এই গল্পটা আমি আঠারো বছর আগে লিখেছিলাম। তখন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর জন্যে গল্প-টল্প লিখতাম। একটা গল্পের জন্যে আটশো টাকা দিত। মূলত টাকার জন্যেই এইসব গল্প লিখতাম। আর স্বপ্ন দেখতাম, আলৌকিক কিছু হয়ে জীবনটা পাল্টে গেছে।
গল্পটা বলছি শোনেন, দুই নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে আঠারো বছর আগে লেখা গল্পটার শুরু।
০২
মানুষ ছেঁড়াকাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আমি সেইসব মানুষের মতো হতে পারিনি। আমি ছেঁড়াকাঁথার তলে শুয়ে জেগে জেগে দেখি কোটি টাকার স্বপ্ন। স্বপ্নটা আমি রাতের বেলাতেই দেখি। ঘুমের ভিতর ওই স্বপ্ন আমি দেখি না, কেননা ঘুমের ভিতরটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওটা দুঃস্বপ্নের দখলে। তাই কোটি টাকার স্বপ্নটা আমি মনের মতো করে বুনি। ঘুমের বাইরে চোখ খোলা থাকে। মাথার কাছের টেবিল-ল্যাম্পটি দেয়ালমুখী। সারা রাত ধরে জ্বলতে থাকে। এইসব আধো আলো-আঁধারিতে আমার দুইটি চোখের দৃষ্টি উড়ে যায়, যেন-বা প্রজাপতি হয়ে উড়ে গিয়ে বসে সিলিঙে। নিমেষ পড়ে না তেমন। আমি ভাবনার অফুরান আকাশে স্বপ্ন বুনি, আমার কোটি টাকার স্বপ্ন। টাকার স্বপ্ন ছাড়া আমার অন্য কোনো স্বপ্ন নেই বললে ভুল বলা হবে। তবে টাকার স্বপ্নটা প্রথমে বুনি। তারপর অন্যগুলি ধাপে ধাপে একটার-পর-একটা আসে।
ভাবি হঠাৎ যদি রাস্তার পাশে একটা ব্যাগ পেয়ে যাই এক কোটি টাকায় ভর্তি! অত টাকা একটা ব্যাগে ধরবে তো? ধরবে না কেন? যদি তা আকারে বড় হয়। ব্যাগটা নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাব যে-কোনোভাবে। তারপর? টাকাগুলি বের করব। খালি ব্যাগটা কুচি-কুচি করে কাটতে হবে। কুচি-কুচি টুকরোগুলি আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে, যতক্ষণ না ছাই হয় ততক্ষণ পোড়াতে হবে। টাকাগুলি রাখতে হবে এখানে-সেখানে, বইয়ের ভাঁজে, বুকশেলফের পেছনে, আলমারির তলায়। কিংবা কয়েক জায়গায় মাটি খুঁড়ে রাখতে হবে। এইসব হচ্ছে সাবধানতা। টাকার মালিক যদি টাকার সন্ধানে তৎপর হয়, পুলিশ যদি যত্রতত্র তল্লাশি চালায় কিংবা টাকার নম্বরগুলি যদি পর পর ছাপিয়ে দেওয়া হয় খবরের কাগজে; এজন্যে টাকাগুলি ব্যাংকে রাখা যাবে না প্রথমে, অনেকদিন পর রাখতে হবে। নতুন নোটগুলি মাটিতে ঘষে পানিতে ভিজিয়ে হাত দিয়ে কচলিয়ে পুরাতন করে দিতে হবে। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গার ভিন্ন ভিন্ন দোকান হতে এক-একটা বড় নোটে এক-একটা জিনিশ কিনতে হবে। খুচরো টাকাগুলিই তখন নিরাপদ টাকা। ওগুলি ব্যাংকে জমা দেওয়া যাবে। একটা পাঁচশো টাকার নোট থেকে পঞ্চাশ টাকা দামের একটা বই, কলম কিংবা যে-কোনো একটা জিনিশ কিনলে বাকি ফেরত পাওয়া যাবে সাড়ে চারশো টাকা। সেই সাড়ে চারশো টাকাই নিরাপদ টাকা। এইভাবে সমস্ত টাকা নিরাপদ করে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করতে কতদিন লাগতে পারে? এক বছর, দুই বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর? কী জানি! যতদিনই লাগুক একসময় তো সব টাকাই নিরাপদ করা যাবে। তারপর স্বপ্নপূরণ। এই কাজেও সাবধানতা অবলম্বন চাই। ধরা পড়ার সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করে দেওয়া হঠকারিতা হবে। একদিন এইসব টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা থাকবে। তারপর?
