রঞ্জন বিয়ে করেছে মাত্র এক সপ্তাহ হলো। এখনো গ্রামের বাড়িতে বউকে নিয়ে মা-বাবার কাছে যায়নি। চিন্তা করলো, আরও এক সপ্তাহখানেক পড়ে বউকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। কিন্তু মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে। কারণ, সে মা বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে। তাদের কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই হুট করে বিয়ে করাটা তার জীবনের জন্যে চরম ভুল হয়েছে বলে তার কাছে মনে হয়। তার ওপর শহরের মেয়েকে বিয়ে করাটা তার জীবনের জন্যে দ্বিতীয় ভুল হয়। এখন এই বউ গিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারবে কি না, সেটাই তার চিন্তার বিষয়। তবু অনেক মোটিভেশন দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে রঞ্জন রুমে ঢুকে। ওই সময় তার বউ শিউলী মোবাইল নিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। রঞ্জন খাটের ওপর বসে বললো, মোবাইলটা একটু রেখে দাও। আমি একটু কথা বলি।
শিউলী: জরুরি ম্যাসেজ লিখছি। একটু সময় অপেক্ষা। হুম, এখন বলতো পারো
রঞ্জন: ভাবছি, আগামীকাল আমরা গ্রামের বাড়িতে যাবো।
শিউলী: কী বলছ এসব! আগামীকাল সকালে যাবো? আর কটা দিন অপেক্ষা করলে হয় না? তারপর না হয় আমরা যাবো!
রঞ্জন: আরে! আমি তোমার মতো একটা সুন্দরী, আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছি, শিক্ষিত পরিবারের স্মার্ট মেয়ে বিয়ে করেছি, সেটা গ্রামের মানুষকে দেখাতে হবে না?
শিউলী: আর এটা মনে রেখো, আমি কিন্তু শহরের ভদ্র পারিবারের মেয়ে। আর একটা আলাদা মর্যাদা আছে। সেটা যেন গ্রামে গিয়ে নষ্ট না হয়।
রঞ্জন: সেটা আমি সবই জানি। তুমি দেখো, গ্রামের বাড়িতে গেলে মানুষজন তোমাকে দেখার জন্যে ভিড় করবে। সেটা কি তোমার কাছে ভালো লাগবে না? ওরা তোমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে! তখন তো আমার খুবই গর্ব হবে। আমি তোমার মতো সুন্দরী আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছি।
শিউলী: কিন্তু গ্রামের পরিবেশ যে আমার ভালো লাগবে না। আমি যে মানিয়ে নিতে পারবো না।
রঞ্জন: তোমার কোনো সমস্যা হবে না। তোমার যা কিছু লাগে, সবই আমি ব্যব্যস্থা করবো। এ নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না।
শিউলী: ঠিক আছে। তাহলে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।
রঞ্জন: সবকিছু গুছিয়ে নাও।
০২.
সকালে রঞ্জন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রস্তুত করে যাওয়ার জন্যে। এদিকে শিউলীকেও জাগিয়ে তোলে। রঞ্জন বারান্দায় পায়চারী করছিল তখন। আর শিউলী প্যান্ট শার্ট পরে বারান্দায় এসে রঞ্জনকে বললো, এবার চল, আমি প্রস্তুত!
রঞ্জন হা করে শিউলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বললো, তুমি এ পোশাকে বাড়িতে যাবা?
