পর্ব-২
এরপর লোকমুখে শোনা গেলো ঝালকাঠির দেবকান্তি ওঝা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রোগীকে বাঁচাতে পারে। দুই দিন পরেও চিকিৎসা করে সে মানুষ বাঁচিয়েছে। ঝালকাঠি রওয়ানা দেয় আবুয়াল আর হাবীব। স্বল্পভাষী, বিনয়ী সৈয়দ মিয়া ভাই তাদের খুবই প্রিয়। সে যেন বেঁচে ওঠে সেটা তারা মনে-প্রাণে চায়। দেব কান্তি ওঝা পৌঁছালো রাত এগারোটায়। এসেই জানালো, আগে মনসা দেবীর পূজার ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য পাঁচ রকমের পাতা, সাত রকমের ফুল, খই ভাজা, চিরা ভাজা, সন্দেশ আর লাগবে মোমবাতি। আগামীকাল সকাল সকাল আমি যোজ্ঞি শুরু করতে চাই। রাতটা রোগীর ডান হাতের কনুই আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিচ্ছি। অই আংটিই তার রক্ষাকবচ। আগামীকাল বেলা আছরের ভেতর রোগী চোখ মেলবে ভগবান যদি চায়।
সকালে দই, চিড়া, পাঁচটা রসগোল্লা খেয়ে দেবকান্তি ওঝা আরম্ভ করলো পূজা। মনসা দেবীর নামে পূজা দিয়ে শুরু করলো তিন ওঝা বীণ বাজানো আর বিষ নামানোর ঝাড়ফুঁক-তন্ত্রমন্ত্র। আসর-মাগরিব গেলো সৈয়দ আর চোখ খুললো না। অবশেষে দেবকান্তি ওঝা বললো, কী ঘটনা! আমার ধ্যান করতে অইবে। আধাঘণ্টা ধ্যান শেষে বললো, মা মনসার খুব কাছের কারও স্বার্থে আঘাত লাগছে। তাই ওই সাপকে মা মনসা নিষেধ করে দিছে আইতে। এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না। কথা ছিল দশ হাজার টাকা দেওয়ার। পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে দেবকান্তি ওঝা বেরিয়ে যায়।
শোকের মাতম ওঠে সমস্ত চরবাড়িয়ায়। প্রায় হাজার পাঁচেক লোক হয় সৈয়দের জানাজায়। লোকমুখে ফেরে সৈয়দেরর সল্পভাষিতা আর ভদ্রতা। বলে, মজিদ খানের পোলা এমন কেমনে অইছিল! তাই বুঝি আল্লাহ রাখলো না। বড় ভালো ছেলে ছিল!
তিন দিনের দিন দাফন করা হয় সৈয়দকে। সৈয়দকে দাফন করে ঘরের দরোজায় বসে কবরের দিকে তাকিয়ে আপন মনে ভাবতে থাকে মজিদ খান। কেমন দুঃস্বপ্নের মতো সব ঘটে গেলো। তার মনে ভেসে উঠতে থাকে সব দৃশ্যপট। প্রথম একদিন স্বপ্নে দেখলো, সাতটা পিতলের ড্যাগ দেখিয়ে বলছে ‘টাকা নে, ডাব-নাহইল দে।’ তারপর আবার দ্বিতীয় রাতে একই স্বপ্ন, ‘টাকা নে ডাব-নাহইল দে।’ এরপর একদিন স্বপ্নে ফিসফিস করে বললো, ‘আইজ চান্নি-পসর রাইত। পুকুর পাড়ে আয়। পুকুর পাড়ে আইয়া টাকা নিয়া যা।’ সেই স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে ওঠে মজিদ খান। রাত তখন দুটা বাজে। জোছনাধোয়া রাতে নারকেল গাছগুলোকে মনে হয় কোনো দীর্ঘদেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের কিরণ পড়ে পুকুরটাকে মনে হচ্ছে রুপার খনি।
মজিদ খান সোৎসাহে চলে যায় পুকুর পাড়ে। প্রকৃতির সব মাধূর্য ছাপিয়ে মজিদের ভেতরের লোভী রাক্ষসটার জিহবা তখন লকলক করে উঠেছিল। কিছুক্ষণ চরম উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে মজিদ। আজই সে কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবে! কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে উদ্যত হয়। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটে সেই পরম আশ্চর্যের অপার্থিব ঘটনাটি। পুকুরের পূব কিনারা থেকে একে একে উঠতে থাকে সাতটি পিতলের ড্যাগ। মজিদ খানের ইচ্ছা সব ড্যাগই সে আটকে রাখবে। কিন্তু ড্যাগগুলো ধরতে গেলেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে প্রথম ড্যাগটিতে মজিদ খান প্রস্রাব করে দেয়। স্থির হয়ে যায় ড্যাগটি। তারপর ড্যাগটির ঢাকনা খুলে ঢেলে নেয় সব মুদ্রা। রৌপ্যমুদ্রার সঙ্গে ড্যাগের ঢাকনার সঙ্গে লেগেছিল একটা স্বর্ণমুদ্রা। যার গায়ে খোদিত আছে একজন সর্পরানীর মাথায় হীরার মুকুট। এরপর মজিদ খান অই স্বর্ণমুদ্রাটিও নিয়ে ড্যাগে ঢাকনা লাগিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। কিন্তু অই ড্যাগ আর ডোবে না। ড্যাগ পুকুরে ঘুরতে থাকে সাতদিন ধরে। পুকুরের এমাথা থেকে ওমাথা ড্যাগ শুধু ঘুরতে থাকে উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতো । কিন্তু দেখে শুধু মজিদ খান আর সায়রা বানু। অন্য কোনো মানুষ ড্যাগ দেখতে পায় না। সায়রা বানু বলে, দেহেন ড্যাগ তো যায় না। কিছু একটা করেন। মজিদ খান বলে, আলো অকম্মা মাগী তোর চিন্তা কী জন্য? আমি কি মইরা গেছি!