০৩.
রবিনাথের একটা গান বাজছে কোথাও। বোধহয় রুমি শুনছে: ‘আমি কেবলই স্বপন/করেছি বপন/বাতাসে…’। কিন্তু মেয়েটা এখনো জেগে আছে কেন? তারও কি ইনসোমনিয়া?কেমন করে? সাধারণত তার বাবা বাসায় না থাকলে গান-টান বাজায়, আজ বোধহয় তিনি নেই। হয়তো গ্রামের বাড়ি গেছেন। মাঝে-মধ্যে কখনো-সখনো যান তিনি। মাসের শুরুতে উইক- এন্ডে। রুমি গানটা আবারও রিওয়াইন্ড করে দিয়েছে: ‘…তাই আকাশ কুসুম/করিনু চয়ন হুতাশে,…।’ সে কি জেনে গেছে যে আমি জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছি? গানটা আমার প্রিয় ঠিক, কিন্তু এই মুহূর্তে ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আমার স্বপ্ন নিয়ে সে উপহাস করছে। রাগ লাগছে আমার, খানিকটা অপমানও। গানটা বন্ধ করা দরকার। কিন্তু কীভাবে? মেইন-সুইচটা অফ করে দিলে কেমন হয়? আমি আস্তে আস্তে উঠে বসার ঘরে গিয়ে মেইন-সুইচটা নিঃশব্দে অফ করে দিয়ে ফিরে এলাম বিছানায়। টেবিল-ল্যাম্পটা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ঘরটা অন্ধকারে ভরে গেল। নিকষ কালো অন্ধকারে যেন জীবনানন্দ দাশের সাতটি তারার তিমির নিভে গেছে। এখন ভৌতিক অন্ধকার! স্বপ্নের জাল এমন আঁধারে বোনা যায় না, বুনতে হয় আলো-আঁধারিতে।
এই ঘরটাতে কোনো জানলা নেই। ভেন্টিলেটরগুলিও কেন জানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জানলা থাকলে খুলে দিতাম। এই মুহূর্তে জানলা দিয়ে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম লাইট এসে ঢুকছে ঘরে। সে আরেক রহস্য, সেই আলোয় শরীরের রং পাল্টে যায়। তবু সেই অদ্ভুত আলোর নিচেই দঁড়িয়ে থাকে রাতখেকো রমণীরা। না, রমণী বললে ভুল বলা হবে। কারণ রমণ-ব্যাপারটা তাদের জন্য দুর্ভোগ ছাড়া কিছু নয়। তবু সেই দুর্ভোগ তারা ভোগ করে কেবল পেটের তাগিদে।
শীত লাগছে খুব। শীত এসে গেল নাকি! এখনো তো হেমন্ত। তবে শীত লাগছে কেন আজ? শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসছে বিবর্ণ শীত। আমি পায়ের কাছ হতে ভাঁজ-করা কাঁথাটার ভাঁজ খুলে গলা পর্যন্ত টেনে নিলাম। এইবার ঘুম আসুক। আয় ঘুম আয়।
ঘুম আসতে আসতেও আর আসতে পারল না। তন্দ্রামতো এসে আবার নেমে গেল খাটের তলায়, ঘরের মেঝেতে। দরজার তলার ফাঁক গলে ঘুম বুঝি তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছে এখন মহাসড়কে। কারণ মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে রাতের মৃত্যু। কলোনির মসজিদে আযান হচ্ছে। কাকপাখিরা ডাকছে। তাদের কা-কা কা-কা কাকলিতে জাগছে এই যান্ত্রিক শহর। ঘুমে জড়িয়ে আসছে আমার চোখ। আমার ইনসোমনিয়া। সপ্তাহে পরপর দুয়েকদিন আমি এমন করে সারারাত ঘুমুতে পারি না। ভোরের দিকে ঘুম হয়। তাও ঘণ্টাদুয়েকের জন্যে। স্বপ্ন বুনতে বুনতে কবে যে আমার দুটি চোখে অনিদ্রারোগ বসত গেড়েছে! বুঝতে পারিনি।
এখানে আসার পর হতে এই তিনবছরে ওর সঙ্গে একটা কথাও হয়নি। আমি যেচে কথা বলতে পারি না মেয়েদের সঙ্গে। সেও বলেনি।
বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে মশারির বাইরে ঠিক কানের কাছে একটা মশা প্যান-প্যান-প্যান শব্দ করে ঘুরছে। এত জায়গা থাকতে কেবল কানের কাছে কেন মশা ঘোরে? এটাও তো একটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু এই জাতীয় গবেষণা কেউ করে না। সুমি হিন্দি বুঝত না বলেই হয়তো বলত, মশারা হিন্দি গান করে। কী জানি, সুমি এখন কী করছে। ও কি এখন স্নান সেরে পুজোর ফুল কুড়োচ্ছে? ঝরা ফুলে কি পুজো হয়? আমি জানি না। কোনোদিন পুজো-আচ্চা করিনি আমি, ওসব মানি-টানি না।
খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। না, স্বাভাবিক কোনো ঘুম নয়। সারারাত ধরে জাগরণের ক্লান্তি থেকে এই ঘুম। মশাটা বড্ড বিরক্ত করছে। আমি কাঁথাটা মাথা পর্যন্ত টান দিলাম। যা শালা! পায়ের দিকটা আলগা হয়ে গেল। শীত লাগছে পায়ে, আমি পাদুটি গুটিয়ে নিলাম কাঁথার নিচে। সত্যিই কাঁথাটা ছোট হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় ছিঁড়েও গেছে। মাঝখানে চট দেখা যাচ্ছে। আসলেই কি কাঁথাটা ছোট হয়ে গেছে, নাকি আমি খানিকটা লম্বা হয়ে গেছি? বুঝতে পারছি না। কাঁথাটার মধ্যে আমার মায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি। কাঁথাটা মা আমার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বুনেছিল। মাঝখানে চট। দুপাশে মায়ের পুরনো শাড়ি। মায়ের ঘ্রাণটা অদ্ভুত মিষ্টি, যেন ঘুমজাগানিয়া। পার্থিব কোনো ঘ্রাণের সঙ্গে এর তুলনা চলে না, এ ঘ্রাণ অপার্থিব সুন্দর। মায়ের শীর্ণ কিন্তু মায়াময় মুখটি এখন মনে করছি আমি। এইতো মা আমার বসে আছে। পুকুরঘাটে চালধোয়া হাত তার জলে ডুবে আছে। নির্লিপ্ত মা যেন ভাবছে আমার কথা।
গ্রামের বাড়িতে আমাদের বিশাল পুকুর, ছোটখাটো দিঘিও বলা যায়। পুকুরের জল ছেয়ে আছে পদ্মফুলে, শাপলাও আছে। বর্ষাকালে যখন পদ্মপাতায় জল জমে, তখন জীবনদাশের একটা লাইন মাথার ভিতর ঘোরে বারংবার: ‘জানি আমি, তুমি রবে‒/আমার হবে ক্ষয়,/পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়…।’ কখনো পদ্মফুল দেখে সুনীলের কবিতার কথা মনে হয়। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটিতে সুনীল কী অদ্ভুত এক কথা বলেছেন! আমার মনে হয়, আমাদের এই পুকুরে ফোটা পদ্মফুলের মাথায় কোনো সাপ আর ভ্রমর খেলা করে না। যদি করত তবে দৃশ্যটি কেমন হতো? মা এইসব ভাবে না। মা ভাবে আমার কথা কিংবা দোয়েলের কথা। আমি মাকে ভাবছি, মায়ের সরল মায়াময় মুখটি আমার চোখে ভাসছে। শাদা শাড়িতে আমার বিধবা মাকে দেবীর মতো লাগে। দেবীর মতো কেন? আমার মা তো দেবীই।
ঘুম আসছে সমস্ত শরীর ভেঙে, দুচোখ ভরে নিঝুম ঘুম। আমি নিশ্বাস ভরে মায়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে এখন ঘুমের হাত ধরব।
গতবার যখন বাড়ি গিয়েছি তখন দেখেছি মা পেঁপেগাছ লাগিয়েছে। বাড়ি হতে বড় রাস্তায় উঠতে পথের দুধারে অনেক পেঁপেগাছ। বাগানের নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, পেঁপে এইসব বিক্রি করে মা কোনোরকমে চালিয়ে নেয়। তাছাড়া বড়দা চলে যাওয়ার পর তার ঘরটা ঠিকঠাক করে ভাড়া দিয়েছেন, সেই ঘর-ভাড়ার টাকাও কিছু পাওয়া যায়। আমিও প্রতিমাসে কিছু কিছু পাঠাই। খুব প্রয়োজন না হলে মা আমার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে না। প্রয়োজন বলতে বোনের কিংবা মায়ের চিকিৎসা, ভাইয়ের বই কেনা, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি, তেমন প্রয়োজন হলেই চিঠি লিখে শুধু। তবে আমি মাঝে মাঝে চিঠি লিখি মাকে; লিখি শুধু একটি বাক্য, ‘মা ভালো আছ?’
