মানুষ মাত্রই এক একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। মানুষের এই স্বাতন্ত্র্যের দুটি দিক আছে। একটি হলো বাহ্যিক গড়ন, অন্যটি তার জীবনাচরণ। বাহ্যিক গড়নের অর্থ তার দৈহিক গড়ন আর জীবনাচরণের বিষয়টি অনেকাংশেই বুদ্ধিবৃত্তিক । যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যক্তির নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত ধারণা, তার দর্শন, মতবাদ; সেইসঙ্গে পূর্বপুরুষদের উত্তর-সাধনা। আর এসব কিছু মিলেই নির্মিত হয় স্বতন্ত্র রীতি। সুতরাং আসল বিষয়টি হলো রীতিই, যার কারণেই স্বাতন্ত্র্য নির্মিত হয়।
এই শৈলী বা রীতির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে আসছে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সুপ্রাচীনকাল থেকে অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য চর্চার সেই আদিলগ্ন থেকে তার শৈলী বিশ্লেষণের সাহিত্যও রচিত হয়ে আসছে। আর এই রীতির স্বাতন্ত্র্যের জন্য একজন লেখক বা কথাসাহিত্যিক অন্যের থেকে অনন্য হয়ে ওঠেন। আর এ কারণেই শওকত ওসমানের ‘জননী’ বা ‘ক্রীতদাসের হাসি’ অন্য যেকোনো উপন্যাসের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে সেই অন্য যেকোনো উপন্যাস থেকে ঠিকই খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে ওই স্বাতন্ত্র্যের কারণে।
আর রকিবুল হাসানের ‘অগ্নিকা আঁধার’ রীতিগত ও আখ্যান বিবরণে ,চারিত্র্যিক বহুত্ববাদী কণ্ঠস্বরে বিশেষ করে বস্তুনিষ্ঠ বিষয় ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য।
এই উপন্যাসে সমকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন রকিবুল হাসান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ প্রতিনয়ত বদলে যাছে। বর্তমান আমরা যে সমাজ কাঠামোর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, তাতে ঘটছে নানান পরিবর্তন । সেই পরিবর্তনের নানামুখী দিক। এই পরিবর্তনের নানাদিকের প্রভাব আমাদের যাপিত জীবনে চিহ্ন একে দিয়ে যায় ক্ষেত্র বিশেষে তৈরি করে নানান সংকট। সাহিত্য সবসময় সেই সংকটকে উপস্থাপন করে ব্যক্তি জীবনের নানান ছাঁচে নানান ঢঙে। ‘অগ্নিকা আঁধার’-এ এমন সংকটই চিত্রিত হয়েছে। এ সংকট নৈতিকতার সংকট, এই সংকট সামাজিক জীবনের সংকট, এই সংকট মূল্যবোধের সংকট, এই সংকট আপসহীনতার সঙ্গে রফাদফা করে নেওয়া মধ্যবিত্ত মানসিকতার সংকট ।
অপয়সৃয়মান ক্ষয় হয়ে আসা সংস্কৃতির সংকট যা সমাজের গভীর ক্ষতের দিকে আঙুলি প্রদর্শন করে। উপন্যাসে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপাতদৃষ্টিতে এক উচ্চ আর্দশ বা শপথ বিরাজ করলেও তলে তলে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও এর নিয়মতান্ত্রিক অস্বচ্ছতার দরুন মানুষের কর্দয রূপটির অতলান্ত স্বরূপটি অত্যন্ত প্রাঞ্জলতার মধ্য দিয়ে নানান বিচিত্র বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য, সমতা ও সমন্বয়তার ভেতর দিয়ে নির্ণিত হয়েছে এর রীতির জগৎ। এই রীতির জগৎ ভাষার আশ্রয় বড়ই সহজ সরল, যা বুঝতে কোথাও যুঝতে হয় না । অর্থাৎ কোনো বক্তব্যের আড়ম্বরতা নেই। বাচনের এমন এক বিশিষ্টতা, যা ভিন্ন একমাত্রা ও উচ্চতায় ভাষার আশ্রয়ে তৈরি করে দিয়েছে এর রীতির জগৎ। নির্মিত হয়েছে শিল্পের অনন্যতার অবয়ব। এখন এই বাচনের বৈশিষ্ট্যতা কী?
