(পর্ব-০২)
ক্ষুধা লাগলে মানুষ খাবার খায়, খেয়ে ক্ষুধা মেটায়। জানার বা পড়ারও এক ধরনের ক্ষুধা আছে। বই পড়লে সেই ক্ষুধা মেটে। এই এক অন্য রকম নেশা। কেবল কবি-সাহিত্যিকই নয়, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিক যে পেশারই হোন না কেন, জাতপড়ুয়ারা ‘নেশা’র ঘোরে বই সংগ্রহ করেন। গড়ে তোলেন ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। জাদুকর জুয়েল আইচের লাইব্রেরিতে রয়েছে অনেক মূল্যবান সংগ্রহ। ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ের র্যাক। এরপরও ঘরময় যেখানে-সেখানে বই আর বই। আমি নিজের চোখে দেখিনি। তবে তার এক আত্মীয়ের মেয়ে সামান্থা অধিকারী অথৈ আমার মেয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অথৈর মায়ের মুখে এসব গল্প শুনেছি। এছাড়া জুয়েল আইচের নিজেরও এ বিষয়ে ‘আমার সুখের সাগর’ নামে একটি লেখা আছে। সেখানে তিনি বলছেন, ‘বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। বই থেকে যত আনন্দ আমি পেয়েছি তার কোনও তুলনা হয় না। বই পড়া এবং বই কেনা দুটোতেই আমার সমান আনন্দ। যে বই আমার ভালো লাগে তা সংগ্রহ করে নিজের লাইব্রেরিতে রেখে দেই। মনে হয় স্থায়ী এক বন্ধুকে সঙ্গী কললাম।’
এই সুযোগে জুয়েল আইচ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি। সেটি বই পড়া-বিষয়ক না হলেও বই পড়তে গিয়েই তো জেনেছি। আজকের প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ এক সময় সর্বহারা পার্টি করতেন। বিষয়টি প্রথম জানতে পারি এই সময়ের আলোচিত লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা পড়ে (বইটির নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না)। ১৯৭১ সালে বরিশালের পেয়ারা বাগানে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে জুয়েল আইচ যুদ্ধ করেছেন। বাবা-মায়ের দেওয়া তার নাম ছিল গৌরাঙ্গ লাল আইচ। ওই সময় সেটিকে তিনি সংক্ষেপ করেন জি এল আইচ। যুদ্ধের সময় তার ছদ্মনাম ছিল কমরেড জাহিদ। পরে জুয়েল আইচ নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। দেশ-বিদেশে তিনি এখন এ নামেই পরিচিত। পাক আর্মিদের তীব্র আক্রমণের মুখে পেয়ারা বাগানের পতন ঘটলে জুয়েল আইচ গোপনে ভারতে চলে যান। পরে মেজর জলিলের অধীনে ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক, বই পড়া আর বই সংগ্রহ করাও এক ধরনের নেশা। পাবলো নেরুদা দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহ করতেন। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ত্রিশ হাজার বই ছিল। এক সময় তিনি বইগুলো চিলি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। তৎকালীন চিলি সরকার বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়কে নেরুদার বই উপহার দেওয়াকে সরকার সন্দেহের চোখে দেখেছিল।
আমাদের বাসা ছিল লালবাগে। এর ঠিক উল্টোদিকে ছিল মেনন ভাইর স্ত্রী বিউটি আপাদের বাসা। তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। বিউটি আপার বাবা কেরামত আলী সাহেব ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এই কেরামত আলী, আমার কাজিনরা এবং আমি মিলে তখন লালবাগে একটা লাইব্রেরি করেছিলাম
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রিয় শখ ছিল বই সংগ্রহ করা। কেবল বই রাখার জন্য তিনি নিজের বাড়ি তৈরি করেছিলেন। এ বিষয়ে উল্লেখ আছে শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লাইব্রেরিটি ছিল দর্শনীয় বস্তু। বহু সহস্র টাকা ব্যয়ে তিনি ইহার জন্য মূল্যবান গ্রন্থসমূহ সংগ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহা যেন তাহার প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় ছিল।’ বিলাত থেকে চামড়া দিয়ে বইয়ের কাভার বাঁধাই করে আনতেন বিদ্যাসাগর। এক ভক্ত তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—এত টাকা খরচ করে বই বাঁধানোর দরকার কী? জবাবে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ভালোবাসি বলে। তুমি তোমার কুরূপা স্ত্রীকে অত রত্নালংকারে সাজিয়ে টাকা নষ্ট করো কেন?’