এরপর সৈয়দকে নিয়ে পাট কাটতে গেলে দেখে পাটের আঁটির ওপর সাপ, ধান কাটতে গেলে দেখে ধানের গোলার ওপর সাপ! সীমিত হতে থাকে সৈয়দের চলাফেরা। সৈয়দ আর ফুটবল খেলতে যায় না, চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় যায় না। একা টয়লেটে যেতেও সাহস পায় না সৈয়দ। এর ভেতর পাঁচদিন অতিবাহিত হয় টাকা পাওয়ার। একদিকে সাপের উৎপাত অন্যদিকে সমস্ত পুকুর ধরে ড্যাগ এর ঘুরপাক খাওয়া। এসব বিষয় আমলে নিয়ে মজিদ খান যায় লতিফ কেরানির সঙ্গে বুদ্ধি পরামর্শ করতে।
কেরানিদের বুদ্ধি, ধন, সম্পত্তি চরবাড়িয়ায় বিখ্যাত।
লতিফ কেরানি বললো, তুমি বটের টাকাটা পুকুরে ফেলে দাও তাইলে ড্যাগ ডুবে যাবে। সেদিন ভর দুপুরে সেই স্বর্ণমুদ্রাটা ফেলে দিলো পুকুরে। অমনি ঝুপ করে ডুব দিলো ড্যাগ কিন্তু সমস্ত পুকুরজুড়ে উথাল-পাতাল ঢেউ উঠলো। মজিদ খান মনে মনে প্রমাদ গুনলো। অইদিন সন্ধ্যায় এক প্রকাণ্ড কমলা রঙের সাপ সায়রা বানুর ছাগলের ছানা মুখে নিয়ে চলে যেতে নেয়। মজিদ খানকে চিৎকার করে ডাক দেয় সায়রা বানু। মজিদ খান সাপের মাথায় লাঠি ছুড়ে মারে। ছাগল ছানা সাপের মুখ থেকে ছিটকে পড়ে। সাপ মজিদ খানের দিকে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে চলে যায়। হো হো করে হেসে ওঠে ড্যামকেয়ার মজিদ।
একসময় প্রচুর জমি-জমা থাকলেও কীর্তন খোলার ভাঙনে প্রায় সর্বস্বান্ত। গরু পুষে আর বর্গাচাষ করে কোনোরকম দিনাতিপাত করে মোবাশ্বের হোসেন, তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে।
সেদিন রাতে মজিদ খান ও সায়রা বানু দুজনেই স্বপ্নে দেখে, কে যেন পালকিতে করে নিতে এসেছে সৈয়দকে। ঘুম ভেঙে পানি খেয়ে ঘুমালে আবার মজিদ স্বপ্ন দেখে, এক নর্তকী নেচে চলেছে সাপের সাজে আর তার কানে ফিসফিস করে বলে, ‘ডাব-নারকেল দিতে হবে।’ মজিদ খান চিৎকার করে ওঠে সৈয়দ! বলে। ঘুম ভেঙে দেখে সৈয়দ অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
এরপর দিন রাতেই তারা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে ঘুমাতে যায়। কিন্তু সেই নিশ্ছিদ্র মশারির ভেতর থেকে দুজনের মাঝখান হতে সাপ সৈয়দকেই কামড় দেয়। সব স্মৃতিচারণ শেষে মজিদ খান চিৎকার করে ওঠে আহা সৈয়দ! আহা আমার বাবা! সবচেয়ে খারাপ বাবার হৃদয়ও বুঝি ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র। সেই বিমূর্ত রাত্রিতে কবরের দিকে তাকিয়ে মজিদ ভাবে, সব সম্পত্তি নিয়াও কেউ যদি আমার সৈয়দরে ফিরাইয়া দিতো!
