অনুজপ্রতীম কবি বীরেন মুখার্জীর কবিতাগ্রন্থের নাম, রাত্রিনামা, জতুগৃহের ভস্ম, মায়া ও অশ্রুনিনাদ, গুচ্ছঘাসের অন্ধকার, এরকম। ২০১৬ সালে ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’ আর ২০১৪ প্রকাশিত হয় ‘জলের কারুকাজ’। এ গ্রন্থগুলোর নামও কাব্যময়, দ্যোতনাময় ও হৃদয়গ্রাহী। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ১২টি। প্রত্যেকটির নামকরণে একটা জাদু আছে। চোখ টানে। তার কবিতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে পাঠক একটা নতুনের উপস্থিতি লক্ষ করতে পারেন। আমার কাছে মনে হয়েছে বীরেন একটু আলাদাই লেখেন। তার ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ শুনেই অন্ধকারকে আমরা একটা বিশেষ দিক থেকে অবলোকন করতে পারি।
একটা আগ্রহ কাত হয়ে পড়ে এই ধ্বনিগুচ্ছ-এর দিকে। অন্ধকার রাত্রির নয়, অন্ধকার ‘গুচ্ছঘাসের’ তীব্র নয়, তিত-তিক্ত নয় তবে, অন্ধকার রয়েছে আবিষ্কারে। আমরা যেমন বলি মনের গহীনে অন্ধকার তখন রাত্রির অন্ধকারকে বুঝাই না, কিন্তু এই অন্ধকারের একটা প্লাবনপ্রিয়তা আছে। সে অন্ধকার জ্ঞানের, উপলব্ধির, বোধের, প্রকাশের এবং প্রতিদিনের, নিত্যের। এই অন্ধকার রাত্রির অন্ধকারের চেয়েও ভয়াবহ, অনেক বেশি তীব্র, এবং এর বেষ্টনীতে সকল শুভ শুকিয়ে যায়। ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ তেমনি এক ক্রিয়া যা রয়েছে আলোর মধ্যে ঘাসের প্রতীকে। এই ঘাস জীবনকে দ্যোতনা দেয়, জীবনকে মুগ্ধতার মধ্যে আন্দোলিত করে। কিন্তু তার চারিধারের অন্ধকার সকলের প্রত্যক্ষণের নয়, সংবেদনশীল মানুষের তা নজরে এড়ায় না। নামকরণের এই সার্থকতা থেকে আমরা তাকাতে পারি আমাদের চারপাশে যেখানে রয়েছে সমাজ, গুচ্ছগুচ্ছজীবনে রয়েছে সঞ্চালন প্রবাহ, তবু কোথায় যেন থমকে আছে, কোথায় যেন দৃশ্যমানতা ডুবে আছে এক অন্ধকারে, যার দিশা নেই, আগামী নেই, প্রকৃতির পল্লবিত উচ্ছ্বাস নেই, যা আছে তা তলিয়ে আছে এক অন্ধকারে যা ঘোর নয়, দৃশ্যমান আবার দৃশ্যমানও নয়; এই দ্বৈরথ এই টানাপড়েন নিয়ে তার ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’। ‘হাঁটছি আমরা’ শিরোনামের কবিতাটির পাঠ নিয়ে দেখা যাক, বীরেন মুখার্জী কেমন করে কবিতাকথায় জীবন হাল-চালের কথাগুলো বলছেন-
সকাল হেঁটে যাচ্ছে-
কাঁধে কুয়াশাজর্জর শীতবস্ত্র; হাঁটছি আমরা
নগরীর বাহুল্যবাগান পেরিয়ে রাত্রি অভিমুখি;
নিখিলবিশ্বে নেচে ওঠা সেলফি উৎসব আরও রঙিন
দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে শান্তি তামাশা,
সুরক্ষিত ভেতর মহল, রক্ত আলোকে উজ্জ্বলআমরা হাঁটছি, পদশব্দে ভুলফুল; দেখি-
শাস্ত্রীয় উঠোন যেন পৃথিবীর সমস্ত আর্তচিৎকার
উপমিত হাসি আর মানবভস্মে গম্ভীরভেতর-বাহির পোড়াগন্ধ, হাঁটছি আমরা-
হেঁটে চলেছে শীতবস্ত্র, গভীর রাত ও অগ্নি-তামাশা
আড়ালে আলোকের গোপনগর্ভ, গতিশীল বাস্তব
‘সকাল হেঁটে যাচ্ছে-’ এই দৃশ্য অপরিচিতই কারণ সকাল হাঁটে তাতো আমরা কখনও দেখিনি, তবে সকালের সূর্য হাঁটে আসমানে সেটা কল্পনা করা যায়, কারণ সূর্য ধীরে ধীরে পূর্ণকিরণে উঠে আসে আমাদের দেখা পূর্ব-দিগন্ত হতে। আমরা মনে করি ওটাই সূর্যের বাড়িঘর, তারপর সারাদিন হেঁটে তবে তার ভ্রমণ শেষ করে পশ্চিম দিগন্তে। ওটাও আমাদের সত্য ও মিথ্যের অবলোকন কারণ আমাদের কাছের দৃশ্যমান দিগন্ত কোনটাই সত্য নয়। তবু আপেক্ষিক সত্য হয়ে এক সত্যের রূপ লাভ করেছে। ঠিক তেমনি সকাল হেঁটে যাচ্ছে না, হেঁটে যাচ্ছে সকালের মানুষ, আর তাই যেনো আরেক সত্যকে যুক্ত করে বলছে তার ‘কাঁধে কুয়াশাজর্জর শীতবস্ত্র’ মনে হয় সকালটাই হেঁটে যাচ্ছে কারণ সকাল ও মানুষ দুই প্রান্ত এখানে যুক্ত হচ্ছে নিত্যতায়। ব্যক্তি হয়ে উঠছে সমাজ, সমাজের প্রতিটি মানুষই সকাল হলে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বেরিয়ে পড়ে, সকাল যেন এক উপমা হয়ে মানুষ ও তার জীবনকে নির্দেশিত করে আর মানুষের শরীরে শীত প্রদমনে শীতবস্ত্র সেও যেন হেঁটে যাচ্ছে। অর্থাৎ বহুখণ্ড দৃশ্য একখণ্ডে যুক্ত করে একটা দৃশ্যের রূপদান আর তখন কবি বলছেন ‘নিখিলবিশ্বে নেচে ওঠা সেলফি উৎসব আরো রঙিন’- যা এই দৃশ্যের বিপরীত দৃশ্য তৈরি করছে। একদিকে শীতবস্ত্রজর্জর অন্যদিকে সেলফির উৎসব দুটি ভিন্ন চারিত্রকাঠামো তৈরি করে কবি বলছেন ‘পৃথিবীর সমস্ত আর্তচিৎকার’। কোথায়? ‘শাস্ত্রীয় উঠোনে’ শাস্ত্রীয় উঠোন কেন? কারণ এই উঠোন বাড়ির আঙিনা নয়, এই উঠোন ত্রাণের মনোভূমি, যার রীতি আছে, নিয়ম আছে, হিসেব আছে, আর হিসেবের বিস্তৃতি আছে এবং কবির ‘মানবভষ্মে গম্ভীর’ কথাটি একটু খাপছাড়া হলেও ভাষ্য থেকে ভাষ্যান্তরে যুক্ত করলে আমরা যে চিত্রটি তুলে নিতে পারি তা হলো জীবন ও মানুষ।
যা চেয়েছি যা পাই নি পাই না কখনো, অথচ তা পাবার কথা ছিল, অরণ্য অস্তিত্বের মতো তা জেগে থাকে নীরব ভাষা হয়ে, আর একদিন তার প্রশমনও ঘটে প্রাত্যহিক ক্রিয়ার মধ্যে অসহায়ত্বকে স্পর্শ করে অক্ষমতাকে উগড়ে দিয়ে।
