পর্ব-০৩.
পিনুর জ্বরটা কয়দনি হয়ে গেলো। ছাড়ছেই না। হুক হুক করে কশিটা আছেই। কাশি। পরীক্ষা এগিয়ে এলেই তার এরকম হয়। অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবারের জ্বর ঠাণ্ডা কাশি বেশ বেশি। হয়তো অতিরিক্ত টেনশনের কারণে। এ নিয়ে বাবা-মা’র দুশ্চিন্তার কম থাকে না। রানুও অনেক টেনশন করে ছোট ভাইটাকে নিয়ে। এখন তো শহরে থাকে। সংসার করে। চাকরি করে। বাড়ির সব খবর তার কাছে পৌছে না। তারও অত দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকার সময় নেই। আগে পিনুর জ্বর হলে রানু সারারাত ছোট ভাইয়ের মাথার কাছে বসে থাকতো। জলপটি দিত। সেদিন এখন পুরনো দিন হয়ে গেছে। পিনুর জ্বর নিয়ে মা রাহেলা বেগম বাবা অলি মাহমুদ উদগ্রিব হয়ে ওঠেন। জ্বরটা অনেকদিন থাকলে, কাশি না গেলে শরীরটা দুর্বল হয়ে যাবে। পড়ালেখার ক্ষতি হবে। রেজাল্ট খারাপ হয়ে যেতে পারে। চন্দনা তাদের আশ^স্ত করে। টেনশনে জ্বর কাশি ঠাণ্ডা এসব হয়ই। কোন সমস্যা নেই। শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে। আমি তো আছি। তারপরও সবার একটু মনখারাপ। পরীক্ষার আগে ছেলেটার কেন যে এরকম হয়!
পিনুর মাথায় পানি দেয়া থেকে শুরু করে গা ধোয়া মোছা ওকে খাওয়ানো ওষুধ সেবন করানো সবকিছু সে নিজে হাতে করতে থাকে। প্রচণ্ড জ্বরে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাথার পাশে বসে কখনো পানি দিচ্ছে কখনো জলপটি দিচ্ছে চন্দনা। বছরের বেশি দিন এ বাড়িতে আসা হয়ে গেছে তার। কিন্তু পিনুকে এরকম সে কখনো দেখেনি। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। চন্দনা রাহেলা বেগমকে একবার বললো, খালা, রানু ভাইকে একবার খবর দেব নাকি?
নিজের সাথে নিজেই বাড়াবাড়ি করছি! নিজে নিজেই ভেবে নিচ্ছি আকাশ-পাতাল কত কিছু। ওর জন্য আমি এত অস্থির কেন! আমি যা ভাবছি পিনু কি সেরকম কিছু ভাবে আমাকে নিয়ে! জানি না, কিছুই জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
রাহেলা বেগম একটু মন খারাপ করেই বললেন, না। থাক দেখি দুদিন। ওর বাড়ি আসার কথা শুনলেই বৌমা খুব অশান্তি করে। এখন বলার দরকার নেই।
খালু যদি বলেন ওকে জানাও নি কেন?
উনি বলবেন না। উনি নিজেও এসব অশান্তি পছন্দ করেন না। ছেলেটাই কেমন পর হয়ে গেছে! কী যে বৌমা পেলাম কপালে!
চন্দনা আর কথা বাড়ায় না। পিনুর গা-টা মোছাতে থাকে।
লেবুর শরবত থেকে শুরু করে কত কিছুই যে পিনুর জন্য তৈরি করে। কিন্তু তার মুখে একফোটাও স্বাদ নেই। কিচ্ছু খেতে পারছে না। এক দুবার বমিও করেছে। শরীরটা দুর্বুল হয়ে গেছে। গা-টা পুড়ছে। ডাক্তারকে ফোন করেন অলি মাহমুদ। ডাক্তার এসে দেখে-শুনে কিছু ওষুধ দিয়ে গেলেন। সেগুলো নিয়ম করে খাওয়াতে বললেন। চন্দনা পিনুকে রাতের ওষুধ খাইয়ে দেয়।
রাত বেশ বাড়তে থাকে। পিনুর পাশে বসে থাকে চন্দনা। একটু পর পর কপালে হাত দেয়। রাহেলা বেগম ঘওে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অলি মাহমুদ ঘুমিয়ে পড়েছেন। চন্দনাই একরকম জোর করে তাদের ঘুমাতে বাধ্য করেছেন। বয়স হয়েছে তাদের। পিনু অসাড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। মাঝে মাঝে জ্বর কমছে, বাড়ছে। কখনো মাথার চুল মেসেজ করে দিচ্ছে। কখনো মাথায় পানি দিচ্ছে। কখনো পা-দুটো ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছে। যাতে জ্বর নেমে যায়। চোখ ধরে না রাখতে পেরে ওর পাশে শোয় চন্দনা। শোয়ার আগে যার চোখে এত ঘুম, ঘুমে ঢুলে পড়ছিল, শোয়ার পর সেই ঘুম যেন হাওয়া হয়ে গেলো। গতরাতে পিনু যা করেছে, তা যদি আজো করে! তারপরও কেন ওর কাছে শুইছি! গতরাতে ও যদি চেতন মনে করে, তাহলে সেই সাহসটা তো আজও করবে। ও ছোট ভাই কিন্তু বয়সটা তো একদম ছোট নয়, উঠতি যৌবন। পাগলাটে বয়স। ওর বয়সে তো কতজন বিয়ে করে ঘর করে।
