পর্ব-৪
গালি, বকা আর মার খেয়েও রহিম অষ্টম শ্রেণীপর্যন্ত লেখাপড়া করে। আরশাদকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় মজিদ। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীতে তিনটাতে ফেল করে আরশাদ। ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে থাকে মজিদের। আজকাল শরীর ও বেশ খারাপ থাকে। মারধর করে হালিমাকে। হালিমা কান্নাকাটি করলে শ্লেষে বলে, মাগী তোরে মারলে কান্দস, টেকা দেলে খুশি অস ক্যা!
পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন ঘুরে বেড়ায় কালো, মাথায় খাড়া চুল আর তীক্ষ্ণ চোখের আরশাদ।
প্রখর সূর্য ও একসময় পশ্চিম দিকে ঢলে পড়তে থাকে। দুরন্ত অশ্বটিরও পা ভাঁজ হয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করে একসময়। তেজি, বদমেজাজি আর দুর্মর লোভী মজিদের শরীর খুব ক্লান্ত লাগে এখন। সায়রা বানু মারা গেছে কেবল মাস ছয়েক হলো। দেবরের ঘরে বসে মৃত্যু অব্দি মজিদকে অভিশাপ দিয়ে গেছে। আর দিনে যে কত কতবার বলেছে, আহারে আমার সৈয়দ! মজিদ ভাবে, মাগী মরতে মরতেও আমারে অভিশাপ দিয়া গেছে! অর অভিশাপই মোর লাগছে!
বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ওয়ার্ড বয়ের চাকরি হয়েছে রহিমের। মজিদের পা কেটে গেছে শামুকে। কোনোভাবেই পায়ের ঘা শুকায় না। পচন ধরলে রহিম নিয়ে যায় বরিশাল হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে রক্তে চিনির পরিমাণ অনেক বেশি। কিডনি দুইটাই ধরে গেছে। পায়ে গ্যাংরিন হয়ে গেছে।
তিনমাস হাসপাতালে চিকিৎসা চলে মজিদের। আমেনা, হাজেরা ও তাদের স্বামী সন্তান কেউ দেখতেও যায় না। যে একদিন পুরো চরবাড়িয়া দাপিয়ে বেড়াতো, সেই মজিদ আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে কাঙালের মতো। রহিম খোঁজ খবর নেয়। আর জব্বার খান সবসময়ই ছেলেদের পাঠায় ভাইয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। তিনমাস পাঁচ দিনের মাথায় মজিদ মারা যায়।
হকের বোন কোহিনুর সবসময় আরশাদকে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। কখন কী প্রয়োজন খেয়াল রাখে। একদিন রাতে কোহিনুরকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আরশাদ আলী।
আরশাদের বয়স তখন নয় বছর। সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়ানো, ডাংগুলি খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো আর রহিমের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানে দোকানে চা-বিস্কুট আর বিভিন্ন বাজে খাবারে পেট ভরানো আরশাদের প্রতিদিনের রুটিন হয়ে যায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু করে কারিগর বিড়ি টানা। এরপর শুরু হয় বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে শিশুদের প্যান্ট খুলে যোনীতে হাত দেওয়া। একটু বড় মেয়েদের আড়ালে আবডালে পেলেই সদ্য গজিয়ে ওঠা স্তন টিপে দেওয়া। বাড়ন্ত ছেলেগুলোর মাথায় যৌন অনুভূতি গেঁথে দেওয়া। এলাকায় রটে যায় মজিদের যোগ্য বংশধর হয়েছে।
রহিমের সহকর্মী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে ভাসানচর গ্রামের মায়ার সঙ্গে। মায়া খুব বড়লোক চৌধুরী বাড়িতে ফুটফরমাশ খাটতো। মায়ার গায়ের রঙ আপেলের মতো। চুলগুলো ঘনকালো কোমর অব্দি, খাড়া নাক, চিকন ঘনকালো ভ্রূ। রহিম বউকে নিয়ে খুউব গর্ববোধ করে। মনে মনে ভাবে, আমার বউটা শাবানার মতো সুন্দর। দেবরের সঙ্গে মায়ার খুব খাতির। ছোট্ট ভাইকে যা আবদার করে তাই ছোট্ট ভাই এনে দেয়। এরই মধ্যে রহিমের ছোট শালী লিলি বেড়াতে আসে। আরশাদ বেশ উপহার সামগ্রী কিনে দেয় লিলিকে। যৌন সুখ আরশাদ এর মধ্যে অনেক পেয়েছে। কিন্তু লিলির মতো অমন লাজুক, ফর্সা আর লম্বা ঘনকালো চুলের একটা বউ যদি আরশাদের হতো! তাইলে ভাইজানের বউ মানে মায়া যেমন সুন্দরী অন্তত তার কাছাকাছি হতো! আরশাদ মনে মনে ভাবে, ভাবী ফিরাইয়া দেবে!
