এই লেখার প্রয়োজনে ‘রুদালি’ সিনেমা দেখতে হয়েছে। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালের ১৮ জুন। সিনেমার প্রধান চরিত্রে ছিলেন ডিম্পল কাপাডিয়া। তার নাম রাখা হয়েছে সানিচারি। সহ-অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে রয়েছেন, রাজ বাব্বর, রাখি গুলজার, আমজাদ খানসহ অনেকেই। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে মূলত ভারতের রাজস্থান প্রদেশের একটি হতদরিদ্র সম্প্রদায় ‘রুদালি’কে নিয়ে।
সম্প্রদায়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা অল্প কিছুক্ষণের জন্য উঠিয়ে রাখছি। আগে সিনেমার একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বলে নেওয়া যাক। সিনেমার শুরু থেকে শেষের ৩ মিনিট আগ মুহুর্ত পর্যন্ত যত হৃদয় বিদারক ঘটনাই ঘটে যাক না কেন, ডিম্পল কাপাডিয়াকে কাঁদতে দেখা যায়নি। সিনেমা’র এই নায়িকা চেষ্টা করেও তার স্বামী মারা যাওয়ার পর কাঁদতে পারেননি। তার সন্তান তাকে ফেলে যাত্রাপালা’র দলে চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ায় কষ্টে তার ভেতরটা ফেটে গেলেও নির্বাক শুধু বসেছিলেন। খুব ছোট বেলায় সানিচারির মা-ও যাত্রাপালার দলে চিরদিনের জন্য চলে যান।
এদিকে গুলজার ছিলেন একজন ‘রুদালি’। সিনেমায় তার নাম ছিল ভিকনি। তিনি সানিচারি যে এলাকায় বসবাস করতেন, সেই এলাকার জমিদার ঠাকুরের আশুমৃত্যু উপলক্ষে আমন্ত্রণ পান। এরপর সানিচারির বাড়িতে আশ্রয় নেন। সানিচারি ও ভিকনি বেশ ক’দিন একসঙ্গে বসবাস করেন। এ সময় সানিচারি ভিকনিকে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ও নিজের দারিদ্র্যের গল্প শোনান! সানিচারির গল্প শুনে ভিকনি সত্যিকার অর্থে কেঁদে ফেলেন। কিন্তু সানিচারির চোখ বেয়ে একফোঁটা জলও ঝরতে দেখা যায়নি।
আজ থেকে তিন যুগ আগেও মরা’র বাড়িতে গিয়ে একদিন কাঁদার জন্য পাঁচ থেকে ছয় টাকা দেওয়া হতো তাদের।
সিনেমার এক পর্যায়ে ভিকনিকে রাতের বেলা সে যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানে যেতে হয়। যাওয়ার সময় সানিচারিকে তিনি বলে যান, দু’দিন পরেই আসছি। এসে আমার জীবনের গল্প শোনাবো। তখন ঠিক তোমার চোখ দিয়ে পানি ঝরবে। কিন্তু গল্পের একবারে শেষ মুহূর্তে যখন জমিদার ঠাকুর রাম আভতার মারা যান, ঠিক তার একটু আগে ভিকনির গ্রাম থেকে লোক মারফত খবর আসে সানিচারির কাছে। ভিকনি মারা গেছেন। ওই সময় সানিচারি জমিদার ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ভিকনির মৃত্যুর খবর দেওয়ার সময় সানিচারিকে আরও জানানো হয়, মারা যাওয়ার আগে ভিকনি বলে গেছেন, সানিচারিকে যেন জানানো হয় ভিকনি তার মা ছিল। ভিকনি তার মা ছিল এটা জানার পর সানিচারি প্রথমবারের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন! এরপর থেকে সেই কান্না ও মাতম করেই রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়। নিজেকে তিনি তার মা ভিকনির মতো একজন ‘রুদালি’ হিসেবে তৈরি করেন।
এখন রুদালি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। একসময় ভারতের পুরো রাজস্থানের বিভিন্ন এলাকায় পথে-ঘাটে-বাজারে রুদালি সম্প্রদায়ের ভুরি ভুরি দেখা মিলতো। কালো শাড়ি, মাথায় ঘোমটা দেওয়া বিভিন্ন বয়সের রুদালি নারীদের কাজ ছিল মূলত টাকা-পয়সার জন্য মৃতের বাড়িতে গিয়ে কান্না করা। শোকের মাতম করা। তাদের পেশাদার বিলাপকারীও বলা হয়। আজ থেকে তিন যুগ আগেও মরা’র বাড়িতে গিয়ে একদিন কাঁদার জন্য পাঁচ থেকে ছয় টাকা দেওয়া হতো তাদের।