একদিকে যেমন জীবনের দুঃখবেদনা হাহাকার অন্যদিকে এক কৃত্রিম উল্লাস যা আনন্দ নয়, যা কেবলই তামাশা। একদিকে উন্নয়ন বলে চিৎকার অন্যদিকে উঠোনে মানবভষ্ম আর পদশব্দে উঠে আসছে ভুলফুল; অর্থাৎ যা আনন্দ তা এতই ঠুনকো এত ভেজালপূর্ণ, পরিণামে তা আনন্দ নয় বরং ভুলিয়ে দেয়ার এক পুঁজিবাদী প্রতারণা, কিন্তু সে পুড়িয়ে দিচ্ছে ভেতর ও বাহির যার গন্ধ একটু সচেতন হলেই ভোরের মানুষ, হাঁটা মানুষ টের পেতে পারে। আমরা যারা হাঁটছি তারা টের পেতে পারি, এবং দৃশ্যটি মিলিয়ে দেখলে কুয়াশার ভেতর যে মানুষটি হেঁটে যাচ্ছে অর্থাৎ আমরা হেঁটে যাচ্ছি বিচ্ছিন্নতায় ‘কুয়াশাজর্জর শীতবস্ত্র’র ন্যায় মনে হবে, কারণ কুয়াশায় কেবল বস্ত্রজড়ানো চলমান বস্তুটিকেই মনে হবে হাঁটারত, ধীরে ধীরে অপসৃয়মান। আর শেষ তিন পঙ্ক্তিতে কবিতাটির সংহতি দেয়ার একটা দর্শন যোগ করেছেন কবি এভাবে ‘গভীর রাত ও অগ্নি-তামাশা/ আড়ালে আলোকের গোপনগর্ভ, গতিশীল বাস্তব’। এই বাস্তবের ভেতরেও আড়ালের আলোকের গোপনগর্ভ আছে, আর সমস্ত জড়তা ভেঙে সে হয়ে ওঠে বাস্তব।
ইতালির ফ্লোরেন্স-এর গির্জায় দুটি দরজার কাজ করেছিলেন জগত খ্যাত শিল্পী গিবের্তি। তার ৭৭ বছর জীবনের আটচল্লিশ বছর কেটে যায়। ১৪২৫ সালে কাজ শুরু করে শেষ দরজাটি তিনি শেষ করেন ১৪৫২ তে ২২ বছর সময় নিয়ে আর প্রথমটি শেষ করেছিলেন ২১ বছর সময় নিয়ে। এই দরজা যখন জনসম্মুখে উন্মোচন করা হয় তখন ফ্লোরেন্সবাসীদের জয়ধ্বনি আর থামে না, তারা বলল হ্যাঁ এই হলো আমাদের অহঙ্কার। একজন বিখ্যাত ভাস্কর বললেন ‘এতো স্বর্গের দরজা’, সেই থেকে এই দরজা দুটির নাম হয়ে গেলে স্বর্গের দরজা। ‘গেটস অব প্যারাডাইস’ এই দরজায় ওলড টেস্টামেন্টের দশটি উপাখ্যান আছে। গিবের্তিও সময়কাল ১৩৭৮-১৪৫৫, ‘ইয়োরোপের ভাস্কর্য’। শিল্প এমনই, তার সংগে মানুষের সংযোগ ঘটলে তার শক্তি মানুষের শক্তি হয়ে ওঠে এবং মানুষের সংগে তার যোগাযোগ হয়ে ওঠে আনন্দ, যে আনন্দ প্রেরণা হয়ে জাগ্রত করে মানুষ। একইভাবে দা ভিঞ্চির মোনালিসা, শিল্পীর ৭ বছরের শ্রম, মানুষ তাকে গ্রহণ করতে পারল এর স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধের কারণে, মানুষের সাথে প্রতিনিয়তই এই সৃষ্টির যোগ তৈরি হচ্ছে এর প্রাকৃতিক বিষয়গুলো অটুট থাকার কারণে।
শিল্প যখন কলাকৈবল্যবাদীতায় আক্রান্ত হয় তখন মানুষ আর তাকে গ্রহণ করতে পারে না। সেখানেই একজন কবি এবং তার পাঠকের ব্যবধান তৈরি হয়। বীরেন মুখার্জী তার প্রত্যেকটি কবিতায়, কবিতার স্বভাবানুযায়ী আড়াল রেখেছেন বটে, কিন্তু পাঠক তা অনুধাবনে সক্রিয় হলেই তার কবিতা শিল্পের সুন্দরকে ছুঁতে পারেন।
একটা কথা অবশ্যই বলা দরকার যে, কথাসাহিত্যে যতটা ছড়িয়ে গড়িয়ে বলা যায় কবিতায় তা হয়ে উঠবে না, কারণ কবিতা একটি সংঘবদ্ধ শিল্প। এর কতগুলো নিয়ম রয়েছে, যদিও নিয়মগুলো পুরানো থেকে ভাঙছে, আসছে নতুনে তবুও এর বিস্তার গল্পের মতো নয়। খুব অল্প পরিসরে ঠেসে দিতে হয় বলাগুলো, তাই তাতে উপমা উৎপ্রেক্ষা, ইমেজ তাল, লয় ছাড়াও প্রতীক ও মিথের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। বীরেন যেমন বলেন-
‘শোক পাত্রে জমে থাকা আমি সেই পাপ
ঝরে যাই প্রতিদিন-শ্যামল বিষাদ’
এই পঙ্ক্তি একটা বোধের সৃষ্টি করে, নানা তিক্ততায় কবি মন বিষিয়ে উঠে। তৈরি হয় ক্ষোভ, ক্ষোভ প্রকাশ অক্ষমতায় শীতল এক বোধ এক অসহায়ত্ব শোক হয়ে ওঠে। যা চেয়েছি যা পাই নি পাই না কখনো, অথচ তা পাবার কথা ছিল, অরণ্য অস্তিত্বের মতো তা জেগে থাকে নীরব ভাষা হয়ে, আর একদিন তার প্রশমনও ঘটে প্রাত্যহিক ক্রিয়ার মধ্যে অসহায়ত্বকে স্পর্শ করে অক্ষমতাকে উগড়ে দিয়ে। এখানে টুকরো আকারে ব্যক্তিগত বিষাদস্পর্শ আছে তাও সামাজিক বিষাদপিষ্ট। নন্দনতত্ত¡িবদ সিজারোত্তির মত হলো- ‘প্রকৃতিকে উন্নত মানের মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে প্রাণবন্ত চিত্রময় কল্পনা সমৃদ্ধ এবং সমন্বয়মুখর যে আলোচনা তাই হলো কাব্য বা শিল্প’ আর এভারহার্ড মনে করতেন- ‘তাই হল সুন্দর যা আমাদের নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়গুলোকে সুখ দেয়। অর্থাৎ চোখ কান এ দুটি ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসধান করে।’
যেমন একজন মানুষ খুব সরল করে কথা বলে, আবার এজন মানুষ একই কথা বলে ঘুরিয়ে বা নানা রূপকের মাধ্যমে। গ্রামের কোনো কোনো অঞ্চলে মহিলারা যে কথা বলে তার মধ্যে রূপকটাই বেশি মিশেল হয়ে থাকে।
বীরেনের কবিতা নিয়ে কবিতাগ্রন্থের প্রথমে কলকাতা থেকে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের একটি আলোচনা চোখে পড়ল। মি. সেনগুপ্ত খুব চমৎকার করে কাব্যটির আলোচনায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বীরেনের কাব্যযোগ্যতার এবং সমকালীন চলমান বাংলা কবিতা প্রসংগে দু-একটি মোক্ষম কথাও বলেছেন। তিনিও কাব্যের নামকরণটির যথার্থতা এবং অর্থবোধকতাকে প্রশংসালগ্ন করেছেন। চমৎকারভাবে বলেছেন- ‘কবিতার ব্যাখ্যা হয় না, কবিতার ভূমিকা হয় না, কবিতা পড়তে গেলে কবিকে বুঝতে হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতে, প্রতিকূলতা প্রশ্রয়ে একটা মানুষের যে কবিসত্তা গড়ে ওঠে তার সন্ধান না পেলে কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব হয় না’; খুবই সংগত কথা। কারণ কবিতার মধ্যে তাৎক্ষণিক বুঝবার মতো যা থাকে তা যেমন কবিতা, যা বুঝা কষ্টকর তাও তেমন কবিতা, সেইটুকু রয়েছে কবির স্বভাবে। কবির জীবনযাপন চিন্তা-চেতনা, অভ্যেস-রুচি, প্রিয়-অপ্রিয়কে না জানলে তার সৃষ্টিকে পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ব করা দুরূহই বটে। তাই বলে কবিতা এমনও হওয়া উচিত নয় যে কিছুই উদ্ধার করা যাবে না। এই না যাওয়ারও কারণ বিদ্যমান এবং তা রয়েছে কবির স্বভাবে। আধুনিক কবিতায় নতুন যুক্ত হচ্ছে, নতুন ভাবে আসছে আকস্মিকতা, ফ্যান্টাসি, সমাজ-দর্শন, রাজনীতি, আসছে প্রেম ও বিমূর্ততা- এসবকে পড়তে হলে বাস্তবকে একটু জেনে তো নিতেই হবে। বীরেন মুখার্জী দক্ষ হাতে এসবের সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন তার কবিতায়।
