লাস ভেগাস। যতবার ভেগাসের নাম শুনেছি, ততবার চোখের সামনে এক আলোঝলমল শহরের ছবি ভেসে উঠেছে। আমার এমন ধারণা হয়েছে হলিউডের সিনেমা আর আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুদের থেকে জেনে। সেই ধারণাবশত এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে উঠের পথের পাশে ঔৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ভাবি পথে অনেক কিছু দেখতে পাব। কিন্তু পথে কিছুই বুঝি দেখার নেই। কেবল পত্রপল্লবহীন কাঁটাগুল্ম কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। নিষ্প্রাণ মরুময় ভূতল আর পাণ্ডুর আকাশ ছাড়া দু’একটা রেস্টুরেন্ট কিংবা সপিং মল চোখে পড়েছে। মূল শহরটা তাহলে কোথায়? মূল শহর থেকে হোটেল কত দূরে? আমার জানা নেই।
গাড়ি ঘণ্টার কাছাকাছি চলার পর আমরা হোটেল ল্যাক্সরে পৌঁছাই। আমার সহকর্মীরা যে যার মতো পথের ক্লান্তি দূর করতে আর আগামী কালের ভ্রমণের জন্য শরীর-মন তৈরি করতে রুমে ঢুকে পড়েছেন। আমরা কেবল একটা রাত এখানে কাটিয়ে ভোরে গ্রান্ড ক্যানিয়নের উদ্দেশে রওনা দেব। এমনটাই ঠিক করা আছে। কিন্তু আমার অদেখা এ নগর সম্পর্কে তৃষ্ণা থেকে গেল। আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে পথে নেমে আসি, অন্তত আশপাশটা দেখা যাক। দেখতে পাই, এ পাথুরে নগরের দীর্ঘ দিবস পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত সূর্য যেন বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হোটেল ল্যাক্সরের ফটকের বাইরে স্ফিংসের পাথুরে মূর্তি। গোধূলিবেলায় হোটেলের প্রধান ফটকে দাম্ভিক স্ফিংসের মুখের উপর শেষ সুর্যের আলো পড়েছে। আমি স্ফিংসের পাদদেশে অনেকটা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে। পথের দু’ধারের পামগাছের সারি গাছ মনে হয় না, মনে হয় মাথায় খেজুরের পাতার মতো চুলসমেত আফ্রিকান দীর্ঘদেহী মানুষেরা অতিথিদের স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে সূর্য আঁধারের কোলে আশ্রয় নেয়। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একসময় তাকিয়ে দেখি পাথুরে নগরীর সমস্ত আলো বুঝি লাক্সর গিলে খেয়েছে। তখন পামগাছের সারিও আর দেখা যায় না, পথের ধারের লাইটপোস্টের বাতিগুলো গাঢ় রাত্রের অফুরন্ত তৃঞ্ষায় তুচ্ছ পেয়ালার চুমুকমাত্র। স্ফিংসের মুখের দিক তাকিয়ে আমি তার অসীম ক্ষমতা আর সম্রাজ্যের অস্ত যাওয়ার কথা ভাবতে থাকি। তাহলে কি আমেরিকা ফারাও সম্রাট স্ফিংস-এর অসীম ক্ষমতার কথা মনে রেখে চলেছে?
পৃথিবীতে আজ তার যে অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন সেটা কি ফারাও সম্রাটের আদর্শের অনুসরণ অথবা অনুকরণ? ভাবতে ভাবতে একসময় দেখতে পাই, একের পর এক লিমুজেন এসে লবিতে থামছে। আর লিমুজেন থেকে ঝলমলে সব নারী নামছে। লিমুজেন থেকে নেমে আসা ঝলমল পায়ের রঙিন ইশারা আমার মনেও গোপনে দোলা দিয়ে যায়। তখন এক হরিপদ কেরানির ভেতরে আকবর বাদশাহর ভুতের আছর হলে আমি হোটেলের ফটকে ঢুকে পড়ি।
ল্যাক্সরের লবিতে ঢুকেই আমি হতভম্ভ। বিকেলের লবি যেন এখন বদলে গেছে। অভ্যর্থনা কাউন্টার থেকে রুমের চাবি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাই। ঝলমলে আলোর ফোয়ারা থেকে আলো ছিটকে পড়ছে চারদিকে, উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে দেয়ালচিত্র। এ তো কোনো হোটেল নয়, একেই বুঝি রঙ্গশালা অথবা বালা বালাখানা। পবিত্র গ্রন্থে বর্ণিত রাজা সাদ্দাদের প্রাসাদের কথা মনে আসে, সে খোদার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে যে বেহেস্তপ্রতীম প্রাসাদ বানিয়েছিল সেটা কি এর চাইতেও বড় আর মোহনীয় ছিল?
করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি আমি। তারপর কৌতুহলী হয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকি। কোথায় কী আছে, সে তো আমার জানা থাকার কথা নয়। ক্রমশ আলো বাড়তে থাকে, অভিভূত আমি এগিয়ে যেতে থাকি। এদিক ওদিক দেখতে থাকি। কফি মেশিনে কয়েন দিয়ে কপি ভরে নিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে যাই, আরো কী কী দেখা যায়, সে সব দেখতে থাকি।
এরপরেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল চমক, আরো আশ্চর্য হওয়ার পালা।
এমন বিশাল ফ্লোর জুড়ে এত আয়োজন। চারপাশে তাকালাম, সহসা মানুষের এমন কলরব শুনে একবার মনে হলো, আমি এক অচেনা পণ্যের বাজারে ঢুকে পড়েছি। কেবল সওদা করার জন্য অর্থ নেই, আর কী করে তা করতে হয় সেটাও জানা নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে, হাস্যরোল, উচ্ছ্বাসধ্বনি শুনে বুঝতে পারলাম এ হচ্ছে সেই রঙ্গশালা যাকে ক্যাসিনো বলে। ক্যাসিনো সম্পর্কে আমি শুনেছিলাম। বন্ধুদের বর্ণিত ক্যাসিনোর সঙ্গে এর যেন কোনো মিল নেই। তবু আমি এর অর্থ বুঝতে পারছি না। আমার তখনো কৌতুহল মেটেনি।
আমি সীমিত প্রবেশাধিকার অতিক্রম না করে নির্বিঘ্ন দূরত্বে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলাম। নানা রকম বোর্ড আছে। আছে যান্ত্রিক জুয়া খেলার ব্যবস্থা। আমি জানতেও পারি নি, একজন সাহায্যকারী আমাকে লক্ষ্য করেছিল। সে এসে আমাকে প্রতিটা খেলা সম্পর্কে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, বরং মনে মনে না বোঝার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। কারণ, জুয়া খেলা বুঝতে পারলে, খেলতে মন চাইবে, অথবা আমার অক্ষমতার জন্য খারাপ লাগবে। এ প্রাঙ্গণে আমাকে কিছুক্ষণ অবস্থান করতে হলেও আমাকে একাউন্ট দেখিয়ে প্রমাণ দিয়ে কোনো টেবিলে গিয়ে বসতে হবে।
তাদের কাছে পরিবারই সুখ আর আনন্দের উৎস। তাই এদের ভীষণ আমি ভালোবাসি, সম্মান করি।
অতঃপর সে জানতে চাইল, আমি ভেতরে প্রবেশ করতে আগ্রহী কি না। আমি ‘সরি’ বলাতে সে ‘কোনো সমস্যা নেই’ বলে আমাকে আমার রাস্তা দেখিয়ে দিল।
আমি আমার সঠিক রাস্তা পেয়ে হাঁটা ধরব, এমন সময় কেউ একজন আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি পেছন ফিরে তাকালাম, একজন নারী।
হ্যালো, ইয়াং ম্যান? এনি প্রব্লেম?
নো। নট এট অল। থ্যাংকস।
হাউ আর ইউ?
ফাইন। নাইস টু মিট ইউ।
আই গেজ ইউ আর লুকিং ফর সাম ওয়ান। ইজ ইট মি?
সরি!
আই ওয়াজ জোকিং। হোয়ার আর ইউ ফ্রম?
বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ, দা ল্যান্ড অব শেখ মুজিব। আই লাইক হিম। ক্যান ইউ স্পেন্ড সাম টাইম উইথ মি?
আমি ঐ নারীর দিকে তাকালাম। চমৎকার সাজ আর মুখে রঙের প্রলেপ তার বয়সের চিহ্ন আড়াল করতে পারে নি। তবু একজন সিনিয়র সিটিজেন আমার দেশ আর জাতির পিতাকে চেনেন, বিষয়টা আমার কাছে বেশ সম্মানের মনে হলো। আমি সানন্দে সম্মতি জানাই।
ইয়েস, আই ক্যান।
লেটস গো ইনসাইড।
পৌঢ়া আমাকে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তার কাছে বসালেন। বললেন, দেন, হোয়াট ডু ইউ লাইক টু ড্রিংক? আই এম সিওর। ইউ ডোন্ট লাইক এলকোহল। ইজন্ট ইট?