লিলিরে নিয়া সিনেমা দেখতে যেতে চায় আরশাদ। মায়া বলে, এলাকার মানুষ দুর্নাম রটাবে। এইডা ঠিক অইবে না ছোট্ট ভাই। পরিস্থিতি জটিল দেখে মায়া পাঠিয়ে দেয় লিলিকে। লিলি চলে যাওয়ার পরই আরশাদ সরাসরি বলে বসে, ভাবী লিলিরে আমারে দেন। মায়া হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, আরে ছোট্ট ভাই লিলির চাইতে দশগুণ সুন্দরী আইন্না দিমু। একঘরে দুই বইন সংসার করমু নাকি! আরশাদ গো ধরে বসে আমি লিলিরেই বিয়া করমু।
মায়া কিছুতেই এই উড়নচণ্ডী দেবরের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবে না। এই নিয়ে বিরোধ চরমে পৌঁছে যায় দুই ভাইয়ের। আরশাদ তখন বিভিন্ন জায়গায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে বেড়ায়। বাড়ি ফেরে না বহুদিন। আরশাদের মা হালিমাও বিরক্ত হয় মায়ার ওপর। কেন বোনকে বিয়ে দিলো না তার ছেলের কাছে! জমিজমা কি কম আছে আরশাদের? মায়ার মা ও ভাই দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয় লিলিকে।
খুব ক্ষেপে যায় আরশাদ। বাড়ি আসে না মাসের পর মাস। বিভিন্ন জেলায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই পরিচয় হয় মীরা বাড়ির ছেলে হক মীরার সঙ্গে। প্রায় সময় দিনে রাতে আরশাদ পড়ে থাকে মীরা বাড়ি। হকের বোন কোহিনুর সবসময় আরশাদকে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। কখন কী প্রয়োজন খেয়াল রাখে। একদিন রাতে কোহিনুরকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আরশাদ আলী। কোহিনুর কালো হলেও চেহারায় একটা মিষ্টি মায়াবী আভা আছে। আর মুখের কথাও অনেক মিষ্টি।
এমন সময় কোহিনুর দেখতে পায়; কমলা কমলা রঙের একটা সাপের বাচ্চা কাওসারের দিকে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কাওসার যেই সাপটিকে ধরেতে চায়।
গালি আর মাস্তানির জন্য এলাকায় মীরারা বেশ প্রসিদ্ধ।
এবার দুই কোহিনুর আর মায়ার শুরু হয় খুটিনাটি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব। আরশাদ রহিমকে বলে দেয়, আপনে আলাদা ঘর তোলেন। রহিম ছেড় দেয় বাপের ঘর। কিন্তু শুধু ঘর ছাড়া করেই কোহিনুর আর আরশাদ শান্তি পায় না। বাড়ির সব প্রতিবেশী মায়া আর রহিমকে খুব ভালোবাসে। তাদের অমায়িক ব্যবহার আর সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার কারণ সবার সব আয়োজনে তারা উপস্থিত থাকে। এটাই সহ্য হয় না কোহিনুর আর আরশাদের। কোহিনুর জাকে বলে কামের ছেড়ি আর হুমাইন্নার মাঝ খাডাল তুই! এইডা আমার শ্বশুরবাড়ি। তোরে যদি আমি বাড়ি ছাড়া না করি আশেদ মীরার মাইয়া না!