শিউলী: তুমি একেবারে হা করে তাকিয়ে আছ কেন? আর তাছাড়া অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। এই পোশাকে গেলে সমস্যা কোথায়? আমি তো ছোট বেলা থেকেই এভাবেই বড় হয়েছি।
রঞ্জন: আমাদের গ্রামের মানুষ দেখলে তো আরও অবাক হয়ে যাবো। সবাই হা করে তাড়িয়ে থাকবে। গ্রামে এসব চলে না। এভাবে গ্রামে যেতে হয় না। তুমি পোশাক পরিবর্তন করে আসো।
শিউলী: আমি তো আর অন্যদের মতো নই। আমি শহরের মেয়ে তো। আর তাছাড়া শিক্ষিত। ওরা অবাক হলে আমার তো যায় আসে না।
রঞ্জন: এ অবস্থায় আমার মা বাবা দেখলে তারা কী মনে করবে? এটা তো ওরা কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখবে না। তুমি শাড়ি পরে আসো।
শিউলী: তুমি জান না, আমি শাড়ি পরতে পারি না।
রঞ্জন: যদি সেটাও না হয়, তাহলে স্যলোয়ার কামিজ পড়ে আসো। অন্তত সেটাও মন্দ হবে না।
শিউলী: আমি স্যালোয়ার কামিজও পরতে পারি না। কিন্তু তোমার কথায় আমি পড়ছি। জানি না, কেমন হবে!
রঞ্জন: তবু ভালো হবে। সেটাই পরে আসো।
তোমাদের কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন বউ এখানে এনেছি এটা তো এই গ্রামের ভাগ্য। তোমাদের আর আমাদের ভাগ্য।
দু’জনে রাস্তায় বের হতেই রঞ্জন একটা রিকশা ডাকলো। তারপর রিকশায় চড়ে বাস স্টেশনের দিকে রওনা হলো। স্টেশনে পৌঁছালে শিউলী বললো, এখানে কী জন্যে আসলাম?
রঞ্জন: বাসে করে গ্রামের বাড়িতে যাবো।
শিউলী: আমি কেনো বাসে যাবো। তুমি গাড়ি ভাড়া করোনি?
রঞ্জন: ওই ক্ষমতা আমার নেই। তাছাড়া আমার গ্রামে যেতে হলে বাসই যথেষ্ট।
শিউলী: বাসে এসি আছে তো!
রঞ্জন: এসি বাস নেই। লোকাল বাসেই গ্রামে যেতে হবে।
শিউলী: তুমি আমাকে লোকাল বাসে করে নিয়ে যাবা? তারপর কিভাবে যেতে হবে?
রঞ্জন: আমাদের বাজারে গেলে সেখান থেকে ভ্যানে করে বাড়িতে যাবো।
শিউলী: ভ্যানে করে কেনো? ভ্যানে তো মালামাল বহন করে মানুষ। সেটাতে আমি উঠবো কেনো?
রঞ্জন: আমাদের গ্রামে সকলে ভ্যানে করে যাতায়াত করে। খরচ কম।
শিউলী: হায় হায়, তুমি এটা কী বলছ? আমি একটা ভদ্র পরিবারের শিক্ষিত মেয়ে।
রঞ্জন: আমিও তো আধুনিক শিক্ষিত ছেলে। আমাদের গ্রামে সবাই ভ্যানে চলাচল করে। গ্রামের পরিবেশ দেখতে দেখতে হাওয়া খেতে খেতে আমরা যাবো।
শিউলী: আহা করে আমি ভ্যানে উঠলে লোকে কী বলবে। আমি একজন শিক্ষিত মেয়ে; আর তুমিও শিক্ষিত একজন। তোমার তো এসব বোঝা উচিত।
রঞ্জন: সব জায়গায় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াটাই শিক্ষার ধর্ম হওয়া উচিত। আর আমাদের গ্রামেও শিক্ষিত মানুষ রয়েছে। তাড়াও ভ্যানে উঠে যাতায়াত করে।
শিউলী: আচ্ছা, ঠিক আছে এখন চল। কী আর করা যায়, তোমার পাল্লায় পরেছি যখন, তখন তো যেতেই হবে।
যেতে যেতে গ্রামের এক যুবক সাজু, রঞ্জনকে চিনতে পেরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, ও রঞ্জন দাদা, কখন শহর থেকে আসলেন? আর আপনার পাশে যে আছে সে কে?