ফারুকের কথা মনে হয়। ফারুককে ভাবে। ফারুকের জ্বর হলেও এভাবে সারারাত নির্ঘুম কেটে যেতো তার। জ্বর শরীর নিয়েও ফারুক আমাকে ছাড়তো না। শরীর নিয়েই ছাড়তো। পিনু কি আমার ফারুক হয়ে উঠছে! পিনুর জ্বরে চার বছর পর তার এমন নির্ঘুম রাত ফিরে এলো। নির্ঘুম রাত তো কতই এসেছে। কিন্তু কারো সাথে এভাবে কখনো সে জাগেনি। গত রাতে ও যেভাবে আমার সাথে ঘুমিয়েছিল যেন একদম ফারুকের ছবিটা ভেসে উঠেছিল। এরকম একটা উঠতি বয়সের ছেলের সাথে শুয়ে থাকা, রাতভর তার সেবাযত্ন করা, এসব থেকে কী যে হয়ে যায় না-যায়! মানুষের মন তো বড় দুর্বল। আমিও তো মানুষ। পিনুও তো মানুষ। ভুল তো যে কারোরই হতে পারে। কিন্তু মন যদি নিজেই সেই ভুলটা চায়! পারিবারিক সম্পর্ক আর অসম বয়সের কথা চিন্তা করে নিজেকে শামুকের মতো নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখি। নিজের ভেতর দমিয়ে রাখা শরীরের গোপন আগুনটা জ্বলে উঠতে চায়। ও আমার নতুন পিনু হয়ে উঠেছে, ভীষণ আপন হয়ে উঠেছে, নিজের করে পাবার তীব্র বাসনা তৈরি হয়েছে। ওকে আর একটুও ছোট মনে হচ্ছে না, যেন আমি নিজেই বয়সে ছোট হয়ে গেছি ওর কাছে, আমি নিজেই যেন ওর ছোট্ট বউটি হয়ে গেছি।
ফারুকের কথা এখন যতবার মনে হয়, ততবারই ফারুকের মুখটা সরিয়ে দিয়ে ওখানে পিনুর মুখটা চলে আসে। পিনুর অমন স্পর্শ ঘৃণার কষ্টের ক্ষোভের না হয়ে ভালোবাসার হয়ে গেল কেন! পিনু যদি আমার মনের এই অবস্থা টের পায়, তাহলে ও কি তাতানো রোদের মতো জ্বলে উঠবে না! আমি কি তখন ওকে ঠেকাতে পারবো! বারণ করতে পারবো! দড়ি ছেঁড়া এঁড়ে গরুর মতো যদি সে বেপরোয়া হয়ে যায়, আমি নিজেও যদি ভেঙে পড়ি তাতে, নিজেই যদি হেরে যাই! নিজেই যদি তার বেপরোয়ার গন্তব্য হয়ে উঠি! তখন কি হবে! এটা সর্বনাশ হবে না বড় পাওয়া হবে, নিজেও তো জানি না। আমার আত্মার সাথে ও মিশে যাচ্ছে। আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। ও আমার মনে এত আপন হয়ে উঠলো কিভাবে! রাত্রির ওর সামান্য সেই স্পর্শটুকুতে এত শক্তি! এত মাদকতা! এত জীবন জড়ানো! আমাকে ভাঙচুর করে একেবারে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। অথচ ওর ইচ্ছের এক কণাও আমি জানি না।
এ জীবন তো আগেও ছিল। ফারুকের সাথে তো শরীরী বৃষ্টি-পানি কাদা করা জীবন কাটিয়েছি। এক দুই করে প্রায় চার বছর। সময়টা জীবনের পথে খুব বেশি নয় কিন্তু একদমও কমও তো নয়। তারপরও পিনু আমার এত আপন হয়ে গেলো কিভাবে! যেটুকু যা হয়েছে ওর সাথে, ওটুকু তো হতেই পারে। ভুল করেও তো হতে পারে। তা নিয়ে আমি কেন এত কিছু ভাবছি! আর এটা তো কেউ জানেও না, জানছেও না। নিজের সাথে নিজেই বাড়াবাড়ি করছি! নিজে নিজেই ভেবে নিচ্ছি আকাশ-পাতাল কত কিছু। ওর জন্য আমি এত অস্থির কেন! আমি যা ভাবছি পিনু কি সেরকম কিছু ভাবে আমাকে নিয়ে! জানি না, কিছুই জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
কিছুই বুঝতে পারে না চন্দনা। ভাবনাটা তার মাথা থেকে কোনভাবেই দূর হয় না। কোন ব্যস্ততাই তাকে ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। অক্টোপাসের মতো ভাবনাটা তাকে জড়িয়ে রাখে, তাড়িয়ে বেড়ায়।