এরপর রহিমকে আরশাদ বলে, আপনে এই বাড়ি ছেড়ে নিজের জমিতে গিয়া বাড়ি বানান। বাড়ির সব প্রতিবেশী এক হয়ে এর বিরোধিতা করে। কিন্তু কোহিনুর কিছুতেই রহিম আর মায়াকে এই খান বাড়িতে থাকতে দেবে না। আরশাদ একবাক্যে বলে দেয়, এইডা আমার বাপের বাড়ি। যে হালারপো হালায় রহিমের লইগা দরদ চোদাবে তার মায়রে আমি চুদি। মান-সম্মানের ভয়েও আর কেউ কথা বলে না। রহিম চলে যায় খান বাড়ি ছেড়ে। মজিদের সম্পত্তি থেকে কিছুই পায় না রহিম। মাকে দেখাশোনার ভার রহিমের ওপরই বর্তায়।
সেই বারো বছর বয়স থেকেই আরশাদ সাপ দেখে সবসময় চলার পথে। সন্ধ্যার পরে টর্চ লাইট ছাড়া চলতে ভয় পায় আরশাদ। সামান্য অন্ধকারেও আলো ছাড়া চলাফেরা করে না। পঁচিশ বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্নে দেখা শুরু হয় টাকা ভর্তি পিতলের ড্যাগ। আর সেই একই কথা, টাকা নে, ডাব নাহইল দে। কিন্তু জন্মের আগে ভাই সৈয়দের পরিণতির কথা শুনেছে আরশাদ। তাই স্বপ্নেও সে মনে হয় সচেতন থাকে। তিন কন্যার পর এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণকরে আরশাদের। পুত্রের নাম রাখে কাওসার আহমেদ খান।
কাওসারের জন্মের পর ঘন ঘন শুধু পিতলের ড্যাগ স্বপ্নে আসতে থাকে। এক শুক্লপক্ষ রাতে বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে। ঘুমের ঘোরে দাঁড়িয়ে থাকে সাতটি পিতলের ড্যাগের সামনে আর বিরবির করে কথা বলে। এমন সময় রব সাহেবের স্ত্রী রিজিয়া বের হয় প্রস্রাব করতে বাইরে। দেখে আরশাদ দাঁড়িয়ে আছে পিতলের ড্যাগের সামনে। রিজিয়া বলে, অ কি আশিদ্দা তোগো ঘরে কি চোর আইছে? অমনি আরশাদ চকিতে ঘরে প্রবেশ করে। আর ড্যাগ অদৃশ্য হয়ে যায়।
কাওসারের বয়স তখন তিন বছর। একদিন উঠানে বসে খেলছে কাওসার। ভর সন্ধ্যা, ফাগুনের মাতাল বাতাস। পূর্ণ চাঁদ উঠেছে আকাশজুড়ে। কোহিনুর বারবার ডাকে, কাওসার ঘরে আয়। কিন্তু কাওসার উঠানে বসে ছোট ছোট বল নিয়ে খেলেই যাচ্ছে। এমন সময় কোহিনুর দেখতে পায়; কমলা কমলা রঙের একটা সাপের বাচ্চা কাওসারের দিকে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কাওসার যেই সাপটিকে ধরেতে চায়। সাপের বাচ্চাটা আরও ফোঁস করে ফণা তুলে দাঁড়ায়। কোহিনুর স্থির, অবিচল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: সাতটি পিতলের ড্যাগ-৩॥ নুসরাত সুলতানা