পর্ব-৫
পিনুকে অনেক বড় অফিসার বানাতে চায় চন্দনা। ও একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে। আনন্দে গর্বে আমার বুকটা ভরে যাবে। আমি নিজে তো বিসিএস ক্যাডার হতে পারিনি। বিসিএস পরীক্ষাটাই দিতে দেয়নি। সরকারি চাকরির কোন পরীক্ষাই দিতে পারিনি। বেশি সুন্দরী হলে যা হয়। বাবা-মা লেখাপড়া শেষ না হতেই বিয়ে দিয়ে দিলেন। বিয়ের পরে জোর করে বিএটা পাস করলাম। ফার্স্ট ক্লাস পেলাম। কিন্তু পথ তো আর এগুলো না। এত সুন্দরী বউকে শহরে পড়তে পাঠালে কে আবার ধরে নিয়ে যায়! কে আবার আমার প্রেমে পড়ে! আমিই বা কার প্রেমে পড়ি! সবকিছুতেই আপত্তি আর সন্দেহ।
বাধার পিরামিড এসে খাড়া হয় চলার পথে। বাসায় থাকো। খাও-দাও। সাজগোজ কর আর স্বামীর কাছে শোও। ভালোবাসার নামে, আদর সোহাগের নামে একটা ভোগ্যবস্তু বানিয়ে রেখেছিল। তবুও মুখ ফুটে কখনো বলিনি। কখনো একটু আধুটু বললেই অশান্তির আগুন জ্বলেছে। যেখানে যা করতে গেছি, সব কিছুতে বাধা। সব ক্ষেত্রে বাজে কথা; সব ক্ষেত্রে সন্দেহের তীর বিদ্ধ করেছে। ক্ষতবিক্ষত করেছে। তারপরও ফারুককে আমি খুব ভালোবাসতাম। ওর ভোগ্যবস্তু হয়ে থাকতেও খারাপ লাগেনি। মেনে নিয়েছিলাম, এটাই আমার জীবন, এটাই আমার নিয়তি, এতেই আমার নিজেকে সুখী রাখতে হবে। ওটাকেই ভালোবাসা বুঝেছি। তবে ফারুক সব সময় আমার রূপের পাগল ছিল।
আমার মেধা নিয়েও কত গর্ব করতো। বিয়ে করার আগে আমাকে বড় করারও কত স্বপ্ন দেখাতো। পাবার পরে দিনে দিনে নিমিষে তা সব উড়ে গেলো। ও নিজেও তো হারিয়ে গেলো। রাজনীতি আর নির্বাচন করাই ওর জীবনের কাল হলো। জীবনটা দিয়ে দিতে হলো। স্বামী মারা যাবার পরে বিশেষ করে বউ যদি ডাগরই থাকে, তার যে কত রকমের বিপদ! স্বামী বেঁচে থাকতে তা বোঝা যায় না। ফারুকের মৃত্যুর পরে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি। যে শ্বশুর-শাশুড়ি এত আদর করতো, তারাও কত সহজেই অচেনা হয়ে যায়, আচার আচরণে কতো বদলে যায়! আবার যে দেবর কখনো মুখ উচু করে কথা বলেনি, কত সম্মান করে কথা বলতো, হায়রে সেই দেবর; সেই তারেক এখন নিজেই আমার পুরুষ হতে চাই! বিয়ে করতে চাই! বিয়ে করার জন্য বুনো পশুর মতো নির্লজ্জ আচরণ করে। এসব কারণে স্বামীর বাড়িতে আমার থাকাটাই হলো না। ফারুকের স্মৃতি ধরে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম, পারলাম না তো। একটা মৃত্যু সবকিছু কিভাবে ওলোটপালোট করে দিলো। চন্দনার বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। মুখে কেমন যেন বিষণ্নতার ছাপ পড়ে।
চন্দনার প্রতি তার যে দুর্বলতা, তা যদি পিনু বুঝতে পারে, তাহলে তো ওর কাছে সম্মানটা থাকবে না। সপ্তায় সপ্তায় বাড়িতে এসে চন্দনার সাথে নানা উসিলায় কথা বলার সময় অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে সে। চন্দনাও চেষ্টা করে পিনুর থেকে একটু দূরে থাকার।