কেননা প্রথম পরিচয় আব্দুল করিমে সঙ্গে কিন্তু ঘটনা যোগসূত্রতায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ড. ফারজানা ও ড. শাহেদকে কেন্দ্র করে। বিপ্রতীপ এই সহাবস্থানের ভেতর দিয়ে তৈরি রকিবুল হাসানের উপন্যাসের প্রাণবিন্দু। যেখানে লেখক নির্ভার এক বিবরণ তুলে ধরে স্থান ও সময়ের ঐক্য সুনির্দিষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তীকালে উপন্যাসে যে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমিত হতে দেখা যায়, তা স্থান ও সময়ের ঐক্যকে সংহত করে চলে।
কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ বা কথাসাহিত্যে যখন ভাষার প্রয়োগ করা হয়, তখন তা ভাষা নয় তখন তা বাচন। যেমন একজন বক্তা যখন কথা বলেন, তখন তার বিষয়বস্তুকে উপস্থাপনের জন্য তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য শব্দ চয়ন থেকে শুরু করে বাক্যগঠন পুরোটাই তার একান্ত নিজস্ব যা একান্তই ব্যক্তিগত। আর এটি নির্ভর করা তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং অবশ্যই জীবনকে দেখার একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে। সুতরাং বাচনের বিশিষ্টতা এখানেই সেটি সাহিত্য রীতি যা ভাষার মধ্যে নিহিত নয় বরং তা বাচনের বিষয়। যেটি একটি সাহিত্যের অনন্যতার স্বরূপ।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে রীতির এই প্রশ্নটি খুবই কঠিন। কারণ উপন্যাসে বহুতর বিষয় এমন সব আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেখানে দর্শনগত বা চিন্তার স্বরূপের সমন্বয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি সমতৌলিক (plane field) পটভূমিও বিশেষ বিবেচনার বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পায়। এই উপন্যাসে বাচনের জগৎ আর ভাব, বস্তু ও ঘটনাময় বিশ্বব্রমাণ্ডের দ্বৈরথের চিরকালের দ্বন্দ্ব এসেছে সমান্তরাল ভাবে। একইসঙ্গে মহিমান্বিত হয়েছে স্থান,কাল আর পাত্রের ঐক্য।
অনন্য এক বাচন-কৌশলের ভেতর দিয়ে ভাব, বস্তু ও ঘটনাময় জগতের অভ্যন্তরীণ অন্তর্মূল পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি ও ঘটনার পুঙ্খানুআত্মা বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি বাচনের এক জগৎ নির্মাণ করেছেন যা পাঠকের কাছে রসানুভুতিমুলক হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য হয়না মোটেও। তার অসাধারণ বাচন-কৌশলের মধ্য দিয়ে পাঠক নতুন এক অভিজ্ঞঅতার মুখোমুখি হন কিংবা নতুন অনুভূতি তাদের মুগ্ধ করে পাঠক,হদিশ পায় ভাব,বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহের সম্ন্বিত এক জগতের। এভাবেই জীবনতৃষ্ণার ঐক্য ও সংহতির অসাধারণ এক বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নতুন এক জগতের আস্বাদ প্রদান করেছেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন এক আখ্যানের যা মনোবিশ্লেষণের রসে জারিত হয়েছে নতুন রূপে।
এই উপন্যাসের শুরুটা কিভাবে? নিঃসন্দেহে শব্দ দিয়ে, আর সেই শব্দ অভ্রভেদী বিপুল পরিকল্পনা ও কল্পনা-প্রতিভার মূর্তিমান সংস্থাপনার সূচনাবিন্দু । তারপর পটভূমি রচনা, স্থানের ভূগোল নির্মাণ, চরিত্রের নাম, চরিত্রের জীবনালেখ্য, আখ্যান পরিকল্পনা, ঘটনা, স্থান ও সময়ের ঐক্য সংস্থাপন ইত্যাকার বিষয় বিবেচনায় রেখে এই উপন্যাসের সাহসী অভিযাত্রা। ধীরে ধীরে তা চরিত্রের নাম, একাধিক চরিত্রের সম্পর্কসূত্র ও সম্পর্কজাল; সময়, স্থান ও ঘটনার পরিধি ও ঐক্য ইত্যাদি বিবেচনার ভিত্তিতে এগিয়ে যায়। রকিবুল হাসানের উপন্যাসের শুরুর দিকটি উল্লেখ করি, ‘বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চিফ কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিম হুট করেই বাংলা বিভাগের চেয়ারপারসন সুর্দশনা ড. ফারজানার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে একটা দূরত্ব তৈরী করে ফেললো । ইচ্ছে করেই । ড. ফারজানা কিছুই বুঝতে পারলেন না আব্দুল করিমের সাথে কী এমন হল যে তিনি একেবারে নীরবে নিজের মতো করে দূরে সরে গেলেন।
ড. ফারজানার মাথায় কিছুই ঢোকে না। ভাবে চাকরিটা দাপটের সাথে করার জন্য নিজের থেকেই তার সাথে এত ঘনিষ্ঠ হয়েছি ,তাকে আগ্রহী করে তুলতে নিজেকে সবসময় আর্কষণীয় করে রেখেছি। তিনিও তো আমার মুগ্ধতায় অন্ধ হয়েছিলেন ।কী এমন হল যে সবকিছু হঠাট ঝড়ের মতো তছনছ হয়ে গেলো । ডঃ ফারজানা ভাবনার কোন কূলকিনারা খুঁজে পায়না । কেমন যেন ভয় হয়–শেষ পর্যন্ত আমার চাকরিটা থাকবে তো ! চাকরিটা তো উনার হাতে।’
উপন্যাসের শুরু হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুটি চরিত্রের পরিচয়ের মধ্য দিয়ে। চরিত্রের নাম ড. ফারজানা ও আব্দুল করিম । আব্দুল করিম চরিত্রটির পরিচয় শুরুতে দিলেও কাহিনি বিধৌত হয় ড. ফারজানাকে কেন্দ্র করে এবং তার সঙ্গে যোগসূত্রতা ঘটে আরেক চরিত্র ড. শাহেদ জাহানের। এখানে সরাসরি চরিত্রকেন্দ্রিক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বিবরণে। কিন্তু সেই ইঙ্গিতমাত্রেরই মধ্যে অনেক তথ্য আছে। যেমন, আব্দুল করিম। প্রথমেই এই চরিত্রের মধ্যে একটি ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও সুযোগসন্ধানীর আর্কিটাইপ খুঁজে পাই। পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না, কালক্রমে এই চরিত্রটির বিষাক্ততার সঙ্গে তার স্বরূপে আর্বিভূত হন। আবার ড. ফারজানা চরিত্রটির মধ্যে আছে প্রতিষ্ঠালিন্সা। যা নিজেই নিজের কর্দয পরিণতির কবর রচিত করে। বেসাতির ঘাটে নিজেকে পণ্য করে তোলে। এরপরেই আছে স্থান-চেতনা–বাঘাযতীন বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতেই লেখক সুনির্দিষ্ট করে দিলেন, একটি স্থানের ঠিকানা। কিন্তু তারপরই অন্য এক গল্প, যে-গল্প শোনার জন্য পাঠকরা প্রস্তুত ছিলেন না। কেননা প্রথম পরিচয় আব্দুল করিমে সঙ্গে কিন্তু ঘটনা যোগসূত্রতায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ড. ফারজানা ও ড. শাহেদকে কেন্দ্র করে। বিপ্রতীপ এই সহাবস্থানের ভেতর দিয়ে তৈরি রকিবুল হাসানের উপন্যাসের প্রাণবিন্দু। যেখানে লেখক নির্ভার এক বিবরণ তুলে ধরে স্থান ও সময়ের ঐক্য সুনির্দিষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তীকালে উপন্যাসে যে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমিত হতে দেখা যায়, তা স্থান ও সময়ের ঐক্যকে সংহত করে চলে।
লেখক উপন্যাসের সমগ্র আখ্যানটিকে পাঁচটি পর্বে বিভক্ত করেছেন বলা ভালো অঙ্কিত করেছেন । যে পর্বগুলো ক্রমবির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটি পর্বে স্থান ও সময়ের ঐক্যের সঙ্গতিপূর্বক রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিণতি যা পাঠককে অন্য পর্বের দিকেও সমান ভাবে আকৃষ্ট করে। যেমন, ‘মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়ে ড. ফারজানার তার শরীরের গন্ধ এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। কী হবে এখন ! আমার নামও কি এখন তার নামের সাথে উঠে আসবে ! […] ভাবে যেভাবেই হোক চাকরিটা আমার বাঁচাতে হবে । যে পুজো ভগবান মনে করে ভিসি স্যারকে এতদিন দিয়েছি, এখন সিসি স্যারকে সেই একই পূজা দিতে হবে । […] পূজোটা আরও অনেক বেশি করে দিতে হবে । অনেক বেশি নিবেদিত করে দিতে হবে । মনপ্রাণদেহ সব সমর্পণ করতে হবে। […] ভগবান কার পূজো নেবে আর কার পূজো না–নেবে, এ তো এখন নতুন করে অগ্নি খেলা শুরু হয়ে গেলো আমার জন্যে । বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কতদিন থাকতে পারবো !
