বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল
নারী দিলো তাহে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল।
-কাজী নজরুল ইসলাম
‘নারী স্বাধীনতা’ বহিরাবরণে দুটি শব্দের সমন্বয় হলেও এর ব্যঞ্জনা গভীর ও তাৎপর্যবাহী। নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রী সব স্বাধীনতাই নারী স্বাধীনতার অন্তর্গত। তবে, বিস্ময়কর হলেও সত্য, মুখে যতই নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়ানো হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের সমাজের নারীরা কতটা স্বাধীন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে!
মেয়ে শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের ওপর বেশ কিছু বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দেয়। যা আজন্ম তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। চাইলেও এই শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসা পুরোপুরি সম্ভব হয় না। কালের বিবর্তনে কিছুটা শিথিলতা এলেও বড় প্রশ্ন থেকে যায়। কন্যা শিশু জন্ম নেওয়ার পর থেকেই সে অনুভব করে তার বয়েসী ছেলে শিশুর সমাজে যতটা কদর, তার ক্ষেত্রে তত নয়! এক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। মনের গহীনে দাগ কাটে তখনই। এরপর চলতি পথে পরিচয় ঘটে সমাজের বস্তাপচা কিছু মুখরোচক কথার ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ টাইপ অন্তসারশূন্য নীতিবাক্যের। ভালো-মন্দ সব কর্মকাণ্ডই শোভনীয় পুরুষের জন্য। কিন্তু একজন কন্যা শিশু হোক বা বৃদ্ধা সবাই সমাজের রক্তচক্ষুর কড়া শাসনে বন্দি। কিছুটা ব্যতিক্রম পরিবার বা মানুষ নেই তা নয়! তবে ব্যতিক্রম তো উদাহরণ নয়!
বেশিরভাগই কুক্ষিগত চেতনার বেড়াজালে হাবুডুবু খাচ্ছে আজও! ঘরের বাইরে যেতে হতে হলেও ন্যূনতম জবাবদিহিতার বিষয় থাকেই। এর বাইরেও অনেক সমস্যা আছে। জবাবদিহিতা সর্বদাই বাধ্যবাধকতাকে নির্দেশ করে। বিষয়টা যতটা জবাবদিহিতা, তার চেয়েও নিরাপত্তারও বটে! সমাজের নারীরা চাইলেই যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে না। বর্তমানকালে সবচেয়ে বেশি ভীতিকর ঘটনা ঘটছে নারীর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। রাস্তায়, অনলাইন, অফলাইন, কর্মক্ষেত্রে, বাসে-ট্রেনে কোথায় নারীরা নিরাপদা? কোথায় স্বাধীন পরিবেশ!
এটাও নারীদের মাথায় রাখতে হবে। কারও কোনো ক্ষতি না করে নিজের উন্নয়ন, নিজের বিবেককে জাগ্রত করে পথ চলাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। সর্বদা দেশের দশের কল্যাণ তথা নিজের কল্যাণে নারীর ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। নারীর স্বাধীন মনোভঙ্গির উন্নতি হোক। নারী নিজে বাঁচুক, পরিবার বাঁচুক, দেশ বাঁচুক।
মানব জাতির সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে চলাচল করতে পারাটা তার মৌলিক অধিকার। সেটা আমরা কতটা মসৃণ করতে পেরেছি! এক্ষেত্রে নিশ্চয় অবাধ চলাচল কাম্য নয়! স্বাধীনতার সঙ্গে দুটি বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমত মত প্রকাশের, দ্বিতীয়ত চলাচলের স্বাধীনতা। এই দুটো বিষয় সঠিকভাবে রক্ষিত হলে সমাজে নারীরা তাদের সঠিক অবস্থান গড়ে তুলবে বলে আশা করা যায়। নারী বাংলাদেশে জনসংখ্যার অর্ধেক হওয়ার পরও তাকে প্রতিনিয়ত নানা বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। আজও একশ্রেণীর সংকীর্ণচিত্তের মানুষ নারীকে অবরুদ্ধ করে জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