রঞ্জন: আমার বউ! তোমার বৌদি হবে।
সাজু: কবে বিয়ে করলে গো দাদা। ইস! কী সুন্দর বৌদি! একেবারে চাঁন্দের মতো দেখতে গো। এত সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আমাদের গ্রামে এ রকম মেয়ে নেই। বৌদির সঙ্গে যদি একটা সেলফি উঠাতে পারতাম।
রঞ্জন: পরে উঠাতে পারবা। এখন ঘরে যাই। ক্লান্ত হয়ে গেছি। বিকেলে তুমি আমাদের বাড়িতে এসো। তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে।
যেতে যেতে ভ্যান রঞ্জনদের বাড়ির উঠানে গিয়ে থামলো। দূর থেকে মা দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে ছুটে এলো; আর ‘বাবা কেমন আছিস?’ বলে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে রঞ্জনের মা মহাখুশি হয়ে গেলো। তারপর মেয়েটিকে দেখে হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, এই মেয়েটি কে আবার?
রঞ্জন বললো: তার নাম শিউলী। আমরা বিয়ে করেছি। সে তোমাদের বউমা।
তারপর শিউলীর দিকে তাকিয়ে বললো, এই হলো আমার মা বাবা; মানে ফাদার ও মাদার।
শিউলী গ্রামের কুৎসিত চেহারা আর রঞ্জনের মাকে বিশেষ গ্রাম্য কায়দায় সাধারণ শাড়ি পড়া দেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার তাকালো। তারপর রঞ্জনের বাবা রঙিন লুঙিন আর ময়লা গেঞ্জি পরা দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রঞ্জন শিউলীকে প্রণাম করার ইশারা করায় বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর শিউলী বললো, হাই মম, হাই ডেড।
রঞ্জনের মা বাবা হা করে তাকিয়ে রইলো। তারা বুঝতে পারলো না কী বলেছে।
রঞ্জনের মা: তো তুমি বিয়ে করেছ, আমাদের জানিয়েছ? এছাড়া বউ বাড়িতে আসবে শাড়ি পইরা। আর সে এসব কী পইরা আইছে রে বাবা। এটা কেমন বউ হইলো।
শিউলী: এক্সকিউজ মি ডেড। এটাই এখন ফ্যাশন। এটাকে বলে প্লাজো। এখন মানুষ এসবই পড়ে।
রঞ্জনের মা বাবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর রঞ্জনের মা বললো: যাও বউকে ঘরে নিয়া গিয়া শাড়ি পরতে বলো। গ্রামের মানুষক এসব দেখলে হৈ চৈ পড়ে যাবে। মানুষ হাসাহাসি করবো।
রঞ্জন: তোমাদের বউমা হলো ভদ্র পরিবারের শহরের আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে। আর আমিও শিক্ষিত মানুষ। সুতরাং আমাদের জীবনটাই এমন।
রঞ্জনের বাবা বললো: তোরে এই বউরে গ্রামে কেন আনতে বলেছে?
রঞ্জন: তোমরা তো বাবা বুঝতে পারলে না, আমার বউ হচ্ছে ফেসবুক সেলিব্রেটি, টিকটাক সেলিব্রেটি। বিরাট ধনী লোকের মেয়ে। আর তোমরা এ সব কী বলছ।
তোমাদের কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন বউ এখানে এনেছি এটা তো এই গ্রামের ভাগ্য। তোমাদের আর আমাদের ভাগ্য।
রঞ্জনের মা: আরে হইছে হইছে, এখন বউরে ঘরের ভেতরে নিয়া যাও।
রঞ্জন আর শিউলি ঘরে ঢুকে গেলো।
তারপর সংসারের অন্যান্য সমস্ত কাজ করে কলসি নিয়ে জল আনে। রান্নাঘরের রান্নাবাড়ি করে। সংসারের সমস্ত কাজ করে। আর এই মেয়েটা কি তোমার সংসারের এসব কাজ করবে? বউ হয়ে আমরা আমাদের শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন করেছি। এটাই নিয়ম। আর এখন তোমার বউয়ের সেবা যত্ন করবো? তার জন্যে নাস্তা বানাবো, তাই না?
এদিকে রঞ্জনের মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পরে রঞ্জনের মা রঞ্জনের বাবার দিকে বললো, এসব কী কইলো মেয়েটি? বাবারে কইলো ডেড, আর আমারে কি জানি কইলো মেয়ে?
