(পর্ব-১৯)
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ছোটবেলায় ছিলেন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। পরিণত বয়সে যখন তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন, কেউ একজন তাঁর কাছে জানতে চাইলেন—স্মৃতিশক্তি বাড়ানো যায় কিনা? জবাবে আইনস্টাইন বললেন, ‘আমার ছোটবেলা এবং বর্তমানের মাঝে তুলনা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন।’ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনস্টাইনকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। বিজ্ঞানী এবার তাঁর মাকে চিঠি লিখলেন, ‘মা, এতদিনে তোমার বোকা ছেলেটা একজন অধ্যাপক হতে যাচ্ছে, ঠিক যেমনটি তুমি আশা করেছিলে।’
সর্বকালের সর্বসেরা এই বিজ্ঞানীর জীবনে অনেক মজার মজার ঘটনা আছে। এক অভিনেত্রী একবার আইনস্টাইনকে প্রস্তাব করলেন—‘চলুন, আমরা বিয়ে করি। তাহলে আমাদের সন্তান হবে আপনার মতো বুদ্ধিমান, আমার মতো সুন্দর।’ বিজ্ঞানীর উত্তর—‘যদি উল্টোটি হয়—আমার মতো কুৎসিত, আর আপনার মতো নির্বোধ!’
আরেকদিনের ঘটনা। আইনস্টাইন সেমিনারে বক্তৃতা করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়তেন। একই বিষয়ে বারবার কথা বলতে তাঁর ভালো লাগতো না। একদিন তাঁর গাড়িচালক বললেন—‘স্যার, বেয়াদবি না নিলে একটা প্রস্তাব দিতে পারি।’
‘বলো।’
‘আমি বিজ্ঞানের ছাত্র এবং শিক্ষিত। আপনার প্রতিটি সেমিনারে আমি গিয়েছি। বলতে গেলে সবকিছুই আমার মুখস্ত। আপনি যদি অনুমতি দেন—তবে আজকের আলোচনায় আমি অংশগ্রহণ করবো। আপনি শুনবেন।’
‘যদি কেউ চিনে ফেলে?’
‘স্যার, আপনাকে সবাই নামে চেনে। কিন্তু দেখেছে খুব কম মানুষ। তাছাড়া আপনার এবং আমার দেহের গঠন একই রকম। শুধু হেয়ার স্টাইল পরিবর্তন করলেই হয়ে যাবে।’
আইনস্টাইনের অনুমতি পেয়ে ড্রাইভার ডায়াসে উঠলেন। টাইয়ের নট ঠিক করে বক্তৃতা শুরু করলেন। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন দর্শকরা। এরপর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। পুরনো ছকবাঁধা প্রশ্ন। গড়পড়তা উত্তর দিচ্ছেন ড্রাইভার। হঠাৎ একজন কঠিন এবং নতুন প্রশ্ন করে বসলেন। ড্রাইভার ঘামছেন। কী করা যায়! উত্তর দিতে না পারলে আইনস্টাইনের মানসম্মান শেষ! কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্তি বোধ করছি। আপনাদের যাবতীয় প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার জন্য আমি আমার ড্রাইভারকে মঞ্চে পাঠাচ্ছি।’ এবার মঞ্চে উঠলেন সত্যিকারের আইনস্টাইন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আইনস্টাইন নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রস্তাব দেন। যার ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় হিরোশিমা ও নাগাসাকি। পরবর্তীতে অনুশোচনা করে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেদনপত্রে সই করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’
সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যর্থতা মার্কসকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিল। তিনি এমনই হতাশ হয়েছিলেন এবং ভেঙে পড়েছিলেন যে, ডাক্তার তাকে নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে দীর্ঘ বিশ্রামের উপদেশ দিলেন। বিশ্রামকালে বাবাকে মার্কস জানালেন, ‘কবিতাকে বিদায় দিয়েছি। এবার আমার উপাস্য অর্থশাস্ত্র।’
কার্ল মার্কস অল্পবয়সে ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে ও রগচটা। ছোটবেলা থেকে মার্কসের বন্ধুরা তাকে ‘মুর’ বলে সম্বোধন করতো। স্ত্রী জেনিও তাকে এ নামেই ডাকতে পছন্দ করতেন। এ নামে ডাকার কারণ হচ্ছে—মার্কসের চেহারা নাকি দেখতে মরক্কো অর্থাৎ উত্তর আফ্রিকার অধিবাসীদের মতো। ছোটবেলায় মার্কস অল্পেতেই রেগে যেতেন। শৈশবে মার্কসের ওপরে আধ্যাত্মিক প্রভাব পড়েছিল। এর উৎস ছিল প্রতিবেশী একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার। সেই পরিবারের প্রধান ব্যারন ভন অযেস্তফালেন ছিলেন মার্কসের বাবার বন্ধু। তিনি ছিলেন মার্কসের বাবার চেয়েও উদার। পারিবারিক বন্ধু হওয়ায় মার্কস ঘন ঘন ওই বাড়িতে যাওয়া–আসা করতেন। কারণ, সেই বাড়িটির নিচ তলায় ছিল বিশাল একটি লাইব্রেরি। সেখানে হোমার, শেকসপিয়ার, বায়রনের লেখাগুলো থরে থরে সাজানো ছিল।
কার্ল মার্কসের বাবা হার্সেল মার্কস ছিলেন আইনজীবী। ব্যারিস্টার বাবার কাছ থেকে দার্শনিক ভলতেয়ার আর রেশিনের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন মার্কস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও বেশি বইয়ের ভুবনে আরও বেশি নিমজ্জিত হয়ে পড়লেন। বাবার মতো শেকসপিয়ারের অনেক রচনার অংশ বিশেষ তিনি মুখস্ত বলতে পারতেন। গ্রিক দর্শনের দ্যোতনাও তাঁর মনকে এড়িয়ে যায়নি। পৌরাণিক রচনা হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি তো ছিলই, সঙ্গে আরও পরিচিত হয়েছিলেন থালেস, ডেমোকক্রিটাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের রচনার সঙ্গে। যুবক বয়সে মার্কসের আগ্রহের পরিধি কেবল বইয়ের জগতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। লাইব্রেরির নিভৃত পরিবেশে তিনি ব্যারন ভন অয়েস্তফালেনের কন্যা জেনির প্রেমে পড়েছিলেন। মার্কসের চেয়ে চার বছরের বড় ছিল জেনি। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও মার্কসের মধ্যে গ্রিক পৌরাণিক বীর প্রমিথিউসের মন দেখেছিলেন জেনি। মার্কসের বৈপ্লবিক বিজ্ঞতার মাঝে পৌরাণিক চরিত্রের অমৃতসম প্রতিচ্ছবি দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। সেই অনুভূতি রূপান্তরিত হয়েছিল গভীর ও সর্বগ্রাসী প্রেমে।
মার্কসের বাবা পণ্ডিত গোছের মানুষ হলেও মা হেনরিয়েটা অর্ধশিক্ষিতের পর্যায়ে পড়েন। মা ছিলেন প্রবলভাবে ধর্মাশ্রিত মনের মানুষ। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পর ছেলেকে তিনি মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন। বলতেন, ‘বাবা, মার্কস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে চেষ্টা করো। তোমার পড়ার ঘর যেন পরিষ্কার থাকে। সাবান আর স্পঞ্জ ব্যবহার করে ঘর পরিষ্কার রাখবে’, ইত্যাদি। এসব প্রীতি- স্নেহভাজন কর্থাবার্তা বা উপদেশ কার্ল মার্কসকে আরও বেশি রাগান্বিত করতো। তবে এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও মা হেনরিয়েটার প্রায়োগিক জ্ঞান ছিল প্রখর। মার্কস সেটি টের পেয়েছিলন ছোটবেলা থেকে জীবনের মধ্যগগন পর্যন্ত। না-হলে মা যখন টের পেলেন ছেলে অর্থনীতির ওপরে ‘ক্যাপিটাল’ নামে একটি বই লিখেছেন তখন তাঁর মন্তব্য ছিল—‘বাবা, শুনলাম তুমি পুঁজির ওপরে একটি বই লিখেছো। তা বেশ ভালো। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে—তুমি বরং পকেটে কিছু পুঁজি সংগ্রহের ব্যবস্থা করো।’ যদিও পুঁজির শক্তিশালী প্রভাব থেকে মার্কসের জীবন ছিল বহুদূরে।
বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে আইন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করুক। তা-ই হলো। শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৭ বছর বয়সে মার্কসকে আইনশাস্ত্রে পড়তে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলো। বন শহরে মার্কসের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কিছু ইতিহাস আছে। নিজ বাসস্থানের সামনে কয়েক রাত মাতলামির বিষয়টি প্রতিবেশীদের নজর এড়িয়ে যায়নি। পুলিশের কানে তাদের অভিযোগ গেলে মার্কসকে একদিনের জন্য জেল খাটতে হয়েছিল।
একবার বাবা ছেলেকে দেখতে এসেছেন, কিন্তু ছেলে বাসায় নেই। গভীর রাতে ফিরলেন। ঘরে ঢুকে বাবা দেখলেন, সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। ঘরের অবস্থা এমন যে, পা ফেলার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। চারদিকে বই আর কাগজের ছাড়াছড়ি। টেবিলের ওপরে স্তূপকৃত ছাইদানিতে সিগারেটের অসংখ্য অবশিষ্টাংশ, এসবের সঙ্গে চলছে অবিরাম মদ্যপান। মার্কসের জীবনে ধর্মপ্রীতির কণাবিন্দু না থাকলেও একটি ক্ষেত্রে তিনি সমঝোতা করেছিলেন। ধর্ম সংস্কারক মার্টিন লুথারের প্রতি তার একটি সদয় মন্তব্য আছে। এর কারণ, লুথার মদ্যপানকে উৎসাহিত করতেন। দ্বিতীয় আরও একটি কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে লুথারের ধর্মসংস্কারকে মার্কস পুঁজিবাদের প্রসারের মূল কারণ হিসেবে দেখেছিলেন।
১৮৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে ছেলেকে লেখা একটি চিঠিতে বাবা জানান, ‘প্রত্যেক মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা থাকা উচিত, এমনকি কেউ যদি অত্যন্ত প্রতিভাবান স্কলার বা পণ্ডিতও হয়, যেমন- তুমি। তুমি আইনবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ভাবছো, অথচ খরচের ব্যাপারে পুরোমাত্রায় উদাসীন। তোমার ক্ষেত্রে সেটি মোটেও সাজে না।’ ঠিক এসময় অনেকটা বাধ্য হয়ে মার্কসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সাময়িককালের জন্য বন্ধ রেখেছিলেন তাঁর বাবা। ওই সময় মার্কস প্রচুর পয়সা ওড়াচ্ছেন। বাবা দুঃখ করে লিখলেন, ‘ধনীর সন্তানেরা যেখানে পাঁচশো থালেরের বেশি খরচ করে না, সেখানে তুমি করছো সাতশো করে।’
তবে ১৯৩৭ সালে বাবাকে লেখা একটি চিঠি আছে। মার্কস বাবাকে আশ্বস্ত করে জানাচ্ছেন, ‘তুমি যা-ই ভাবো না কেন, আমি কোনও অপদার্থ ছেলে নই। আইনের ওপরে ইতোমধ্যে তিনশো পৃষ্ঠার একটি লেখা লিখেছি। সেখানে নানা ধরনের আইনি প্রত্যয়ের্ বিশ্লেষণ আছে। আমার কবিতা লেখা চলছে, বিয়োগান্ত একটি নাটকও লিখেছি।’ আসল ব্যাপার হচ্ছে—মার্কস এ সময় প্রচুর কবিতা লিখছেন, অধিকাংশই তাঁর স্ত্রী জেনিকে উদ্দেশ করে, আর সেগুলো আবেগের ফুলঝুরিতে পূর্ণ। কবিতার মধ্যে বুক অব লাভ, বুক অব সংস এবং বুক অব ভারস উল্লেখ করার মতো।