চন্দনা নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে গ্রামের ঘরবাড়ি উঠোন সবকিছু ভাবে। জীবনটা কত সুন্দর হতে পারতো, পড়ালেখায় তো খারাপ ছিলাম না। কিন্তু বিয়েকেই আমার ভবিষ্যৎ মনে করে আত্মীয়স্বজন জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। মায়ের কোনো অভিমত; আমার কোনো অভিমত কেউ শুনলো না। খোকসার মেলায় বলির পাঁঠা দেওয়ার মতো আমাকেও যেন বিয়ের নামে বলি দেওয়া হলো। তারপরও বিয়ে করে যে জীবনটা চলছিল, চলছিল তো একরকম। ফারুকের মৃত্যুতে আমার আমিই তো অচেনা হয়ে গেলাম। চারপাশটা অচেনা হয়ে গেলো। এসবের ভেতর দিয়েও খালু আমাকে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি দিয়ে জীবনটাকে স্বাভাবিক করে রেখেছেন। চাকরিটাকে আশ্রয় করে পরিবারে সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারছি। পিনুকে আমি আমার ইচ্ছেমতো নতুন করে স্বপ্নসারথি করে গড়ে তুলবো। অন্তত এখন থেকে নিজের মতো করে স্বপ্নটা দেখতে পারবো; নিজের মতো করে জীবন কাটাতে পারবো। এটা তো আমার মনের সঙ্গে আমি অস্বীকার করতে পারবো না, পিনু যতটুকুই ছোট হোক, ও তো আমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ।
আমার যতটুকুই যা হোক ওর সাথে, সেটা তো নারী-পুরুষেরই সম্পর্ক। সেটা তো আর ভাইবোনের সম্পর্ক নয়। হয়তো মুখ ফুটে তার প্রকাশ নেই। কিন্তু মন থেকে তো দুজনই সেই সত্যটুকু অনুধাবন করি। বাতাসের মতো হয়তো তা দেখা হয়নি আমাদের, অনুভব উপলব্ধি তো ঠিকই বুঝেছি। মনে তো ঠিকই গেঁথে আছে। রানু ভাইও তো আমার পিছু ছাড়ে না। সময় অসময় ফোন করে। মেসেজ করে। ইমোশন দিয়ে কত কথা লেখে। হুটহাট করে বাড়িতে চলে আসে। সব সময় নিজের বউর দুর্নাম-বদনাম করে। বউর কাছে সবময় অত্যাচারিত হয়। এসব বলে সে হয়তো আমার সহানুভূতি চায়, প্রেম চায়। সত্যি কি তার বউয়ের সাথে সমস্যা! নাকি আমাকে তার প্রতি দুর্বল করার জন্য এসব মনগড়া কথা বলে! কিন্তু তা তো আমাকে একটুও টানে না। একটু আধটু হয়তো খারাপ লাগে, কিন্তু তার প্রেমে পড়ার মতো তো ওরকম কিছু নয়। মনটা তো ভেতরে ভেতরে পিনুর জন্যই পড়ে থাকে। পিনু কি আমাকে একটুও ভাবে না! একটওু কি ভালোবাসে না! যদি না ভাববে না ভালোবাসবে রানু ভাইয়ের সাথে আমি কথা বললে তার এতো রাগ হয় কেন! এতো ক্ষেপে যায় কেন! চন্দনা এসব ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিছানা থেকে উঠে জগ থেকে গøাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খায়।
রানু আর পিনু দুভাইয়ের খুব মিল। রানু অনেক স্নেহ করে তাকে। পিনুকে নিয়ে সে একরকম ভয়েও থাকে। চন্দনার প্রতি তার যে দুর্বলতা, তা যদি পিনু বুঝতে পারে, তাহলে তো ওর কাছে সম্মানটা থাকবে না। সপ্তায় সপ্তায় বাড়িতে এসে চন্দনার সাথে নানা উসিলায় কথা বলার সময় অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে সে। চন্দনাও চেষ্টা করে পিনুর থেকে একটু দূরে থাকার। যত কম কথা বলে থাকা যায়। পিনু যা পছন্দ করে না, সে তা করতে চায় না। পিনু অবশ্য ঘরের ভেতরই সবসময় কুনোব্যাঙের মতো থাকে। বাড়ির ভেতর কি হচ্ছে, কার সঙ্গে কি সম্পর্ক; রানু আর চন্দনা কোথায় কিভাবে কথা বলছে; কি কথা বলছে; সাবধানী চোখে সব খেয়াল করলেও, এমন এক ভাব করে থাকে যেন এসব কিছুই জানে না সে, কিছুই বোঝে না। কিন্তু সে যে সবই খেয়াল করে তা কেউ অনুমান করতেও পারে না।
চলবে…