২০১৪ সালে সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাঝখানে তার লেখালেখির শুরু ও বই পড়া নিয়েও জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সাত চল্লিশে দেশ স্বাধীন হলে পরে জমিদাররা এ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তখন দখলদারিত্বের কোনো ব্যাপার ছিল না। দুই দেশের মধ্যে যার যার সম্পত্তি একচেঞ্জ হতো। শান্তিপূর্ণ বিনিময় হতো। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর হিন্দুরা সব হিড় হিড় করে চলে গেলো। কেন যাচ্ছে তখন আমি ভালো করে বুঝতাম না। সেই তেওতার জমিদার বাড়িতে একটা বিরাট লাইব্রেরি ছিল। শেষবার পঞ্চাশের দাঙ্গার পর জমিদারের পরিবার যখন চলে যায়, তখন দুই-তিন আলমারি বই আমার বাবাকে দিয়ে যান। এর মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসিক বই ছিল। ল’-এর বই বেশি ছিল। আমার মনে আছে, জমিদার বাবাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলেকে আইন পড়িও, বইগুলো রেখে গেলাম, কাজে লাগবে।’ আমার বাবাও ছিলেন বইয়ের পোকা। কাজিনরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালযের ছাত্র ছিল, তারাও বই পড়তেন। এখান থেকে আমার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’’
মকসুদ ভাই আরেকটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এরমধ্যে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। আমরা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এসব নেতাকে অনুসরণ করতাম। আমাদের বাসা ছিল লালবাগে। এর ঠিক উল্টোদিকে ছিল মেনন ভাইর স্ত্রী বিউটি আপাদের বাসা। তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। বিউটি আপার বাবা কেরামত আলী সাহেব ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এই কেরামত আলী, আমার কাজিনরা এবং আমি মিলে তখন লালবাগে একটা লাইব্রেরি করেছিলাম। নাম ছিল ‘গ্রন্থ বিতান’, লালবাগ শাহী মসজিদের কাছেই, এখনো সেটা আছে। বেশ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।’’
এ বিষয়ে ইতিহাসের ঘৃণিত চরিত্র জার্মানির শাসক অ্যাডলফ হিটলারের ছিল ভিন্ন মত। তিনি বলেছেন, ‘একশ’টা বই পড়ে নব্বইটি ভুলে যাওয়ার চেয়ে দশটি বই পড়ে নয়টি মনে রাখা অনেক ভালো।’
আগেকার রাজনীতিকদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। তারা দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় লাইব্রেরিতে কাটাতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে বসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নিতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ব্যক্তি লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরিতে তিনি অনেক সময় জরুরি মিটিং করতেন। ১৯৭৫ সাল, তখন দেশে বাকশাল প্রবর্তনের প্রস্তুতি চলছে। বঙ্গবন্ধু একদিন তার প্রাইভেট সেক্রেটারি ফরাসউদ্দিনকে দিয়ে তরুণ বাম রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেননকে খবর পাঠালেন। ১৯৭৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় ৩২ নম্বরে গেলেন এই দুই নেতা। এর পরের অংশটুকু শুনুন হায়দার আকবর খান রনোর কাছ থেকে। তার আত্মজৈবিক গ্রন্থ ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ তে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেখে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘তোরা এসে গেছিস, একটু বস, আমি ওপর থেকে আসছি। মহিউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড) ওদেরকে আমার লাইব্রেরি রুমে নিয়ে বসা।’ মহিউদ্দিন আমাদের লাইব্রেরি রুমে নিয়ে গেলেন। রুমটি বড় নয়। একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার ওপাশে একটা বড় সাইজের চেয়ার, অন্য পাশে দুটো চেয়ার সাজানো। দেয়ালঘেঁষে অনেকগুলো ছোট সাইজের বইয়ের আলমারি। গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাকে সাজানো বই। এই ঘরে পরে বহুবার বসেছি বিশেষ করে আশির দশকে, যখন ১৫ দল করতাম। এই ঘরে পরবর্তী সময়ে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দলবদ্ধভাবে অথবা একাকী ফরমাল ও ইনফরমাল বহু আলাপ করেছি। কিন্তু সেদিন আমার খুব কৌতূহল হয়েছিল লাইব্রেরিটি কেমন, তা দেখার। মেনন টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে রইলো।’’
হায়দার আকবর খান রনো আরও লিখছেন, ‘‘আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম কী কী বই আছে। খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের রচনা সংকলনের সেট সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। আমি যখন দেয়ালের কাছে আলমারির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন হঠাৎ যেন পদশব্দ শুনতে পেলাম। দেখলাম, রাষ্ট্রপতি ঘরে ঢুকেছেন। আমি টেবিলের কাছে ফিরে এসে নির্দিষ্ট চেয়ারে গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, ‘কী দেখছিলি?’সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিলাম, ‘দেখছিলাম কী কী বই আছে।’ তিনি একটু চোখ টিপে বললেন, ‘লেনিনের বইও আছে, মার্কসের বইও আছে।’ অনেকে মনে করেন, যে বই পড়তে ভালো লাগবে, সেটাই পড়া উচিত। এ বিষয়ে ইতিহাসের ঘৃণিত চরিত্র জার্মানির শাসক অ্যাডলফ হিটলারের ছিল ভিন্ন মত। তিনি বলেছেন, ‘একশ’টা বই পড়ে নব্বইটি ভুলে যাওয়ার চেয়ে দশটি বই পড়ে নয়টি মনে রাখা অনেক ভালো।’ মনে হয় হুমায়ূন আহমেদও পড়ার ব্যাপারে ছিলেন সিলেক্টিভ। তিনি বলেছেন, ‘ক্ল্যাসিক বই পড়তে আমার সব সময়ই ভালো লাগে, অনেক বই আছে যা বারবার পড়ি।’’
চলবে…
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-১॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম