কবি হিসেবে অনুভূতির সূক্ষ্ম রূপকার আমিনুল ইসলাম। তিনি যাপিত জীবনের শিল্পিত ভাষ্যকার। স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞার অদ্ভুত মেলবন্ধন তার কবিতা। স্ব-সমাজ, স্ব-কাল তার কবিতায় অনিবার্যভাবেই ডালাপালা বিস্তৃত করেছে। মানবমনের আশ্রয় অন্বেষণ করেছেন আমিনুল ইসলাম। তার কবিতায় জীবনের মধুর যাপন যেমন আছে, তেমনি আছে জীবনের অন্তঃসারশূন্য অন্ধকার ও কৃত্রিমতা প্রসঙ্গও। প্রেমকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছেন ব্যক্তি-অস্তিত্বের সঙ্গে।
অব্যাহত আধুনিক এই কবি দীপ্রআত্মভাবনা আর রৌদ্রজ্বলা সমাজ-ভাবনাকে কবিতায় উপস্থাপন করে কোলরিজ কথিত Suny done এর বহির্বৃতিতে Cave of ice-এর অন্তর্বৃত্তির মেলবন্ধন হিসেবে শব্দে শব্দে বয়ন করেছেন কবিতা।
আমিনুল ইসলামের বিষয়-ভাবনা কেবল বিচিত্র বৈভবেই সমৃদ্ধ নয়, পাশাপাশি ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিশেষ আবহে অন্তর্জগতের সঙ্কোচন ও সম্প্রসারণে আত্মগত, মনোজাগতিক রূপান্তরে সমৃদ্ধ। কবিতার নিরন্তর পরিব্রাজক, স্বদেশ-ভ্রামণিক কবি আমিনুল ইসলাম জীবন ও কবিতার উজ্জ্বল সিলুয়েট হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হন। কবি তাই উচ্চারণ করেন:
নৌকা তো সেই পুরোনো দিনের
বুকের তলায় স্রোতের দাগ
হাইল ও গুড়া রয়েছে অটুট
তুমিও ভোলোনি যোগের ভাগ।
পারানের কড়ি পাচ্ছো যে মাঝি
এই নিয়ে খুশি অন্তহীন
ঢেউ ছাড়া কোনো ঝুঁকি আছে কি না
উদাসীন তুমি রাত্রিদিন।
[মাঝিকে : জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র]
‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’, ‘সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ’ বহু বর্ণিল বিভায় দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে তার কবিতায়। ফলে দেশপ্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনায়ও সাঁতার কাটেন তিনি নিরন্তর। বহির্জীবনের প্রখর রোদ আর অন্তর্জগতের শিশির সম্পাতের অভূতপূর্বসমন্বয় লক্ষ করা যায় তার কবিতায়। কবিতার জন্যে নির্দিষ্ট একটি ‘কাব্যভাষা’ বা‘Poetic diction’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ’
কবি-স্বভাবের স্বাভাবিক নিয়মেই কখনো আবার রূপকধর্মী হয়ে যান আমিনুল ইসলাম। তার কবিতার দীপ্রতা ও প্রাখর্য সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিছক আত্মমগ্ন কবি নন তিনি, মানব-সমষ্টিকে ছোঁয়ার নবীন আনন্দে উদ্বেল হতে চেয়েছেন বরাবর। কবি তাই কবিতায় নিজের কন্ঠস্বর সাজান এ–ভাবে :
১। বিজ্ঞাপিতউঠোনে জমে ওঠা বনসাইয়ের মেলায়
গজফিতা আর কাঁচিহাতে উচ্চকণ্ঠ বামন:
বৃক্ষের বাহুল্য ঠ্যাকাও।
[বনসাই উঠোন এবং প্রান্তরের ‘বৃক্ষ’: স্বপ্নের হালখাতা]২। এ বৃত্তান্ত জমা থাক জলের গহনে
সওদাগরি কিশতির হাঁকডাক, ভাটিয়ালি গান
জলবন্দি নর্তকীর নূপুরের তাল;
বেহুলার ঢেউভাঙা প্রার্থনার ভাষা শিখে শিখে
পোড়াচোখ পড়ে নেয় জলে লেখা পিপাসার পাঠ’
[জলের রেকর্ড: স্বপ্নের হালখাতা]
আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষা আবহমান গ্রামবাংলার জীবনবৃত্তের অভিজ্ঞা থেকে যে আহরিত, তা তার কবিতা পাঠ করলে বেশ বুঝতে পারা যায়। তবে তার কবিতায় আবহমান গ্রামবাংলার আবহের পাশাপাশি নাগরিক পরিবেশ-প্রতিবেশও উঠে এসেছে রক্তমাংস-অস্থি-মজ্জাসহ রক্তাক্ত নগ্নতায়। তার কবিমানসে স্বপ্ন ও ধ্যানের ছবি বিশেষ এক আবেদন সৃষ্টি করে হাজির হয় :
হে জননী, বিষুবরেখায় হেলান দিয়ে চোখ মেলে দ্যাখো-
নদীর মতো বয়ে চলেছি আমি
কাঁধে নিয়ে নিরন্তর কর্মপ্রবাহের জল
আমার সাথে আছো তুমিও
যতদূর গঙ্গা, ততদূর গঙ্গাঋদ্ধি
যতদূর উড়ি আমি, ততদূর বিস্তৃত হও তুমিও।
আলোকজান্ডার যা পারেনি
যা পারেনি সুলতান সুলেমান
কিংবা রানি ভিক্টোরিয়া,
আমি তাই করে চলেছি
এখন কোনো মহাদেশেই আর অনুপস্থিত নও তুমি।
[অভিবাসীর গান: অভিবাসী ভালোবাসা ]
আমিনুল ইসলামের কবিতায় জবীনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংশয়াতীত ও অত্যাশ্চর্য প্রতিষ্ঠা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। উপলব্ধি তার কবিতায় একটি কার্যকরি শক্তিরূপে প্রবাহিত হয়। কোনোভাবেই তার কবিতায় কাব্যগত অভিব্যক্তির অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। পূর্ণাঙ্গবোধের জন্যেই তার কবিতার আয়তনের বিস্তারের মধ্যে একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষকে সচল হতে দেখা যায়। অস্তিত্ব ও ঘটনাক্রমকে মান্য করেই তিনি পথ চলেন। ফলে তার কবিতায় ভাবনা ও প্রতিক্রিয়ার মৌলিকতায় একাত্মতা আছে। এরই সূত্র ধরে তিনি অনুভূতিকে চিত্রে রূপান্তরিত করেছেন এবং সহানুভূতিকে রূপান্তরিত করেছেন দৃশ্যময় উজ্জ্বলতায়। এজন্যে তার কবিতায় শব্দ বর্ণবিভা, মোহমুগ্ধতা, দীপ্তি ও মাধুর্য নিয়ে হাজির হয়:
১। অতএব-
হে পাখি, হে ঝরনা, হে হাওয়া, পর্বতের কোল ছেড়ে চলে এসো।
হে রাখাল, হে প্রেমিক, হে বাউল, না মাড়াইয়ো ঐ পর্বতের ছায়া।
হে আরোহী, হে পর্যটক, হে পাইলট,
দোহাই সূর্যের––মাপতে যেয়ো না তার মাথা খারাপ মাথা উচ্চতা,
আর, পুরস্কৃত ঢিবিগুলো উল্লসিত:আমরাই হিমালয়-
কণ্ঠভোটে প্রমাণিত।
[পর্বতবিরোধী গান: প্রণয়ী নদীর কাছে]২। ভালোবাসা ঘুমিয়েছে––জেগে আছি আমি
আমি কি জাগাব তাকে
চুমু দিয়ে ঘুমন্ত অধরে?