‘সামাজিক সমাচারে দাঁড়িয়ে আছে অবিচল
সময়ের ধ্বজা, কথাসমূহ বন্দি আর-
চারিদিকে অসহ্য অপেক্ষার ভেতর
আমাদের কল্পনার নিঃশ্বাসগুলো
ওঠা নামা করে’
…
বাতাসে-মাটিতে কেবলি গ্রহণের লাল
বিবেক উত্তাল-মুক্তমঞ্চে হোলি খেলে সরীসৃপের দল’
[সামাজিক সমাচারে দাঁড়িয়ে]
কবিতাটি পড়ে পাঠককে সূত্র খুঁজে নিতে চাইলে তাকে আসতে হবে ‘মুক্তমঞ্চে হোলি খেলে সরীসৃপের দল’- এই পঙ্ক্তিতে। কারণ কবিতা বুঝবার জন্য কবিতার মধ্যেই কিছু ড্রাইভ, ইশারা থাকে; প্রথমে সেখানে প্রবেশ করতে পারলেই পুরো বিষয়টি ঘুরে ফিরে দেখা যায়। যদিও কতগুলো চিত্রকল্প অনেকসময় মনে হয় মিলছে না, কবিতা তো আখের মতো টসটসে রসালো ইক্ষু-শর্করা নয়, এর কতগুলো গিরা আছে, গিরাগুলো চূর্ণ করে তবেই পরবর্তী শর্করায় পৌঁছানো যায়। এ কবিতাটির পটভূমি ও তার ভাষ্যনির্মাণ সবই এখনও বর্তমান এবং মুক্তমঞ্চ নামক একটি তামাশার মঞ্চ সেই তাহারা তৈরি করে জনগণের সাথে তামাশাই করে চলেছে, সে তারপর এবং তারপর- আজও।
‘তবুও হেঁটে যাবো’
‘ক্লান্তিহীন হাঁটছি, দ্ব্যার্থহীন উড়াচ্ছি রোদ্দুর
যতই ফিকে হয়ে আসুক সড়কপথ
দূরে সরে যাক নগরীর আলো ও মানুষ
দৃষ্টির ওপারে গন্তব্যের কথা ভাববো’
‘ক্লান্তিহীন হাঁটছি, দ্ব্যার্থহীন উড়াচ্ছি রোদ্দুর’ চমৎকার এই পঙ্ক্তিটি কবিকে বেশি মানুষের বলে চিহ্নিত করে নিতে কষ্ট হবার কথা নয়, এবং একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে কবি বাস্তবতাকেই বোধ করে তার লাগাতার কাব্যহাঁটার মধ্যদিয়ে উড়াচ্ছেন রোদ্দুর, তাপ ও আগামীর উত্তাপ। তিনি শহরের মানুষের দিকে ফিরতে চাননি, কারণ তারা তার উদ্দিষ্ট মানুষ নয়, বাস্তবেও নয়। তিনি দৃষ্টির ওপারে যে গন্তব্য আছে তার কথাই ভাবতে চেয়েছেন। ভাবতে চেয়েছেন সেই মানুষগুলোর কথা যারা রয়েছে দূর গ্রামে, গাঁয়ের মানুষ। এই আশাবাদ একজন সমাজচেতন কবির। আর এভাবেই কবিতা ব্যক্তির থেকে বহু’র হয়ে ওঠে।
‘প্রকাশ্য শক্তি নয়, আজ খেলা হোক মহিমান্বিত আগামীর
পথ নিকটবর্তী হোক বিরুদ্ধ সাঁকো
যৌথদৃষ্টি আর প্রিয় অপরাহ্ণ ঘিরে নৃত্যরত পাখিরা
মোহমুক্তির রঙ নিয়ে উড়ে যাক মনোসরণি বেয়ে..অনেকদূর এসেছি চলে- তীর ছেড়ে
যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয় নোঙর, মাঝ সমুদ্রে’।
