কল্পনা, আবেগ ও অভিজ্ঞতা—এই তিন অনুষঙ্গে সৃষ্ট ত্রিশাখ জলদাসের কবিতা। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘জড়তুল্য পাথর’-এর পাতায়-পাতায় এই মন্তব্যের সাক্ষ্য মিলবে। এবার প্রকাশিত হলো এই কবির দ্বিতীয় কবিতার বই ‘মোমঘর’।
প্রথম বইয়ের কবিতাগুলোর রেশ মনে রেখে ‘মোমঘর’ পড়লে, কবিতাগুলোর অন্তর্গত সুরের ঐক্য কানে বাজে। তবে, সুর প্রায় অভিন্ন হলেও বক্তব্যের ধরন, প্রকাশশৈলী ও বিষয়ে সামান্য হলেও বৈচিত্র্য এসেছে।
মোমঘর পড়তে পড়তে মনে হতে পারে—প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্ক যতটা বাহ্যিক, ততটাই আত্মিক। তাই মানুষ নিজেদের মধ্যেকার কোনো বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করার সময় প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ তুলে আনে যোগসূত্র হিসেবে। এতে বক্তব্য যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি হয় আকর্ষণীয়ও।
কবি ত্রিশাখ যতটা প্রকৃতিপ্রেমী, তারও বেশি ভাবুক। ফলে প্রাকৃতিক দৃশ্যরাজির সঙ্গে চিন্তার অন্বয় সাধনে তাঁকে নিমগ্ন হতে দেখা যায়। কখনো-কখনো আপাতত সমাজ-বিযুক্ত অনুষঙ্গের কবিতা সৃষ্টিতে সময় বিনিয়োগ করতে দেখা যায়। তখন তাঁর কবিতায় সমাজের বাস্তব কোনো চিত্র ফুটে ওঠে না। তবে ব্যক্তির অন্তর্জগত ও দৃশ্যরাজির সমন্বয়ে একেকটি পরিপূর্ণ চিত্রকল্প অঙ্কিত হয়। ‘সাঁকো’, ‘জলরঙ’, ‘বৃষ্টি’, ‘স্কেচ’ এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবিতা।
আধুনিকতার ইতিবাচক দিকের চেয়ে কখনো কখনো নেতিবাচক দিক ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আধুনিকতা যুগ ব্যক্তি, স্বার্থপন্থী বলে, সমাজের অবহেলিত জনদের প্রতি সহানুভূতিকে গুরুত্ব দেয় না। তাই এ সময়ের সম্পর্ক ও প্রয়োজন-সাপেক্ষ, দায় মেটানোর মাত্র। কখনো-কখনো নিষ্ঠুরতা প্রতিযোগিতামূলক।
এই কবিকে ভাববাদী বা প্রকৃতিপ্রেমী বলে মনে হলেও তাঁর আরও একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলো শরীরপন্থী স্বভাব। প্রেম থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক যত অনুষঙ্গই তিনি কবিতা লিখুন না কেন, এর ভেতরে আদিম প্রবৃত্তির, প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকেই। ‘শব্দপাঠ’, ‘উপগতসময়’-এর ভেতর এই প্রকৃতির সর্বোচ্চ চিত্রায়ন ঘটেছে।
এ কাব্যে দেখা যাচ্ছে ত্রিশাখ জলদাসের একটি প্রিয় অনুষঙ্গ মৃত্যুচেতনা। অর্থাৎ আধ্যত্ম সংকটকে কবি প্রাচীন কবিদের মতোই দেখেছেন। মৃত্যুকে অনিবার্য অনুষঙ্গ বলে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু মাঝেমাঝে তিনি মৃত্যুর ভেতরও নতুন প্রাণের উদ্ভাস আবিষ্কার করেন। যা তাঁর চিন্তার জগতকে নতুন রূপে চিনিয়ে সাহায্য করে।
আধুনিকালের কবিকে মূলত এই কাজটিই করতে হয়, অন্তত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন তাঁকে সাধনা করেই যেতে হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে—কবি ত্রিশাখ জলদাস তাঁর মাত্র দুটি কাব্যেই নিজের স্বর আলাদা করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। ‘মোমঘর’ প্রেম-প্রকৃতি-আধ্যাত্ম চেতনার সমবায়ী স্বাক্ষর হয় উঠেছে।