যদি জেগে যায়––দেখতে পাব না তার
হাঁটুর ওপরে থাকা নৃত্যগর্ভ তিল
কে বলে সুন্দর শুধু গৌরবর্ণ গাল আর
সোনারং উরু।
আহা তিল––সোনালি আকাশে
একখানা কালোবর্ণ চাঁদ!
[ভালোবাসা ঘুমিয়েছে-জেগে আছি আমি: প্রণয়ী নদীর কাছে]
আমিনুল ইসলাম জানেন যে, সৌন্দর্য ও বিশ্বাসের প্রতিমা দেখা দিয়েই অন্তর্হিত হয়ে যায়। এজন্যে তার কবিতার অন্যতম মৌলিক লক্ষণ হলো: ‘emotional apprehension of thought; তার কবিতা একইসঙ্গে দৃশ্যময় ও ধ্বনিময়। এই কবির কবিতার অন্যতম থিম হচ্ছে পরিবর্তমান দিন-রাত্রি। পাশাপশি তার কবিতায় এসেছে ‘various verseforms’ টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে গাঁথা তার কবিতায় ‘still life’-এর স্বাদ পাওয়া যায়। গার্ডনার যেটিকে বলেছেন-‘Comlex expressional rhythm’এরই বৈশিষ্ট্য আমিনুল ইসলামের কবিতায় স্বকীয় ভাষ্যে উদ্ভাসিত-
ভুলবশত লাগাম ছাড়াই সেই যে উঠে গেলাম
মাটি থেকে ঘোড়ার পিঠ এতটা উচুঁতে যে
আমি বারবার চেষ্টা করেও নামতে পারছিনা;
লাগাম ছাড়াই চড়ে আছি পিঠে। আমি
ঘোড়া হাঁকাই না, ঘোড়াই নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে।
[চেনা-অচেনা ঘোড়ার পিঠে: আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট]
কবিতাকে অর্থপ্রধান করতে গিয়ে আমিনুল ইসলাম কবিতায় ‘meaning unit’-এর দিকে যেমন জোর দেন, তেমনি তাগিদ অনুভব করেন ভাবার্থ সংহত করার দিকে। কবিতায় বৈচিত্র্য ও স্থিতিস্থাপকতার দিকে লক্ষ্য করেই তিনি এটি অবলীলায় করতে সক্ষম হন। ফলে কবিতায় একজন ‘heart-fleshed’কবিকে খুঁজে পাওয়া যায়ঃ
জোছনা নেই-জলসার আসরও নেই, বাতাসে
ছিটকে পড়া গজলের সুর ও তাল বেজে চলেছে
জলছোঁয়া শঙ্খচিলের ডানায়
আকাশের চেতনা ছুঁয়ে বয়ে চলা সে-সুরের পিঠে
নৈঃশব্দের যাত্রী-
ঢেউ-ঢেউ-নদী-নদী একগুচ্ছ লিরিক্যাল শব্দ।
[ছবি, আমার, ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট]
আমিনুল ইসলাম তার কবিতার বক্তব্যের যে উপকরণগুলো সংগ্রহ করেন নিজের জীবন ও পরিপার্শ্ব থেকে––পাঠক যখন তা চিনতে শেখেন, তখন কবিতার শব্দ ও বধিরতা থেকে পাঠকদের রক্ষা করে এই চিনতে শেখা। তখন আমরা জীবনও জগতকে বিচিত্র উপায়ে প্রত্যক্ষীভূত করার মমার্থ-ও অনুধাবন করতে পারি। এই অন্তর্লীন গভীর জীবনবোধের উৎসবকে আমরা পাঠককুল নিজেদের জীবনেও দৃশ্যমান হতে দেখি। তখন অন্তর্লীনচিরকালীনতাও চিহ্নিত হয়ে যায় তার কবিতায়:
আধাঁরের হাতমোজা পরে পা ছুঁয়ে আছে কে?
যতবারই আগে বাড়ে পা-
ততবারই পেছন থেকে টান;
ধর্ম, রাজনীতি, সভ্যতা––কেউ স্বীকার করে না।
ভূত, যদি নেই––ও বিজ্ঞান, তুমিই বলো-
এই হাত কার? কে টানে পিছন থেকে?
[আঁধারের হাতমোজা পরা হাত: শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ]
আমিনুল ইসলাম জানেন যে, সমাজজীবনসমগ্রতার অঙ্গীকারে ব্যক্তিচৈতন্য হয়ে ওঠে সমন্বিত সমাজচৈতন্যেরই ভাষ্যকার। তার কবিতায় প্রেমের যে বিচিত্র রূপাভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করা যায়, তার মূলেও নিহিত সমাজচরিত্রের উপস্থিতি। আমরা জানি যে, মানুষের যন্ত্রণা, নৈঃসঙ্গ্য, অচরিতার্থবোধের পিছনেও কাজ করে বস্তুজাগতিক অপ্রাপ্তি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি। সামাজিক অস্তিত্বের নিরাপত্তার মধ্যে ব্যক্তির জীবন ও কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এটাতো সত্য কথা যে, কবিতার আবহমানের পটভূমি নির্মিত হয়ে থাকে সমাজচৈতন্য ও শিল্পচৈতন্যের নিগূঢ় ঐক্যসূত্রে। আর তাই আমিনুল ইসলামের প্রেমচেতনা অন্তরঙ্গ অনুভূতির বাণীরূপ হয়েও সামষ্টিক জীবনের সমগ্রতায় আবদ্ধ ও তা অনিবার্যভাবেই:
অনির্ধারিত ফাল্গুনে একবার তোমাকে ফোটাতে চাই
তাই বসন্তের বাতাস হয়ে মাঝে মাঝে নক করি দ্বারে
জানালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে গুনগুনানি
‘লারে লা, লারে লা, লারে লা………..,
উৎসাহিত আমি––মুগ্ধডানা মৌমাছি হই––
হাতের কাছেই নন্দনকানন––গন্দমফলের ঘ্রাণ
গন্দমগাছে ঝুলে থাকা নন্দনের নীড়
সে––নীড়ে গুঞ্জন জাগিয়ে ফাল্গুনের গান গাই,
উড়ে বেড়াই––অনুরক্ত জানালার আশেপাশে
মৌমাছি থামলে––ভেতর থেকে ভেসে আসে গান––ও জানালা, দরোজার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?’