[ বিচ্ছিন্নতার গান]
মাইকেল এ্যঞ্জেলো বলেছিলেন ‘শিল্পী তাঁর হাত দিয়ে ছবি আঁকেন না আঁকেন মস্তিষ্ক দিয়ে’। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার বিখ্যাত চিত্র লাস্ট সাপারে-র সামনে দিনের পর দিন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তুলি দিয়ে রং বা রেখার কোন টানই দিতেন না। লিওনার্দের এই মানস সক্রিয়তা এবং কায়িক নিস্ক্রিয়তা বুঝিয়ে দেয় যে মানুষের মন যখন কোন কিছুতে [সৃজনশীল] নিমগ্ন থাকে তখন বাহ্যিক হয়ে ওঠে নিস্ক্রিয়। একজন শিল্পী তখনই শিল্পী হয়ে ওঠেন যখন অন্যমানুষের চকিতে অনুভব করা বিষয়কে সৃষ্টিযোগ্য বিষয়রূপে দেখেন। কবিও একজন শিল্পী, ভাষা শিল্পী; তার প্রকাশ ভাষায়। ভাষার সুপ্ত ও উপ্ত ক্রিয়াদি তার প্রকাশে থাকে, তাই শিল্পকর্ম বুঝতে যেমন একজন শিল্প-প্রিয় মানুষকে একটুখানিক যত্নবান হতে হয় এবং মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন- আধুনিক কবিতাও তেমনটি দাবি করে, কারণ এগুলো কবিতা- পদ্য নয়। কবিতার গতির মতোই শিল্পের গতি, তাই এর ফাঁকগুলো ভরাট করতে হয় নিজ প্রজ্ঞা ও বিবেচনা দ্বারা। তারপরও কথা থাকে শিল্প এমন দায়িত্ব একজন শিল্পরসিক বা একজন কাব্য-পিপাসুর উপর চাপাবে কেন? সে সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ব্যক্তির প্রকাশ সামাজিক বোধের ওপরই নির্ভরশীল এবং ব্যক্তিরও বৈশিষ্টগত। যেমন একজন মানুষ খুব সরল করে কথা বলে, আবার এজন মানুষ একই কথা বলে ঘুরিয়ে বা নানা রূপকের মাধ্যমে। গ্রামের কোনো কোনো অঞ্চলে মহিলারা যে কথা বলে তার মধ্যে রূপকটাই বেশি মিশেল হয়ে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তি সামগ্রিক সমাজের মানুষ হলেও তার স্বাতন্ত্র্যতা থাকে যা মার্কস তার সাহিত্য প্রসংগে আলোচনায় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন শুধু মাত্র ইতিহাস, সময় ও কাল এবং অর্থনৈতিক কারণগুলোই শিল্পসৃষ্টিতে তার ধরণ ও প্রকাশের আদ্যপান্ত নয়, এখানে ব্যক্তির স্বতন্ত্র মানসিকতার একটা ভূমিকা থাকে।
প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি যে সফল এবং কবিতার দিক থেকে তার নির্মাণ আধুনিক, গোষ্ঠীবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়-তা যে কেউ তার সৃষ্টির দিকে দিকপাত করলে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার ভালো লেগেছে কারণ বীরেন মুখার্জী আধুনিক সময়ের গতিধারাকে যথা উপলব্ধিতে নিয়ে সৃজনমনস্ক হয়েছেন। তার কবিতায় নতুন আছে।