রঞ্জনের বাবা: মনে হয় তোমারে মম কইছে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রঞ্জনের মা বললো: হায় হায় এ কেমন মেয়েরে বাবা?
রঞ্জনের বাবা খাটের ওপর বসতে বসতে বললো, আমার তো মাথা ঘুরতাছে।
রঞ্জনের মা: ছেলেটি কেমন বউ আনলো? আমাদের একটু জানাইলো না। ছেলেটা আমাদের কি সম্মান করলো। এটা মানছি যে, ছেলেটা লেখাপড়া করেছে। তাই বলে আমাদের সম্মান পর্যন্ত করলো না। তাছাড়া মেয়েটার মধ্যে কোনো ভদ্রতা পর্যন্ত নাই। কোনো প্রণাম করলো না। হাই হাই করে কী সব বললো!
রঞ্জনের বাবা: এসব কথা তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর গিয়া। হাই হাই করা বউ নিয়া ঘরে ঢুকছে। তার পেছনে এতো টাকা খরচ করলাম। আর সে কিনা এমন সর্বনাশ করলো!
রঞ্জনের মা: ছেলেটা তো সর্বনাশের মতো কাম করছে। গ্রামের ছেলে হয়ে তার শহরের মেয়ে বিয়ে করা মোটেও উচিত হয়নি।
রঞ্জনের বাবা: এটা কি কইতাছো?
রঞ্জনের মা: ঠিকই কইতাছি। শহরের মেয়েরা গ্রামের পরিবেশে থাকতে চায় না, গ্রামে থেকে সংসার করতে চায় না। ওরা সংসার বুঝে না। ওরা গ্রামে পিকনিক করতে। গ্রামের মানুষদের দেখতে আসে কিছুদিনের জন্যে। গ্রামে থেকে শহরের মেয়েরা করতে চায় না। গ্রাম তাদের ভালো লাগে না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। আমাগো উত্তর পাড়ার ঘটনা তো তুমি জানই। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা অজুহাত দেখাইয়া ডিভোর্স দিয়া চইলা গেছে। মেয়েটা শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান পর্যন্ত করতো না। অশিক্ষিত বলে অবহেলা আর অপমান করতো।
রঞ্জনের বাবা: কি সব বলছো। এই মেয়েটা তো ভালো। তুমি শুনেনি, রঞ্জন বলেছে মেয়েটা ভদ্র ও আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে। আমারে কইলো ডেড, আর তোমারে কউলো মম।
রঞ্জনের মা: সাথে ছেলেটাও যেন কেমন হয়ে গেছে। আচ্ছা, বলতো আধুনিক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কি এমনই হয়?
রঞ্জনের বাবা: মেয়েটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে। তোমার ছেলেতো তাই কইলো।
রঞ্জনের মা: যদি তাই হয়, তাহলে অভদ্র লোকের মেয়ে জানি আরো কেমন হয়!
রঞ্জনের বাবা: আসলে তোমার ছেলেটা একেবারে বোকা। শহরে থেকে কলেজে লেখাপড়া করলো। আর সে আমাদের এতো বড় প্রতিদান দিলো। আমাদের একটু জানানোর প্রয়োজনও মনে করলো না। আচ্ছা, কও তো তোমার ছেলে এই মেয়ে নিয়া কয়দিন সংসার করতে পারবো?