[অনুরাগের জানালা: ভালোবাসার ভূগোলে]
অন্য সব কবির মতো আমিনুল ইসলামও জানেন এবং মানেন যে, মানুষের সৃজনপ্রেরণার উৎস অবশ্যই সমাজ ও সময়। মানুষের সমাজচৈতন্য নির্মিত হয় মানুষের ভাবগত ও বস্তুগত উপকরণপুঞ্জের সুষম ঐক্যে। পরিবেশ-পরিস্থিতি সমাজসম্পৃক্ত হয়ে ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার উৎসলোক হিসেবে আবির্ভূত হয়। কারণ ব্যক্তির চৈতন্য কিংবা সামাজিক চৈতন্য নিঃসন্দেহে ‘social product.’ চেতনার এই সামাজিক নির্মিতিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সমালোচক তাই বলেন: ‘Consciousness is, therefore from the very beginning a social product and remains so as long as men exit at all. Consciousness is at first of course, merely consciousness concerning the immediate sensuous environment and consciousness of limited connection with other persons and things outside the individual, who is growing self-conscious; on the other hand, it is man’s consciousness of necessity of associating with that individuals around him, the beginning of the consciousness that he is living in society at all.’
আবার কখনো কখানো এমনও মনে হতে পারে যে, কবি নিজেই যেন একদিন তীব্র-খর-গভীর-তরঙ্গ-সঙ্কুল নদী হয়ে পৌঁছেছেন মোহনায়। যার জলধারা ব্যাপক ও বিস্তৃত, যে উদ্বেল ও উচ্ছল। আবার নিজের স্রোত রুদ্ধ হয় নিজেরই সঙ্গী আবেগ-স্বপ্ন-ভাববেদনার প্রতিরোধে।
আমিনুল ইসলামের কবিতায় ব্যক্তির বেদনা সমষ্টির বেদনা হয়ে যায়। মজ্জায় মজ্জায় কবি অনুভব করেন তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ। চৈতন্য ও ব্যক্তিস্বরূপকে আশ্রয় করে তাঁর কবিতার জন্ম। সমাজ-সংসার তার কবিতায় কখনোই তামাদি হয়ে যায় না। সময়ের জ্বালা ও ব্যক্তিগতঅন্তরপীড়ার রূপায়ণ ঘটে আমিনুল ইসলামের কবিতায়। ব্যক্তিগত ক্রন্দন তাই তার কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক মহিমা পেয়ে যায়:
রাত-দিন অতঃপর দূষণেই বাঁচা; মানবতা এইসব ধুলোমাখা বাণী
শোনা মাত্র দেহমনে বিবিধ অ্যালার্জি; আর কোনো ঔষধ মেলেনা
ব্যর্থকাম একে একে ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, নামিদামি যতসব তরলের
ডোজ, দুদকের মালিশেও সারে না বেমার! ফলে দেশ-দেশান্তরে
বুশের ইচ্ছার মতো রোগের বিস্তার; পৃথিবী সুসভ্য বলে এভাবে
চলে না; অতএব উচ্চমূল্য মেডিকেল বোর্ড, উচ্চকিত মতভেদ
তথাপি সিদ্ধান্ত––ছুরিকর্ম একমাত্র অবিকল্প পথ। শেষে মিত্রবাহিনীর
মতো কৃতকার্য ছুরিকাম; অথচ আশ্চর্য! আলসার টিউমার মূত্রাশয়ে
অশ্মরীকোনোটাই নয়। চেরাপেটে পাওয়া গেছে সারমেয় লেজ।
[ডায়াগনোসিস আফটার অপারেশন: স্বপ্নের হালখাতা]
যেকোনো বিবেচনায়ই কবির প্রতিভা সমাজায়ত। আর কবির প্রতিভার হিরণ্ময় ফসল কবিতা সেই প্রতিভাসঞ্জাত বস্তুজগতের শিল্পিত রূপান্তর। আমিনুল ইসলামের কবিতাও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। তার কবিতা মানুষের চেতনা এবং সমাজবিন্যাসের উত্তরণের প্রেরণাশক্তি:
যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি–সড়ক বিভাগ তাকে
চৌরাস্তা বলে ডেকে থাকে;আমার কাঁধে ঝুলানো যে ব্যাগ
তার অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক নাম নেই।
এই মোড়ে আলোকের প্রাণে বহুবর্ণ অস্থিরতা;
বামদিকে হেলে পড়া রঙিন নিশানা––
একদিন ডানেও তার কদর উঠেছিল।
ডানপাশে ভাঁড়ারের ছবি–
সেদিকে প্রণাম–অবনত মস্তকসমূহের সারি;
এবং ঠিক সোজা তাকালে
পথের দুপাশে সাদামাটা তিরের ফলা দ্রষ্টব্য।
[ভ্রমণ: কুয়াশার বর্ণমালা]
আমিনুল ইসলাম ভালো করেই জানেন যে, বাK&স্পন্দেরবৈচিত্র্য ও স্থিতিস্থাপকতা ছাড়া কবিতায় শিল্পিত সংযম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য আমিনুল ইসলামের কবিতায় এই শিল্পিত সংযম রক্ষা করার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতায় আছে ‘Semantic rhythm’(the rhythm of thought, meaning) breaks across the metrical pattern.’আমিনুল ইসলাম তাই উচ্চারণ করেন:
আঁধারের জাল ফেলে জেগে আছে রাত
পৃথিবী এখন গুহা মহা এক গুহা
আধরাত আলো দিয়ে মরে গেছে চাঁদ
লাশ নিয়ে বসে আছে গুটিকয় চুহা।নদীর স্রোতের সাথে খেলে সারাদিন
ঘুমিয়ে রয়েছে ঘাটে জলের নায়ক
আবহসঙ্গীতiƒ‡c বাতাসের বীণ
বাজিয়ে চলেছে কোন অদৃশ্য গায়ক।
[আঁধারের জানালায়: স্বপ্নের হালখাতা]
আমিনুল ইসলামের কবিতা কখনো কখনো বাক্-রীতির চেয়ে ‘meaning unit’-এর দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর অনেক কিছুই তার কবিতার উপকরণ হয়ে ওঠে। সেই তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর বিষয়গুলোও চৈতন্যের শোধনেও প্রেরণায় কবিতায় শিল্পরূপের বিভায় বিভামণ্ডিত হয়ে ওঠে। আমরা অবশ্যই এ-কথা সত্য বলে মানতে বাধ্য যে, অনেক তুচ্ছ বিষয়ও, তুচ্ছ বিষয়ের মধ্যেও কবিতার স্ফুলিঙ্গ স্ফুরিত হওয়া অসম্ভব নয়। কবিতায় আমিনুল ইসলাম যে অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করেন, তা তিনি আনেন ব্লটিং পেপারের মতো জীবন অভিজ্ঞতাকে শোধন করে। এই অভিজ্ঞতা কখনো থাকে তার চৈতন্যের অন্তরালে, আবার কখনো বা স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত থাকে। ফলে অভিজ্ঞতাকে কবিতার উপকরণে পরিণত করতে কোনো সমস্যা হয় না। তিনি সহজেই সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন বস্তুসমবায়ের মধ্যে। যে কোনো অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে ধারণ করতে তার কবিসত্তা সব সময়ই প্রস্তুত ও জাগ্রত থাকে:
ভুলে থাকা ভালো নয়––অকপট ভুলেছি সে কথা
দ্রুতচারী সঙ্গীদল, অবসর কোথা স্মৃতির?
পেছনে পাহারা কড়া নিরূপক, ঘোরালেই মাথা
অনিবার্য, অনুতাপ; মোহমুগ্ধ দূরের জিকির।যোজনা ছিল না কোনো অনুপূর্ব সুদীর্ঘমেয়াদি
চাণক্যের মেধা কিংবা আমলার নিপুণ হিসাব;
বোশেখে পুড়েছি মনে, ভরাভাদ্রে অকূলবিবাগী
বেতসলতার মতো দোলায়িত হৃদয়-বেতাব।
[পরিপ্রেক্ষিত: তন্ত্র থেকে দূরে]
আমিনুল ইসলাম জানেন, প্রকৃতির সবকিছুই সময় বা গতির অধীন। কিন্তু এই সময় ও গতিকে ব্যবহার করে বিকল্প প্রকৃতিবিশ্ব রচনা করতে কবি অঙ্গীকারাবদ্ধ। কারণ কবিতাকে তিনি করে তুলতে চান, ‘an object-in-itself’, ‘a self-contained universe of discourses.’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতি ছেয়ে থাকে আমিনুল ইসলামের কবিতা। তবে সব সময় প্রকৃতি প্রত্যক্ষiƒপ নিয়ে হাজির নাও হতে পারে কবিতায়। আমিনুল ইসলামের কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটি লক্ষ্য করা যায়। আব্রামস্ তাঁর‘The Mirror andthe Lamp’গ্রন্থে মন্তব্য করেছেনঃ ‘The key event in this development was the replacement of the metaphor of the poem an imitation, ‘a mirror of nature’ by that of poems as heteroecism, a‘second nature’ created by the poet in an act analogous to God’s creation of the World.’
আমিনুল ইসলাম তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেন:
যদিও লোমশ নয়––কিংবা বাঘের থাবার মতো নখরে সশস্ত্র নয়,
এই হাত অদ্ভুত আঁধারমাখা;
এই হাতের নগ্নকৈশোর একবার দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ,
আর আমি কমপক্ষে তিনবার স্বচক্ষে দেখেছি
তালু-সহ পাঁচ আঙুলের প্রাপ্তবয়স্ক ছাপ
সংরক্ষিত আছে সম্রাট সংরক্ষিতভিভিআইপি রেজিস্টারে।
অথচ ঐ নামগুলোতো জেনেছি––এই সত্য দাবি করি যদি,
চিলের মতো এসে ছোঁমেরে নিয়ে যায়
ভয়রঙের পাজরোভরতি দুঃস্বপ্নের কালো কালো সেপাই!
[দুঃস্বপ্নের সেপাইয়েরা: জোছনা রাত বেদনার বেহালা]
আমিনুল ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্দ্বন্দ্বে অনেকটাই পীড়িত। প্রকৃতি ও চৈতন্যের মধ্যে বিরোধ চিরন্তন। এই দুইয়ের দড়ি টানাটানিতেও হয়ে উঠতে পারে কবিতা––যা জীবনের স্ফটিক ভাষা। এ–কথা বিশ্বের অনেক কবির মতো বাংলাদেশের কবি, বাংলাভাষার কবি আমিনুল ইসলাম-ও জানেন। প্রকৃতি ও চৈতন্যের ক্ষান্তিহীন দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে শেলীর মন্তব্য ছিলো:
‘His heart and mind–both unrelieved wrought in his brain and bosom separate strife.’
জড় ও চেতনার অক্লান্ত, অবিশ্রাম, ক্ষান্তিহীন সংগ্রাম নিয়ে আমিনুল ইসলাম তাঁর কবিতায় উচ্চারণ করেন:
বন্দরে বন্দরে স্বপ্নের বিলবোর্ড
মোড়ে মোড়ে হৃদয়ের ছবি
ফলে তো এসে যায় অনেকেই-
সাথে নিয়ে মহামূল্যবান পুঁজি
ন্যাশনাল শরীর––মাল্টিন্যাশনাল মন।
কিন্তু একি বন্ধু! বিনিয়োগ হবে কোথায়!
এতটুকু উঠোনে কেন এত কোলাহল?
আর কেন এই লাগামহীনতার উৎসব?
[বিনিয়োগ: জলচিঠি নীল স্বপ্নের দুয়ার]
‘সময়’ আমিনুল ইসলামকে দাহ করেছে সত্য; এ-ও সত্যে যে, তিনি তার কবিতায় হয়েছেন আত্মপ্রাতিকৃতিক। ফলে‘The fact of absurdity’তাঁর কবিতায় বড় একটা নেই। যদি বলা হয় তাঁর রক্তনালি প্রেমের গরলে-অমৃতে ভরপুর, মিথ্যে হবে না তা। বাস্তবিকই তিনি প্রেমতাড়িত, প্রেমমথিত। কিন্তু কোনোভাবেই প্রেমোন্মাদ নন। স্বপ্নে-চিন্তায় প্রেমের স্পর্শে-শিহরণে-থরোথরো কবি:
১) একটি চুমুর বিচারশেষে আমার দ্বীপান্তর
সিংহাসনে উঠল হেসে আধ-মনিবের মুখ?
ভাঁড়ার ঘরে কীসের অভাব? কীসের মনান্তর?
বোতাম খুলে দেখলে বুকে সর্বনাশের সুখ।
[দাম : স্বপ্নের হালখাতা]২) পাহাড়ি ঢলে ভাসিয়ে দিতে ব্যবধানের ধাম
ঝড়ের আঙুল জাগিয়ে দিলো শরীরখোলা ঢেউ
বিষ্ণুবরেখায় আমরা দিলাম একটি চুমুর দাম
দুজন ছিল দুই মেরুতে-দেখল নাকো কেউ।
[দাম: স্বপ্নের হালখাতা]
নদ-নদীর তীরে বাঁধা স্বপ্নের আবাসে বাঁশি বাজে। হৃদয়ের জাগরণে নদীর রয়েছে বাস্তব ও বাস্তবাতীত স্পর্শ। নদী যেন কবির অস্তিত্বের আবাহন। অন্য বিবেচনায় কবির দীপ্ত উন্মত্ততার সহযাত্রী। আবার কখনো কখানো এমনও মনে হতে পারে যে, কবি নিজেই যেন একদিন তীব্র-খর-গভীর-তরঙ্গ-সঙ্কুল নদী হয়ে পৌঁছেছেন মোহনায়। যার জলধারা ব্যাপক ও বিস্তৃত, যে উদ্বেল ও উচ্ছল। আবার নিজের স্রোত রুদ্ধ হয় নিজেরই সঙ্গী আবেগ-স্বপ্ন-ভাববেদনার প্রতিরোধে:
১। দেবরাজের বরে নাকি পুণ্ড্র বরেন্দ্র,
তুমি কি সেই আর্শীবাদ গাঢ় প্রাণরসে?
সর্পিলি যদিও শরীর, অমৃত আনন্দ
বাতাস বাজালে বাঁশি তরঙ্গ-নূপুর হয়ে অন্তর প্রকাশে।
প্লাইওসিন দিনে যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ
মহলড্রিম জলকন্যা ভরাকুম্ভ কাঁখে লয়ে পুণ্ড্রে এলে নেমে
কত মারি খরা তাপ টানে পাত্রখান
অফুরান জলসত্র, অকাতর তুমি আরও অনার্যের প্রেমে।
[মহানন্দা : তন্ত্রথেকে দূরে]২। নদীর কত শাসন! জলের কত সংবিধান!
তবুনদীমাতৃক এই দেশে
সিকস্তির ঝুঁকি নিয়েও নদীপাড়ে গড়ে ওঠে ঘর,
ভেসে আসা কন্ঠে খোলে অনুশাসিত কত জানালা।
[নদীমাতৃক প্রচ্ছদে : কুয়াশার বর্ণমালা]
আমিনুল ইসলাম যখন প্রেমের কবিতা লেখেন, তখন তাঁর অন্তরে আবেগের তরঙ্গ ভেসে ওঠে প্রবলভাবে। আসলে প্রেমতো এক মানবাত্মার সঙ্গে অন্য মানবাত্মার আসক্তি। আর তাই প্রেম মানবাত্মার সম্পত্তি। এক মানবাত্মার সঙ্গে অন্য মানবাত্মার এইযে মিলনাকাঙ্ক্ষা, এর মূলে কাজ করে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যবোধ। সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েই আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আত্মার কাম্য বস্তু আসলে সৌন্দর্যই। আত্মার তৃপ্তি সৌন্দর্যের মধ্যেই। আমিনুল ইসলাম জানেন যে, এই সৌন্দর্যাকাঙ্ক্ষা আত্মার ধারায় প্রবাহিত হয়। আর এই সৌন্দর্যাকাঙ্ক্ষাই একের সঙ্গে অন্যের আসক্তির মূল: ‘Certain it is that the natural and primitive relationship of soul to soul is a relationship of beauty, For beauty is the only language of our soul; none other is known to it.’ [‘The Inner Beauty: ‘The Treasure of the Humble’]
স্মৃতি, স্বপ্ন, প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভা আমিনুল ইসলামের কবিতাকে দিয়েছে দার্ঢ্য ও আধুনিক সংহতি। জবীনবাদী এই কবি বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের বিপরীতে জীবনের অনিকেত চেতনা, হতাশা, নিরাশা ও অবক্ষয়ের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে কবিতায় তুলে আনেন অবলীলায়।
ওপরে উল্লিখিত মেটারলিংকের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমিনুল ইসলামও একমত। প্রেমের সার্থকতা আত্মার চিরন্তন সৌন্দর্যে––আবেগময় ভালোবাসায়, আত্মদানে। মেটারলিংক যেমন মনে করতেন––প্রেমএকান্তভাবে মানবাত্মার সম্পত্তি, আমিনুল ইসলাম-ও তাই মনে করেন। তিনি এ-ও মনে করেন যে, প্রেম আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি। কবি তাই তার কবিতায় উল্লেখ করেন:
১। যখন শস্যে উদ্ভাসিত ভূমি
ইঁদুর ব্যস্ত ভূগর্ভস্থ গোলায়
ভালোবাসাঘন নবান্ন উৎসবে
আমরা তখন হিল্লোলিত দোলায়।
যখন হিমের কয়েদি রোদেশ্বর
বুলবুলি খোঁজে নীড়গরমের হাওয়া
ভাপাপিঠার গন্ধে-তাপে তখন
ভালোবাসার প্রাঙ্গণটুকু ছাওয়া।
[আমাদের ভালোবাসার দিন: কুয়াশার বর্ণমালা]২। আহ্নিক গতির রাস্তায় টায়ার পুড়িয়ে আকাল ছিঁড়েছে এই কয় মাস-
যখন শ্বাপদ নখরের সীমায় দুর্ভিক্ষের মাংস হয়েছিল এ হৃদয়;
অথচ প্রত্যাবর্তনে তেমন কোনো সংশয় ছিল না জেনেও কেন যে
আমি এটুকু সময় নিয়ে জাগলারের মতো লোফালুফি করতে পারিনি।
উল্টো আমাকে ইরাক বানিয়ে বুশ-সময় তামাশা করেছে অন্ধকারে।
[তবুও চাই ভালোবাসা: পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি]
আমরা আমাদের যাপিত জীবনেও বাস্তব জগতে যে সৌন্দর্য দেখি, তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলেও তার হ্রাস-বৃদ্ধি আছে, পরিবর্তন আছে। সাহিত্যে যখন তা প্রবেশাধিকার পায়, তখন তা বাইরের ইন্দ্রিয় ও জড় হৃদয়কে তৃপ্ত করে। কিন্তু এ সত্যাটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সৌন্দর্যের অন্তরালেও চিরন্তন সৌন্দর্য এবং অসীম সৌন্দর্য আছে, ইন্দ্রিয়চেতনার পক্ষে তা আয়ত্ত করা অসম্ভব। মানুষের অন্তরতম আত্মাই এই সৌন্দর্যানুভূতির অধিকারী। কবিতায় কবি যে সংকেত ব্যবহার করেন, তা কোনোভাবেই ইন্দ্রিয়সর্বস্ব নয়- এ আবেদন অন্তরতম সত্তার কাছে। যখন কবি সংকেতব্যবহারের মাধ্যমে পাঠকের কল্পনা আবেগকে জাগ্রত করে দেন, তখন আমাদের অন্তরতম সত্তা বা আত্মা সেই চিরন্তর সৌন্দর্য দেখতে পায়। সংকেত বাইরের সৌন্দর্যের দুয়ার দিয়ে পাঠককে চিরন্তর সৌন্দর্যে এগিয়ে নিয়ে যায়, গন্ত্যবে পৌঁছে দেয়। এই বিশাল জগৎ, ব্যস্ত জীবনে যে অসীম, অদৃশ্য সত্য-সুন্দর বিরাজ করছে, আমাদের অন্তরতম সত্তা সংকেতের মাধ্যমে তার স্পর্শ পায়। এ প্রসঙ্গে Carlyle মন্তব্য করেন: ‘In the symbol proper, what we call a symbol there is ever, more or less distinctly and derectly, some embodiment and revelation of the infinite; the infinite is made to blend it self with the finite to stand visible and as it were, attainable there.’
[Sartor Resartus, BK, III, Chapter: III]
আমিনুল ইসলাম কবিতায় সংকেত ব্যবহার করতে গিয়ে উচ্চারণ করেন:
এ নদীর কোনো নাম ছিল না, তথাপি নানাজনে
নানা নামে ডেকেছে। যে-আমগাছের তলায় আমার
নাড়ি পোঁতা, শৈশবের এ নদী সেখানে সংগোপনে
সন্ধ্যাজল দিয়ে আসে; আমের পাতা শিশুর গালের
মতো হয়ে এলে জলের পাঠ নিতে ব্রিজের ওপর
দাঁড়িয়ে আছি; বাতাসে মেলে দেওয়া আরব্য
উপন্যাসের পাতার মতো গড়িয়ে চলেছে ঢেউয়ের
পর ঢেউ; পুরো পাঠ নেওয়ার আগেই উলটে যায় পাতা।
[নদী-দুই: শেষ হেমন্তের জোছনা]
স্মৃতি, স্বপ্ন, প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভা আমিনুল ইসলামের কবিতাকে দিয়েছে দার্ঢ্য ও আধুনিক সংহতি। জবীনবাদী এই কবি বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের বিপরীতে জীবনের অনিকেত চেতনা, হতাশা, নিরাশা ও অবক্ষয়ের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে কবিতায় তুলে আনেন অবলীলায়। বিষাদ, যন্ত্রণানুভব, স্বপ্নভারাতুরতা, আত্মকেন্দ্রিক পরিক্রমা, প্রতিবেশ-পৃথিবীবোধ আমিনুল ইসলামের নিরন্তর পদযাত্রাকে পৌঁছে দেয় নির্দয় পৃথিবীর অমানবিকতার কেন্দ্রে:
১) ওড়ার আকাশ কই? দ্যাখো কত বারুদের ডানা
আকাশে ছড়িয়ে আর অগ্নিশব্দে কেঁপে ওঠে নীল
সাতরঙা রংধনু––সেও জানে তারও ওঠা মানা
বলাকার অভিসার ছিঁড়ে ফেলে সভ্যতার চিল।
তেলির দুয়ারে হানা: ছাড় ব্যাটা জলমূল্যে তেল
তুই ব্যাটা ঘাড়ত্যারা-কথা কস নাহক বেহক
আমরা সুসভ্য দ্যাখ কাকে বলে সভ্যতার খেল!
অগ্নিবীর্যে উদ্বেলিত ক্রুসেডের লিঙ্গ টমাহক।
[সভ্যতার সংঘর্ষ-এক : ভালোবাসার ভূগোলে]২) অসম্বন্ধ এ জীবন––যদি তাকে ভাবোগতিশীল;
আমি কার কে আমার এই সব ভুলে থাকা ভালো
সভ্যতাও রাজনীতি দ্যাখো কত মশাল মিছিল
তবুও প্রত্যেকে একা––ঘরে ফিরে ব্যক্তিগত আলো
নানা-নানি-দাদ-দাদি ভাইবোন আত্মীয়নিখিল
আবেগের মালামাল যত কম হয়-তত ভালো।
[সভ্যতার সংঘর্ষ-ছয় : ভালোবাসার ভূগোলে]
সুন্দরের নিক্কণ––নিস্বনে তুমুল ও প্রগাঢ় এমন একটি মায়াবী জগৎ বসবাস করে আমিনুল ইসলামের মধ্যে। কিন্তু তাই বলে তার কাব্যজগৎ, মানবরহিত––নার্সিসীয়––এমন বলা যাবে না কিছুতেই। বাস্তববোধজর্জর কবিসত্তার মধ্যেও স্বাপ্নিক উদ্দামতার যাত্রা চলতে থাকে। যা আমিনুল ইসলামের কবিতায় দুর্মর বাসনার সংরাগনিয়ে হাজিরহয়:
চাঁদবোনা শাড়ি পারে হেঁটে যায় রাত
আমার উঠৌনজুড়ে কুয়াশার হিম
উষ্ণতার গোলাঘরে লাগিয়ে কপাট
তুমি দূরে বসে আছো উদাসী অসীম
[বিড়িম্বিত জোছনায় : পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি]
কবিতা আমিনুল ইসলামের কাছে আপন ভুবনের একান্ত সত্তা। ফলে তাঁর কবিতা হয়েছে স্বকীয়তার প্রামাণ্য দলিল। তাঁর কবিতার আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভার অন্তরালে রয়েছে এক ধরনের কাতরতা, এক ধরনের নিভৃতি অথচ গভীর বিষণ্নতা, এক ধরনের কোমলতা। কবিতায় কবি নিজেকেই অনাবৃত করেন নিজের কাছেই। তাঁর কবিতায় যে গূঢ়তা আছে, তার উৎস হচ্ছে অতিগোপন রোজনামচার রস। নিজের সঙ্গে যেন নিজের কথোপকথন। আমিুনল ইসলামের কবিতায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ আছে, অতীতের নিবিড় কোলাহল আছে, বর্তমানের বিমূঢ় iƒপতন্ময়তার কথা আছে:
চলনবিলের শিথানছুঁয়ে
শতবর্ষের সাক্ষী বটগাছ
তার ডালে ব্যাঙ্গমার সমাধি
বিস্তারিত প্রাণে একদিন
বেহুলাও বসেছিল তার ছায়ায়
করাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে তার
জল দিয়েছি তার শেকড়েও।নাইবা হলো যাওয়া সমুদ্রের বাড়ি
জলের দৌড়ে নাই বা হলো লেখা
প্রান্তবাসী এই আমার নাম
আমাকে মনে রাখবে
গরিবের বউয়ের মতো এক ভূগোল।
[একটি নদীর আত্মকথা : পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি]
লোকজ ঐহিত্য আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিপুলভাবে সংবধিত।কারণ বাংলার মৃত্তিকার সাথে কবির যে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নিসর্গ নিমগ্নতায় সমর্পিত এই কবি তাই তার কবিতায় লেখেন:
সুনীল এখন সমস্ত আকাশ।
পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে রাখালদাশ পেয়েছিল
স্রোতেলাস্রবণ;
জনারণ্য ভেঙে আমিও পেয়েছি
স্বর্গ থেকে নেমে আসা নদী।
সোনারোদে উদ্ভাসিত বালুচ্ছাপ পাঠ করে জেনেছি-
এ নদীর জল ভেঙেছে বারোঘাটের কানাকড়ি,
কারণ, তার পিপাসা প্রবলতর ছিল;
এ জলে সাঁতার কেটেছেব্যাচেলর একঘোড়া,
কারণ, তার সর্বাঙ্গে গোপন এক জ্বর ছিল;
এ জলের গভীরে ডুব দিতে চেয়ে ডুবেছে
জল ভেঙে ক্লান্ত এক সংসারী,
[পিপাসার জল : পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি]
প্রকৃতি––নিসর্গের রূপদৃশ্যময়তাকে কবিতায় টেনে নিয়ে গেছেন আমিনুল ইসলাম। আবহমান বাংলা আর বাংলার প্রকৃতি––নিসর্গের শোভা, চিত্ররূপয়তা এই কবির আরাধ্য। কিন্তু এর মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে অজানা বেদনার গভীরতর ধারা, বেদনার ধারা।তা অনুসন্ধান করে লাভ করেছেন কবি প্রশান্তির হ্রদ। রূপদৃশ্যময়তার পাশাপাশি গূঢ় রহস্যময় অগ্রসরমানতা আমিনুল ইসলামের কবিতাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা ও আয়তন:
বোকা মাঝি! ডরাও ক্যানো?