ইয়েস, আই লাইক ফ্রেস জুস।
আমি জুস আর পৌঢ়া বিয়ারে চুমুক দেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে একজন নারী জুয়ারিকে দেখতে থাকি। তিনি চরকার সুইচ টেপেন চরকা থামলে একটু আক্ষেপ করেন।
ওহ ন্যারোলি মিসড! আবার সুইচ টিপে বলেন, ইটস ফর ইউ।
আই ডোন্ট হেভ ফেইথ ইন ফেইট। চরকার উপর চোখ রেখে আমি পূর্বের প্রসঙ্গ টেনে বলি, আই এম এস্টোনিসড, ইউ নো মাই কান্ট্রি!
ইয়েস, আই হেড বিন দেয়ার ফর সাম টাইম।
রিসেন্টলি?
দেন এগেইন মিসড। তবু তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন, আইম সিওর, ইট ওড বি। ইটস ইউর লাক।
আমি তাকিয়ে দেখি এবারের চালে দান লেগেছে। তিনি উল্লসিত। তিনি হাত বাড়িয়ে দেন। আমি একটা চর্মাচ্ছাদিত হাতে আমার হাত রাখি। আমার হাত হাতে নিয়ে তিনি বললেন, ইউ আর সো লাকি!
আমার তবু জুয়ায় কোনো আগ্রহ জাগে না। আমি তার পূর্বালাপের সূত্র ধরে জানতে চাই, হোয়েন ইউ হেডবিন ইন মাই কান্ট্রি?
ইটস আফটার ইনডিনেডেন্স। বাট বিফোর কিলিং অব শেখ মুজিব। আই লাইকড হিম ভেরিমাচ।
ও আই সি। দেন হাউ ডিড ইউ সি আওয়ার কান্ট্রি এন্ড আওয়ার পিপল?
সুড আই টেল ইউ দা ট্রুথ?
অফকোর্স। হুআই নট?
ভদ্র মহিলা আমার চোখের দিকে তাকালেন, বেশ শক্ত করে উচ্চারণ করলেন, ইউ পিপল আর কাওয়ার্ড। দোস হু কিল্ড দেয়ার ফাদার দে ডোন্ট লাভ দেয়ার কান্ট্রি এট অল। আই মাস্ট সে।
ভদ্র মহিলার চোখ যেন বয়সী সিংহীর মতো জ্বলে উঠল। তারপর আবার জুয়ার বোর্ডে সুইচ টেপেন এবং ঘুর্ণায়মান বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি তার মুখে দিক তাকিয়ে রইলাম। তার মরুময় কণ্ঠবেষ্টিত মালার মিলিয়ন ডলারের হীরে চকচক করছে। আমি বুঝতে পারি, নিজেকে সামলে নিতেই তিনি আমার দিকে আর তাকাচ্ছেন না। আমি অপেক্ষা করি। কারণ, আমি ততক্ষণে জেনে গেছি ঘুর্ণন শেষ হতে দুমিনিট সময় লাগে। আরো এক মিনিট পর ঘুর্ণন শেষ হবে।
কিন্তু তিনি আবারও আরেক রকম জুয়ার মেশিনে সুইচ টিপলেন। আমিও আর যেন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অতঃপর তিনি মুখ খুললেন। বললেন, যদি তোমাদের নেতাকে তোমরা না মেরে ফেলতে আজ তোমার দেশ কোথায় চলে যেত জান? তোমরা সেটা আন্দাজও করতে পারবে না।
তখন আমারও ইতিহাসের দিকে চোখ পড়ে। তার কথার জবাব দিতে গিয়ে আমি বললাম, সাম ইনটেলেকটুয়ালস, ইভেন ফ্রম আমেরিকা, থট দেট এট দেট টাইম ইউএস পলিসি অলসো আনইথিক্যালি সাপোর্টেড ব্রুটাল কিলিং অফ আওয়ার গ্রেট লিডার। দেয়ার আর এভিডেন্স দেট ইউর দিদেন এডমিনিস্ট্রেশন কুড নট টলারেন্ট আওয়ার লিডার, এস হি বিকেম দা ভয়েস অফ প্রলেতারিয়েত অফ থার্ড ওয়ার্ল্ডস। ইভেন, ইন নাইনটিন সেভেনটিওয়ান, ইউর গভনমেন্ট ডিড নট সাপোর্টেড আস, সাপোর্টেড পাকিস্তানি জান্তা।
রাইট ইউ আর। বাট, হাও ইউ থট দেট এভরি গভমেন্টস সসাপোর্ট ইউ? ইট ডেফিনিটলি নট, বাট দেয়ার অয়ার সাম পিপল ইন দা ইউএসএ হু সাপোর্টেড ইউর ফ্রিডম। ইজিনটিড?
ইয়েস। আই নো দেট। উই আর গ্রেটফুল টু দেম। উই রিমেম্বার দেম উইথ ডিউ রেসপেক্টস এন্ড অনার।
এবার ভদ্রমহিলা প্রসন্ন হলেন।
ওকে, লেটস কাম টু প্রেজেন্ট টাইম। হাউ ডু ইউ রান ইউর কান্ট্রি নাও?
ইয়েস, উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট।
ডু ইউ আন্ডারস্ট্যানাড নাও দা সেক্রিফাইস অফ ইউর ফাদার অব নেশন, শেখ মুজিব?
ইয়েস। উই আর সেলিব্রেটিং ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস বার্থ ডে অব দা ফাদার ইন দিস ইয়ার।
দেটস গুড। আই থিংক ইউ মাস্ট রিমেম্বার হিজ সেক্রিফাইস এন্ড বো ডাউন ইউর হেড ফর প্রিভিয়াস মিসটেক।
উই মাস্ট।
ভদ্র মহিলা চাল দিতে থাকেন। আর গলা ভেজাতে মাঝে মাঝে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে থাকেন। তিনি আমাকে আর কিছু বলেন না। আমি এরপর ভাবি, তার কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ি। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালে তখন তাকে আর কেবল জুয়াড়ি ভাবতে পারি না। আমার জাতিকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন বলে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো বাড়তে থাকে।
তুমি আর কিছু খাবে না?
কেন? তুমি তো আমার মতো বুড়ো হয়ে যাও নি, এখনই তো ভোগ করবে, বাছা আমার।
তিনি সুইচ টেপেন। একজন ওয়েটার এলে তাকে এসপারাগাসসহ ক্যাভিয়র দিতে বলেন। সঙ্গে আবারো তাজা আপেলের রস।
আমি বুঝতে পারি এসবই আমার জন্য। তবু আমি তাকে নিষেধ করতে পারি না। আবার মনে হয়, তিনি আমার সঙ্গ উপভোগ করছেন। তিনি আবার চাল দিতে থাকেন। এবার মনে হয়, হারজিতের কোনো ভাবনা নেই তার। তিনি শত শত ডলার বিনাশ করতে থাকেন। তখন তার পাশে বসে থেকেই আমার মনে একটা নতুন প্রশ্ন জাগে, একজন বয়োবৃদ্ধ নারী আর এমন একজন সচেতন মানুষ কেন দীর্ঘরাত জুয়ার টেবিলে কাটান? আমার জানতে ইচ্ছে করে, তৃতীয় বিশ্বের একজনকে পেয়ে কেন গল্প করেন তিনি? কিন্তু কারো সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়, এটা ভদ্রোচিতও নয়। ততক্ষণে খাবার এসে যায়। তিনি বিয়ারের গ্লাস আমার জুসের গ্লাসের সঙ্গে ঠুকে বলেন, লেটস সেলিব্রেট দ্য নাইট। আর গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাতৃসুলভ মৃদু হেসে আমাকে প্রশ্ন করেন।
তোমার পরিবারের কথা বলো। আমি জানি, বাঙালিরা পরিবারকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাদের কাছে পরিবারই সুখ আর আনন্দের উৎস। তাই এদের ভীষণ আমি ভালোবাসি, সম্মান করি। তোমার পরিবার সম্পর্কে বলো। আমি তোমার পরিবার সম্পর্কে শুনতে চাই।
এক নিঃসঙ্গ জীবন বুঝি এগিয়ে যেতে থাকে জীবনের শেষপ্রান্তে, ঘূর্ণায়মান চরকায় শেষ চাল দেবার জন্য।
আমার পরিবার ঢাকায় আছে। আমার স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে নিয়েই আমার জীবন। তোমার দেশে এসেছি দাপ্তরিক কাজে। তবু আমি প্রতিদিন ওদের সঙ্গে কথা বলি, আমার বউ, আমার সন্তানরা আমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে পরিবারের কাছে ফিরে যাব। আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে, বেশ ক’দিন পরিবার বিচ্ছিন্ন থাকায় আমার পরিবার সম্পর্কে আরো কী কী বললাম। তার পর আবেগ সম্বরণ করে থামি।
ভদ্র মহিলা চুপচাপ বসে শুনলেন। আমি খেয়াল করি, আমার পরিবারের কথা তিনি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। আমি যখন পরিবার নিয়ে কথা বলছিলাম তখন তিনি একবারও জুয়ার বোর্ডের সুইচ টেপেন নি। আমি এবার তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। কিন্তু সে কথা বলতে বাধে। তার মুখের দিক তাকিয়ে থাকি। আর তখন বিয়ারের গ্লাস হাতে নিয়ে তিনি নিজেই কথা বলতে শুরু করেন।
আমি তেমাদের পারিবারিক বন্ধনটাকে খুব সম্মান করি। তিনি থামেন। বিয়ারের গ্লাস ঠোঁটের কাছে নেন, কিন্তু চুমুক দেন না। গ্লাসটা হাতে ধরে রেখে ছাদের রশিতে ঝুলন্ত ঝাড়বাতির নীল আলোর ফোয়ারার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীল আলায় তার মুখখানি গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের নাবিকের মতো দেখায়।
অতঃপর তিনি যেন বহুদূরের অতীত থেকে, যেন গভীর কোনো সমুদ্রের তল থেকে মুক্তো তুলে আনার মতো করে স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলতে লাগলেন, যখন তোমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হলে তার পর আমি তোমার দেশে গিয়েছিলাম। তোমাদের নেতা আর দেশটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল। তোমাদের পারিবারিক বন্ধন আর ভালোবাসার সম্পর্ক আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল। আমি ভাবছিলাম, বাংলাদেশে থেকে গেলে কেমন হয়? তখন এমন একজনকে পেয়েও গেলাম যাকে ভালোবাসা যায়। আমি তাকে জীবন সঙ্গী করার কথা ভাবছি, আর তখনই তোমরা ম্যাসাকার করে দিলে, আমার স্বপ্ন রক্তাক্ত করে দিলে। তোমরা তোমাদের লিডারকে হত্যা করলে। আমি তখন আর তোমাদের বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি আমার দেশে ফিরে এলাম।
তার পর?
আমি এখানে এসে একজনকে ভালোবাসলাম, আমাদের একটা সন্তানও হলো।
ভদ্রমহিলা আবার চুপ করে গেলেন। যেন আবার তিনি স্মৃতির জলে ডুব দিলেন। আমি তার মুখের দিক তাকিয়ে আছি⎯কখন তিনি ভেসে উঠবেন। আমি অপেক্ষা করতে থাকি, কিন্তু তিনি কিছুই বলেন না। অগত্যা আমি কথার সূত্র ধরিয়ে দিতে তাকে প্রশ্ন করি।
তার পর? আপনার ভালোবাসার সেই মানুষটি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ভালোবাসার মানুষ! ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিক তাকালেন, ভালোবাসা কারে কয় আমায় বলতে পারো তুমি!
আপনার কী মনে হয়, কারে বলে ভালোবাসা?
এদেশে আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসি না, কেবল পরষ্পর ভোগ করি। এ দেশটা ভোগ্যপণ্যের বাজার। আমার সমাজ, আমার অর্থনীতি, আমাদের জীবন সবই ভোগ্যপণ্য। আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসি না, নিজেদের কেনা-বেচা করি।
আর আপনাদের সন্তান? সে কোথায় আছে?
আমি জানি না। আমার সন্তান কোথায় আছে, সে তো আমি জানি না। বাবা।
ভদ্র মহিলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখন আমার মনে হয়, তিনি কি আমারই মুখে তার সন্তানের ছায়া অবলোকন করতে চাইছেন!
তাহলে কে আপনাকে এখন সঙ্গ দেয়?
কেন দেখতে পাচ্ছো না? এই যে জুয়ার বোর্ড, এই ক্যাসিনো।
প্রবীনা মৃদু হাসেন এবং আবার চাল দেন। তার পর আমি নির্বাক বসে এক অস্তমিত জীবনের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনিও আমার মুখের দিক নীরবে তাকিয়ে থাকেন। অতপর রাত গভীর হতে থাকে। এক নিঃসঙ্গ জীবন বুঝি এগিয়ে যেতে থাকে জীবনের শেষপ্রান্তে, ঘূর্ণায়মান চরকায় শেষ চাল দেবার জন্য।