রাজনৈতিক বেষ্টনীতে মানুষের বোধ-ভাবনা-জীবন ক্রমাগত সংকোচিত হতে হতে পাড়হীন কিনারাহীন এক মহাসমুদ্রে ধাবমান। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার সমাজ থেকে, তার ভাবনা থেকে, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। সে এখন যন্ত্র-মানুষ। কেবল দুমুঠোর জোগাড় যেন তার সারাদিনের প্রার্থনা। তার শ্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মূল্যহীন মূল্যে বিক্রয় হয়ে যাচ্ছে আর তা জমছে পুঁজিপতির কোঠায়। এর পরিবর্তন একজন সচেতন কবি তো চাইবেন সর্বক্ষণ আর তার সৃজনের দায়ও সেই দিকে আর তা যে উগ্রতায় আর সম্ভব নয় শক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শক্তি-প্রয়োগক্রিয়ায়ও নয় বরং বিপরীত যুগের ভাবনায় ও পরিকল্পনায় তার প্রকাশ দেখি আমরা এই কবিতায়।
‘প্রকাশ্য শক্তি নয়, আজ খেলা হোক মহিমান্বিত আগামীর’ ভাষ্য থেকে অনুধাবন করা যায় যে পরিবেশ পরিস্থিতি গণমুক্তির বিষয়টির অনুকূলে নেই। তাই প্রকাশ্য শক্তি প্রয়োগও বিপরীতক্রিয়ার ভয়াবহতা সৃষ্টি করবে। তাই চেতনাগত ক্রিয়া জনগণের মধ্যে ছড়ানো এবং সেই শক্তিকে জাগরিত করা যার আগামী আছে এর মধ্যদিয়ে ‘পথ শেষে নিকটবর্তী হোক বিরুদ্ধ সাঁকো’ অর্থাৎ গণজাগরণের সংহতির পর্বে জীবনের বিরুদ্ধ সাঁকো/ কালভার্ট/ প্রতিবন্ধকতা বিলুপ্তির নিকট পৌঁছাবে এবং তখন ‘যৌথদৃষ্টি আর প্রিয় অপরাহ্ণ ঘিরে নৃত্যরত পাখিরা/ মোহমুক্তির রঙ নিয়ে উড়ে যাক মনোসরণি বেয়ে…’ এই ভাষ্য একটা লড়াইয়ের একটা পরিসমাপ্তির দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে যেখানে ‘পাখিরা মোহমুক্তির রঙ নিয়ে উডে যায়’ অর্থাৎ পুরনো ভাঙে এবং নতুন দিকের, নতুন দিগন্ত মনের সরনি বেয়ে’… জেগে ওঠা কাক্সিক্ষত হয়। তার পরের স্তবকে রয়েছে সিদ্বান্ত ও সমাপ্তি ভাষ্য। ‘অনেকদূর এসেছি চলে-তীর ছেড়ে’ অর্থাৎ এটা করতেই হবে, কারণ মানুষের ক্রিয়া প্রলম্বিত হয়েছে অনেকঅনেক সময় ধরে এবং সমাজমানুষের এই বোধ তীব্র হলে আর ফেরার পক্ষ থাকে না, তখন সে ‘মাঝ সমুদ্রে’ আর দো-টানা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে নোঙর তুলে এখন দূরবর্তী।
বীরেন মুখার্জী নানা রুচির ও গঠনের কবিতা লিখছেন প্রায় প্রতিদিন। ১২টি কাব্যই কেবল নয়, রয়েছে গবেষণা, প্রবন্ধ এবং কথাসাহিত্য। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি যে সফল এবং কবিতার দিক থেকে তার নির্মাণ আধুনিক, গোষ্ঠীবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়-তা যে কেউ তার সৃষ্টির দিকে দিকপাত করলে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার ভালো লেগেছে কারণ বীরেন মুখার্জী আধুনিক সময়ের গতিধারাকে যথা উপলব্ধিতে নিয়ে সৃজনমনস্ক হয়েছেন। তার কবিতায় নতুন আছে।