ডুবে যাবে! সাঁতার কেউ ভুলে?
ঘোরো ক্যানো গাঙের পাড়ে!
এমনি টান-জোয়ার ওঠে ফুলে!এইতো আমি বেঁধে এলাম
আমার নৌকা––দুলছে গলুই তার;
নোঙর বাঁধা! জমল তবে
এই সুযোগে সিন্ধু অভিসার।
[একদনি প্রতিবেশী জলে : মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম]
সমকালীন বাংলা কবিতার পালে যারা হাওয়া লাগিয়ে যাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম তাদেরই একজন। আমিনুল ইসলামের প্রকাশিত বিভিন্ন কাব্য, পত্র-পত্রিকায় প্রকম্পিত কবিতা পাঠ করে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে, আমিনুল ইসলামের কবিতার শেকড় অনেক গভীরে। স্বপ্ন ও সৌন্দর্য চেতনায় বয়ে এনেছেন এই কবি পরম সৌগন্ধ্য। কল্পনা তার কবিতার আশ্চর্য এক চন্দন। মায়াবী সুন্দর স্বপ্নময় এক হৃদয়বিশ্ব আমিনুল ইসলামকে অখণ্ড সত্তার করেছে স্বপ্নব্যাকুল, পাশাপাশি প্রতিবেশ পৃথিবীর আঁচড়ও তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। একদিকে অসুস্থ বস্তুবিশ্ব, অন্যদিকে স্বপ্নসৌন্দর্যপ্রবণ, আত্মবাদী সত্তার প্রতিষ্ঠা প্রয়াস; আমিনুল ইসলামের কবিতায় বসবাস লক্ষ্য করা যায় দুই মহলে। এক্ষেত্রে আত্মসংরক্ষণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন ও বস্তবের দ্বন্দ্ব-দ্বিধা-বৈরিতার সহ অবস্থান। এ কাজটি আমিনুল ইসলাম তাঁর প্রতিভা, সৃজন-ক্ষমতা, নির্মাণের কৌশল দিয়ে সম্পন্ন করেছেন।
ব্যক্তি, সমাজ,জীবনের অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ রূপ আমিনুল ইসলামের কবিতায় উঠে এসেছে আপন শক্তিতে। অবিরাম স্বতঃস্ফূর্ততা আমিনুল ইসলামের কবিতার প্রাণশক্তি। নিজের সত্তায় ও প্রণোদনায় কবিতাকে ধারণ করেছেন তিনি।
আমিনুল ইসলামের অনেক কবিতায় প্রণয়প্রবর্তনার জন্ম হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে রোমান্টিকতার অমোচনীয় প্রভাব। তার এই প্রেমের কবিতায় মিশে রয়েছে দেহ মনের বিচ্ছুরিত তীক্ষ্ণ রশ্মি যা আমিনুল ইসলামের প্রেমনিষ্ঠ কবিতাকে করেছে দীপ্তিময়। সৌন্দর্যখচিত এক প্রণয় প্রতিমার অবয়ব সহজেই চোখে পড়ে তার কবিতায়। প্রেমের মধ্য দিয়ে জীবনচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে আমিনুল ইসলামের কবিতায়। আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতায় কখনো হৃদয়াগ্নি ও প্রেমাগ্নি একাত্ম হয়ে যায়। আবার কখনো দেহাগ্নি ও প্রেমাগ্নি একাত্ম হয়ে যায়। এভাবেই তার কবিতা কখনো হৃদয়ানুষঙ্গী; আবার কখনোবা শরীরানুষঙ্গী। এই দুইয়ের রসায়ন তাঁর কবিতাকে আলোকিত করে। প্রেমের কবিতা রক্তস্বপ্নে আলোড়িত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, প্রেম অপবিত্র হয়ে গেলো, পথভ্রষ্ট হয়ে গেলো। দেহ-মনের নির্ভুল নির্দেশ মেনেই আমিনুল ইসলাম প্রেমের কবিতা লেখেন,
আমার ভালোবাসা বঙ্গোপসাগরের হৈমন্তিক হাওয়া
যখন তুমি হাঁপিয়ে উঠবে ছকবাঁধা প্রাত্যহিকতায়
যেমন হাঁপিয়ে ওঠে ভ্যাপসা সাঁঝে ভাদরের ঢাকাশহর
যখন সঙ্গম-উত্তর প্রাণের পাতায় উড়ে এসে জমা হবে
ক্লান্তির কার্বন গ্যাস
তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমার একমুঠো ভালোবাসা
মেখে নিও মনে যেভাবে তুমি মেখে নাও রোজ-
বগলে, বুকের মৌচাকে, সংবেদনশীল শস্যের ক্ষেতে
ঘামরোধী ট্যালকম পাউডার।
দেখো-পরদিন তুমি দ্বিগুণ ক্ষুধায় জড়িয়ে ধরবে পুরাতন বাহু।আমার ভালোবাসা রেখে দাও জোয়ানা-রেখে দাও রিজার্ভ ফান্ডে তোমার
যেভাবে সোনাব্যাঙ লুকিয়ে রাখে কুড়িয়ে পাওয়া আধুলি তার
যেভাবে গোপন ফাইল লুকিয়ে রাখে পাসওয়ার্ড-যুক্ত হার্ড ডিস্ক
যেভাবে কবি রেখে দেয় প্রিয়তম অধরের পাশে একখানা একাদশীর চাঁদ!
[আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট: আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট]
আমিনুল ইসলামের কবিতায় আনুভূমিক বিস্তার যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি গভীর জীবনবোধে আলোড়িত হয়ে দার্শনিক দৃষ্টির প্রক্ষেপণও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর কবিতা পাঠকের চেতনার ভেতরে প্রদেশকে আলোকিত করে। জীবনকে বিবিধ প্রক্ষেপণ থেকে আলো ফেলে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় আমিনুল ইসলামের কবিতায়। তিনি কোনোভাবেই তাৎক্ষণিকতার অবধূত নন। জীবনের অপার রহস্যময়তাকে প্রবাদপ্রতিম কবিত্বে উদঘাটনের সযত্ন প্রয়াস চালান এবং ব্যক্তিমানুষের মানসজগতের দ্বন্দ্বের দ্বৈরথসমূহের সুলুক সন্ধান করেন এই কবি। ফলে তাঁর কবিতায় জীবন জিজ্ঞাসা গভীর:
মাল্টিকালার স্বপ্নের ফুটবল নিয়ে খেলতে খেলতে
কিপার-হীন পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়েও
পেলের পায়ে শেষ পর্যন্ত গোল হবে না-
হে প্রভু, এও কি সম্ভব? নাকি এর উত্তর খুঁজে পেতে
একুশ শতকের এই নাস্তিক মনটাকে ফিরে যেতে হবে
তর্কযুক্ত তোমার আলো-আঁধারির ফেলে-আসা উঠোনে?হায় প্রভু, তোমার কমলালেবুর ঝাঁপিহীন ঝুড়িতে
বিস্ময়ের আর কত মার্বেল লুকিয়ে রেখেছো
ভালোবাসায় মুগ্ধ হতে ভালোবাসার প্রতিভাকে
বারবার লাল-নীল বিহ্বলতায় ভরে দেয়ার ভাবনায়!
(সে এক অদ্ভুত ব্যর্থতা: জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার)
আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট পরিচয়, নতুনত্ব, নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।। এজন্যে তাঁর কবিতাকে আঙ্গিক কুশলতায়ও সিদ্ধি অর্জন করতে হয়েছে। ভাষার বিচিত্র শক্তিকে তিনি নিজস্ব যোগ্যতায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। এই কবি মানবতাবাদী এবং স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের সফল রূর। মানবমুক্তিই আমিুনল ইসলামের কবিতার আরাধ্য। কাব্যজিজ্ঞাসায় মুখরিত আলোচ্য এই কবি কল্যাণধর্মী জীবনের রূকার। তিনি কবিতা সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করেন, তা হচ্ছে ‘quantity change into quality.’ তার কবিতা কখনো কখনো ‘মিনিং ইজ বিয়িং’, আবার কখনো বা ‘মিনিং ইজ বায়োলজি’।
আমিনুল ইসলামের কবিতা যে অর্থময়তার বয়নসাধনের নবায়নের প্রস্তাব, তা বলাই সঙ্গত। শব্দের কেন্দ্রমুখী অর্থবোধকতাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর মধ্যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যা কবিতার জন্যে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।সঙ্গত কারণেই তার কবিতা ‘Mobility’ বা সচলতার সক্রিয় বুনোট। শব্দের দাঁড়ানো প্রকল্প বা বাইপেডালিজম-এর অন্তর্নিহিত বাঁক আমিনুল ইসলামের কবিতায় সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
নিবিড় ছন্দের কাছে বাঁধা আমিনুল ইসলামের কবিতা। ছন্দ ব্যবহারে তার সফলতা এবং সাবধানতার পরিচয় নিহিত রয়েছে তার কবিতায়। তার কবিতায় অর্থের সঙ্গে ধ্বনিজাল মিলে একটি আলাদা প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যায়। আত্ম-উন্মোচনের এক ধরনের উদ্বেলিত নিরীক্ষার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় আমিনুল ইসলামের কবিতায়। তার কবিতা নিঃসন্দেহে তার সত্তার নির্যাস। ব্যক্তি, সমাজ,জীবনের অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ রূপ আমিনুল ইসলামের কবিতায় উঠে এসেছে আপন শক্তিতে। অবিরাম স্বতঃস্ফূর্ততা আমিনুল ইসলামের কবিতার প্রাণশক্তি। নিজের সত্তায় ও প্রণোদনায় কবিতাকে ধারণ করেছেন তিনি।
শব্দঅনুষঙ্গের ‘inversion’এবং ‘metaphor.’এর তির্যকতা কবিতার অন্তরে স্বাচ্ছন্দ্যে প্রবেশ করাতে তিনি আন্তরিক। তার কবিতায় শব্দের অতিরিক্ত লাবণ্য রয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে ‘syntax’ এর-ভিন্নতার জন্যে।তাঁর কবিতায় শব্দের‘breakdown of communication’নেই, নেই‘loss of relationship’ কিংবা‘loss of identity’- তার কবিতায় ‘being এবং‘trace’-এর ভিন্নমাত্রা লক্ষ্য করা যায়। আমিনুল ইসলামের কবিতা অন্তর্বয়িত কবিতা ইংরেজিতে যাকে বলা হয়: ‘interwoven poetry.’ ইমেজের ‘distortion’ আছে তার কবিতায়।
আমিনুল ইসলামের কবিতা হৃদয়াবেগের আশ্রয়ে, ব্যক্তিত্ব ও জীবনবোধে আমাদের ভিন্ন এক দিগন্তের দ্বারপ্রান্তে নিয়েযায়। তার কবিতা প্রগাঢ় আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী কবিতা। মনোবিশ্ব ও বস্তুবিশ্ব-এই দুই বিশ্বই তাকে তাড়িত করেছে। শব্দকে তিনি ‘distortion’-এর প্রাবল্যে ও কনোটেশনের বৈচিত্র্যে ভিন্নতর দ্যুতিতে কবিতায় নবনির্মিতি দিয়েছেন। ক্যাটালগ ব্যবহারের প্রবণতাও কখনো কখনো তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। আবার তিনি ‘refrain’–ও ব্যবহার করেন। জীবনানুভূতি ও কাব্যানুভূতির স্বাতন্ত্র্যে আমিনুল ইসলাম হয়েছেন সমকালীন বাংলাদেশের একজন উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। এক্ষেত্রে তার নিজস্ব জীবনরুচি ও কাব্যরুচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।