পর্ব -১৪
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যয়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ প্রথমে ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল ‘বিচিত্রায়’। পরে সেটি বই আকারে বের হয়। এটি ছিল লেখকের প্রথম উপন্যাস। সত্যজিৎ রায় যখন ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছিলেন, তখন তার আর্থিক সংকট চলছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক অনুদান পাওয়া যায় কি না, তা আলাপ করার জন্য গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। ছবির কিছু অংশ তাকে দেখানো হলো। বিধান রায় জানতে চাইলেন, তাহলে ছবির পাত্রপাত্রী গ্রাম থেকে চলে যায়?
সত্যজিৎ: হ্যাঁ।
বিধান: তোমাদের আজকালকার ছেলেদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। আমরা উচ্চ ফলনশীল বীজ দিচ্ছি। হালের বলদ দিচ্ছি, আর তুমি কিনা বলছ—গ্রাম থেকে চলে যায়। ছবির গল্প কে লিখেছে?
সত্যজিৎ: বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
বিধান: বিভূতিকে ডাকো।
সত্যজিৎ: তিনি তো মারা গেছেন, স্যার।
বিধান: কী বিপদ। অন্য কাউকে দিয়ে কাহিনি বদল করে লিখে নাও।
সত্যজিৎ: স্যার, বিখ্যাত লেখক তো। বাঙালি সমাজ আপত্তি করবে।
অবশ্য পরে এই সিনেমার গল্প পাল্টাতে হয়নি। টাকাও দিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তৈরি হলো গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকাহিনি নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’—যা আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে, সুযোগ পেলে আরেকবার দেখে।
বিভূতির ‘আরণ্যক’ আমি পড়েছি, কিন্তু তার বিখ্যাত আরেক উপন্যাস ‘ইছামতি’ আজও পড়া হয়নি। আশির দশকে বাংলা বাজারের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে প্রায়ই ঢুঁ মারতাম। একদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি ‘স্টুডেন্ট ওয়েজে’ হুমায়ূন আহমেদ বসা। প্রকাশনীর মালিক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ’র সঙ্গে তিনি কী নিয়ে যেন কথা বলছেন। ততদিনে হুমায়ূনের প্রকাশিত সব বই পড়ে ফেলেছি। কোনোকিছু চিন্তা না করে দোকানে ঢুকে পড়লাম। হুমায়ূনকে উদ্দেশ করে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তিনি তাকালেন, চেহারায় ফুটে উঠেছে কেমন একটা সারল্যের ভাব। নাকি প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন, বুঝলাম না। বললেন, ‘আসেন।’ চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসেন। বলেন কী জানতে চান?’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রমথ চৌধুরী, গুরু-শিষ্য। প্রমথ বিয়ে করেন রবিঠাকুরের ভাইয়ের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে। কিছুদিন ঠাকুর এসেস্টের ম্যানেজারিও করেছেন
বাংলা অ্যাকাডেমির বই মেলায় তাকে দূর থেকে দেখেছি, সারাক্ষণ ভিড় পরিবেষ্টিত হয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। কখনো কথা হয়নি। আমি ভেবে অবাক হলাম, এতবড় একজন বিখ্যাত লেখক কত নিরহঙ্কার আর সহজ-সরলভাবে কথা বলছেন। বললাম, ‘আপনার প্রায় সব উপন্যাসের চরিত্রের নামগুলো ঘুরেফিরে একই। এর কোনো রহস্য আছে কি না, জানি না। তবে মাঝেমধ্যে একঘেয়েমি লাগে।’ তিনি একটু গম্ভীর হলেন। বললেন, ‘দুয়েকটি নাম বলেন।’ বললাম, ‘শফিক, রানু, নিলু ইত্যাদি।’
হুমায়ূন: ‘ও। আপনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন?’
আমি: ‘‘হ্যাঁ, তার ‘আরণ্যক’ পড়েছি।’’
হুমায়ূন: ‘ইছামতি?’