এই উপন্যাসে বহুস্বরতার প্রাণ হয়ে উঠেছে, যা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রাণভোমরা, যার বাচনিকতার ভেতর দিয়ে জীবনতৃষ্ণার বহুত্ব নির্ধারিত হয়েছে। সেইসঙ্গে চরিত্র, আখ্যান, পটভূমি, বাচন ও কণ্ঠস্বরের বহুত্বের বৈপরীত্য ও ঐক্যের সন্ধান পরিলক্ষিত হয়।
এক নতুন ঘটনার ইংগিত দিয়ে শুরু হয় আরেক পর্ব । এভাবেই চারিত্রের মধ্যদিয়ে একের পর এক গ্রন্থিত হতে থাকে আখ্যানের জগৎ যেখানে লেখকের নিজস্বতা একেবারেই নতুন। উত্তর আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করে বস্তুনিষ্ঠ, ঘটনাপ্রবণ ও ভাবগত বিচিত্রের বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃজনের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের তথা সমাজ বাস্তবতার অফুরন্ত সম্ভাবনা ও মাহাত্ম্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন ।
পরাধীন দেশে পাকিস্তান শাসিত সামরিক জান্তার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, সময়ের অগ্নিগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন রকিবুল হাসান ৩১ মে , ১৯৬৮ সালে, গ্রামের নাম কয়া, জেলা কুষ্টিয়া। উত্তাল সময়ের দেশমাতৃকার নানা টানাপড়েনে দোলাচলে অসাধারণ এক সাহসী মনোবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার রচনার ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে এক নষ্ট-ভ্রষ্ট বিবেক বির্বজিত মূল্যবোধহীন নীতি নৈতিক স্খলিত বিপথগামী সামাজিক পটভূমিতে, যা সর্বোতভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রিক ও মনোদৈহিক পশ্চাৎপদতা ও বিকার-বিকৃতির বিরুদ্ধে। ফলে তিনি যে আখ্যানের দ্বারা জগৎ নির্মাণ করেছেন, সেই জগৎ আমাদের যাপিত জীবনের অনুবর্তী এবং তার বঞ্চনা ও দ্রোহের এক নিরবচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর ঐক্য ও সংহতিতে সমৃদ্ধ। উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে বিবরণের ভেতর দিয়ে আর ক্রমশ চরিত্রগুলো সাহসী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একেকটি প্রতীক হয়ে উঠছে। এ যেন পক্ষান্তরে লেখকেরই উচ্চারণ তবে তা বড় সতর্ক বড়ই মজ্জাগত ।
যেমন, ‘আপনি মুক্তিযুদ্ধ মানেন ? দেশের স্বাধীনতা মানেন ? জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মানেন ?
…স্যার ,আপনাকে একটা কথা বলি ,আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিনা জানি না। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করেছেন। আমার চাচাকে রাজাকাররা হত্যা করেছে। এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় কত কুমারী ধর্ষিতা হয়ে মা হয়েছেন, সেসব শিশুকে কিছু বিদেশি–যারা ভগবানের মতো–তারা দত্তক নিয়ে মানুষ করেছেন ।সে সব যুদ্ধ শিশুদের বাবা-মায়ের নাম জানেন কি স্যার ?