রঞ্জনের মা: আমারো মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না। বউ আমাদের একেবারেই পছন্দ হয় নাই। এখন তুমি গিয়া কও এই বউ ফেরত দিয়ে দিতে।
রঞ্জনের বাবা: বাহ্! এটা কি দোকানের মাল নাকি যে কিনে নিয়ে আসলাম; আর পছন্দ হইলো না, বদল করে নিয়া আসবো।
রঞ্জনের মা: এটা কেমন বউ। শাড়ি পড়ে না, কেমন কেমন জামা কাপড় পড়ে। চুলগুলো লাল লাল। কথাবার্তায় বেটা বেটা ভাব।
০৩
শিউলী ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিল। তার কাছে গ্রামের পরিবেশ আর এই ঘরে থাকা একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। জলের মাছ যেমন ডাঙায় রেখে দিলে লাফালাফি করে, তেমনি তার মনটাও লাফালাফি করছিল। তার ইচ্ছে করছিল একেবারে দৌড়ে ছুটে পালায়। ফিসফিস করে শিউলী বলছিল, ডিজগাস্টিং! এমন নোংরা পরিবেশে আমি কেমন করে থাকবো? এখানে মানুষ থাকে নাকি। চারিদিকে কেমন নোংরা নোংরা।
এমন সময় রঞ্জন ঘরে ঢুকলো। তখন শিউলী বললো, এই যে মশাই। তুমি আমাকে এ রকম পরিবেশে কেন নিয়ে আসছ? তুমি জান না আমি এ ধরনের পরিবেশ একেবারে পছন্দ করি না। তুমি জান না, আমি শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত আর ভদ্র মেয়ে। আমি এ রকম নোংরা পরিবেশে কিভাবে থাকবো?
রঞ্জন: এখানে নোংরা কি দেখলা? গ্রামের পরিবেশই তো এমন!
শিউলী: তুমি এসব কি বলছো, এটা তো টিনের ঘর। এখানে আমি থাকবো কিভাবে? এখানে আমাকে মানায় বলতো? এখানো কোনো এসি নাই, ফ্যান নাই।
রঞ্জন: আরে, এটা তো টিনের ঘর। এখানে আমি এসি লাগাবো কিভাবে? তুমি জানালা দেখছো না, জানালা দিয়ে প্রকৃতির বাতাস হু হু করে ঢোকে। এর চেয়ে আর কী ভালো আশা করতে পারো বলতো! এখানে গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যায়। এসি ফেল হয়ে যায়।
শিউলী: তুমিও এসব বলছ? তুমি আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছ তো? আর আমি বা তোমাকে কী বলবো? আমার কিছু বলার নেই।
এরপর শিউলী ধপাস করে খাটের ওপর বসে পড়লো মনমরা হয়ে। শিউলীর কাছে একেবারে কিছুই ভালো লাগছে না।
পরের দিন সকালে শিউলী মাথায় চিরুনি দিতে দিতে বললো, আমি কিন্তু সকালে ভাত খেতে পারবো না। আমার কফি লাগবে, ডিম ভাজি লাগবে, পরোটা লাগবে।
রঞ্জন: গ্রামের মধ্যে এসব চা কফি নাস্তা আমি কোথায় পাবো? এখানে এসব পাওয়া যায় না।
শিউলী: সেটা আমি কী জানি? আচ্ছা, তোমার মা আছে না! তোমার মাকে বলতে পারো আমার জন্যে পরোটা বানিয়ে দিতে!
রঞ্জন: তোমার জন্যে নাস্তা বানাতে তোমার শাশুড়িতে বলতে পারি আমি? এটা কি বলা ঠিক হবে?
শিউলী: মাকে কেন এটা বলা যাবে না? তাছাড়া তাকে এসব বললে সমস্যা কী?
রঞ্জন: ঠিক আছে তুমি কোনো সমস্যা করো না, আমি ব্যবস্থা করছি!
এরপর রঞ্জন ঘর থেকে বের হয়ে তার মাকে গিয়ে বললো, মা, তোমাদের বউ চা নাস্তা ছাড়া কিছু খায় না সকালে। তার জন্যে পরোটা আর চা অথবা কফি বানিয়ে দিও।
রঞ্জনের মা হতবাক হয়ে গেলো ছেলের মুখে এসব কথা শুনে। ভাবলো, ছেলেটা কী শিক্ষা পেয়েছে? এছাড়া তারই বা এত বড় সাহস হয় কিভাবে আমাকে এভাবে কথাটা বলতে? তারপর রঞ্জনের মা বললো, আমি তোমার বউয়ের জন্যে নাস্তা বানাবো? এই কথা তুমি আমাকে বলতে পারলা?