কেউ কেউ আবার টাকার সঙ্গে তাদের পুরনো কাপড়, রুটি, ভাতও দিতো। যে কারণে রুদালিরা অপেক্ষা করতো মানুষের মৃত্যুর। কারণ কেউ মারা গেলে তাদের ডাকা হবে কেঁদে বুক ভাসানোর জন্য। রুদালিরা মূলত কাঁদতো উচ্চবর্ণের এবং জমিদার বাড়ির কেউ মারা গেলে তাদের জন্য। কারণ মরার বাড়িতে মৃত ব্যক্তিকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে আত্মীয় স্বজনসহ প্রতিবেশীরা আসবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জমিদার বা ঠাকুরবাড়ির কন্যা গিন্নিরা বাইরের লোকজনের সামনে কান্না করবে এটা তারা মানতে পারতো না। বাড়ির মেয়ে বা বউঝিরা ঘরের ভেতর ঘোমটার আড়ালে কাঁদুক আর না কাঁদুক কিন্তু বাড়িতে কেউ মারা গেছে অথচ বাড়িতে উচ্চৈঃস্বরে কোনো নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ নেই, এটা আবার কেমন কথা। কাউকে না কাউকে কাঁদতে তো হবেই। এ রকম চিন্তা থেকেই হয়তো দুশো বছরেরও বেশি আগে ‘রুদালি’ সমাজের জন্ম হয়। এরপর থেকে জমিদার বা ধনী পরিবারে কেউ মারা গেলে বা মারা যাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে আগে থেকেই ‘রুদালি’দের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। মারা যাবে এমন বাড়িতে গিয়ে রুদালিরা আগে থেকেই কান্নাকাটি এবং শোকের বিলাপ শুরু করে দেয়। ‘জমিদার বাবু মারা গেলে আমাদের কী হবে? এই পুরো সমাজের কী হবে? আমাদের মাথা থেকে ছাদ সরে যাচ্ছে, হে ভগবান আরও ক’টা দিন বাদে আমাদের অন্নদাতাকে নিলে না কেন?’ বিভিন্ন বাক্যে তারা বিলাপ করে আর বুক চাপড়ে কাঁদে।
বিশেষত ভারতের রাজা জমিদার ও সুলতান বা নবাবরা ইংরেজদের অন্ধ অনুকরণকেই তাদের বিশেষত্ব বলে গণনা করতেন।
কখনো কখনো রুদালিদের কোনো ধনী পরিবার একটানা ১০ থেকে ১২ দিনও কাঁদিয়ে বিলাপ করে নেয়। এতে করে ওই পরিবারের পয়সা খরচের মতো কলিজা আছে এমনটা দাম্ভিকতা জাহির হতো। প্রশ্ন আসতে পারে অন্যের মৃত্যুতে পয়সা নিয়ে কাঁদা যায়? চোখে পানি আসে কিভাবে? রুদালিদের এই কৌশলটাও জানা ছিল। তারা শুধু কান্নার অভিনয় করতো মাত্র। যে কারণে তাদের চোখ থেকে সত্যিকার অর্থের কান্নার পানি ঝরতো না। তারা বিশেষ এক ধরনের কাজল ব্যবহার করতেন এবং এক ধরনের গাছের শেকড় ব্যবহার করতেন যেটা চোখে লাগানো মাত্র চোখ জ্বালা করে অনবরত পানি ঝরতো। কেউ কেউ থুতুও ব্যবহার করতেন। এরসঙ্গে চলতো তাদের বিলাপ, বুক চাপড়ানো, মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া। গত ২ যুগ আগেও রাজস্থানের ধনী পরিবারের কেউ মারা গেলে রুদালিদের প্রতিনিয়ত ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো। তবে বর্তমান সময়ে এর প্রচলন অনেক কমে গেছে।
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে জানা গেছে, রাজস্থানের কিছু অজপাড়াগাঁয়ে এখনো রুদালিদের দিয়ে কান্না এবং বিলাপ করিয়ে নেওয়া হয়। তবে রুদালিদের জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, তাদের জীবন ভীষণ কষ্টের ছিল। নিচুবর্ণের হওয়ায় এবং দারিদ্র্যের কষাঘাতে অনেক নারীই অন্যদের দেখে এই পেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। আবার নিম্নবর্ণের হওয়ায় অনেকে জমিদার বা উচ্চবর্ণের পরিবারের চাপে পড়ে রুদালি হয়েছেন। রুদালিরা মরা মানুষের বাড়িতে কান্নার জন্য গেলেও শোকে স্তব্ধ প্রাসাদে অনেক সময় তাদের যৌন লালসার শিকার হতে হতো। তারা জন্ম দিতো অবৈধ সন্তান! যে কারণে রুদালিদের বাঁকা চোখে দেখতো তখনকার সমাজ।
বি. দ্র. এই সঙ্গে উল্লেখ করা যায়, অভিজাত ইংরেজ সমাজে এমনি শোককারী বা Mourner-দের প্রচলন আছে। সেখানে কালো রঙের কফিনবাহী গাড়িতে করে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর, তার সামনে সামনে ফোঁস ফোঁস করে কান্নার অভিনয় করে চলতে থাকে ওই মোরনারদের। তাই একথা ভাবলে খুব বেশি অযৌক্তিক হয়ত হবে না যে এই রুদালি প্রথা ইংরেজ রাজত্বের সমসাময়িক। বিশেষত ভারতের রাজা জমিদার ও সুলতান বা নবাবরা ইংরেজদের অন্ধ অনুকরণকেই তাদের বিশেষত্ব বলে গণনা করতেন।
আরও পড়ুন: