পর্ব-২৯
-শিমুল?
-বলো।
-ঢাকা থেকে এসে এই লঞ্চগুলো কোথায় কোথায় যায়?
-এই তো সামনেই। তেলিখালি, তেলিখালির পর তুষখালি, তুষখালির পর রায়েন্দা, রায়েন্দার পর শরণখোলা, শরণখোলার পর মোড়েলগনজ, মোড়েলগনজের পর খসিয়াখালি।
-তুমি জানো কিভাবে? অবাক মিলি মাহজাবীন।
-ওদিকে ছোটবেলায় গিয়েছিলাম আব্বার সঙ্গে।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ, বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলি? সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে শিমুল। পাশে মিলি। দুজনকে ঘিরে তমাল জগদীশ, মুজাহার আলী, হানিফ মৃধা, এনামুল হক। আমাদের একটা নতুন বাড়ি আছে, ধরো আমাদের গ্রাম উজানগাঁও থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে, মোড়েলগঞ্জ নাম থানার। মোড়েলগঞ্জ থেকে আরও ভেতরে পশ্চিমের দিকে গ্রাম জিউধারা। সেই গ্রামে আমাদের এক চাচাতো ভাই টুকু বিয়ে করেছে ঘসিয়াখালি। সেই বিয়ের অনেক পরে আব্বাকে দাওয়াত দিলে আমিও গিয়েছিলাম। সেটা ধরো আজ থেকে বিশ বছর আগে। আমাদের তালই বাড়ির কাছেই বাজার, বাজারের সঙ্গেই নদী। সেই নদী পার হয়ে এই লঞ্চ চলে যেতো বাগেরহাটে। বাগেরহাট তখন মহকুমা শহর। এখন তো জেলা।
-তোর সব মনে আছে? হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে এনামুল হক।
সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে। চারদিকে হালকা অন্ধকার। কোলায় নাড়ার মুথায় পা লেগে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয় মিলি মাহজাবীন। চট করে হাত ধরে শিমুল।
-হ্যাঁ মনে আছে। ঘসিয়াখালির সেই তালোই বাড়ির একটা স্মৃতি আমাকে এখনো নাড়া দেয়।
-কী সেটা? হাসে মিলি? কোনো সুন্দরী মেয়ে?
-সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।
-আরে তখন তো আমি মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ি। ঘটনা ঠিক না, বলা যায় প্রথা। প্রথাটা হলো আমরা সাত আটজন মেহমান। একসঙ্গে খেতে বসেছি। ভাতের বড় বড় প্লেটও আসছে, সঙ্গে এক একটা প্লেটে এসেছে আট নয়টা বাটি।
-বাটি? সবাই ফিরে তাকায় শিমুলের দিকে। কিসের বাটি?
মিলির প্রশ্নে বলে শিমুল, তরকারির বাটি।
-তোর কি মাথা খারাপ অইচে শিমুল? ঘোৎ করে ওঠে হানিফ। একটা পেলেডের মইধ্যে অতোগুলা বাডি থাহে ক্যামনে?
-হেইডাতো আমারও কতা, হানিফকে সমর্থন করে বাসুদেব রায়।
-সবটা না শুনলে বোঝা যাবে না তো। শোন, হাতের তালু গোল করে দেখায় শিমুল-এত্ত ছোট আকারের পিতলের বাটি। প্রত্যেকটা বাটিতে ভরা তরকারি মাংম মাছ ডাল…আলাদা আলাদা করে। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম বাটি, আর ভাতের থালার দিকে। আমাদের অবস্থা দেখে বয়স্ক তালোই বললেন, এটা আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। ছোট ছোট বাটিতে আমরা তরকারি দেই। যে যার মতো নিয়ে খায়। আপনারাও শুরু করুন, মজা পাবেন।
-শুনেই তো আমার ভালো লাগছে, হাসতে হাসতে বলে মিলি মাহজাবীন। আমাদের দেশে এই ধরনের একটা অসাধারণ প্রথা আছে।
-আমরাও ভালো লাগচে ব্যাপারডা; সমর্থন করে মিলিকে বাসুদেব রায়। মজার ঘটনা, একটা বড় প্লেটে অনেকগুলা ছোড ছোড বাডি।
-এখনো কি সেই প্রথা আছে, ওই এলাকায়?
-জানি না আমি, মিলির প্রশ্নে জানায় শিমুল আহসান। বলে, সময়ের ব্যবধানে কত কিছু পাল্টে যায়! হয়তো আছে, হয়তো নেই আধুনিক সময়ের টানাপড়েনে হারিয়ে গেছে ছোট ছোট বাটির প্রথা। কিন্তু ঘটনাটা আমার মনে আছে এখনো।
হাঁটতে হাঁটতে, গল্প করতে করতে বাড়ির মধ্যে ঢোকে সবাই। উঠোনে এসে কেবল দাঁড়িয়েছে সবাই, ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আসে পারুল বেগম। পেছনে রূপালী, পাশের বাড়ির দুই চাচি। পারুল বেগম এসেই দাঁড়ায় শিমুলের সামনে, তোর কি কোনো আক্কেল জ্ঞান অইবে না শিমুল?
-আমি কী করলাম মা? একেবারে ভেবাচেকা খেয়ে যায় মায়ের আকস্মিক আক্রমণে।
-হাত ধরে মিলির, তুই সন্ধ্যার সময়ে নতুন বৌরে লইয়া গাঙ্গের পারে গেলি ক্যা? জানো না, নতুন বৌ লইয়া আনানে গানাডে যাইতে নাই? যদি কোনো সমস্যা অয়, তহন কি করবি পরের মাইয়া লইয়া?
সবাই চুপ। একেবারে বোকা বনে গেছে সবাই।
-আহো আমার লগে, মিলিকে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে যায় পারুল বেগম। রূপালী আর দুই মহিলাও পেছনে পেছনে চলে যায়। ওদের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢোকে তমাল আর জগদীশ। উঠোনের হালকা অন্ধকারে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে হানিফ মৃধা, শিমুল আহমান, মোজাহার আলী, বাসুদেব রায়, এনামুল হকসহ বাকিরা। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এনামুল বুঝতে পারে গ্রামীণ লৌকিকতার ধরনটা।
মিলি বাটির দুটো পিঠা রেখে খালি বাটিটা দেয় তমালের হাতে। দেওয়ার সময়ে হাতে একটা চিমটিও দেয়। তমাল হাসতে হাসতে চলে যায় দৌড়ে।
-বাপরে বাপ, প্রথম শব্দ করে মোজাহার আলী, জীবনে চাচির এত রাগ দেহি নাই।
-রাগ হওয়ারই কথা, এনামুল হকের মৃদু গলা। বলে, আসলেই আমাগো ভুল হইচে। যদিও কিছু অইবে না। তয় চাচির বিষয়ডা আমাগো মাতায় রাহা দরকার ছিল। অনেক ঘুরলাম আইজ, যাইরে শিমুল। সকালে বাজারে আসিস। দু পা সামনে গিয়ে আবার দাঁড়ায় ফিরে, কিরে তোরা কী করবি? যাবি না?
-মোরা তো তোর পিছে পিছে আইতেছি। জবাব দেয় হানিফ মৃধা। এনামুলের কাঁধে হাত রাখে হানিফ, ল এক লগে যাই।
শিমুল আহসানকে উঠোনের অন্ধকারে একলা রেখে ওরা চলে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আকাশ আর তারা দেখে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে ঢোকে শিমুল। সামনের বারান্দা, বড় ঘর পার হয়ে রান্নাঘরের সামনে যায় শিমুল। চুলোয় আগুন জ্বলছে। চুলোর পাশে বাড়ির তো বটেই আশেপাশের বাড়ির সাত আটজন নানা বয়সের মহিলা মেয়ে বসে আছে। সবার মাঝে একটা চেয়ারে বসেছে মিলি। মিলির সামনে একটা বাটি ধরে আছে মা নিজের হাতে, মারে আমরা গেরামের মানুষ। আমাগো লগে তোমাগো শহরের অনেক কিছু মিলবে নানে। এহন ধরো বাডিডা, পানিটা একটু গরম এক টানে খাইয়া হালাও।
বাটি হাতে নিয়ে মিলি তাকায় শাশুড়ির দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে রূপালী, তমাল আর জগদীশ। সবাই তাকিয়ে দেখছে মিলিকে।
-শয়তান বা ভূত পেতনি যেন তোমারে কোনো ক্ষেতি করতে না পারে, হের লাইগা লোয়া আগুনে পোড়া দিয়া পানিতে ভিজাইয়া তোমারে হালকা গরম পানি খাইতে দিছে মা, ভয় নাই, খাও ভাবি।
অন্য মহিলাদের মধ্যে পাশের বাড়ির আবুলের দাদি বলে, খাইয়া হালাও নাতীর বৌ, খাইয়া হালাও।
মিলি একটানে পানিটুকু খেয়ে ফেললে পারুল বেগমের মুখের ওপর দিয়ে বড় একটা ফাঁড়া কেটে যাওয়ার মেঘ সরে যায়। চুলোর চারদিকে বসা মহিলারা এসেছে পারুল বেগমকে সাহায্য করছে। মিলি, নতুন বৌ বাড়িতে আসা উপলক্ষে নানা ধরনের পিঠা বানানোর আয়োজন চলছে। বাটির পানি খাওয়ার পর পারুল বেগম আবার হাত ধরে মিলির, বৌ তুমি চুলার পরে বও।
মিলি তাকায় শাশুড়ির দিকে।
-হোনো, চুলার পাশে বইয়া হাত দুইডা আগুনের ওপর দিয়া একটু গরমের স্যাকা নিবা। শয়তানরা আগুন খুউব ভয় পায়।
একটু দূরে দাঁড়ানো শিমুলের দিকে তাকায় মিলি। বুঝতে পারছে না, ওকে ঘিরে সন্ধ্যায় কেন এইসব করছে শাশুড়ি? এটাও কি সন্ধ্যার সময়ে নদীর তীরে থাকার কোনো কুলক্ষণের প্রভাব প্রথা? আর সব আমাকে ঘিরে? শিমুলের বিষয়ে তো নেই কোনো প্রথার বোঝাপাড়া?
শিমুল চোখে ইশারা করে, যাও।
শাশুড়ির হাতে হাত রেখে চুলোর কাছে এগিয়ে যায় মিলি মাহজাবীন। শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে দেখে আসছে রান্নার ভিন্ন কলাকৌশল। গ্যাস নেই, কাঠ আর গাছের শুকনো পাতা চুলোর কাছে আগেই জড়ো করা থাকে। সেই কাঠ আর শুকনো পাতা দিয়ে কী অবলীলায় রান্না করছে গ্রামের নারীরা। এখনো দেখছে একটা দুই মুখের চুলোয় আগুন জ্বলছে। একটা চুলোর পাতিলে চলছে চাল রান্না। আর একটা চুলোয় হচ্ছে তেলে ভাজা এক ধরনের পিঠা। চুলোর একটু দূরে দুজন মহিলা চালের রুটি বান্নাচ্ছে। আরও কয়েকজন মহিলা কাজ করছে। মিলি এগিয়ে এলে চেয়ারটা ঠেলে দেয় রূপালী। চেয়ারে বসলে পারুল বেগম মিলি হাত দুটো ধরে নিজেই চুলোর আগুনের ওপরে হাতদুটো ধরে, এইভাবে হাত দুইডা রাহো।
মিলি হাত রাখে আগুনের হালকা আঁচের ওপর, মিনিটা খানেক পর পারুল বেগম বলে, এহন আহ সরাও। মিলি হাত সরিয়ে নিলেও চুলোর আগুনে সারা শরীরে উত্তাপ অনুভব করে। এবং চোখে মুখে কপালের ওপর ঘাম জমে। রূপালী দৌড়ে ঘরের গিয়ে দ্রত ফিরে আসে, হাতে হাতপাখা। বাতাস করতে শুরু করে মিলিকে। তালপাখার ঠাণ্ডা বাতাসটা ভীষণ ভালো লাগে মিলির। কিন্তু এতসব মানুষের মাঝখানে বসে রূপালীর হাতের দেওয়া বাতাস উপভোগ এক ধরনের অসস্তির জন্ম দেয় মনে। তাকায় পাশে, নেই শিমুল।
-আমার হাতে দাও রূপালী। হালকা স্বরে বলে মিলি।
হাসে রূপালী, তুমি পারবে না ভাবি।
-পারবো, দাও না আমার হাতে।
-নাও, দেহি কেমন পারো।
রূপালীর হাত থেকে পাখাটা নিয়ে হাত ঘুরিয়ে বাতাস করতে শুরু করে মিলি। প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত অন্যরকম লাগলেও পরেই ঠিকভাবে নিজেকে বাতাস করেত পারে। মিলি হাসে। উঠোন ঘিরে মহিলারও কাজ করতে করতে হাসে।
তেলের কয়েকটা পিঠা একটা বাটিতে নিয়ে পারুল বেগম রূপালীর হাতে দিয়ে বলে, তোর ভাবিরে ঘরে লইয়া যা। মিলির হাত ধরে রূপালী, লও ঘরের মইধ্যে। মিলি নিজের হাতে হাত পাখা নাড়াতে নাড়াতে রূপালীর সঙ্গে ঘরের ভেতরে যায়। ঘরে শুয়ে বই পড়ছে শিমুল। টেবিলের ওপর পিঠার বাটিটা রাখে রূপালী, ভাইয়া পিডা খাও। বেণী দুলিয়ে চলে যায় রূপালী।
-দে। হাত বাড়ায় শিমুল।
মিলি নিজেই দেয় শিমুলের হাতে। শিমুল পিঠা হাতে ধরে তাকায়। উঠে বসে, তুমি বানিয়েছ?
মাথা নাড়ায় মিলি, আমি বানিয়েছি।
দুজনে হাসে।
দুজনে পিঠা খায়। পিঠা খেতে খেতে বলে মিলি, খেতে দারুণ লাগছে। শিমুল, এই পিঠার নাম কী?
-তেলের পিঠা।
-কী দিয়ে বানায়?
-চুমু আর আদর দিয়ে বানায় এই পিঠা।
-আড়চোখে তাকায় মিলি, তাই?
মাথা নাড়ায় শিমুল, সেটাই তো জানি আমি।
পিঠা খেতে খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিমুলের বুকের ওপর, তোমার কেবল খাই খাই। এখন চুমু আর আদর খাওয়ার সময় না। এখন পিঠা খাওয়ার সময়, পিঠা খাও।
শিমুল জড়িয়ে ধরে মিলিকে, পিঠা তো খাবোই কিন্তু তোমাকেও খেতে ইচ্ছে করছে।
-ছাড়ো। দরজা খোলা, যেকেনো সময়ে রূপালী, মা কিংবা তমাল এসে পড়তে পারে। ছাড়ো শিমুল।
-ভাবি! তমালের গলা শোনা যায় রান্নাঘর থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে শিমুল ছেড়ে দেয় মিলিকে। শিমুলের বুক থেকে ছাড়া পেয়ে নিজেকে পরিপাটি করতে করতে তাকায়, কী খেলে না চুমু?
-দেখা যাবে গভীর রাতে।
খাট থেকে নেমে ওড়না ঠিক করতে করতে হাসে মিলি, তুমি তো একটা ডাকাত। তোমাকে পুলিশে দেওয়া দরকার।
-ভাবি! দরজায় তমাল। মায়ে জিগাইচে, আরও পিডা দেবে?
বাটির দিকে তাকিয়ে বলে মিলি, আর দুটো দিয়ে যাও। আর শোনো তমাল, তুমি তো আমার কাছে একদম আসো না। আমাকে ভালোইবাসো না। দূরে দূরে থাকো।
মিলির কথার উত্তরে কী বলবে খুঁজে পায় না তমাল। একবার তাকায় মিলির দিকে, আর একবার শিমুলের দিকে। মুখে বোকা বোকা হাসি।
-তমাল?
-কন, মাথা মাটির দিকে।
-তুই তো নারকেল গাছ বাইতে পারিস?
ঘাড় নাড়ে, পারি।
-কালকে একটা পির ডাব নারকেল পারবি। এমন ডাব, ভেতরে হালকা শাঁস হয়েছে, বুঝলি?
-বুঝজি।
-বাটিটা নে, আরও কয়েকটা পিঠা নিয়ে আয়।
মিলি বাটির দুটো পিঠা রেখে খালি বাটিটা দেয় তমালের হাতে। দেওয়ার সময়ে হাতে একটা চিমটিও দেয়। তমাল হাসতে হাসতে চলে যায় দৌড়ে।
আরও পড়ুন: মোকাম সদরঘাট-২৮॥ মনি হায়দার