রঞ্জন: আরে মা সে তো সাধারণ মেয়ে না। তাছাড়া তার মতো মেয়ে এই গ্রামে আছে নাকি। এটা তো তোমাদের বোঝা উচিত।
রঞ্জনের মা: বরং তোমার বউকে সকালে উঠে সবার জন্যে নাস্তা তৈরি করতে বলো। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দিবে আর কলসিতে ভরে পানি আনবে। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে নাস্তা তৈরি করবে। এটা একটা বউয়ের জন্যে বড় দায়িত্ব। সংসার এভাবেই শুরু করতে হয়। তোমারই বা এত বড় সাহস হলো কিভাবে আমাকে তোমার বউয়ের জন্যে নাস্তা তৈরি করার কথা বলা?
রঞ্জন: সে তো গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো নয়। এটা বুঝতে পারছ না কেন?
রঞ্জনের মা: এটা তুমি বুঝ না। তোমাকে কে বলেছে শহরের মেয়ে বিয়ে করতে? এসব মেয়ে নিয়ে গ্রামের পরিবেশে সংসার করা যায়? আমাদের পাশের বাড়ির সংসারটা এভাবে ভেঙে গেছে সেটা তুমি জান না। তুমি তো লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছ, আধুনিক শিক্ষিত হয়েছো। তোমার তো এসব বোঝা উচিত। ওরা শহরের পরিবেশে বড় হয়ে গ্রামে থাকতে পারে? ঠিকতে পারে? তুমি কি বুঝে তাকে বিয়ে করেছো? আমরা গ্রামের মানুষ। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, শিখে আসছি, ঘরের বউরা সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দেয়। তারপর সংসারের অন্যান্য সমস্ত কাজ করে কলসি নিয়ে জল আনে। রান্নাঘরের রান্নাবাড়ি করে। সংসারের সমস্ত কাজ করে। আর এই মেয়েটা কি তোমার সংসারের এসব কাজ করবে? বউ হয়ে আমরা আমাদের শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন করেছি। এটাই নিয়ম। আর এখন তোমার বউয়ের সেবা যত্ন করবো? তার জন্যে নাস্তা বানাবো, তাই না?
আর এদিকে মা উঠো দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মুখে কোনো কথা বলতে পারে না। আর বাবার মুখেও কোনো কথা বের হয় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।
রঞ্জন মাথা নিচু করে রইলো। তার মুখে কোনো কথা বের হলো না। মনে মনে ভাবলো, মহাবিপদের ভারী বোঝা মাথা নিয়েছে মনে হচ্ছে। রঞ্জনের মা ঘরে ঢুকে সংসারের অন্যান্য কাজ করতে লাগলো। তারপর মনমরা হয়ে চেয়ারে বসে রইলো। ভাবতে লাগলো, ছেলের এমন আচরণ নিয়ে। ছেলের কথাবার্তা শুনে মা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না।
রঞ্জনের বাবা সকাল সকাল বাজার করে ঘরে ঢুকে চিন্তিত দেখে বললো, কী ব্যপার, তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে! মনে হচ্ছে, বউ দেখে তুমি মোটেও খুশি হওনি।
রঞ্জনের মা: হুম! আমি খুশি হইছি ডিসকো বউ দেইখা। আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে।
রঞ্জনের বাবা: ও, তোমার বুঝি নাচতে ইচ্ছে করছে। ভালো ভালো খুব ভালো। তাহলে হেলিয়ে দুলিয়া কোমড় দুলাইয়া নাচতে থাকো।
রঞ্জনের মা: তোমারে মনে হইতাছে খুবই খুশি হইলা!
রঞ্জনের বাবা: আমিও মনের দুঃখে এসব বলতাছি গো! তুমি বুঝতে পারছ না?
রঞ্জনের মা: তোমার ছেলে আমাকে কি বলছে জানো তুমি?
রঞ্জনের বাবা: কী বলছে?
রঞ্জনের মা: কইছে, তার বউয়ের জন্যে চা নাস্তা বানাইতাম!
রঞ্জনের বাবা হতভম্ব হয়ে গেলো। এটা কি কথা! ছেলেটা এতো সাহস পেলো কোথা থেকে?
তারপর রঞ্জনের বাবা বললো, তোমারে কয় তার বউয়ের জন্যে চা নাস্তা বানাতে, তার সেবা যত্ন করতে। দাঁড়াও, একটু অপেক্ষা করো। ঘুম থেকে উঠুক, তারপর আমি দেখতাছি কী করা যায়।
রঞ্জনের মা: এ কেমন বউ! আমরা সকলে মিলে তার সেবা যত্ন করবো! পরিবারে কেমন শিক্ষা পাইলো!
রঞ্জনের বাবা: আচ্ছা, আজ শিখিয়ে দেবো কিভাবে সেবা যত্ন করতে হয়। যে ছেলের জন্যে আমরা এত কিছু করলাম সেই ছেলে কি না, বলে তার বউয়ের সেবা যত্ন করতে।
০৪.
শিউলী: শোনো, আমার কিন্তু গ্রামের অখাদ্য একদম ভালো লাগবে না।
রঞ্জন: কেন কী হয়েছে? আমার মায়ের রান্না তো মোটেও খারাপ না। খুবই ভালো তো। আমার মনে হয়, তুমি অভ্যস্ত নয় তো তাই এভাবে বলছ। তাই তোমার কাছে সবকিছু কেন জানি খারাপ লাগছে।
শিউলী: ভালো রান্না করে! গ্রামের এসব খাওয়া যায়? আমার এসব খাবার রুচিতে বাধে। তুমি জানো না, আমি ভদ্র লোকের মেয়ে, শহরের শিক্ষিত মেয়ে। তুমি আমার সম্পর্কে জানো না, আমি হোটেলে খেয়ে অভ্যস্ত।
রঞ্জন: রাগ করো না শোনা।
শিউলী: আচ্ছা, তুমি কেনো আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ বলো তো। আমার একদম ভালো লাগছে না।
রঞ্জন: আরে, দেখছো না, গ্রামের মানুষ তোমাকে দেখলে অবাক হইয়া তাকিয়ে থাকে। আমি যে একজন বড় লোকের মেয়েকে, শিক্ষিত শহরের আধুনিক মেয়েকে বিয়ে করছি সেটা দেখানোর জন্যেই তোমাকে নিয়ে এসেছি। সবাই তোমাকে দেখে কত অবাক হয়!
শিউলী: আমার এসব একদম ভালো না।
রঞ্জন: অপেক্ষা করো। আস্তে আস্তে সবই ভালো লাগতে শুরু করবে।
শিউলী: আমার জন্যে বাইরের খাবার নিয়ে এসো। আমি ঘরে খেতে পারবো না।
রঞ্জন: অপেক্ষা করো। আমি কাজের মেয়ে নিয়ে আসবো।
শিউলী: এই পরিবেশই আমার ভালো লাগে না। এখানে যতই আমার জন্যে কাজের লোক নিয়ে আসো, আমার কিছুই ভালো লাগবে না।
রঞ্জন একেবারে চুপ হয়ে গেলো। হতভম্ব আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ভাবতে লাগলো, কী সমস্যা! এই সমস্যা দূর করা মোটেও সম্ভব নয়। নিজেকে বড়ই বোকা আর অপরাধী মনে হচ্ছে। কিভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায় ভাবতে লাগলো। এমন সময় শিউলী এসে রঞ্জনকে বললো, চলো, আমরা তোমাদের উঠোনে কয়েকটা সেলফি তুলি।
ওরা সেলফি তুলছে এমন সময় রঞ্জনের বাবা পেছন থেকে এসে চিৎকার করে বললো, বন্ধ কর এসব রঙঢঙ! তুমি কোন লাট সাহেবের মেয়ে। প্যান্ট পইরা ঘুরে বেড়াবা। আর উঠোনে রঙঢং করে সেলফি তুলবা! সকাল হলে তোমার শাশুড়ি তোমাকে নাস্তা বানিয়ে দেবে, এটা তোমার কী ধরনের শিক্ষা? গ্রামে আইছ শাড়ি পরো। রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্না শুরু কর। সংসারে দায়িত্ব বুঝে নাও। আর তুমি এভাবে চলতে পারবা না এই গ্রামে। সংসার করতে চাইলা মন দিয়ে তোমাকে সংসার করতে হবে।%