অধিকারবঞ্চিত অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের অধিকার সচেতন করে জাগিয়ে তুলতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার পথ ধরে এসেছেন বেগম সুফিয়া কামাল, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম, ড. মালেকা বেগম, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ নারী নেত্রী। তবু কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে আছে আদিম বর্বরতা! এখনো অনেক পরিবার আছে, যারা জাতিগঠনে নারী সক্রিয়তার বিরোধী আবার অনেকেই ধর্মীয় শিক্ষার গণ্ডিতেই নারীকে আবদ্ধ রাখতে চায়। আবার এমনও পরিবার আছে, যারা নারীদের উচ্চ শিক্ষা লাভ ও চাকরি করার বিপক্ষে। এক্ষেত্রে পরিবারের সামর্থ্যহীনতা যেমন রয়েছে, তেমনি সামর্থ্য থাকলেও সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও রয়েছে। গ্রাম-শহর মিলে প্রতিদিন একাধিক কন্যা শিশু পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ছে। এছাড়া বাল্যবিবাহ অন্যতম একটা প্রতিবন্ধকতা নারীর পরিপূর্ণ বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে।
স্বাধীনতার প্রশ্নে এলে সবাই নারীকে খারাপভাবে এমনকি একজন নারী হয়েও অন্য নারী সম্পর্কে ভাবতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এক্ষেত্রে যদি বলতে হয়, তবে অবশ্যই বলবো, নারীরাই নিজের নারীর বেশি বিরূপ সমালোচনা করে।
একজন নারীর বেড়ে ওঠা তার পরিবারে। মায়ের আচরণ, মায়ের শালীনতা নিয়ে সে বড় হয়। কিন্তু সেই মেয়ে শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যদি কোনো আমূল পরিবর্তনের ছটা লাগে, তাহলেই সংরক্ষণশীলর নির্দ্বিধায় বলে, সমাজ রসাতলে গেলো! এক্ষেত্রে প্রথা ব্যাপারটা বেশি খোঁচা দেয়। কিন্তু প্রথা কী? প্রথা তো মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছিল। যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রথা-রীতিনীতির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও কাম্য। প্রথা, মনের কুক্ষিগত সংস্কার ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। না হলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। প্রত্যেক নারী ও পুরুষের স্বাধীন সত্তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। মনের বদ্ধ ঘরকে উন্মুক্ত করে পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নারীর স্বাধীনতা মানে কখনোই এই নয় যে, তা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নেবে! স্বাধীনতারও একটা মাপকাঠি আছে, যখন সেই নির্দিষ্ট গণ্ডি ভেদ করে, তখন তা আর স্বাধীনতা থাকে না! এটাও নারীদের মাথায় রাখতে হবে। কারও কোনো ক্ষতি না করে নিজের উন্নয়ন, নিজের বিবেককে জাগ্রত করে পথ চলাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। সর্বদা দেশের দশের কল্যাণ তথা নিজের কল্যাণে নারীর ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। নারীর স্বাধীন মনোভঙ্গির উন্নতি হোক। নারী নিজে বাঁচুক, পরিবার বাঁচুক, দেশ বাঁচুক।
এখন সমাজে ডিভোর্সের পরিমাণ বড্ড বেড়ে গেছে। এটাকে কী বলবো! নারী স্বাধীনতা? যদি বলি, হ্যাঁ; তবে তা কিছুটা বটে! কারণ এখনকার নারী সমাজ বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখ খোলে! তবে যেকোনো কিছুর পেছনে ফিরলে একটা গল্প তো থাকেই। তাই শুধু নারীকেই এজন্য দোষ দেবো কেন? আবার এমনো নয়, সর্বদা পুরুষই দোষী! এক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্তব্য ও স্বাধীনতা দুটোকেই প্রধান্য দেওয়া উচিত। আগের যুগে পরিবারের শিক্ষা ছিল, যায় হয়ে যাক, সংসার ছাড়া যাবে না। তার মানে কি এই তার যে, জীবন যেখানে অতিষ্ঠ, সেখানেও মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হবে? সমাজে এক্ষেত্রেও নারীকেই দোষারোপ করি।কিন্তু স্বাধীন মানুষ স্বাধীন সত্তার যুগে সবাই বেশ কিছুটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে! একে অন্যকে শ্রদ্ধা করার জায়গাটা কমে এসেছে! নাগরিক জীবন ও যান্ত্রিকতাকে ব্যলেন্স করা যায় না বলেই হয়তো এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে! নারীর স্বাধীনতার মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলে একজন মেয়ে, বোন, স্ত্রী, মা হয়ে সমাজের প্রতিপদে তারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে।