না ,তুমি বলো।
বাংলাদেশ।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য, এক স্পর্ধার নাম। এই চরিত্রের কণ্ঠস্বর সমস্ত অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে সময়ের প্রতিকুলতার স্রোতে এক অপাপবিদ্ধ প্রতিভূ। এ যেন জোরালো এক প্রতিবাদ। আঁধারের গায়ে চেতনার বারুদ ,মুহূর্তেই বিস্ফোরণ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন দুর্নীতির দুর্বিনীতরা ক্ষমতার মসনদে আসীন, তখন সম্পূর্ণ নীতি বিরুদ্ধ ধারার বিরুদ্ধে এক সপাট আঘাত এই ‘অনিন্দ্য অর্ঘ্য’ এক সমাজমুখী, কদর্যতার বিরুদ্ধে শাণিত কণ্ঠস্বর। সমাজের পাকে না জড়িয়ে বরং সে জীবনকে দেখে এক স্বচ্ছ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে।
এই হলো উপন্যাসের বিবরণের ভাষা লেখকের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। অনিন্দ্য অর্ঘ্য নামে একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে লেখক ব্যক্তিক ,সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবন ও জগতের উত্থান ঘটাতে চেয়েছেন–এই বিবরণের মধ্যে এই কণ্ঠস্বরের মধ্যে সেই পরিচয় মিলে। এই কণ্ঠস্বর ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়–ব্যক্তিবিশেষ নয় এটি ব্যক্তিনির্বিশেষ, সর্বজনীন ,আর এখানেই উপন্যাসের সারল্য ও ব্যতিক্রমধর্মিতা ।
এই অনিন্দ্য অর্ঘ্য উপন্যাসের বহুমুখী কণ্ঠস্বরের এক দুর্দমনীয় প্রতীক, এক অমোঘ নিয়তি। এই অনিন্দ্য অর্ঘ্যকেও নিয়তির সঙ্গে যুঝতে হয়। সেই নিয়তিকে অতিক্রম করার জন্য গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো তাকেও নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হয় । কিন্তু নিয়তিকে সে অতিক্রম করতে পারে বা পারে না কখনো। এই হলো প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত নিয়তি। অনিন্দ্য অর্ঘ্যের ট্রাজেডি যেমন বঞ্চনার, সেই বঞ্চনা যেমন প্রকৃতিগত, তেমনি তার উত্তরণও প্রকৃতিগত। এই যে জীবনের পরস্পরবিরোধী দুই তলের যে-পরিচয়, সেখানেই নিহিত আছে এই চরিত্রের সৃষ্টি-সৌন্দর্য তথা উপন্যাসের সৌন্দর্য ।
প্রথাগত শুরুর বাইরে এসে সামজিক ব্যাধিকে দর্পণে প্রতিবিম্বিত করার সাহস বাংলা কথা সাহিত্যে খুব বেশি সুলভ নয় । সরাসরি চরিত্রের কণ্ঠস্বরে ব্যক্ত জীবনবোধ ও সমস্যার গভীরে প্রবেশ করার প্রবণতা খুব বেশি নয়। অধিকন্তু উপন্যাস জুড়ে লেখকের কণ্ঠে শুনতে হয় চরিত্রের বিবরণ যেন লেখকের সত্তারই অনুরণন অথবা চরিত্র যখন কথা বলে, তখন মনে হয় সে-কথা যেন লেখকেরই কণ্ঠস্বর। কিন্তু এই উপন্যাসে বহুস্বরতার প্রাণ হয়ে উঠেছে, যা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রাণভোমরা, যার বাচনিকতার ভেতর দিয়ে জীবনতৃষ্ণার বহুত্ব নির্ধারিত হয়েছে। সেইসঙ্গে চরিত্র, আখ্যান, পটভূমি, বাচন ও কণ্ঠস্বরের বহুত্বের বৈপরীত্য ও ঐক্যের সন্ধান পরিলক্ষিত হয়। বিষয়বস্তুনিচয়, আখ্যান বর্ণন ও চারিত্র্যিক দৃঢতায়, স্বতঃস্ফূত ভাষার প্রয়োগ, স্থান, কাল ও পাত্রের অসাধারণ ঐক্য ও সংহতির ভেতর দিয়ে এই উপন্যাস এগিয়ে গেছে স্বচ্ছন্দে।
উত্তর আধুনিক কথাসাহিত্যের যুগ দর্পনে এক অদম্য সমাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে স্পর্ধার আখ্যান ‘অগ্নিকা আঁধার’।