আমি বুঝতে পারি বেশ, এক লাইনের চিঠি, তবু মা তাতেই খুশি।
মাথাটা খুব ভারী ভারী লাগছে। যে-কারণেই হোক, ঘুম যখন একবার ভেঙেছে তখন আর আসবে না। তবে তন্দ্রাভাবটা চোখে লেগে আছে। আমি চোখ বুজে আছি। মাথাটি ঘুরছে। চোখ খুললে বুঝতে পারব, কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না এই মুহূর্তে। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে আমার মধ্যে। মাথার ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা কি শুরু হচ্ছে? সাইনাসের সমস্যা তো লেগেই আছে। কোনো ভাবনায় ডুবে যাওয়া দরকার। এই সময় গ্রামে গিয়ে ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটলে কেমন হয়? আমি মনটাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলাম। আদিগন্ত ধানক্ষেত, পাশে নদী, নদীর নাম মাতামুহুরি, দিঘল বাঁক। সুদূরের পথ কেটে হেমন্তের ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছি আমি। ফসলের ঘ্রাণে আমি ক্রমশ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছি।
০৪
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? জানি না। আরিফের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আরিফ সমানে ডেকে যাচ্ছে। আর গা ধরে ঝাঁকাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদূর হতে আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ। কী জানি এমন মনে হচ্ছে কেন আজ! তবে ঝাঁকুনিটাতে আরাম বোধ হচ্ছে। কেমন যেন এখন ইচ্ছে করেই চোখ খুলছি না। ঝাঁকাক বেটা। দেখি কতক্ষণ পারে।
আরিফের ডাক বন্ধ হয়ে গেল। সে আমার পাশ থেকে উঠে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। আমি চোখ খুললাম, ওকে ডাকলাম। কিন্তু আমার কণ্ঠ হতে আওয়াজ বের হলো না। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে দেখা যায়। ডাকলাম আবার, ‘আরিফ!’ নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে ওঠলাম। এ কী! কেমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে, অন্যরকম‒ গলায় শ্লেষ্মা জমানো নাকি? আরিফ আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘কতক্ষণ ধরে ডাকছি, বেটার কোনো হুঁশ নাই! জ্বরে তো তোর গা পুড়ে যাচ্ছে। চল্ ডাক্তারের কাছে যাই।’
‘কটা বাজে?’ আমি বললাম।
‘সাড়ে এগারোটা।’
‘মানে কী! অ্যালার্ম বন্ধ করেছে কে ঘড়ির? চাকরিটা বুঝি গেল আমার!’
