কবি ও ভ্রামণিক কামরুল হাসানের নতুন উত্থানকাল। এ জগতে বহু সৃষ্টিশীল আছেন, যাদের সৃজনক্ষমতা বুঝতে সমকাল বহু কাল খরচ করে ফেলে। আলোচ্য কবি ও ভ্রামণিক কামরুল হাসান সে রকম এক কীর্তিমান। পঞ্চাশ উত্তরে এসে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের নবায়ন হয়েছে। এখন লোকে তাকে আমন্ত্রণ দিয়ে মূল্যায়ণ করছে, তাকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখছে, প্রকাশকরা যেচে পাণ্ডুলিপি নিচ্ছে এবং সাহিত্য সংগঠন ঘটা করে জন্মদিন পালন করছে। সাহিত্যের যেমন, ক্লাইমেক্স বা চরম স্তর থাকে, কামরুল হাসানের লেখক ‘হয়ে ওঠা’র হয়তো চলছে ক্লাইমেক্স। তা যদি নাও হয়, তবে তাই হোক।
আমাদের ক’বছরের বন্ধুত্ব, ভ্রমণ ও দিনযাপন পরিচিত মহলে জ্ঞাত। এই আকস্মিক বন্ধুত্বের হিসাব কষতে বসে দুজনেই দেখি, আশির দশকে দু’জনে ছিলাম কবিদের মিলনমেলা ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’র আড্ডারু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উসপ্রেসে অধ্যাপক হারুন উর রশিদ ও গবেষক আজাদ কালামের নিঃশর্ত উৎসাহে সহপাঠী সরকার আমিন নেতৃত্ব দিয়েছিল আমাদের ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’যাত্রায়। মধ্য আশিতে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় কাব্য আড্ডার পর প্রথম যে সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল ক্ষীণ কটির। প্রকাশের জন্য যে কবিতাগুলো পাওয়া পাওয়া যায়, তা সম্পাদনা করে সাজিয়ে দিতে বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক অগ্রজ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা (বর্তমানে মহাপরিচালক)-কে অনুরোধ করা হয়েছিল। অধমের ‘তোমার চোখকে যদি’ কবিতাটি প্রথম পাতায় স্থান দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন সংকলন।
প্রসঙ্গত, সান্ধ্য সাহিত্য অভিযাত্রার কারুকার সরকার আমিন ও শাহনাজ মুন্নীসহ কয়েক কবির সেই কবিতাটি মুখস্থ হয়ে যায়। তখন তারা ‘তোমার চোখকে যদি আকাশ ধরি জলি/ আর কাজলকে রঙ তুলি/ মনের কোণে গাইবে কি গান/ আনন্দে বুলবুলি’— বলে খেপাতেও দ্বিধা করতো না।
গীতলগদ্যের বহমানতা অক্ষুন্ন রেখে স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা করে দেন ভ্রমণের, আগ্রহীন নন আরোপিত শব্দচয়নের কারুকাজের ক্লেশে।
জীবনসূর্যের আহ্বানে সাহিত্যসন্ধ্যা থেকে পিছিয়ে পড়লে মঙ্গলসন্ধ্যা প্রকাশিত চার কবির কাব্যগ্রন্থ তালিকায় স্বভাবত আমি ছিলাম না, কামরুল হাসান ছিলেন। তাই যদি থাকবেন, তাহলে দীর্ঘ সান্ধ্য আড্ডায় আমাদের পরিচয়, ওঠএবাস; অন্তত তিন যুগ ভুলে রইলাম কী করে? বন্ধুত্ব নবায়নের পর ভাবনাটি এই প্রশ্নটি প্রথম মাথায় আসে দু’জনেরই। হতে পারে দু’জনই হারিয়ে গিয়েছিলাম পৃথিবীর পথে।
দুই.