নারীর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার, তার মর্যাদা ও তার ক্ষমতায়ন সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষের সমপর্যায়ে নারী প্রতিষ্ঠিত হলে মানব-সভ্যতাও বিস্ময়করভাবে পরিপুষ্ট হবে।
নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সমাজ বা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, তা জানা জরুরি! পরিবার থেকেই নারী-পুরুষের বিভেদ শুরু হয়। তাই পরিবারই পারে নারীকে সুযোগ্য মর্যাদা দিতে। শুধু ৮ মার্চ ঘটা করে ‘বিশ্ব নারী দিবস’ পালনের কোনো মানে হয় না। বরং প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত নারীর জীবনকে সুরক্ষিত ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা হোক। কিছু হলেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র চোখ বুজে নির্দ্বিধায় বলে ওঠে, নারীর দোষ। কিন্তু যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচারটা কেউ করতে চায় না। অথচ এটাই নৈতিক দায়িত্ব। যার চর্চা সমাজে খুব কম! পুরুষ বা নারী দুজনেই একটা ভালো সমাজ গঠনের মূল কারিগর। সেক্ষেত্রে নারীকে আলাদাভাবে বিভাজন করা উচিত নয়।
শুধু অর্থনৈতিক সচ্ছলতাকে নারীর স্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করা যায় না। বরং তাকে সুন্দর-সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপনে সাহায্য করাই নারীর স্বাধীনতা। পুরুষ বা নারীর শ্রেণীবিভেদ কাম্য নয়। বরং উভয়কে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নারীর অধিকার ক্ষুণ্ণ করা চলবে না, তার ওপর নির্যাতন চলবে না। বরং নারী- পুরুষ সবাইকে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে হবে যৌথভাবে। কণ্ঠ মেলাতে হবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর বাণীর সঙ্গে। বলতে হবে,
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
ভালো-মন্দের বিভেদ বুঝে সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। আর তা প্রত্যেকের পালন করা একান্ত কর্তব্য। নারী বা পুরুষ কেউ কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বরং সহযোগী হওয়াটাই শ্রেয়। কেউ কারও দাস-দাসিতে পরিণত না হয়ে, স্বাধীনভাবে গড়ে উঠুক জীবন। জীবনের রঙ্গমঞ্চে সবাই সহযোগী হলেই কেবল মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব। নারী-পুরুষ উভয় মিলে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলাটাই আমাদের কাম্য।
নারীর স্বাধীনতা কতটুকু রক্ষিত হয়েছে সেটা না জানলেও বর্তমান সমাজে নারীদের যে অগ্রগণ্য ভূমিকা, তা চোখে পড়ার মতো। মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভালো ফল করছে, চাকরির ক্ষেত্রেও দিনদিন নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। তারা একাধারে পরিবার যেমন সামলে চলেছে তেমনি পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে দ্বিধা করছে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অর্থনীতির দিকে লক্ষ করলে বুঝতে পারি, নারীর অবদান কতটা! নারীর স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা গেলে নারীদের অংশগ্রহণ আরও জোরালো হবে। জাতীয় জীবনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে হলে দেশ ও জাতিগঠনে নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার, তার মর্যাদা ও তার ক্ষমতায়ন সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষের সমপর্যায়ে নারী প্রতিষ্ঠিত হলে মানব-সভ্যতাও বিস্ময়করভাবে পরিপুষ্ট হবে। সহযোগিতা ও সহমর্মিতা চর্চার মাধ্যমে জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরানো সম্ভব।
আরও পড়ুন: করোনায় সমাজ ও অর্থনীতি ॥ জান্নাতুল যূথী