চন্দনা ওর মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো মিষ্টি করে টেনে দেয়, আর এসব ভাবনার ভেতর নিজে ঢেউ হয়ে এলোমেলো ভাসতে থাকে। ঘুমঘুম কণ্ঠে পিনু বললো, আপু, ঘুমাও। আমার এখন খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগলে তোমাকে বলবোনে।
তুমি ঘুমাও। চন্দনা ওভাবে জেগেই থাকে। হাতের আঙুলর নেড়ে দেয়। পায়ের আঙুল নেড়ে দেয়। পিনু একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। চন্দনা ওর পাশেই শোয়। কেমন যেন একটু সংকোচ কেমন যেন একটু ভালো লাগা অনুভব করে। যা এর আগে পিনুর কাছে কখনো অনুভব করেনি। আজকের মতো করে পিনুকে সে কোনদিন ভাবেনি। ভাবতে ভাবতে চন্দনাও ঘুমিয়ে পড়ে। বাঁশঝাড় থেকে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ একসময় ঘুমটা ভেঙে যায় চন্দনার। কপালে হাত দিয়ে পিনুর জ্বর দেখে। তারপর চন্দনা আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে।
পিনু বিভোর হয়ে ঘুমোচ্ছে।
চন্দনার ঘুম আসছে না। বিরক্ত লাগে পিনুর ওপর। এতো ঘুমোচ্ছে কেন! ও যদি বুঝতে পারছো ওকে আমি কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি!
চন্দনার রাতভর ভাবনায় মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে থাকে পিনু। ফারুক সেখান থেকে পলেস্তরার মতো খসে পড়ে। মানসিক এক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে কেমন যেন নিজের কাছে নিজে বিদ্ধ হতে থাকে চন্দনা। পিনুর সাথে এখন যে তার কী সম্পর্ক; মনের সাথে সেটারই হিসাব মিলিয়ে উঠতে পারে না। না ছোট ভাই, না প্রেমিক, না স্বামী। বিধবা শরীরে আগুনের তাপ যে ভালোভাবেই লেগেছে, বিধবা মন থেকে যে তা রীতিমতো বৈধব্যের সাদা শাড়িটা পুড়িয়ে, কামরাঙা রঙিন শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে, তা ভালোই বুঝতে পারে চন্দনা।
শেষ রাতে ঘুমের ভেতর কখন যে ডুবে যায় চন্দনা, যখন ঘুম ভাঙে তখন সকালের স্যাঁতস্যাঁত ভাবটা আছেই। বৃষ্টি থামলেও ভিজে আছে মেঘ, ভিজে আছে সকাল।
নিজের ভেতর নিজেই অদ্ভুত এক রসায়নের ভেতর পড়ে যায় সে। পিনুকে মন থেকে আগের মতো আর ছোট ভাইটি মনে করে না। কিন্তু এও ভাব, যে স্পর্শ তাকে এতো করে ভাবাচ্ছে, এতো দূর নিয়ে এসেছে, তা পিনুর ইচ্ছাকৃত নয়, ঘুমের ভেতর অবচেতন মনের ঘটনা। যদি ইচ্ছাকৃত হতো তাহলে আজ রাতে আমাকে বিছানায় একা পেয়ে অমন করে নির্ভার ঘুমোতে পারতো না। আজ তো ও আমাকে ফিরেও দেখেনি। জ্বরও যে বেশি ছিল তাও নয়। ছিলো না বললেই চলে। চন্দনার চালচলন হাবভাব দেখে বোঝার বা অনুমান করার কোন উপায় নেই পিনুকে তার নিজের ভেতর বড়রকমের একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে।
স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। কিন্তু ভেতরে যে একটা নতুনস্রোত বয়ে যাচ্ছে, খানিকটা অপরাধবোধও লাগছে, এর ভেতর দিয়ে একরকম ভালোলাগাও ফুটে আছে। তা সে কাউকে বলতে পারে না। নিজের সাথে নিজে মানতেও পারছে না। আবার নিজেকেই বলে পিনুর তো কোন দোষ নেই, ঘুমের ভেতর তো কত কিছুই হয়। আর আমি নিজের থেকেই তো ওর কাছে শুইছি। ওর সঙ্গে এখন কিভাবে চলা উচিত আমার! কিছুই বুঝতে পারে না চন্দনা। ভাবনাটা তার মাথা থেকে কোনভাবেই দূর হয় না। কোন ব্যস্ততাই তাকে ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। অক্টোপাসের মতো ভাবনাটা তাকে জড়িয়ে রাখে, তাড়িয়ে বেড়ায়।
চলবে…
চন্দনা যখন নদী হয়ে যায়-০২॥ রকিবুল হাসান