ছোট ভাই জব্বার খানের সঙ্গে সারাবছর ঝগড়া বিবাদ লাগিয়েই রাখে মজিদ। ছেলের মৃত্যুর পর সায়রা বানু একটু কথা কাটাকাটি হলেই জব্বার খান ও সাহারা খাতুনের পাঁচ ছেলের মৃত্যু কামনা করে। পা দিয়ে মাটি টিপে দাঁত কাটতে কাটতে সায়রা বানু বলে, এই তোর পাঁচ পোলা কবর দেই। সাহারা খাতুন খালি জায়নামাজে চোখের জলে পুত্রদের নেক হায়াত ভিক্ষা চেয়ে স্রষ্টাকে বলে, ‘হে পরোয়ারদিগার, হে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনি আমার মানিকদের নিজের রহমতে রক্ষা কইরেন। আমি কারও ক্ষতি চাই না। অন্য কারও অসৎ প্রতিহিংসার কবল থেকে আমার পুত্রদের আপনি বাঁচান।
সৈয়দ মারা যাবার পর সায়রা বানুকে অনিশ্চয়তা আর হতাশা আচ্ছন্ন করে ফেলে। দুই মেয়ে আমেনা আর হাজেরার বিয়ে হয়েছে পাশের দুই গ্রামে। বড় মেয়ে আমেনার বিয়ে হয়েছে লামচরী গ্রামে। সন্তান-সন্ততি আর কিছুট অভাব অনটন নিয়ে বেশ আছে আমেনা।
হাজেরার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম কাকাশুরায়। হাজেরার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। বেশ সুখে আছে হাজেরা। সায়রা বানুর কেবলই মনে হয় মজিদ খান উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য, বংশ রক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলবে। তখন সায়রা বানু কোথায় যাবে! তাই সে স্বামীর কাছে পাঁচ জৈষ্ঠ ধানি জমি চায়।
সায়রা বলে, আমার তো পোলা নাই অই জমির আয় দিয়া আমি বাঁচমু। কিন্তু বেঁকে বসে মজিদ, বলে আমি যদি আরেকটা নিকাও করি তুই সংসারে থাকপি। তোরে জমি লেইখা দিমু ক্যা? এই নিয়ে বিরোধ বাঁধে মজিদ খান আর সায়রা বানুর। সায়রা বানু শাপ-শাপান্ত দিয়ে বলে, আমার পোলা খাইছে, এহন আমারে জমিও দেবে না। মজিদ খান বেদম প্রহার করে সায়রা বানুকে। মেয়ে-জামাই, দেবর ও দেবরপুত্ররা সবাই সায়রা বানুর পক্ষে দাঁড়ায়। সায়রা বানু নারী নির্যাতন ও অবহেলার নালিশ এনে মামলা ঠুকে দেয় বরিশাল জেলা আদালতে।
যে দেবরের পুত্রদের প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিতো সেই দেবরের ঘরে গিয়েই ওঠে সায়রা বানু। আমেনা হাজেরা স্বামী-সন্তান নিয়ে জব্বার খানের ঘরেই বেড়াতে আসে। মজিদ খান তিন জৈষ্ঠ জমি দিয়ে সায়রা বানুর সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেয়। এরপর মেয়ে-জামাই এসে মজিদ খান আর সায়রা বানুর ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দেয়। মামলা উঠিয়ে নেয় সায়রা বানু কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর আগের মতো ভালো হয় না।
যতকিছুই হোক মজিদ খানের মনে শান্তি নেই। তার বংশের বাতি নেই। মজিদ খান দৃঢ় সংকল্প হয় দ্বিতীয় বিয়ের জন্য যদিও বয়স তখন পঞ্চাশের ঘরে কিন্তু তার ভাবনা হলো, পুরুষের আবার বয়স কী?
মজিদ খান এখানে, সেখানে নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে থাকে। খুঁজতে থাকে চল্লিশের নিচের পোক্ত শরীরের কোনো নারী। যাকে সে রতি ক্রিয়ায় চরম উপভোগ করতে পারবে এবং সে নারীর গর্ভ থেকে পাবে নিজের পরম আকাঙ্ক্ষিত বংশধর।
পাশের গ্রাম লামচরীতে বসবাস করে মোবাশ্বের হোসেন হাওলাদার। একসময় প্রচুর জমি-জমা থাকলেও কীর্তন খোলার ভাঙনে প্রায় সর্বস্বান্ত। গরু পুষে আর বর্গাচাষ করে কোনোরকম দিনাতিপাত করে মোবাশ্বের হোসেন, তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সকিনার বিয়ে হয়েছিল ধনী পরিবারে। কিন্তু যৌতুক দিতে ব্যর্থ হওয়া সকিনাকে স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে আসতে হয়েছে বিয়ের ।
চলবে…
সাতটি পিতলের ড্যাগ-১॥ নুসরাত সুলতানা