বিশেষজ্ঞরা এসব লেখায় কবি গ্যেটে ও মিলারের প্রভাব লক্ষ্য করলেও এক পর্যায়ে মার্কসকে সাহিত্যের জগতে অনুপ্রবেশের পরীক্ষণ ব্যর্থ ঘোষণা করতে হলো। বাবা তাঁর ছেলের এসব লেখার কিছু কিছু পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ব্যাপারটি এক ধরনের অত্যাসন্ন বিপর্যয় ভেবে পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। সাহিত্যে তার মেধার অকার্যকারিতা যে সিুনিশ্চিত, সেটি দেরিতে হলেও মার্কস অনুধাবন করলেন। পরাজয় স্বীকার করে লিখলেন, ‘হঠাৎ অনেকটা জাতুর মতো একটি চিন্তা আমাকে আঘাত করলো। আমি সত্যিকার অর্থ কবিতা এবং সাহিত্য বলতে কী বুঝায়, তার উজ্জ্বল আরও প্রত্যক্ষ করলাম, ঠিক যেন দূর থেকে সুন্দর কোনও পরিবৎ প্রাসাদের মতো। আমার এতকালের সব সৃষ্টি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আমার জীবনের এক অধ্যায়ের যবনিকা পড়লো, নতুন এক দেবতার সান্নিধ্য পেলাম। সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যর্থতা মার্কসকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিল। তিনি এমনই হতাশ হয়েছিলেন এবং ভেঙে পড়েছিলেন যে, ডাক্তার তাকে নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে দীর্ঘ বিশ্রামের উপদেশ দিলেন। বিশ্রামকালে বাবাকে মার্কস জানালেন, ‘কবিতাকে বিদায় দিয়েছি। এবার আমার উপাস্য অর্থশাস্ত্র।’
মুজতবার জবাব, ‘লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের উক্তি ওটি। রবীন্দ্রনাথ উত্তর শুনে বললেন, ‘ইংরেজদের পক্ষে এ কথা বলা আশ্চর্য নয়।’ কবির যুক্তি তখনকার মতো মেনে নেন মুজতবা।
মোজেস হেস নামে একজন জার্মান দার্শনিক ছিলেন। বয়সে তিনি মার্কসে ছয় বছরের বড়। সবে ডক্টরেট ডিগ্রি শেষ করে মার্কস বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন। ঠিক ওই সময় হেস একটি মন্তব্য করেছিলেন, ‘শোনো, বর্তমানকালে সত্যিকার দার্শনিক হলেন ডক্টর মার্কস। দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ার, হলবাখ, লেসিং, হেইন অথবা হেগেলের গুণাবলি দ্রবীভূত আঁকারে যদি একজনের মধ্যে দেখতে চাও, তাহলে সেটি ডক্টর মার্কসের মধ্যেই পাবে।’ (কার্ল মার্কস: জীবনদর্শন-বদরুল আলম খান)
জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর পরিচিত ও অপরিচিত লোকের কাছে জীবনে চিঠি লিখেছেন দশ লাখেরও বেশি। এসব চিঠির বেশিরভাগই ছিল রহস্যে ঘেরা। একবার নারীদের একটি ক্লাব থেকে তাঁর ‘দ্য ইন্টেলিজেন্ট ওমেন্স গাইড’ বইটির এককপি উপহার চেয়ে অনুরোধ জানায়। সেই চিঠির জবাবে শ লিখেছিলেন, ‘যে সমিতি সাড়ে বারো শিলিং দিয়ে আমার এখখানা বই কিনতে পারে না, সেই সমিতির বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’ কিছুদিন পর ওই সমিতির পক্ষ থেকে আরেকটি চিটি এলো, তাতে লেখা, ‘আপনার হাতে লেখা মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এই মন্তব্যের বদলে আমরা দোকান থেকে এককপি বই পেয়েছি।’ উত্তরে বার্নার্ড শ লেখেন, ‘মেয়েরা কী বোকা! আমার ওইটুকু হাতের লেখা দিয়ে পঞ্চাশ পাউন্ড পাওয়া যেতো।’