তাঁর চিত্রকল্প প্রকৃতিনির্ভর। দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয়কে তিনি মূল্য দিয়েছেন বেশি। তবে, অলঙ্কার হিসেবে উপমার প্রতি আগ্রহ কম। পাশপাশি নিরূপিত ছন্দের প্রতি রয়েছে ঔদাসীন্য। এই স্বভাব হয়তো সমকালীন স্রোতের। কিন্তু কবিকে মনে রাখতে হবে, স্রোতে গা ভাসিয়ে বেড়ায় ঝাঁকেঝাঁকে ‘কই-পুঁটি’। তাই এই মাছগুলো দূর থেকে দেখতে একই রকম দেখায়। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে দৃঢ়গতিতে চলতে পারে কেবল দলছুট বোয়াল-কাতল। কবিকেও সে রকম দলছুট হতে হয়। সমকালের গণরুচির যোগান না দিয়ে তাঁকে নতুন রুচি নির্মাণ করতে হয়। তাঁর কবিতায় বিষয়বস্তুর ছড়াছাড়ি। কবিতার প্রধান অনুষঙ্গের একটি বিষয়বস্তু—অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রকৃত কবি বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবিত হন না—আঙ্গিক-প্রকরণ নিয়েই নিমগ্ন হন। বিষয়বস্তুসর্বস্ব রচনা লেখক দুর্বলরা। সময়ের প্রধান কবিরা আঙ্গিকে-প্রকরণে বিপ্লব ঘটান।
তাঁর পূর্ববর্তী কাব্য ‘জড়তুল্য পাথর’-এও তিনি নিরূপিত ছন্দে উদাসীন ছিলেন। বর্তমান কাব্যেও তাই। অর্থাৎ কবিতার প্রকরণের দিক থেকে অন্তত তিনি প্রচল রুচির স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। এ সময়ের বড় স্রোতটি ছন্দবিমুখ। ছন্দহীন বাক্যরাশিতে অনেকেই কবিতার নামে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। আর সময়ের ডামাডোলে ছন্দহীনতার দিকেই দুর্বলদের আকর্ষণও বেশি। তবে, শক্তিমান কবিমাত্রই নিরূপিত ছন্দে স্বস্তি খোঁজেন। ত্রিশাখ জলদাসও বিষয়টি দ্রুত উপলব্ধি করবেন। তাঁকে মনে রাখতে হবে—সময়ের প্রচলস্রোতে গা ভাসানো প্রধান কবিদেরা কাজ নয়; এটা দুর্বলদের কাজ। তাঁর কাজ হলো সময়ের জন্য স্বতন্ত্র স্রোত সৃষ্টি করা। তা করতে হলে সবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে নয়, দলছুট হয়েই করতে হবে। এ জন্য সবার আগেই তাঁকে ছন্দনিষ্ট হতে হবে।
তবে, এই কবিকে আলাদা করে চেনার একটি সহজসূত্র তাঁর প্রতিটি কবিতায় তিনি বিছিয়ে রেখেছেন। কবিতাগুলোর শেষপঙ্ক্তি পরিণতি-সিদ্ধান্তধর্মী। একেকটি বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের পরই তিনি একটি সিদ্ধান্ত টানেন, কখনো-কখনো সিদ্ধান্ত টানেন না, কিন্তু পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আর এ ধরনের পঙ্ক্তি রচনার সময় তাঁর কিছু কমন শব্দের পুনরুক্তি ঘটে। উদাহরণ দেওয়া যাক—
১। সাঁকোর ওপর দিয়ে ফিরে যাচ্ছে সাঁকো (সাঁকো)
২। দীর্ঘসঙ্গমে কখনো পোয়াতি হয় না বৃষ্টি (বৃষ্টি)
৩। পরিত্যক্ত মৈথুনে গলে যাচ্ছে স্বপ্নে (জলরঙ)
৪। পৃথিবী বিভোর হয় শীতল সঙ্গমে (গীত)
৫। পাতার আড়ালে/ ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে অন্ধকার (দেহাতী কবিতা)
৬। শিলাস্তর চুয়ে নেমে যাচ্ছে কৃষ্ণ-দগ্ধ জল (অয়োমুখ)
৭। ছায়াঘুমে ফিরে যাচ্ছে অনুরুদ্ধ মেঘদূত/ দুটি অগ্নিমুখী সাপ পাশাপাশি মোমঘরে (মোমঘর)
৮। মৃত চাঁদের গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে অবসাদে (শব্দ)
৯।ভোগ সকল বস্তুকেই বৃত্তাকার দেখে। (বৃত্ত)
১০। আর আমি ডুবে যাচ্ছি একটি পরিপূর্ণ শীতসঙ্গমে (শীত)
১১। আমার ভেতর হেঁটে যাচ্ছে বিব্রত দুপুর (অবয়ব)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে—প্রায় পঙক্তিই হয় পরিণতিমূলক না হয় সিদ্ধান্তমূলক। এই যে, এক ধরনের বৈশিষ্ট্য এই কবি কবিতার ভেতর চারিয়ে দিয়েছেন, এতে তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র শনাক্ত করা অনেকটাই সহজ হয়ে পড়েছে। আধুনিকালের কবিকে মূলত এই কাজটিই করতে হয়, অন্তত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন তাঁকে সাধনা করেই যেতে হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে—কবি ত্রিশাখ জলদাস তাঁর মাত্র দুটি কাব্যেই নিজের স্বর আলাদা করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। ‘মোমঘর’ প্রেম-প্রকৃতি-আধ্যাত্ম চেতনার সমবায়ী স্বাক্ষর হয় উঠেছে।
মোমঘর: ত্রিশাখ জলদাস
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য: ১৩০ টাকা।