‘অ্যালার্মে যখন তোর ঘুম ভাঙছে না, তখন অ্যালার্ম বন্ধ করে তোকে ডাকতে গিয়ে দেখি তোর গায়ে জ্বর। তাই আর ডাকিনি। এখন চল্, হাত-মুখ ধুয়ে নে; ডাক্তারের কাছে যাবি।’
‘না রে,ডাক্তারের কাছে পরে যাব, আগে ডিউটিটা সেরে আসি। নাহয় চাকরিটা যাবে।’ বলে আমি উঠতে গেলাম, কিন্তু উঠতে পারলাম না। শুয়ে রইলাম।
আরিফ বলতে গেলে তেড়ে এল আমার কথা শুনে, ‘শালা! ঘুসি মেরে চাপা ভেঙে ফেলব। চাকরি,না! বড় চাকরিবান হয়েছে। এই অবস্থায় রোদে ঘুরে ঘুরে তোমার পবিত্র ডিউটি সারলে বেতনের টাকাটা নিতে তুমি বেঁচে থাকবে না।’ আরিফ আমাকে শোয়া হতে টেনে তুলল, বলল, ‘যা বাথরুমে যা।’
আরিফ আমার রুমমেট, আমার ক্লাসমেট, আমরা খুব বন্ধু। আমাকে পছন্দ করে। এই ছয়ফুট বাই বারো ফুটের রুমটা আমরা দুজনে মিলে সাবলেট নিয়েছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার মাথা ঘুরছে, কেমন অন্ধকার লাগছে সমস্ত! কোনোরকমে তবু বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভেজানো দরজা ঠেলার আগেই নিজামভাই একপ্রকার দৌড়ে এলেন। বললেন, ‘ভিতরে লোক আছে।’ তিনি দরজায় বারকয়েক টোকা দিয়ে ভিতরের সেই লোকের উদ্দেশে বললেন, ‘রুমি, কল ছেড়ে দাও, কল ছেড়ে দাও।’
আমি খাটে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। কল ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ভিতরে কেউ থাকলে তা জলপড়ার শব্দে বাইরে থেকে জানা যাবে। বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো যায় না, ওটা সবসময় ভেজানো থাকে। ছিটকিনিটা অনেকদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে। কেন তা ঠিক করা হচ্ছে না বুঝতে পারছি না। রুমি এখন বাথরুমে। কতক্ষণে বের হবে? বোঝা যাচ্ছে না। পেটব্যথা, মোচড়াচ্ছে, সঙ্গে শীত। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। পাদুটি টান টান করে ঘাড় পর্যন্ত শক্ত করলাম। সমস্ত শরীর কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে নিলাম। এতে ফল পাওয়া যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে
পেট-মোচড়ানোটা চলে যায়। কিন্তু পদ্ধতিটা কাজ দিতে দেরি করছে কেন আজ?
জ্বর এলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। তখন আমি ইশকুলে পড়ি, সেভেন-এইট হবে হয়তো, মনে নাই। একবার আমার ম্যালেরিয়া হলো। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আর মাথাব্যথা। সাগুদানা ছাড়া কিছু খাই না। একটা খুবই তিতা ওষুধ খেতে হয়। সেইসময় ম্যালেরিয়া হলে শৈলেন্দ্র ডাক্তার আমাদের নিভাকুইন নামে একটা কুইনান খেতে দিত। ওইটা এমন তিতা ছিল যে খেতে গেলেই বমি আসত। রাতে ঘুম হতো না। তো, সেইবার তিনরাত মা আমার খাটের পাশে মেঝেতে শুয়ে জেগে ছিল। আর কিছুক্ষণ পর পর কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখছিল। আর বলছিল, ‘আব্বা, ঘুম যা, আব্বা, ঘুম যা।…’
পেট-মোচড়ানোটা ভালো যন্ত্রণা দিচ্ছে। রুমিটা কবে যে বের হবে? এই বাসায় এই একটাই বাথরুম, এক বাথরুমে সাতজন। হ্যাঁ, পেটব্যথা চলে যাচ্ছে।
রুমি হচ্ছে নিজামভাইয়ের ছোটবোন, এইবার সে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। আর নিজামভাই হচ্ছেন এ বাসার বড়ছেলে। মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। দুই বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরছেন। ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। তাই বেকার। এ বাসার একটা ঘর মাসে চৌদ্দশো টাকা ভাড়া। আমি আর আরিফ থাকি। এ বাসায় সর্বমোট তিনটা ঘর, একটা বসার ঘর, একটা সাবলেট, অন্যটা নিজামভাইয়ের বাবা-মা, রুমি আর প্রাইমারিতে পড়ুয়া ছোটভাইটা থাকে। কীভাবে থাকে? জানি না। অবশ্য ঘরটা একটু বড় তুলনামূলকভাবে। নিজামভাই ঘুমান বসার ঘরে, খাট-টাট নেই। বেতের সোফা, ওখানেই তিনি ঘুমের কাজ সারেন। এদের অবস্থা দেখে আমার খালি একটা গানের কথা মনে পড়ে, সুমনের ‘দশফুট বাই দশফুট’, বিশেষ করে কয়েকটা লাইন, ‘খাওয়া-বসা ঘুম একই জায়গায়/ছেলেমেয়ে দেখে আধো-তন্দ্রায়/বয়স্ক দুই দেহ মিলে যায়/আঁধার ঘনালে ঘুটঘুট’।
নিজামভাইয়ের বাবা, মানে এ বাসার কর্তা, কাজ করেন জিপিও-তে। কোন্ পোস্টে জানি না। গত তিনবছরে ভদ্রলোকের সঙ্গে ভালোভাবে আলাপই হয়নি। রাশভারি-টাইপ মানুষ, ধার্মিকও বটে। কপালে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে, সিজদার ফল। আরিফকে মাঝেমধ্যে ডেকে কথাটথা বলেন, কিন্তু আমার বেলায় ব্যতিক্রম।
আগামী মাসে পোস্টঅফিস কলোনির ছয় নম্বর বাড়ির তিনতলার এই ফ্ল্যাটের এই একরত্তি ঘরে তিনবছর পূর্ণ হবে আমার আর আরিফের। কখন যে তিনটি বছর পার হয়ে গেল টের পাইনি। তিনবছর মানে কত দিন? এক বছর সমান যদি তিনশো পঁয়ষট্টি দিন হয়, তবে তিনবছরে? কী যন্ত্রণা! আবার মাথায় তিন বছরে কয়দিন এটা ঢুকল কেন? এখন মাথার ভিতর এটা ঘুরতেই থাকবে। এমনিতেই অঙ্কে আমি কাঁচা। মেট্রিকে অঙ্কে পেয়েছিলাম চল্লিশ। তাও আবার বীজগণিতে আর সম্পাদ্য করে। পাটিগণিত বুঝি না কিছুই। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। তিন বছরে কয়দিন? তিন গুণ তিনশো পঁয়ষট্টি, যাহ্ শালা! মাথায় অঙ্কটা খেলছে না। চিন্তাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া দরকার।
হ্যাঁ রুমি। রুমি এতক্ষণ কী করছে বাথরুমে? বাথরুমের দরজার দিকে তাকালাম আমি। বাথরুম হতে রুমি বের হলো। মেয়েটা দেখতে শ্যামলা, কিন্তু বেশ সুশ্রী। তার ভেজা দীর্ঘ চুল পিঠময় ছড়ানো আমি দেখতে পাচ্ছি। এখানে আসার পর হতে এই তিনবছরে ওর সঙ্গে একটা কথাও হয়নি। আমি যেচে কথা বলতে পারি না মেয়েদের সঙ্গে। সেও বলেনি।
এ কী! আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল। এই এরিয়াতে আমিই চিঠিপত্র বিলি করতাম দুইদিন আগেও। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে থেকে কাজ করছেন?’
মা-বাবা-ভাইয়ের কারণে, সংকোচে, খানিকটা ভয়ে। পরিবারটা মোটামুটি রক্ষণশীল বলা যায়। তবে কথা না হলেও রুমি মেয়েটা কেমন কেমন করে তাকায় মাঝে মাঝে। ওর সেই দৃষ্টির অক্ষর অন্তত আমার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়েদেরকে আমার এমনিতেই দুর্বোধ্য মনে হয়। তবু রুমিকে দেখলে আমারো কেমন এক অনুভূতি জাগে। বুঝি না, ওকে দেখলে রবিনাথের একটা গানই মাথার ভিতরে বারংবার ঘুরপাক খায়: ‘এসো শ্যামল সুন্দর/আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা/বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।’ এ আরেক যন্ত্রণা। এখন গানটা ঘুরছে মাথায় ভিতর। কী করা যায়?
জ্বরটা ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে। কালকের দিনটায় খুব ধকল গেছে শরীরের উপর দিয়ে। অবশ্য এ-কাজে ধকল আছেই। কিন্তু গতকাল ধকলটা একটু বেশিই গেছে। পকেটে টাকাকড়ি ছিল না একটাও। তাই দূরের জায়গাগুলিতে হেঁটে হেঁটে কাজ সারতে হয়েছে। এরা যাতায়াত খরচটা দেয় না। তবু উপায় নেই। কাজটা পরিশ্রমের হলেও এ-কাজে অন্যরকম লাভ আছে। অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। অনেক অলিগলি রাস্তাঘাট চেনা যায়। নানা ধরনের লোকের সঙ্গে দেখা হয়। মাঝে মাঝে আমি টুকটাক লেখালেখি করি, তার জন্যে উপদান-টুপাদানও পেয়ে যাই কখনো।
একবার এক বড় সরকারি অফিসের কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিতে গেলাম। মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত ছিলাম। ঘামে জামা-কাপড় ভেজা মনে হচ্ছিল। একটু বসতে পারলেই বাঁচি। বললাম, ‘একটু বসতে পারি?’ লোকটা বলল, ‘না না’ ওখানেই দাঁড়ান।’ এমনভাবে কথাটা বলল যেন অস্পৃশ্য কোনো জীব।
প্রথমদিকে অবশ্য এইসব খুব আঁতে লাগত, হীনম্মন্যতা হতো। এখন এইসব কিছুই অবশিষ্ট নেই আর আমার। আরেকবার এক বাড়িতে অযাচিত এক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিল। একটা পার্সেল নিয়ে গিয়েছি, পড়ন্ত দুপুরবেলা। একটা বাচ্চামেয়ে দরজা খুলে দিয়ে পার্সেলটা নিয়ে ভেতর থেকে সিগনেচার এনে দিয়ে বলল, ‘তুমি একটু বসো ভাইয়া, আমি তোমাকে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দিই।’
বোধহয় আমার সারাশরীর জামা-কাপড় ঘামে ভেজা দেখে ওর মায়া হয়েছিল। ওর কথায় আমার চোখে জল এসে গেল। সেই জল আমি মুছলাম না। মুছতে গেলে যদি সে দেখে ফেলে। এমনিতে বুঝতে পারবে না। কারণ আমার কপালে-গালে চোখের জলের মতোই ঘাম। ভাবলাম, আমার এই অশ্রুও ঘাম বলে ধরে নিক ও। আমার হাতে অনেক কাজ বাকি ছিল, তা নাহলে বসে মেয়েটার কাছ হতে একগ্লাস ঠাণ্ডা জল আমি অবশ্যই খেতাম। আমি ওর মাথায় হাত রেখে আদর করে দিলাম। বললাম, ‘না ভাইয়া, আমার হাতে মেলা কাজ। যাই।’
সেদিন আমার শুধু দোয়েলের কথা মনে হয়েছিল। তাছাড়া অমন করে কেউ কোনোদিন আমাকে বসতে বলেনি, জল খেতে বলেনি।
আবার পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। আরিফ কী যেন লিখছিল। এবার সে বলল, ‘বাথরুম মনে হয় ফাঁকা হয়েছে। যা ফ্রেশ হয়ে আয়।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
০৫
কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কে এল? আরিফ মনে হয় টিয়্যুশনিতে গিয়েছে। আমি বালিশটা বুকে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম, আমার কাছে কেউ আসবার নেই। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। জ্বর বোধহয় আর আসেনি। তবে মাথাব্যথাটা আছে এখনো হালকা। মাইগ্রেনের ব্যথা দুইদিন থাকে একটানা। ডাক্তারের কাছ হতে আসার পর জ্বরটা আবারো বাড়ছিল। আরিফ মাথায় পানি ঢালল অনেকক্ষণ। এরপর ভেজা গামছা দিয়ে সমস্ত শরীর মুছে দিলে জ্বর নেমে যায়। খেয়েটেয়ে ওষুধ খেলাম। তারপর শুতে শুতেই ঘুম।
আজকে আমাকে বুঝি ঘুমে পেয়েছে। অন্যদিন ঘুমের জপ করলেও ঘুম আসতে চায় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বিকেল চারটা সতেরো। রুমির ভাইটা আমাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল। বলল, ‘ভাইয়া, আপনার একটা চিঠি এসেছে।’
বললাম, ‘কই?’ বলে আমি হাত পাতলাম।
ও বলল, ‘দরজায় পিয়ন দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দিচ্ছে না।’
আমি দরজায় গেলাম। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মতোই হ্যাংলা-পাতলা। পোস্টঅফিসের পিয়ন সে নয়। একটা চিঠি আমার হাতে দিল সে। মায়ের চিঠি। আমি প্রাপ্তির স্বীকারপত্রে সিগনেচার করতে গিয়ে দেখি ‘বৈশাখী কুরিয়ার সার্ভিস’। এ কী! আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল। এই এরিয়াতে আমিই চিঠিপত্র বিলি করতাম দুইদিন আগেও। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে থেকে কাজ করছেন?’
‘আজ সকাল থেকে।’