি মানুষের পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন, মানুষের একান্ত আপন কিছু ভালোলাগা ভালোবাসা ভিন্ন থাকে, সেই অবস্থান থেকে একেক মানুষ একেক অবস্থানে বিরাজ করে।
মামুন রশীদের কবিতা পাঠে কখনো আবেগে আপ্লুত হতে হয়, কখনো স্মৃতির জোয়ারে ভেসে যায় মন; ঠিক তেমনি কবির একটি কবিতা:
স্মৃতির শহরে ফিরে যেতে নেই
কেঁপে ওঠে বুক দক্ষিণ জানালা থেকে
দুচোখে ভেসে ওঠে উদার আকাশ।
বাঁশবনে, নিবিড় করে, ক্রমশ নির্জন হয়ে ওঠা
দুপুরে, কোন না কোন কিছু অনন্ত অতীত
থেকে ক্ষিপ্র চিৎকার তুলে মাথা চাড়া দেয়-
ভবিষ্যতে- ভীষণ অতীত থেকে…
(স্মৃতির শহরে ফিরে যেতে নেই)
মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিসত্তাকে তিনি যেনো ফুলের সাথে তুলনা করেছেন অতন্ত্য সুন্দর ভাবে। প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন, প্রতিটি মানুষের পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন, মানুষের একান্ত আপন কিছু ভালোলাগা ভালোবাসা ভিন্ন থাকে, সেই অবস্থান থেকে একেক মানুষ একেক অবস্থানে বিরাজ করে। তাই হয়তো কবি লিখেছেন-
প্রতিটি ফুলের রয়েছে নিজস্ব সৌরভ
যা তার একান্ত আপন-হাতে নিয়ে-
অবরুদ্ধ জীবন পেরিয়ে-কারও কারও ঘ্রাণ
ছড়িয়ে পড়ে সবচেয়ে উঁচুতে স্থির হয়ে থাকা তারায়।
বাতাসের ঘূর্ণিতে কারও কারও উদোম নৃত্য
কেবলি নিন্দিত হয়। কেউ কেউ আতশবাজির
ঝলসে যাওয়া আগুনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বারবার ভুলের
আক্ষেপে আদিঅন্তে বৃষ্টির ফোটায়, জলাঙ্গীর ঢেউয়ে-
আছড়ে, অস্থির-এক ছটফটে প্রজাতির মতো
বিবর্ণ হয়ে পড়ে’
(প্রতিটি ফুলের রয়েছে নিজস্ব সৌরভ)
প্রতিটি মানুষের জীবনে শূন্যতা আসে, তাই বলে জীবন শূন্য হয়ে যায় না। কিছু কিছু শূন্যতা স্মৃতির পরশে সবুজের স্নিগ্ধ বুকে অঙ্কিত করে বেদনার ফুল। তাই কবির ভাষায় লিখি-‘সময় বলে কিছু নেই।’ বাতাসের আধিক্যে বুকের ভেতরে ওঠে ঢেউ। মুচড়ে দুমড়ে নতুনের দিকে ছোটে। শ্রাবণে প্লাবণে আর ধেয়ে আসা ঝড়ে ঢাকে মেঘলা আকাশ। সেই শূন্যতা ভিজে ওঠা চোখে যেনো লোনা পানি, অব্যক্ত বেদনার ছাপ, কোনদিন ভুলে না যাবার অঙ্গীকার। প্রকৃত ভালোবাসার ভিত্তি তৈরি হয় অগাধ বিশ্বাসের মাঝে। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। সেখানে থাকে শুধুই ছলনা আর মোহ। অন্তরের অগাধ বিশ্বাস যখন চূর্ণ বিচূর্ণ হয় তখন সেখানে দীর্ঘনিশ্বাসের অন্ধকার এসে ভীড় জমায় বিষের দহনে। তাই কবি লিখেছেন-প্রবেশের প্রথম দিনেই হাতে উঠেছিল একখন্ড হীরে তাতে দৃঢ় হয়েছিল বিশ্বাস, হীরের খনিতে হীরেই থাকে। অথচ দ্বিতীয়বার হৃদপিন্ডের হাতুড়ি পেটা উপেক্ষা করে হীরের খনিতে ঢুকতেই দেখি দীর্ঘশ্বাসের মতো জমা হওয়া অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে গায়ে শোষিত আর বিশ্বাসহীনতার বাতাস আটকে আছে।
কবি মামুন রশীদের প্রতিটি কাব্যেই প্রকৃতির গভীর প্রেম ফুটে ওঠেছে অভাবনীয় শিল্পশৈলীতে। নির্দ্বিধায় বলা চলে মামুন রশীদ প্রকৃতই কবি। তার কবিতা হৃদয়কে আন্দোলিত করে গভীর থেকে গভীরে।
কী অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন কবি তার কবিতায়। কবি তার কবিতায় যেনো জাদুবাস্তবতার সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে দেয় তার প্রতিটি কাব্যগাথার শব্দমহলে। সমুদ্রের গভীরতার থেকেও যেনো গভীর ধ্যানে ও সাধনায় সাহিত্যের মাঝে মগ্ন আছেন কবি মামুন রশীদ। কবি ধ্যানে জ্ঞানে সাহিত্যের প্রেমে প্রকৃতির প্রেমে আর ভালোবাসার নিগুঢ় বন্ধনে কবিতাযাপন করেন একনিষ্ঠ শব্দশ্রমিক হয়ে। জীবনের সাথে সাহিত্যকে গেঁথেছে যেনো নকশীকাঁথার মতো সুন্দর কারুকার্যে। বিরহের অন্তরে দহন জ্বালার কাব্যের মাঝেও রসবোধের একটা বিরাট রোমান্টিক রোমহর্ষক অংশ সৃষ্টি করেন তার কবিতায়।
তাই যেনো কবি লিখেছেন-
বুকের মধ্যে বয়ে চলা যে সর্বশক্তিমান সমুদ্র
নির্ভুল গর্জনে তপ্তবালুতে আছড়ে ফেলে ঢেউ
তাও ঠিক ঠিক গুনতে পারো অভিজ্ঞ
আম্পায়ারের মতো আমি মুগ্ধ দীর্ঘমায়ায়
তোমার সমুদ্র মেলানো উপমায়
একজন মানুষকে কবি হয়ে ওঠতে হলে প্রথমেই তাকে প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। প্রেমিক হতে যে তাকে শুধুই নারীর প্রেমে পড়তে হবে তা কিন্তু নয়। আবার নারীর প্রেমে পড়বে না তাও নয়। প্রথমেই প্রকৃতি প্রেমিক হতে হবে বাস্তব, পরাবাস্তব, জাগতিক, পারমার্থিক চিন্তা-চেতনা, ধ্যান ও সাধনার প্রেমে। যে প্রেমকে আঁকড়ে ধরে সাহিত্যের জগতে জীবনকে পরিচালনা করা হয়। কবি মামুন রশীদের প্রতিটি কাব্যেই প্রকৃতির গভীর প্রেম ফুটে ওঠেছে অভাবনীয় শিল্পশৈলীতে। নির্দ্বিধায় বলা চলে মামুন রশীদ প্রকৃতই কবি। তার কবিতা হৃদয়কে আন্দোলিত করে গভীর থেকে গভীরে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো সৃষ্টি করে গভীর অনুভুতি পাঠকের অন্তরে।