আমি: ‘নাম শুনেছি। পড়িনি।’
হুমায়ূন: ‘সুযোগ হলে পড়বেন। বড় উপন্যাস। আমি যখন আপনার মতো ছাত্র ছিলাম, তখন ইছামতি পড়েছি। সে অনেক আগে। ইছামতি নদীর নামে লেখা এই উপন্যাসে তিন বোন আছে। তাদের নাম নিলু, বিলু ও তিলু। সেই যে পড়েছি, আজও তাদের ভুলতে পারি না। আমার বুকের মাঝে স্থায়ী হয়ে আছে। যখন কোনো নতুন কাহিনি লিখতে বসি, তারা সামনে চলে আসে। শুধু আমি না, মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা ভোলা যায় না।’ হয়তো অন্য নামগুলোর নেপথ্যেও এ ধরনের কোনো ঘটনা আছে।’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম।
‘আমার চারবাড়ি’ নামে আত্মজীবনীতে মনীষা রায় জানিয়েছেন, ‘‘একদিন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ বইটি হাতে এলো। এর আগে আমি কখনও ওঁর লেখা পড়িনি। ‘আরণ্যক’ পড়ে আমার অন্তরে বিরাট তোলপাড় হয়ে গেলো। সেদিনই সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম প্রেম। এর আগে যত বই পড়েছি, তাতে আনন্দ পেয়েছি, কিন্তু মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের যুগপৎ আলোড়ন এই প্রথম। সাহিত্য রচনার এক অদমনীয় বাসনা আমাকে চেপে ধরলো। ফুলস্কেপ কাগজের একটা খাতা তৈরি করলাম। তার ওপরে চায়নিজ ইংক দিয়ে লিখলাম ‘আমার লেখা’। এই সংকল্পের কথা কাউকে বলিনি। কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়ার অনেক আগেই এই প্রেম আমাকে আবিষ্ট করেছিল। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর এক টিপ ঘুমিয়ে উঠিয়ে চোখেমুখে ঠাণ্ডা জল দিয়ে খাতা খুলে বসতাম। এই গোপন অভিসার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বাসনা তৈরি হলো। নিজস্ব একটি ঘরের জন্য প্রাণ আকুলি-বিকুলি করতে লাগলো। সেখানে থাকবে আমার বইখাতা আর সে ঘরের নির্জনতায় বসে আমি রচনা করবো ‘গল্প এবং কবিতা।’’
নব্বইয়ের মাঝামাঝি, আমি তখন সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। সাংবাদিক অঞ্জন রায় পাবনা থেকে লেখা পাঠাতেন। পরে ঢাকা এসে আজকের কাগজে জয়েন করেন, আবার ছেড়েও দেন। শুরু করেন বইয়ের ব্যবসা। পল্টনে সিপিবি অফিসের সামনে তার দোকানের নাম ‘বই মেলা’। মাঝে মাঝেই যেতাম। একদিন অঞ্জন আমাকে ধরিয়ে দিলো লিও তলস্টয়ের আন্না কারেনিনা, কার্ল মার্কসের পুঁজি-১ ও পুঁজি-২। বাংলা ভাষা এত কঠিন হতে পারে, পুঁজির অনুবাদ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। তাছাড়া আমি অর্থনীতির কিছুই বুঝি না। ফলে মনকাড়া মলাট আর উন্নত ছাপার ‘পুঁজি’ কেবল নেড়েচেড়ে দেখেছি, পড়া হয়নি, আজও সেভাবেই আছে।
তবে অঞ্জনের দোকান থেকে কেনা একটি বইয়ের গল্পে আলাদা স্বাদ পেয়েছিলাম, লেখক সুবিল মিশ্র। তার লেখাও সেই প্রথম পড়া। বইটি পড়ে প্রথাবিরোধী এই লেখক সম্পর্কে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়।
বিত্ত, বৈভব ও জৌলুশ থেকে অনেক দূরে ছিলেন সুবিমল মিশ্র। সাদামাটা জীবন-যাপনের অংশ হিসেবে চৌকির সঙ্গে একটি বেঞ্চ জোড়া লাগিয়ে তার ওপরে বই রাখতেন এই লেখক। দেড় কক্ষের আবাসনে খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সোফাসেট আর ছিল বই। ঘরে পা ফেলার জায়গা ছিল না। টেবিলে বই, চেয়ারে বই, তাকে বই, শোয়ার জায়গাতেও বই। ঘরে ঢুকতে গেলে বই ঠেলে ঢুকতে হয়। সুবিমল মিশ্রের অন্তিম ইচ্ছে ছিল—মরার পর তাঁকে যেন বই দিয়ে পোড়ানো হয়। তিনি নিজেই নিজের বই প্রকাশ করেন এবং বিক্রি করেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লেখাপড়া করেন পাঁচ ঘণ্টা, লেখেন তিন ঘণ্টা। স্কুল শিক্ষকতার ফাঁকে সাত শ’ পৃষ্ঠা লিখে সত্তর পৃষ্ঠা ছাপতে দেন। দিনে ষাট/সত্তরটি বিড়ি খান। চিকিৎসকের নিষেধ সত্ত্বেও ডিমভাজা, কালো চা পান এবং দেদারছে ধূমপান, সবই চলে।
নিজের সৃষ্টি ‘দেবদাসের’ মতোই জীবনযাপন ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। জীবনভর নেশা করেছেন তিনি। শেষ জীবনে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। প্রচলিত আছে যে, তখনো তিনি নেশার জন্য জিবে নিতেন সাপের ছোবল। নিজের ক্ষতি জেনেও অনেক মহৎ লেখকই জীবনের প্রতি বেহিসাবি অবিচার করেছেন। প্রথাবিরোধী মানেই নিয়ম ভাঙা! আজও বিষয়টি বুঝে উঠতে পারিনি।
হুমায়ূন আহমদের ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিশোরদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় লেখক। কেবল কিশোররাই নয় অল্পবয়সীদের জন্য লেখা তার বইগুলো বড়দেরও সমানভাবে টানে। বই পড়া নিয়ে তার বক্তব্য—একটি চমৎকার বই পড়লে বুকের ভেতরে এমন একটি অনুভূতি হয়, যার কোনো তুলনা নেই। ভালো একটি বই পড়ার পর আমার মাঝে মাঝেই ভালো কিছু লেখার জন্য হাত নিশপিশ করে। নিজের ভেতরে আশ্চর্য এক ধরনের উৎসাহ বোধ করেছি। সৃজনশীল কাজতো কখনো চাপ দিয়ে করানো যায় না। সেটি সব সময় হয়ে থাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বই পড়ার চেয়ে সুন্দরভাবে সেই কাজটি আর কেমনভাবে করা যায়?
সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি পাবনার হরিপুর গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে তিনি জন্মেছিলেন যশোরে। তারপর পরিবারের সঙ্গে চলে যান নদীয়া জেলায় এবং পরে স্থায়ী ঠিকানা হয় কলকাতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রমথ চৌধুরী, গুরু-শিষ্য। প্রমথ বিয়ে করেন রবিঠাকুরের ভাইয়ের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে। কিছুদিন ঠাকুর এসেস্টের ম্যানেজারিও করেছেন। জীবনের পড়ন্তবেলা কেটেছে শান্তি নিকেতনে।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন কলকাতাভিত্তিক এলিট সমাজের প্রভাবশালী প্রতিনিধি। কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে একাধিক বাড়ি তৈরি করে ভাড়ায় খাটাতেন। জনৈক আত্মীয় টাকা ধার নিয়ে নগদে শোধ করতে না পেরে প্রমথ’র নামে জমিদারি লিখে দিয়েছিলেন। সেসব থেকে নগদ উপার্জন ছিল বেশ। কিন্তু জমিদারদের চিরাচরিত রেওয়াজ অনুযায়ী খরচের পাল্লা ছিল ভারী। ফলে শেষ জীবনে সহায়-সম্পদ হারিয়ে অর্থ সংকটেও পড়েছেন। এসব কথা তিনি উল্লেখ করে গেছেন আত্মজীবনীতে।
আমি বহু ইংরেজি বইয়ের নাম জানতাম। এর ফলে দাদার, সেজদার, আমার ও আমার ছোট ভাই আমিয়র বই কেনা বাতিক হয়।
তৎকালীন সাহিত্যজগৎ ছাড়াও সাহিত্যের বাইরেও প্রমথ চৌধুরীর ব্যাপক পরিচিত ছিল। লেখক অতুলচন্দ্র গুপ্ত তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা অনেক সময় রহস্য করে বলেছি যে, ছয় কোটি বাঙালির মধ্যে প্রমথবাবু চার কোটি লোককে চেনেন। যার সঙ্গেই তার পরিচয় হয়, তার শরীর ও মনের চেহারা ও ভাবভঙ্গি তার মনে এঁকে যায়। আর মনে করলেই তার শব্দচিত্র অসাধারণ কৌশলে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। এর পরিচয় তার ছোট গল্পে ছড়ানো রয়েছে।’
বন্ধুদের উপর্যুপরি অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী চল্লিশ দশকের শুরুতে প্রথমে ‘রূপ ও রীতি’ নামের পত্রিকায় আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন, নাম দেন ‘আত্মকথা’। ‘রূপ ও রীতি’ বন্ধ হয়ে গেলে বিরতি দিয়ে পুনরায় বিচ্ছিন্নভাবে ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকায় আত্মকথা লেখা অব্যাহত রাখেন। ১৯৪২ সালে যখন ‘আত্মকথা’ বই আকারে বের হয়, তখন সব লেখা খুঁজে পাননি প্রকাশক। সে যা-ই হোক, আমরা বরং বইপড়া এবং বই নিয়ে প্রমথ চৌধুরী কী বলেছেন, কী ভাবতেন সে বিষয়ে অগ্রসর হই।
‘আত্মকথা’য় প্রমথ চৌধুরী বলেছেন,
‘‘বাবা বাংলা বই পড়তেন না, কেননা তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি দেদার বই পড়তেন, কিন্তু সেসবই ইংরেজি বই। তবে এসব বই এলো কোত্থেকে—বাবা যখন যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখন দীনবন্ধু মিত্র সে শহরের পোস্ট অফিসে কোনো বড় চাকরি করতেন, নবীন সেনও ছোকরা ডেপুটি ছিলেন, আর আমার বিশ্বাস, বঙ্কিমের ভাই সঞ্জীবও ছিলেন ডেপুটি, আর শিশির ঘোষ তো যশোরেরই লোক।
সে যা হোক, অল্প বয়সেই আমি কালী সিংহের মহাভারত পড়েছি, আর পড়েছি হরিদাসের গুপ্তকথা। এই বই অবশ্য বালকের পাঠ্য নয়, কিন্তু তার ভাষা সাধু ভাষা নয়, আর অতিশয় চটকদার। সে বইয়ের প্রথম পাতা পড়ে দেখবেন, লেখা কী চমৎকার। অবশ্য আরব্য উপন্যাস বাংলায় পড়েছি। আর রবিনসন ক্রুশো ও রাসেলাস। হেমচন্দ্রের একটি কবিতাবলীর একটি কবিতা ‘ভারত সংগীত’ আমাদের সেকালে মুখস্ত ছিল। সেকালে বাঙালির মনে পোয়েট্রিজমের জোয়ার এসেছিল। আর আমরা ছোট ছেলেরা সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলুম। আমাদের বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা ছিল। বাবার পড়ার ঝোঁক বোধহয় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করি।
আমার বড় দাদা ইংরেজি ভাষা খুব ভালো জানতেন। আর আমার সেজো দাদা কুমুদনাথ অল্পবয়সে থেকেই ছিলেন শিকারি। তিনি শিকারের বই পেলেই পড়তেন। তিনিই আমাকে ইংরেজি নভেল পড়তে শেখান।
আমাদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চার সুযোগ ছিল। বাবার একটি ইংরেজি বইয়ের প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। মায়ের মুখে শুনেছি, বাবা হিন্দু কলেজ থেকে পাস করে ফেরবার সময়ে একদিনে এই লাইব্রেরি কেনেন। এ লাইব্রেরিতে ছিল অনেক ইতিহাসের বই ও প্রতি ঐতিহাসিকের সমগ্র বই। কারও বই সাত-আট ভল্যুমের কম নয়। আর ছিল স্কটের সমস্ত বই। দশ-বারো ভল্যুম শেক্সপিয়ারের, মিলটনের সমগ্র কাব্য, বায়রনেরও তা-ই। বলা বাহুল্য, এসব বই আমরা স্পর্শ করিনি। মাঝে-মধ্যে স্কটের দু-একটি নভেল পড়েছি। এই লাইব্রেরির প্রসাদে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় হয। আমি বহু ইংরেজি বইয়ের নাম জানতাম। এর ফলে দাদার, সেজদার, আমার ও আমার ছোট ভাই আমিয়র বই কেনা বাতিক হয়।
পরে আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি লাইব্রেরি সংগ্রহ করি। সব চাইতে বড় লাইব্রেরি ছিল দাদার, তারপর সেজদার ও অমিয়র। বাবার লাইব্রেরি ও দাদার লাইব্রেরি এখন কাশির হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার ফরাসি লাইব্রেরিও সেখানে এবং আমার ইংওেরজি বই শান্তিনিকেতনে। আর শ-পাঁচেক বই আমার কাছে আছে।
বই কিনলেই যে পণ্ডিত হয়, তা অবশ্য নয়। তবুও এসব কথা বলছি এই জন্য যে, লাইব্রেরি করার শখ এখন আর লোকের নেই। তার একটি কারণ, লাইব্রেরি থাকলে পুরনো কাগজের দামে বিক্রি হয়। কলকাতা শহরে দেখেছি কোনো কোনো বাড়িতে বড় লাইব্রেরি ছিল, এখন নেই। আমি জানি সুবোধ মল্লিকের কাকা হেমন্ত মল্লিকের বাড়িতে নাতি-হ্রস্ব লাইব্রেরি ছিল। রবীন্দ্রনাথ দেদারছে বই কিনতেন, কিন্তু লাইব্রেরি গড়েননি। গগনেন্দ্র ঠাকুরের বাড়িতে একটি প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের একটি চমৎকার লাইব্রেরি ছিল। তাঁর সংগৃহীত ফরাসি বই আমি কিনি। কিন্তু তাঁর ইংরেজি বইয়ের কী হলো জানিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয়েরও প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল।
এসব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা কৈশোরে লাইব্রেরির আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছি। এখন লাইব্রেরি হয়েছে সকলের জন্য, ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়।’’ (আত্মকথা: প্রমথ চৌধুরী)