আপাদমস্তক সৃজনশীল কামরুল হাসানের সৃষ্টি বিবেচনার জায়গা এটা নয়। এই বিক্ষিপ্ত ও টুকরো স্মৃতিমালায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে না। তবে বিশ্বাস করি তিনি যে মাত্রার সৃজনবুঁদ, তার ওপর মুল্যায়নমূলক রচনার জরুরত আছে, বিশেষত তার এই নতুন উত্থানকালে।
নতুন করে পরিচয়-বন্ধুত্বের পর দেখি তিনি প্রথম প্রেমিকা কবিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ কমিয়ে ভ্রমণে নাম লিখিয়েছেন। সামনে পাই তার তিনখানা ভ্রমণগ্রন্থ; ‘বিলেতের দিনগুলি’, ‘আমির তিমুরের দেশে’, ‘মহাদেশের মতো এক দেশে’। নতুন ভূগোল পেলেই তৈরি হয় তার নতুন ইতিহাস, নতুন পাণ্ডুলিপি। পরে প্রকাশিত হয় ‘সিমলা মানালির পথে’, সম্প্রতি ‘হায়দ্রাবাদের যাত্রী’। যদিও ভ্রমণগদ্যের এসব নাম পূর্বপ্রজন্মগন্ধী, কিন্তু লেখা আধুনিক; কী শব্দচয়নে, কী বিষয় বর্ণনায়।
পরিচিতমহল জানেন, এই্ ভ্রামণিক গদ্যে অনুপুঙ্খ, অকপট ও রসপ্রিয়। তিনি সিডনি বা স্কটল্যান্ড যেতে ঘর থেকে শুরু করেন, শেষ করেন ঘরের দরজায় ফিরে। অকপটে লিখতে পছন্দ করেন ঘটনার নেপথ্যকথা। শপথকারী নন বলে লেখায় কখনো কখনো অনুরাগ ও বিরাগ বেজে ওঠে উচ্চকণ্ঠে। কোথাও কোনো লুকোছাপা করার ধার ধারেন না। গীতলগদ্যের বহমানতা অক্ষুন্ন রেখে স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা করে দেন ভ্রমণের, আগ্রহীন নন আরোপিত শব্দচয়নের কারুকাজের ক্লেশে।
ভ্রমণমুখ্য আমার এ আলোচনায় তার ভ্রমণগদ্যের কয়েকটি প্রবণতার উদাহরণ দিচ্ছি। লেখক রসপ্রিয় বলে উজাড় করে তুলে ধরেন হাস্যকৌতুকের ভাণ্ড, ‘স্কাই লাউঞ্জে এসে সেই পুরান খাতির-যত্ন পাই। এ যেন বন্দরে রেখে যাওয়া বাঁধা প্রমোদিনী, আঙুররসের পাত্র ঠোঁটের সমুখে তুলে ধরে।’ (সিমলা মানালির পথে)।
লেখকের দেখার জগতের বর্ণনা যেন চমৎকার চিত্রকল্প হয়ে ওঠে, ‘টারমাকের কাছে মসৃণগ্রাত্রের বড়ো বড়ো বিমানগুলো মনে হলো পোতাশ্রয়ের সমুদ্রজাহাজ। তবে আকার মনে পড়িয়ে দেয় তিমির কথা, বিমানবন্দরের উঁচুমাথা বাতিস্ট্যান্ড থেকে আলো পড়ে চকচক করছে তাদের তেলভরা গা। টার্মিনাল ভবনের ওয়েটিং জোনগুলো টিভির বড় পর্দার মতো নীল, আর অপেক্ষমান যাত্রীরা পর্দার ভেতের ঢুকে পড়া চরিত্রসমূহ।’ (সিমলা মানালির পথে)।
স্বতঃশ্চল ও গতিময় গদ্য কামরুল হাসানের লেখার অঙ্গশোভা। ‘দিন গড়িয়ে গেছে বিকেলে, ইতিহাস ও পুরাণের প্রান্তরে নেমেছে আলোকপ্রদায়ী সূর্য।’ (সিমলা মানালির পথে)
আমার সীমাবদ্ধতা তার সব রচনা না পড়া আর প্রশস্ততা ঈর্ষাহীন দারাজদিলে সমকালীন বন্ধুটির প্রাপ্যস্তুতি ও সমালোচনার স্পর্ধা। আমার পছন্দ তার সৃজনশীলতার গতিময়তা, অপছন্দ প্রকাশের উন্মুখতা।
বইয়ের নাম সাধারণই হোক বা মাধুর্যময়, সমকালীন ট্রেন্ড ও আধুনিকতাকে অপূর্ব শব্দচয়নে তুলে আনতে কালবিলম্ব করেন না তিনি। কয়েকটি উদ্ধৃতি দিতে পারি,
০১.
‘আধুনিক নগরগুলো বিশেষ করে জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া দেশগুলোয়, যেমন এই্ ভারতে, সবুজ সরিয়ে বসতি গড়েছে, প্রান্তরের উন্মুক্ততা ভরে ফেলেছে দালানে; জলাশয় ভরাট করে, নদীর দু’পাড় সঙ্কুচিত করে, তার কোমরের ওপর সেতু পেঁচিয়ে প্রকৃতিকে করে তুলেছে বিরল দর্শন। নগরগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট, সেখানে বন নির্বাসিত, বৃক্ষ বিরল, জলাশয় মলিন, নদী নিস্পেষিত। হাদ্রাবাদের সৌভাগ্য নিজামরা কিছু চমৎকার জলাশয় নির্মাণ করেছিলেন। পরিবেশ সচেতনতা থেকে আধুনিক যুগে নির্মিত হয়েছে কিছু পার্ক। দিনের কিরণে কিংবা রাতের আলোয় হুসাইন সাগরের পাড়ে হায়দ্রাবাদ মনোমুগ্ধকর। উত্তরপার্শ্বের একটি পার্কের পাশ ঘেঁষে সে (অটোচালক) বেরিয়ে গেল উত্তরাভিমুখী যাত্রায়। নিয়ন আলোয় ফাঁকা পথঘাট, নির্জন লতাকুঞ্জ, বৃক্ষাবলী, হৃদের ওপাড়ের কুহকজাগানো শহরটি ভালো লাগছিল। পার্কিটির নাম সঞ্জীভিয়া, আমি ভেবেছিলাম সঞ্জীবনী, কেননা পার্ক তো সঞ্জীবনীই।’ (হায়দ্রাবাদের যাত্রী)।০২.