রাশিয়ায় গোর্কি গবেষকদের মতে, গোর্কির যেসব চিঠি রক্ষা করা গেছে তার সংখ্যাই বিশ হাজার। রুশ বিপ্লবের আগে কিংবা পরে ইউরোপের এমন কোনও মনীষী ছিলেন না, যাঁর সঙ্গে পত্রালাপ করেননি গোর্কি। কত সহস্র লেখক ও কর্মী যে তাঁর কাছে এসেছেন সাহিত্যের সবক নিতে, নিজেদের পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করাতে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। স্মৃতিচারণে কোনও সাহিত্যিকই বলতে পারেন না যে, তাঁদের কোনও আবেদন কোনোদিন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে গোর্কির কাছে।
বড় কোনো লেখকের একটুখানি পরামর্শ বা একটি চিঠি পাঠক কিংবা যে কারও জীবন পাল্টে দিতে পারে। তেমন ঘটনা ঘটেছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনে। ১৯১৯ সাল। মুজতবা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সে বছরেই রবীন্দ্রনাথকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ওই বছরের নভেম্বরে সিলেটে এসেছিলেন কবি। মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশে ‘আকাঙ্ক্ষা’ বিষয়ে বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। কিশোর মুজতবা সেই বক্তৃতা শুনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেন—‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী কর্তব্য?’ সপ্তাহখানেকের মধ্যে আসমানি রঙের একটি খামে কবির জবাব এলো—
কল্যাণীয়েষু,
আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে, এ কথাটার মোটামুটি পথ এই যে, স্বার্থই যেন মানুষের চরম লক্ষ্য না হয়। কিন্তু এই কথাটাকে কাজে খাটাইবার পথ বহু বিচিত্র, কারণ সকল মানুষের স্বাভাবিক শক্তি এক রকমের নহে। সেজন্যই আমাদের এই আত্মদানের পথ আমাদের শক্তি অনুসারে স্বতন্ত্র। তোমার পক্ষে কোন পথ সত্য তাহা বাহির হইতে বলিয়া দেওয়া সম্ভব নহে। যদি আত্মোৎসর্গই তোমার যথার্থ লক্ষ্য হয়, তবে অন্তরের ইচ্ছাবেগেই সত্য পথে বাহির হইবে। যদি তাহাতে স্বার্থপরতা, অহংকার, যশোলিপ্সা প্রভৃতি মিশ্র থাকে তবেই ভুল হইয়া যায়।
বিস্তারিত করিয়া লিখিবার সময় আমার নাই। লেখাও অনাবশ্যক। কারণ, সত্য মুখের উপদেশের উপর নির্ভর করে না, অন্তরের অকৃত্রিম ইচ্ছাই তাহার আশ্রয়।
মূলত রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিখানিই মুজতবা আলীকে শান্তিনিকেতনে পড়ার বিষয়ে ইচ্ছের বীজ বুনে দিয়েছিল। ১৯২১ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে শান্তিনিকেতনে পৌঁছান তিনি, ভর্তি হন স্কুল বিভাগের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে। সামনা সামনি দেখা হতেই কবিগুরু তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার মুখ দিয়ে তো কমলা লেবুর গন্ধ বেরুচ্ছে।’
শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর মুজতবা প্রথম সাক্ষাতে কবিগুরুকে বলেছিলেন, কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষভাবে শিখতে চান। কিন্তু কবি তাতে ঠিক সম্মতি দিতে পারেননি। পাল্টা জবাবে মুজতবা বলেন, ‘মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিসই বোধ হয় ভালো করে শেখা যায় না।’ এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের জিজ্ঞাসা, ‘এ কথা কে বলেছে?’ মুজতবার জবাব, ‘লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের উক্তি ওটি। রবীন্দ্রনাথ উত্তর শুনে বললেন, ‘ইংরেজদের পক্ষে এ কথা বলা আশ্চর্য নয়।’ কবির যুক্তি তখনকার মতো মেনে নেন মুজতবা।
চলবে…