‘প্রিন্সেস স্ট্রিট ধরে হাঁটি আর খুব দ্রুত দিনটির পরমায়ু ফুরিয়ে যাওয়া দেখি। তখন ঘড়িতে সাড়ে চারটা, কিন্তু নেমে এসেছে সন্ধ্যার প্রায়ান্ধ অন্ধকার।’(বিলেতের দিনগুলি)।০৩.
‘আমাদের টেবিলের সমুখের টেবিলে চারটি কিশোরী মেয়েকে দেখি, যারা অনুপম লাবণ্যময়। বয়স তাদের আরও কান্তিময়, আরও নমনীয় করে তুলেছে। এ বয়সের কিশোরীদের যা হয়, কথায়-কথায় হেসে গড়িয়ে পড়া, এ ওর সাথে খুনসুটি করা, এরাও তার ব্যত্যয় নয়। ফ্লাইড চিকেন আর আলু ভাজা খেতে খেতে রাতুলের সাথে গল্প করি আর নয়নভরে দেখি ওই স্বর্গঅপ্সরীদের।’(বিলেতের দিনগুলি)।
সম্প্রতি কামরুল হাসানের এক বড় পরিচিতি হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কথক হিসেবে। নগরীর সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিলে তিনি এর আদ্যপান্ত অপরূপ বর্ণনায় লিখে থাকেন ধারাবাহিক। জীবনচলার পথে দেখা হওয়া নানা পর্যায়ের সফলদের ওপর, দিনযাপনের খুটিনাটি অভিজ্ঞতার ওপরও দীর্ঘ লেখায় তার ক্লান্তি নেই। এসব লেখার নিঃশর্ত প্রকাশক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এরকম লেখালেখিতে তার মিলেছে ‘কালচারাল হিস্টোরিয়ান’ অভিধা। তবে বন্ধুদের অভিযোগও আছে এন্তার, কামরুল হাসান মেধা ও সময় নষ্ট করছেন অকাজে, অপাত্রে।
এই কবি ও ভ্রমণলেখকের নতুন উত্থানকাল বলে তার প্রতি সুবিচার ও মুল্যায়ণও দেখার বা দেখতে মুখিয়ে থাকার কাল।
দিনমানের হালচাল আর দিনযাপনের বাস্তব কাহিনীর পিছনে দৌড়ে ফিকশনকে (অপরূপ সত্যের মতো মিথ্যা) বঞ্চিত করছেন। তার হাত আসলে ফিকশনের হাত, গদ্য আসলে ফিকশনের গদ্য। আমার কথা ভিন্ন, জানি, ওসব কামরুল হাসানের মেইন কোর্সের পাশের সাইড ডিশ। ইতোমধ্যে সাহিত্যদুনিয়ায় তার প্রজননসংখ্যায় যোগ হয়েছে, কাব্যগ্রন্থ চৌদ্দ, ভ্রমণগদ্য পাঁচ, প্রবন্ধ গ্রন্থ দুই, গল্প এক ও অনুবাদ তিন। সময় নষ্ট করার অজুহাত যারা তোলেন, তাদের গ্রন্থসংখ্যা কতো জানা নেই।
সুহৃদসঙ্গে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে এই কবি, ভ্রামণিকের ব্যক্তিগত আবেগ, আনুভূতি ও আচরণ কিছুটা পরিচিত। তিনি কোন কোন বিষয়ে চরমতর্কে তেতে উঠলেও, সারাক্ষণ চারণ কবির মতো কবিতার চরণ আওড়ান। মাথায় নামা কবিতা মুখে নামান, পরে কলম-কাগজে। সৃষ্টি হতে থাকে অনবদ্য সব স্তবক। বহু খ্যাতিমান কবিকে অন্তরঙ্গ ভাবে দেখেছি, জেনেছি- এরকম আগুয়ান চরণ আওড়ানোর অভ্যেস কখনো কারও দেখিনি। হাসানের আরেকটি প্রবণতা-অনবরত ছবি তুলে যাওয়া, নোটবুকে কিছু টুকে রাখা। এই বিষয়টি খুব কম সৃষ্টিশীলের ক্ষেত্রে দেখতে পাই।
আমার সীমাবদ্ধতা তার সব রচনা না পড়া আর প্রশস্ততা ঈর্ষাহীন দারাজদিলে সমকালীন বন্ধুটির প্রাপ্যস্তুতি ও সমালোচনার স্পর্ধা। আমার পছন্দ তার সৃজনশীলতার গতিময়তা, অপছন্দ প্রকাশের উন্মুখতা।
যাই হোক, কামরুল হাসান আশিদশকের যে মাপের কবি, হালের যে রকমের নিবেদিপ্রাণ ভ্রমণগদ্যকার-তার প্রকৃত বিবেচনা অপেক্ষমান। এই কবি ও ভ্রমণলেখকের নতুন উত্থানকাল বলে তার প্রতি সুবিচার ও মুল্যায়ণও দেখার বা দেখতে মুখিয়ে থাকার কাল।