‘কবি নাসের মাহমুদ’ নাকি ‘ছড়াকার নাসের মাহমুদ’—কবিতা অপেক্ষাকৃত কম লিখেছেন, ছড়াতেই তার রাজত্ব ছিল। কিন্তু স্বল্প-সংখ্যক যে কবিতাগুলো লিখেছেন—তাতে তার শক্তিমান কবি সত্তাটি চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। ‘সাইকেল’ নামে একটি গল্পও লিখেছেন। গান নিয়েও কাজ করেছেন। নাসের মাহমুদ নামের সঙ্গে ‘ছড়াকার’ অভিধাটি রাজকীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমার কাছে কবি নাসের মাহমুদও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কবি-গবেষক বিলু কবীরের সঙ্গে যৌথভাবে তার প্রকাশিত কাব্য ‘যে তুমি একমাত্র আমার’ যৌবনে রক্তে আগুন ধরানোর মতো বেশ কিছু কবিতা সেখানে আছে। তার কবিতার ভেতর আমরা উঠতি যৌবনে বুঁদ হয়ে থেকেছি। মুগ্ধতার ঘোরের অতলে ডুবে থেকেছি। সে কারণে নাসের মাহমুদ ছড়াসাহিত্য নিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় সাধনারত থাকলেও, অবিস্মরণীয় অনেক ছড়ার সৃষ্টিসম্ভারে বাংলার ছড়াসাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করলেও, কবি হিসেবেও তিনি শক্তিমান ছিলেন। সে কারণে শুধু ছড়াসাহিত্যে নাসের মাহমুদকে বন্দি বা সীমাবদ্ধ করে রাখার সুযোগ নেই। তিনি সাহিত্যে বহু বিচিত্র কাজ করেছেন যেমন, তেমনি তার জীবনও ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ—জীবন-জীবিকার জন্য পেশার বদল কম ঘটেনি। দেশের বাইরেও গিয়েছিলেন—ভাইদের ব্যবসা-বাণিজ্যেযুক্ত থেকেছিলেন। কিন্তু সাহিত্য-প্রাণ নাসের মাহমুদ বিদেশের নিশ্চিন্ত সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্য জীবন ফেলে আবার দেশেই ফিরে আসেন—অনিশ্চয়তার জীবনকে সানন্দে গ্রহণ করেন।
বহুমাত্রিকতায় আশ্চর্যরকম এক প্রাণশক্তি ছিল তার মধ্যে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। তার মৌলিক ও সম্পাদিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে—যে তুমি একমাত্র আমার (বিলু কবীরের সঙ্গে যৌথ), শতবর্ষের নির্বাচিত হাসির গল্প, খুলে খাপটা সোজা সাপটা, গোলপাতা লম্বা, ছড়াসমগ্র-১, বাবা তোমার জন্য, দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কিশোর গল্প, দুই বাংলার ভূতের ছড়া, ধ্রুব এষের ছড়া, আজ আমরা গাছ পাখিরা সব ভাই ভাই, হৃষীক, বাবার গল্প, সেকালের ছড়া একালের ছড়া, মায়ের গল্প, একুশের ছড়া কবিতা, এই আমাদের বাংলাদেশ, একুশের ছড়া কবিতা, নির্বাচিত আধুনিক বাংলা গান, মামাবাড়ির গল্প, ছড়া সব করে রব, পঞ্চপাণ্ডব-৩, পঞ্চপাণ্ডব-৪, আলো তুমি ভালো থেকো প্রভৃতি।
কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদ—আমি যাকে সব সময় সদ্বোধন করেছি ‘ভাই’। আগে-পরে কোনো বিশেষণ কখনো যোগ করিনি। পরিবারের আপনজন বলতে যা বুঝি, তিনি তা থেকে আমার কাছে একটুও কম ছিলেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো বেশিই ছিলেন। যা পরিবারেরও অনেকেই তা হয়ে উঠতে পারেন না। তার চলে যাওয়ার সংবাদ পাই শ্রদ্ধাভাজন কবি-গবেষক বিলু কবীরের কাছ থেকে। করোনার কঠিন সময় তখন। এই সংবাদে পাথর নীরবতা নেমে আসে আমাদের পরিবারে। চোখের পানিতে চোখ অন্ধ হয়ে আসে। বুক ভরা ব্যথায় মুষড়ে পড়ি।
একদমই অপ্রস্তুত ছিলাম এই রকম ভয়াবহ বেদনার্ত একটি সংবাদের জন্য। বুকের ভেতর যে তখন কী ভীষণ হাহাকার করে উঠলো—কী এক ভীষণ শূন্যতার আগুন হয়ে জ্বলে উঠলো, করোনার ভয়াবহতায় তাকে শেষ দেখাও দেখতে যাওয়া হয়নি। কী এক ভীষণ অমার্জনীয় অপরাধবোধে অতলে তলিয়ে যেতে থাকি, নিজের কাছেও নিজের ক্ষমা হয় না। কাজী নজরুল ইসলামও যখন ভীষণ অসুস্থ ছিলেন—কলকাতায়, চিনতে পারতেন না কাউকে, কখনো কখনো এক আধটু চিনতে পারতেন কাউকে কাউকে—যারা খুব কাছের ছিলেন—খুব আপন ছিলেন—একদম হৃদয়ে গ্রোথিত মানুষ ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না, সেই ভয়াবহ সময়ে তিনি পরম সুহৃদদের দেখা খুব একটা পাননি। তার কাছের পরম বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই দেখতে যাননি। অথচ তাদের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের একসময় প্রতিদিনের জীবন ছিল—আড্ডা ছিল।
আমার কেন যেন মনে হয় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কবি নাসের মাহমুদের করুণ ও মর্মন্তুদ শেষ সময়কাল খুব করে মিলে যায়। মাত্র দুতিনজন ব্যতিত কেউই তাকে নিয়মিত দেখতে যেতেন না। অথচ এই মানুষটি কতোভাবে আমাদের স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন—আদর করতেন—কত শত স্মৃতি তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাকে ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয় এই জনমে। শ্রদ্ধায় সম্মানে ভালোবাসায় নাসের মাহমুদ আমার কাছে প্রাণময় স্নেহশীল জীবন্ত একজন আপন মানুষ—তিনি নেই এটা আমি বিশ্বাসে রাখতে চাই না।
কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদের সঙ্গে আমার কবে প্রথম দেখা—তা নির্দিষ্ট করে হয়তো এখন বলাকঠিন। কিন্তু সময়কালটা ১৯৮৮ শেষের দিক। জাতীয় কবিতা পরিষদ—কুষ্টিয়া শাখার উদ্যোগে কুষ্টিয়ায় পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান। ঢাকা থেকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও কবি মুহাম্মদ সামাদ এসেছেন। বড় আয়োজন। পুরো কুষ্টিয়া যেন কবিতা উৎসবে মেতে উঠেছে। কবি নাসের মাহমুদ এই অনুষ্ঠানের আয়োজনে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। তার চেষ্টা ও শ্রমে এত বড় অনুষ্ঠান। তার সঙ্গে সাংবাদিক সনৎ নন্দী, কবি খৈয়াম বাসার ও কবি আখতারুজ্জামান চিরুসহ সেই সময়ে আরও অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তখন কবি আখতারুজ্জামান চিরু ছাড়া এদের আর কাউকে চিনি না। কিন্তু নামগুলো জানি। এ নামগুলো তখন গোটা কুষ্টিয়া শহরে জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে।
আমি তখন একটু-আধটু কবিতা লিখি। কুষ্টিয়ার সন্তান হলেও আমি তখন কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একদমই অপরিচিত। কারণ আমি উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছি পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে। যে কারণে পাবনা শহর আমার কাছে যত চেনা, যত পরিচিত; কুষ্টিয়া ততটা নয়। ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ খ্যাত কবি ওমর আলীকে পেয়ে যাই বুলবুল কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে। তার সঙ্গে আমার পরম আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে কবিতা লেখালেখির কারণে। তার সঙ্গে ক্লাসের পড়া নিয়ে কখনো কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না, অথচ প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে কবিতা প্রসঙ্গে। কবি ওমর আলীকে ছেড়ে কুষ্টিয়া এসে নিজের শহরে নিজে অপরিচিত এক তরুণ হয়ে উঠি। কোন কবি-সাহিত্যিককে তখনো চিনি না, বাংলা অনার্সের শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক হিসেবে পেয়ে যাই প্রফেসর ড. আবুল আহসান চৌধুরী ও কবি-গীতিকার আবু জাফরকে। কিন্তু তাদের স্নেহ-সান্নিধ্য অর্জন সহজ ছিল না। তারা দুজনেই গুরু-গম্ভীর ছিলেন। সে-কারণে তাদের সঙ্গে দূরত্ব ঘুচতে সময় লেগে যায়। একটা সময়ে তাদের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হই ঠিকই, ততদিনে সময়ও অনেক গড়িয়ে গেছে। ফলে কুষ্টিয়া আমার কাছে তখনো প্রাণের হয়ে ওঠেনি। শূন্যতার ভেতর দিয়েই আমার দিন পার হতে থাকে। কিন্তু আমি বাংলায় পড়ি—সাহিত্যচর্চা করি—অথচ কুষ্টিয়ায় একাকিত্বের ভেতর—শূন্যতার ভেতর দিয়ে যেতে থাকি।
দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা অফিসে মাঝেমধ্যে যাই। লেখা দেই। লেখা ছাপা হয়। সেখানে শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক আবদুর রশীদ চৌধুরীর আন্তরিক স্নেহ পেলেও, বয়সের বিস্তর পার্থক্যের কারণে নিজেকে সহজ করে নিতে পারি না, তার প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে। বরং আন্তরিকতা গড়ে ওঠে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক লাকি মিজানের সঙ্গে। তখন আতিক হেলালের সঙ্গেও পরিচয় হয়। তিনিও পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। লাকি মিজান বড় ভাইসুলভ আচরণ করতেন, ভালো লাগতো। আমি তখন প্রতিদিন কয়া গ্রাম থেকে কুষ্টিয়া শহরে আসা অপরিচিত এক মেঠো তরুণ।
তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। সাংবাদিক সনৎ নন্দীসহ কুষ্টিয়ার আরও অনেকেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। কয়া গ্রামের রাজনীতিক ব্রজেন বিশ্বাস অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছিলেন।
কবিতা লিখি কিন্তু কবিতার মানুষদের আমি পাচ্ছি না—যেখানে মন ভরে আড্ডা দিতে পারি—মন ভরে কবিতা পড়তে পারি—মন ভরে কবিতা শুনতে পারি। শূন্য মাঠের অসহনীয় রোদের মতো লাগে কুষ্টিয়া; যেখানে প্রতিদিন পুড়তে থাকি। একদিন কবি আখতারুজ্জামান চিরূর কাছে যাই। কোর্ট স্টেশনের পাশে তার ছোট্ট একটা ঘর—সেখানেই সারাদিন মগ্ন থাকেন—জীবনজীবিকার প্রয়োজনে সাইনবোর্ড লেখেন—সুযোগ পেলেই কবিতা লেখেন—কবিরা সেখানে আসেন—আড্ডা দেন। তাকে কবিতা লিখি বলতেই আন্তরিকতা দেখালেন। স্নেহ করলেন। আমার কবিতা পড়লেন। কাটাছেঁড়া করলেন। অনেক উপদেশ দিলেন। যখন ইচ্ছে তখুনি যেতে বললেন। ভালো লাগলো মানুষটিকে। মনে হলো কবিতার মানুষ তো এমনই—হৃদয়বান। হৃদয় দিয়ে আপন করে নেন।
কবিতা উৎসবে আমি গিয়েছিলাম কবি আখতারুজ্জামান চিরুর মুখটা বুকে ভরে। কারণ তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়ার ‘কবি’ বলতে তাকেই চিনি। অনুষ্ঠানে তিনি এত ব্যস্ত—তার নাগাল পাওয়া আমার কঠিন হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টায় একবার তার সঙ্গে কথা বললাম, জানালাম, কবিতা পড়তে চাই। তিনি ‘আগে বলবে না, এখন কিভাবে নাম ঢুকাবো—’বলেই তাড়াহুড়ো করে আমাকে কবি নাসের মাহমুদকে দেখিয়ে দিলেন। নাসের মাহমুদ নামটি ভালোভাবেই আগে থেকে জানি। বগলভর্তি কাগজ নিয়ে তিনি কথা বলছেন, তার চারদিকে জড় হয়ে আছে তরুণ কবি-সাহিত্যিক। আমি তাকে আগে ভালো করে দেখি। ফর্সা ফুটফুটে কী অসাধারণ চেহারা। একবার দেখলেই চেহারাটা সারাজীবন মনে থাকবে। সবার ভেতর থেকেও তিনি অন্য জ্যোতিতে উজ্জ্বল। আমি তার সামনে গিয়ে—তিনি নাসের মাহমুদ নিশ্চিত জেনেও, বলি, আপনি কি কবি নাসের মাহমুদ?
জি, আমি নাসের মাহমুদ। বলুন—
আমি রকিবুল হাসান। আমার বাড়ি কয়া গ্রামে। আমি এ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে চাই।
অবশ্যই পড়বেন। এবং আপিনই প্রথম কবিতা পড়বেন।
কবি নাসের মাহমুদের উদারতা ও আন্তরিকতায় বিস্মিত হই। তার বদান্যতায় অনুষ্ঠানে প্রথম কবিতাটি আমিই পড়লাম। পরের দিন কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, কবি নাসের মাহমুদ ও আমি একটা ভ্যানে করে শিলাইদহে যাই। কুষ্টিয়া বড়বাজারের ঘাট পার হয়ে ভ্যানে উঠেই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে আমি অনুরোধ রাখি, স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সে-মুহূর্তেই একটি কবিতা রচনার জন্য। তিনি আমার অনুরোধ রেখে মুহূর্ত দেরি না করে বললেন, ‘এ যাত্রা শুধুই রবীন্দ্রনাথের জন্য’। এটিই কবিতা। পরবর্তী সময়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে এ কথাটি আমি কয়েকবার বলেছি। তিনি খুশি হয়েছেন। হাসি দিয়ে বলেছেন, ‘আমি তো ভুলে গেছি’। সেই যাত্রায় কয়ার বুকের ওপর দিয়ে যেতেই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে হাতের ডান পাশে মুখ করে খানিকটা হাত বাড়িয়ে বাড়িটা লক্ষ করে কবি নাসের মাহমুদ বললেন, ‘হুদা ভাই, এটি কিন্তু বিপ্লবী বাঘা যতীনের বাড়ি’। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘তাই নাকি’ বলেই গভীরভাবে বাড়িহীন ভিটের মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবি নাসের মাহমুদ আবার বললেন, ‘আমাদের রকিবের বাড়িও কিন্তু এই গ্রামেই।’ এ কথা শুনে জাতিসত্তার কবি তাকালেন আমার দিকে।
এরপর থেকে খুব দ্রুততায়কবি নাসের মাহমুদের সঙ্গে আমার শ্রদ্ধা-স্নেহের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তাকে শুধু ‘ভাই’ সম্বোধন করতাম। তিনি কবিতাপাঠের পরেই আশ্চর্যজনকভাবে ‘আপনি’ ফেলে দিয়ে বললেন, ‘রকিব, কাল সন্ধ্যার পরে আমার বাসায় এসো। পেয়ারা তলায় আমার বাসা। চেনো তো? না চিনলে ওখানে গিয়ে যে কাউকে বললেই আমার বাসা দেখিয়ে দেবে।’ তার আন্তরিকতা আমাকে এতটা মুগ্ধ করে, মনে হলো কুষ্টিয়া শহরে আমি এতোদিন যা খুঁজছিলাম, তা আজ পেয়ে গেছি। পরদিন সন্ধ্যার পরে আমি তার বাসায় যাই। সেই রাতে তার বাসা থেকে আমার আর ফেরা হয়নি। সারা রাত জেগে দুজনের কবিতা আড্ডা—বিভিন্ন কবির কবির কবিতাপাঠ—নিজেদের কবিতা পড়া—আলোচনা—মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাতটি দ্রুত দৌড়ে যেনো পালায়। মনে হলো কত কাল আগে থেকে যেন আমাদের গভীর সম্পর্ক। মানুষকে মুহূর্তে আপন করে নেয়ার তার আশ্চর্যরকম সম্মোহনী এক ক্ষমতা ছিল। আমার খরার মেঘ কেটে শহরময় যেন কাঙ্ক্ষিত কবিতার বৃষ্টিতে ভরে ওঠে।
২.
তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গস্পর্শী। সারা দেশের মতো উত্তপ্ত কুষ্টিয়াও। আমরাও তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়। প্রতিদিন মিছিল-মিটিং চলছে। সাথে চলছে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। সেই সময়ে কুষ্টিয়া শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রচুর লোক হতো। প্রধান আকর্ষণ ছিল কবি নাসের মাহমুদের ছড়াপাঠ। বিশেষ করে তার ‘এক রাজা দুই বিবির ছড়া’ দীর্ঘ এই ছড়াটি বাদে তখন কুষ্টিয়াতে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কল্পনা করাও কঠিন ছিল। নাসের মাহমুদের রাজনৈতিক ছড়া শোনার জন্য তরুণদের যে উপচেপড়া ভিড় হতো, এখন সেটা কল্পনা করাও কঠিন। আমিও তখন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন মিছিলে ও সভায় থাকছি, বক্তৃতা করছি—স্লোগান দিচ্ছি—নাসের মাহমুদসহ কুষ্টিয়ার প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনৈতিক কর্মী—আমাদের প্রেরণা দিচ্ছেন—সহযোগিতা করছেন—কখনো কখনো আমাদের সঙ্গে থাকছেন। এভাবে একসময় বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে উঠি। কবি-সাহিত্যিকদের কাছের এবং স্নেহের হয়ে উঠি। যেখানে নাসের মাহমুদ আমার পদ-নির্দেশক হয়ে ওঠেন। তার সময় দিবসের অনেকখানি করে সময় কাটতে থাকে। রাজনৈতিক কবিতা লিখতে থাকি। কবিতার ছোট কাগজ বের করতে থাকি।
কয়েকজন উদ্যমী তরুণকে নিয়ে সাহিত্য সংগঠন ‘কলকণ্ঠ অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করি। সে-সময়ে পত্রিকা প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘কলকণ্ঠ অ্যাকাডেমি’ কুষ্টিয়াতে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়। কবি নাসের মাহমুদ এ সংগঠনের পরোক্ষে বড় শক্তি ছিলেন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমরা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের পুকুরপাড়ে এক সকালে বসে আছি, কমন রুমের পেছনে। একটু পরেই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। কবি নাসের মাহমুদ ও সাংবাদিক সনৎ নন্দী এলেন। ছাত্রদের সভায় যোগ দিতে। তার হাতে বাজারের ব্যাগ। বাজার করবেন বলে বাসা থেকে বের হয়েছেন। তিনি বাজার নিয়ে যাবেন, তারপর রান্না হবে। কবি নাসের মাহমুদ সেদিন বাসায় ফিরেছেন মধ্য রাতে। খালি ব্যাগ হাতে। বাজারের টাকা ছাত্র আন্দোলনের জন্য চাঁদা দিয়ে দিয়েছেন। এরকম একদিন নয়, বহু দিন ঘটেছে। সংসারে থেকেও সংসারহীন ছিলেন তিনি। এরশাদের পতন ঘটানো তখন তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরশাদের পতনের জন্য—গণজাগরণ তৈরি করার জন্য তখন তিনি মরিয়া—সংসারের টাকা চাঁদা দিচ্ছেন—ঘরে কে কী খাচ্ছেন—কী রান্না হচ্ছে বা আদৌ রান্না হচ্ছে কি না—বাসায় খাবার আছে কি না—এসব তিনি কখনো ভেবেছেন বা খবর রেখেছেন বলে মনে হয়নি। স্বৈরশাসকের কাছ থেকে গণতন্ত্র উদ্ধারই তখন তার কাছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সে লক্ষ্যেই লিখেছেন সাড়া জাগানো অসংখ্য ছড়া, উপস্থিত থেকেছেন বিভিন্ন সভায়, ছড়া পাঠ করে জনতাকে উজ্জীবিত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে। পকেটের টাকা সাহিত্য সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনকে চাঁদা দিয়ে শূন্য হাতে বাসায় ফেরা তার একরকম নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সংসার নামক ব্যাপারটি তার কাছে অগুরুত্বপূর্ণই থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। সংসারের চেয়ে তার কাছে তখন দেশের গণতন্ত্রের মুক্তি এবং শিল্প-সাহিত্যচর্চা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গক্রমে, বাঘা যতীনেরএকটা ব্যাপারের সঙ্গে নাসের মাহমুদের একটি ব্যাপার অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায়। যদিও ঘটনা ও সময় পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু চেতনার জায়গায় ঢেউটা একটা জায়গায় এসে মিলে যায়। সেটা হলো, বাঘা যতীন যখন বালেশ্বরে ব্রিটিশসৈন্য পরিবেষ্টিত—মৃত্যুর মুখোমুখি, তখন তার শিষ্যরা তাকে বলেছিলেন, ‘দাদা, তুমি পালিয়ে যাও—তোমার স্ত্রী-সন্তান আছে। তোমার অবর্তমানে তাদের কী হবে?’ বাঘা যতীন তখন ব্রিটিশ সৈন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে সহযোদ্ধাদের বলেছিলেন, ‘দেশের বৃহৎ স্বার্থে এসব ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। আমরা মরবো দেশ জাগবে।’ বাঘা যতীনের মতো ওরকম কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অবতীর্ণ হননি নাসের মাহমুদ। কিন্তু দেশের জন্য—দেশের শিল্প-সাহিত্যচর্চা ও বিকাশের জন্য নিবেদিত খাঁটি একজন বাঙালি ছিলেন, যেখানে তিনি ব্যক্তি-বৈষয়িক স্বার্থ-চিন্তা করেননি। তিনি ইচ্ছে করলে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রবহমান কঠিন পথ ছেড়ে প্রতিষ্ঠিত ভাইদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেকে নিবেদিত করে অর্থশালী ধনী ব্যক্তিদের মতো নিশ্চিন্ত ঐশ্বর্যময় জীবন ভোগ করতে পারতেন। যতটুকু জানি, তার প্রতিষ্ঠিত ভাইয়েরা তাকে ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত করার জন্য কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু কবি নাসের মাহমুদ বিত্ত-বৈভবের জীবনে বিন্দুমাত্র মোহ অনুভব করেননি।
কখনো কখনো ভাইদের অনুরোধে যুক্ত হয়েছেন, কিছুদিন পরেই আবার সেখান থেকে পাখির মতো উড়াল দিয়ে নিজের আপন বাগানে ফিরে মন খুলে ছড়া লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, আড্ডা দিয়েছেন। তাকে অর্থ-ঐশ্বর্য্যে বাঁধবে, এমন শক্তি ভাইদের ছিল না, স্বাধীনভাবে গান গাওয়াই যার স্বভাব, তিনি কি অর্থবিত্ত-সংসারের খাঁচায় বন্দি থাকেন! থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে শিল্প-সাহিত্যে নিবেদিত সৎ মানুষ হয়ে একরকম সংসার ও অর্থবিত্ত বৈরাগী হয়েই আপন সাধনায় নিবেদিত থেকেই অসময়ে চলে গেলেন। এই সময়কালে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কত মানুষই তো বিখ্যাত, কিন্তু ভালো মানুষ কজন আছেন! ব্যক্তিলোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে ক’জন সত্যিকারের সাহিত্যসাধক হয়ে উঠতে পেরেছেন! আত্মবিক্রীত খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যসাধকদের মিলনমেলায় নাসের মাহমুদ ব্যতিক্রম ছিলেন, তিনি ভালো মানুষ ছিলেন।
ব্যক্তি-হীনস্বার্থে দলবাজি—স্বার্থ উদ্ধারে আত্মবিক্রয়—এসব তাকে কখনো দখল করতে পারেনি। নির্লোভ খাঁটি সাহিত্যসাধক আরও হয়তো অনেকেই আছেন, তারাও নাসের মাহমুদের মতোই অবহেলিত ও অমূল্যায়িত থেকে যান। তারা এসব নিয়ে ভাবেনও না। যেমন ভাবেননি নাসের মাহমুদ। নিজের আদর্শ-মূল্যবোধে-সততায়-সাধনায়—ভালোবাসায় নিজের মতো করে পথ হেঁটেছেন—যে পথ লালনের উদাসী একতারার মতো—সুরের মূর্ছনায় শুধুই মুগ্ধতা দিয়ে গেছেন, পাবার কথা ভাবেননি। নাসের মাহমুদ চলে গেছেন। তার সৃষ্টিকর্ম অমূল্য সম্পদ রেখে গেছেন। কিন্তু নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী যে আন্দোলন হলো, যে আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ছড়া লিখে নাসের মাহমুদ বারুদ জ্বালিয়ে রাখতেন। গোটা দেশেই তখন সাহিত্যে নতুন এক অগ্নি হাওয়া লেগেছিল স্বৈরাচারের পতন ঘটানোকে কেন্দ্র করে। সেই চেতনা বর্তমানে কতটা জীবন্ত আছে, প্রশ্ন জাগে।
৩.
নাসের মাহমুদ আমাদের কয়া বাজারে একসময় প্রায়ই আসতেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটা বিখ্যাত গ্রাম কয়া। এ গ্রামে একটি বাজার আছে—এটা ‘কয়া বাজার’ নামে পরিচিত। তিনি একসময় ওষুধের ব্যবসা করতেন। কয়া বাজারে ডা. রব্বেলের ডিসপেন্সারিতে প্রায়ই আসতেন। সেখানে তার সঙ্গে কখনো কখনো আমার দেখা হয়ে যেতো। ওষুধের বেচা-বিক্রি ফেলে কবিতার গল্প হতো। তিনি টাকা চাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। ডা. রব্বেল তার এই আত্মমর্যাদাকে সম্মান করতেন। তার লেখালেখি সম্পর্কেও জানতেন। নাসের মাহমুদ এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ডা. রব্বেল তাকে একজন গুণী কবি হিসেবে সম্মান করতেন এবং তার পাওনা টাকা একটা খামে ভরে বিনীতভাবে কবির হাতে দিতেন। নাসের মাহমুদ এতে সম্মানিত বোধ করতেন। তিনি খামটা খুলেও দেখতেন না। জানতেও চাইতেন না, খামের ভেতর কত টাকা আছে। খামটা নিয়ে অমনি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতেন। বোঝা যেতো, এ সব বেচা-বিক্রি, টাকা-পয়সার হিসাবের মানুষ তিনি নন। জীবন-জীবিকার জন্য নিরুপায় হয়েই যে কাজটা করছেন, আনন্দের সঙ্গে করছেন না, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে করছেন না, তা তার চেহারাতেই বোঝা যেতো। এটাও যে খুব বেশি দিন করেছেন, তাও নয়।
কয়া গ্রাম নিয়ে তার অনেক গর্ব ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী-বীরবাঘা যতীনের বাড়ি এখানে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই গ্রামের চ্যাটার্জি পরিবারের বিশেষ অবদান আছে, সাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় এ গ্রামের সন্তান, কবি শরৎশশী দেবী এ গ্রামের কন্যা, কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপধ্যায়ের পৈতৃকভিটা এখানে—এসব তার জানা ছিল। তিনি এসব বলতেন—গল্প করতেন। এ গ্রামের সন্তান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বইগুলো তার পড়া। তাকে নিয়েও গর্ব করতেন। কয়া গ্রামের মানুষকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। কয়া গ্রামের মানুষও নাসের মাহমুদকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের জন্মজয়ন্তি উপলক্ষে আমরাকয়ার বাজারে বেশ বড় করে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম।১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে। ‘ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন সাহিত্য সংসদে’র উদ্যোগে। আমি তখন এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। নাসের মাহমুদ এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। সাংবাদিক সনৎ নন্দীসহ কুষ্টিয়ার আরও অনেকেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। কয়া গ্রামের রাজনীতিক ব্রজেন বিশ্বাস অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে চা খেতে খেতে আলাপচারিতায় নাসের মাহমুদ বলেছিলেন, ‘আমাকে এই প্রথম কোন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির সম্মান দেওয়া হলো। তোমাদের গ্রামটা আমার ভালো খুব লাগে। ওষুধ বিক্রির জন্য তোমাদের গ্রামে যতটুকু আসি, তার থেকে অনেক বেশি আসি মনের টানে—এখানকার মাটির টানে—এখানকার মানুষের ভালোবাসা আমাকে টেনে আনে। ডা. রব্বেল আমাকে এত সম্মান করেন, আর কোনো ডাক্তারের কাছে আমি এত সম্মান পাইনি।’ নাসের মাহমুদের চোখটা সেদিন ভিজে উঠেছিল, সামান্য সম্মানেই তিনি শিশিরের মতো ভিজে উঠতেন। তার চোখের পাতা ভরা সেই আনন্দ-শিশির আমি এখনো অনুভব করি, যেমনটা লিখতে লিখতে এখন অনুভব করছি। মনে হচ্ছে এই তো কয়া বাজারে বাঘা যতীন থিয়েটারের বেঞ্চিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই কবি নাসের মাহমুদ কথাগুলো বলছেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
নাসের মাহমুদ আমাদের পরিবারের নমস্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন—তার দেওয়া সোনার হারটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি—কখনো কখনো বের করে স্পর্শ করি—যেন আকাশসমান উঁচু নাসের মাহমুদকেই স্পর্শ করি-যিনি আকাশের নক্ষত্র হয়ে আলোতে আলোতে মিশে গেছেন—সেই অধরা বড় ভাইকেই স্পর্শ করি।
সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় কয়া গ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। বহু বিখ্যাত মনীষীর পদধূলি রয়েছে এ গ্রামে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি আছে এখানে। সেই আবহটা প্রবহমান স্রোতের মতো চলে আসছে এখনো। কবি নাসের মাহমুদ কয়া গ্রামের সেই আবহে ক্ষণিক হলেও প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পেরছিলেন। কয়া গ্রামও তার মতো খ্যাতিমান কবি-ছড়াকারের স্মৃতি ধারণ করে ধন্য হতে পেরেছে।
৪.
নাসের মাহমুদ সময়ের স্রোতে আমার সাহিত্যচর্চায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। যখন যা লিখি, নিসঙ্কোচিত্তে তাকে দেখাই। না দেখানো পর্যন্ত স্বস্তি নেই। তিনি যত ব্যস্ত থাকুন, ও সবের গুরুত্ব না দিয়ে তাকে কবিতা দেখাই। তিনি গুরুত্ব দিয়ে কবিতাটা পড়েন। প্রথম বলেন খুব ভালো হয়েছে তো। এর পরে এক আধুটু পরামর্শ দেন। কখনো কখনো দুই-একটি শব্দ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। নাসের মাহমুদ আমার এবং আমার মতো অনেকের কাছেই প্রতিদিনের নিশ্বাসের মতো অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। আমি তখন অনার্সের ছাত্র। ১৯৯১ সালের কথা। কবিতার বই বের করবো। তাকে বলতেই তিনি বললেন, কবিতাগুলো নিয়ে সন্ধ্যার পরে বাসায় এসো। আমি এক সন্ধ্যায় ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’ কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তার বাসায় যাই। একদিনে শেষ হয় না। এভাবে কয়েক দিন যাই।তিনি আমাকে সামনে বসিয়ে কবিতাগুলো ঠিকঠাক করে দেন। কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম পরিবর্তন করে দেন। নিজের ব্যস্ততা ভুলে আমার মতো নগন্য একজন তরুণের কবিতা—যা আদৌ কবিতা হয়েছে কি না—তাই নিয়ে মেতে ওঠেন মহা-আনন্দে। তার আনন্দ দেখে—মূল্যবান সময়ের এমন ব্যয় দেখে মনে হয় যেন তার নিজের কবিতার বই বেরুচ্ছে! তার সেই আনন্দ মুখটা আমার চোখে লেগে আছে। সেই আনন্দমুখটা এখন আমার চোখের গহিনে বেদনার কাব্য—নীরব অশ্রুপাত।
৫.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ শেষ করে আমি ঢাকায় চলে আসি, জীবন-জীবিকার সন্ধানে। নাসের মাহমুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের খানিকটা ঘাটতি ঘটে যায়। কুষ্টিয়া গেলে দেখা হয়। কথা হয়। অবধারিতভাবে চা খেতে হয়। তখন তিনি কুষ্টিয়া শহরে খুব ব্যস্ত মানুষ। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন। ‘কাগজমেলা’ নামে কাগজ-কলমের স্টেশনারির দুটো দোকান দিয়েছেন। সারাদিন ক্রেতাদের ভিড়। সন্ধ্যা হতেই কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক—রাজনৈতিক কর্মী—মুক্তমনের মানুষদের নিয়মিত আড্ডা, আর দেদারসে চা। দোকানে লোকজন আছে, ক্রেতাদের তারাই সামলান। নাসের মাহমুদ তখন দোকানের ভেতরে বা দোকানের সামনে চেয়ারে বসে চা আর সাহিত্য আড্ডায় হারিয়ে যাওয়া মানুষ। দোকানের বেচা-বিক্রির হিসেবের বহু বাইরে তখন তিনি। এই ছিলেন আমাদের ‘ব্যবসায়ী’ নাসের মাহমুদ। যিনি আমার মতো অনেকেরই সাহিত্য গুরু ছিলেন—পরম শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন—ভালোবাসার মানুষ ছিলেন। ভালোবাসার ভেতরেই তিনি থাকতেন—সৃষ্টিশীলতার মধ্যেই তিনি থাকতেন। সেখানে লাভ-লোকসানের বৈষয়িক হিসাব কী করে জায়গা করে নেবে? পারেওনি বৈষয়িক হিসাব তাকে দখলে নিতে।
১৯৯৫ সালের শেষ দিকে পত্রিকায় সাংবাদিকতা দিয়ে আমার পেশাগত জীবন শুরু হয়। কয়েক বছর পরে আমি নিজেই সাপ্তাহিক ‘অর্থবিত্ত’ নামে একটি পত্রিকা বের করা শুরু করি। ‘অর্থবিত্ত’ বের হওয়ামাত্রই বিশ কপি করে নাসের মাহমুদকে পাঠিয়ে দিতাম। সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে। তিনি খুব খুশি হতেন। তার কাছে যারা আসতেন, তাদের সবাইকে দেখাতেন আর মুখ বড় করে বলতেন, ‘আমাদের রকিবের পত্রিকা’। ঢাকায় থেকে নিয়মিত এরকম একটা কাগজ করি—এ নিয়ে তার অনেক গর্ব ছিল। একবার ‘অর্থবিত্ত’র একটি সংখ্যায় তাকে নিয়ে লিখলাম এবং তার একটি ছবি বড়ো করে লেখাটির সঙ্গে রঙিন করে ছাপলাম। সে সংখ্যাটি তাকে কুরিয়ারে না পাঠিয়ে আমি কুষ্টিয়া চলে আসি—সংখ্যাটি নিজে তার হাতে দেবো বলে। সন্ধ্যায় তার দোকানে গিয়ে একপাশে দাঁড়াই—চুপচাপ। দেখি তার ব্যস্ততা। তিনি ব্যস্ততায় খেয়াল করেননি, আমি দাঁড়িয়ে আছি। ক্রেতা ভেবে তাকাতেই আমাকে দেখে আনন্দভর্তি স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘রকিব, কখন এসেছ? ভেতরে এসে বসো।’ আমি দোকানের ভেতরে গিয়ে বসি। বাইরে আরো অনেকেই বসে আছেন—চা খাচ্ছেন। আড্ডা দিচ্ছেন। আমার জন্য চা এলো। বললাম, ভাই ‘অর্থবিত্ত নতুন সংখ্যা’। বলেই তার হাতে দেই। সব কাজ ফেলে ‘অর্থবিত্ত’ হাতে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন, আর বলেন, কিভাবে এত সুন্দর একটা কাগজ কর!’ মূহূর্তেই একটা পাতায় তার চোখ আটকে যায়—রঙিন পৃষ্ঠার প্রায় অর্ধেকটা ভরে তার ছবি—তাকে নিয়ে লেখা। এক নিমিষে পড়লেন। তার পর বললেন, ‘আমার লেখালেখি জীবনে এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সম্মান—সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। আমাকে নিয়ে আর কেউ এভাবে লেখেননি।’ যারা সামনে বসে ছিলেন, তাদের সবাইকে অর্থবিত্ত’র একটা করে কপি দিয়ে বললেন, ‘দেখেন আমাদের রকিব আমাকে নিয়ে লিখেছে’। আমি তার আনন্দ দেখি—তার ভেতর একটা শিশুমন দেখি। তিনি যে আমাদের জন্য কতভাবে কত কিছু করেছেন, করছেন; সেসব নিয়ে কোনোদিন টু শব্দটিও করেন না। অথচ এক অনুজপ্রতিমের কাছ থেকে সামান্য এ সম্মানটুকু পেয়ে আনন্দে গর্বে কতভাবেই যে বললেন, একজন কত বড় মনের মানুষ হলে এমন করে বলতে পারেন!
আমি জানি এটি তার জন্য খুবই সামান্য কিছু। আসলে তিনি আমাকে খুশি করার জন্য, নিজে অনেক বেশি খুশি হওয়ার ভাব করেছেন। আমি যে কুরিয়ারে না পাঠিয়ে নিজে পত্রিকাটি হাতে করে কুষ্টিয়ায় তার কাছে চলে এসেছি, আমার এই আবেগকে তিনি ভালোবেসে বুক ভরে গ্রহণ করেছেন। আর তার প্রকাশ করলেন তাকে নিয়ে লেখাটির বারংবার প্রশংসা করে। একসময় আড্ডা শেষ হয়—দোকান বন্ধ হয়—আমরা দুজন পেয়ারাতলার দিকে একসঙ্গে হাঁটতে থাকি। আলোর ভেতর দিয়ে আমি এক আলোকিত মানুষের সঙ্গে পথ ধরে হাঁটতে থাকি—তার কথা শুনতে থাকি। সেই রাত আলোর থেকেও অনেক বেশি আলোময় ছিল—এখনো তা অনুভব করি। কুষ্টিয়ার কোনো পথই কি বাঁকি আছে যে-পথে নাসের মাহমুদের সঙ্গে আমি হাঁটিনি! হয়তো আছে, আমার জানা নেই। কুষ্টিয়াতে গেলে আমি এখনো অদৃশ্য অধরা কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদের সঙ্গে হাঁটি—যে মানুষটি গোটা কুষ্টিয়াকে কবিতা-ছড়ায় আলো বুনে রাখতেন, সেখানে বসেই সারা দেশে তিনি ছড়িয়ে থাকতেন—সারা দেশের ভালোবাসা তার জন্য কুষ্টিয়াতে নেমে আসতো নীরব শিশিরের মতো—সারা দেশ জানতো, কুষ্টিয়াতে নাসের মাহমুদ আছেন।
৬.
কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদ দূরে থেকে আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। ২০০২ সালে ২৭ জুন আমার কাব্যর (কাব্য হাসান) জন্ম। কুষ্টিয়াতে। কাব্যর মামা-খালারা তখন কুষ্টিয়ার নতুন কোর্টপাড়ায় থাকেন। টালি পাড়া নামেও পরিচিত। কাব্য হাসপাতাল থেকে মায়ের সঙ্গে সেখানেই ওঠে। তখন বৃষ্টির শহর কুষ্টিয়া। যে বাসাটাতে থাকতো সেই বাসাটার সামনের পথ বৃষ্টির পানিতে প্রায় সময় ডুবে থাকতো। প্যান্ট হাঁটুর ওপর গুঁজে, স্যান্ডেল বা জুতা খুলে হাতে নিয়ে যেতে হতো। কাব্য’র মামা-খালারাও নাসের মাহমুদের খুব কাছের মানুষ, রাজনৈতিকভাবে—সাহিত্য-শিল্পের মানুষ হিসেবে। যেন একই পরিবারের সদস্য সবাই। তখন সেই বাসাতে কারও মোবাইল ছিল না। আমি কুষ্টিয়া থেকে চলে আসার পরে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে কিভাবে! ভাবতেই নাসের মাহমুদ একেবারের অভিাভাবকসুলভ কণ্ঠে বললেন, ‘এটা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি প্রতিদিন রাত দশটার পরে কল পাবে। মিলির সঙ্গে কথা বলতে পারবে।’ তখন প্রতিদিনই প্রায় কুষ্টিয়ায় বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাট ডুবে থাকে।আমি চলে অসার পরে তিনি প্রতিদিন রাতে ‘কাগজমেলা’ বন্ধ করে বাসায় যাবার পথে মিলিদের নতুন কোর্টপাড়ার বাসায় যেতেন। প্যান্ট হাঁটুর ওপরে গুঁজে, এক হাতে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে, বগলে কোনো পেপার বা কবিতার বই চেপে, ছাতা মাথায়, মোবাইল বুক পকেটি ভরে রাত সাড়ে দশ এগারটার দিকে মিলির বাসায় যেতেন। তারপর তার মোবাইল থেকে ফোন করে আমার সঙ্গে মিলির কথা বুলিয়ে, কাব্যকে এক পলক দেখে আবার ঝুমঝুম বা ঝিরঝিরে বৃষ্টির পথে কাদাপানি পেরিয়ে বাসায় ফিরতেন। একদিন দুদিন নয় অনেকগুলো দিন তিনি প্রতিরাতে এভাবে গিয়েছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে প্রতিদিনই বারণ করেছি, প্রতিদিনই বলেছেন, ‘আমি তো বাসায় ফেরার পথেই প্রতিদিন কাব্যকে দেখে যায়। এতে আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না।’
আমি তো জানি রোজ রোজ বৃষ্টিস্নাত অতটা রাতে পেয়ারাতলার বাসায় ফেরার পথে নতুন কোর্টপাড়া হয়ে যাওয়াটা সহজ নয়। মিলি যতদিন কুষ্টিয়া ছিল, প্রতিটি দিন তিনি রাতে তাদের বাসায় গিয়েছেন। আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলিয়েছেন। আমাকে হয়তো অনেকেই স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু নাসের মাহমুদের মতো অতটা গভীরভাবে তখন আমাকে আর কেউ স্নেহ করেননি। আমার পরিবারকেও তার মতো করে আর কেউ ভালোবাসেননি।
নাসের মাহমুদ এর পর ঢাকায় চলে আসেন। শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে ‘বাংলার মুখ’ বইয়ের দোকানের দায়িত্ব নিয়ে বসেন। এটার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কবি-গবেষক বিলু কবীরের। তিনি তখন একটা এনজিও প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। এনজিওর মালিকও সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা ছিলেন। নাসের মাহমুদ আর বিলু কবীর দুজনে বন্ধু—হৃদয়ের গভীরে তাদের বন্ধন—অবিচ্ছেদ্য আত্মা। নাসের মাহমুদকে একটা সুন্দর দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে আসাই তার মূলত মূল লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্যেই এনজিও প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে ‘বাংলার মুখ’-এর জন্ম হয়। যার পুরো দায়িত্ব ছিল নাসের মাহমুদের। বই বিক্রি সেখানে কতটুকু হতো জানি না, যখনই গিয়েছি, তখনই আড্ডা দেখেছি, নিজেও কখনো কখনৈা সে আড্ডায় শরিক হয়েছি। সেখানেই একদিন তিনি আমাকে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, একটি কথা তিনি বলতেনই, বিপ্লবী বাঘা যতীন নিয়ে রকিব একটা ভালো কাজ করেছে। বাঘা যতীনের প্রতি তার অতল শ্রদ্ধা ছিল। তিনি আমার ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন’ বইটি ‘বাংলার মুখে’ এমনভাবে সাজিয়ে রাখতেন, যেন সবার চোখে পড়ে। আমার এত ভালোবাসা, এত আদর কিভাবে যে মাটিতে মিশে গেলো, ভাবতে বুকটা ভেঙে আসে। যখনই দেখা হতো বা মোবাইলে কথা হতো। প্রথমেই তিনি বলতেন, ‘কাব্য কেমন আছে? মিলি কেমন আছে?’ তারপর জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি কেমন আছ?’ তারপর জানতে চাইতেন কী লিখছি, কী পড়ছি। পত্রিকা কেমন চলছে। একদিন হুট করে আমার মিরপুরের বাসায় এলেন। আগে থেকে একটুও বলেননি। মিরপুর-১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে এসে ফোন করে বললেন, তোমার বাসার ঠিকানা বলো।
বললাম, আপনি কোথায়?
বললেন, মিরপুরে আছি। ঠিকানাটা বলো, আমি তোমার বাসায় আসবো।
আপনি মিরপুরের কোথায়, বলেন। আমি আসছি।
তোমাকে আসতে হবে না। মিরপুরের সব চিনি আমি।
ঠিকানা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই দেখি তিনি চাপাহাসিতে আমার দরোজায়। দরোজাটা খুলেই অপেক্ষা করছিলাম। একটা বড় খামে কয়েকটা কবিতার বই জড়ানো। আমাদের বাসাটা নতুন প্রাণ পায়। কাব্য ছোট। আড়াইজনের বাসা যেন অন্যরকম এক আনন্দে ভরে ওঠে। কাব্য সামনে আসতেই পকেট থেকে সোনার একটা হার বের করে নিজে হাতে কাব্যর গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘কাব্যর জন্য এটা কয়েকদিন আগে কিনেছি। সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াচ্ছি। ওকে দিতে আসবো সময় মিলছিল না।’ যে মানুষটা কোথায় যাচ্ছেন—কোথায় আড্ডা দিচ্ছেন—কোথায় কী খাচ্ছেন না-খাচ্ছেন, নিজের সংসারের খবর থাকে না নিজের কাছে, সেই মানুষটি মানুষের জন্য কত গভীর স্নেহ আদর ভালোবাসা বুক ভরে নিয়ে বেড়াতেন, সেখানে তার একটুও কমতি ছিল না, একটুও ভুল হতো না, কতো মমতায় কতো দরদ দিয়ে কত প্রিয় মুখ নিজের বুকের ভেতর ভরে রাখতেন, বাইরে থেকে ‘এলোমেলো’ মানুষটিকে দেখে তা কিছুতেই বোঝার উপায় ছিল না। আমি ও মিলি বললাম, ভাই, আপনি এ কী করেছেন!আপনার দোয়া ও আশীর্বাদই তো ওর জন্য বড় সম্পদ।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন সংসার জীবনে চরম বিহেসিবে, কবিতায় ছিলেন কঠিন হিসাবী। এই বাংলারই আর এক নাসের মাহমুদও সংসারে কোনোদিন হিসেবের মধ্যে থাকেননি, কিন্তু তার ছড়ায় তিনি ছিলেন পুরোদস্তর হিসেবি। আর মানুষের প্রতি ছিল তার বুকভরা ভালোবাসা। কাব্যকে নিয়ে যখন বলেন, ‘আমি তো ওর বড় চাচা। কাব্য একদিন অনেক বড় হবে। ওর ভেতরই আমি বেঁচে থাকতে চাই।’ আনন্দে তার চোখ দুটো ভিজে ওঠে। আমরা অবাক হয়ে দেখি, আমাদের সময়কালের এক ঋষীপুরুষকে—যিনি সাধারণের ভেতর থেকে অসাধারণ অসামান্য।
সারা রাত দুজনে সাহিত্যের কত কী নিয়ে আলোচনা করেছি। একটুও ঘুমাইনি। রাতের গভীরে সাহিত্যের আলোচনা, নিজেদের কবিতাপাঠ আর মাঝে মাঝে মিলির চা—কখন যে রাত ভোর হয়ে আসে, দু’ভাই বুঝতেই পারিনি। আমাদের গ্রামটা নিয়ে তিনি খুব গর্ব করতেন। বলতেন, বিপ্লবী বাঘা যতীন, সাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়—সবই তোমাদের গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তোমাদের গ্রামে এসেছিলেন। ভাবা যায় ব্যাপারটা! দেখো, একদিন তোমার নামটাও তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। আমি বলি, ‘ভাই, এটা বেশি হয়ে গেলো’। তিনি বললেন, ‘বেশি বলিনি। ঠিকই বলেছি। আমার এই কথাটা একদিন সত্য হবে’। আমি আর কথা বাড়াই না। ওমর আলীর কবিতা তিনি পছন্দ করতেন। সেই রাতে ওমর আলীর কবিতা নিয়েও কত কথা হয়েছে। বলেছেন, ওমর আলী বাংলাদেশের একজন খাঁটি কবি। আবুল আহসান চৌধুরীর গবেবষণা, বিলু কবীরের লেখালেখি, আখতারুজ্জামান চিরুর কবিতা, খৈয়াম বাসারের কবিতা—শাহানারা ঝর্নার কবিতা—কুষ্টিয়ার আরও কত কবি-সাহিত্যিককে নিয়ে সেই রাতে কত আলোচনা হয়েছে।
আলী হাবীবের ছড়া নিয়েও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। সেই রাতে চেনা-জানা হৃদয়ের কাছের কত কবিদের নিয়ে যে তিনি গল্প করেছিলেন। কুষ্টিয়াকে তিনি কী যে গভীর ভালোবাসায় বুকের ভেতর ভরে রাখতেন। জীবনের কী এক নিয়তি, সেই ভাই—যিনি আমার পথপ্রদর্শক—আলোর পথ—সেই প্রাণবন্ত স্নেহপ্রবণ কবি নাসের মাহমুদ—এখন কী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন—সেই ঘুম আর ভাঙে না কোনোদিন—ভাঙবেও না। আর কোনো রাত তার সাথে আলোর গল্প হয়ে নিদ্রাহীন হয়ে উঠবে না।
নাসের মাহমুদ আমাদের পরিবারের নমস্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন—তার দেওয়া সোনার হারটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি—কখনো কখনো বের করে স্পর্শ করি—যেন আকাশসমান উঁচু নাসের মাহমুদকেই স্পর্শ করি-যিনি আকাশের নক্ষত্র হয়ে আলোতে আলোতে মিশে গেছেন—সেই অধরা বড় ভাইকেই স্পর্শ করি।
৭.
একবার বইমেলায় আমি, মিলি ও কাব্য ঘুরছি, হুট করে দেখি সামনে নাসের মাহমুদ। কী যে খুশি হলেন—সারা মুখে আনন্দের আভা ছড়িয়ে কাব্যকে বুকের ভেতর লতার মতো জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘কাব্য, তো বড় হয়ে গেছে। সেই একটুখানি কাব্য! বৃষ্টির ভেতর ভিজে ভিজে ছোট্ট একটা কাব্যকে দেখতে যেতাম, সেই কাব্যটা এখন বইমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে! খুব ভালো লাগছে, রকিব। চলো, সবাই মিলে চা খাই।’ একসঙ্গে সবাই চা খাই। তারপর কাব্যকে নিজের লেখা বই দিলেন। নিজের হাতে কী সুন্দর করে কাব্যর নাম লিখে দিলেন। লিখতে লিখতেই বলেন, ‘কাব্য নামটা খুব সুন্দর হয়েছে’।
কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদ আছেন তার সোনার বাংলাদেশেই—বাংলাদেশের মাটিতেই—এক জাতিতে—এক আকাশের পাখি হয়ে।
কাব্য এদিক থেকে সৌভাগ্যের অধিকারী। বইমেলায় গেলেই তার বিলু কবীর কাকু, আহসান নবাব কাকু, আব্দুর রউফ কাকু তাকে কত যে বই উপহার দেন। কত যত্ন করে কাব্যর নামটা লেখেন। বেঁচে থাকলে আবারও বইমেলায় যাওয়া হবে আমাদের। কিন্তু হুট করে ছুটে এসে পরম আপনজন নাসের মাহমুদ বুকভরা স্নেহ মমতা ভালোবাসায় কাব্যকে বুকের ভেতর আর জড়িয়ে ধরবে না। আমাদের স্নেহসিক্ততায় বাঁধবে না। কাব্যর মায়াবী মুখটা নেড়ে নেড়ে বলবে না কাব্যটা বড় হয়ে যাচ্ছে। এই বেদনা চিরকাল আমাদের বহন করে বেড়াতে হবে। এই শূন্যতা কোনদিন যাবার নয়। নাসের মাহমুদের শূন্যতা আমাদের পরিবারে আরো বড় হয়ে উঠলো, তার মৃত্যুর ঠিক দুমাস পরেই ৩ জুন ২০২০ আমার অনুজ রুস্তম আল বুলবুল আকস্মিকভাবে মারা যায়। বুলবুলের মৃত্যুতে যে শোক আমাদের পরিবারকে বিব্ধস্ত করে তুলেছিল, তখন নাসের মাহমুদ বেঁচে থাকলে তার যে শান্ত্বনার হাতটি মাথার ওপর শক্ত করে পেতাম, সেটা অনুভব করে আরো বেশি শোকার্ত হয়েছি। কষ্টে বেদনায় শূন্যতায় বুঝেছি, কতোটা আপন ছিলেন তিনি, বিপদে তার মুখটা বারবার মনে করেছি, আমাদের এই মহাবিপদে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জন্য নাসের মাহমুদকে খুব প্রয়োজন ছিল। কঠিন বাস্তবে এও বুঝেছি, পরম আপনজন নাসের মাহমুদের স্নেহার্দ্র নির্ভরতার হাত আর কখনো আমাদের মাথার ওপর পাবো না—আমাদের চারদিক ফাঁকা হয়ে গেছে—চারপাশ শূন্য হয়ে গেছে।
৮.
বিশ্বসাহিত্যে কেন্দ্রে স্নেহধন্য নাট্যকার-কবি-প্রাবন্ধিক লিটন আব্বাসের উদ্যোগে কুষ্টিয়ার কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে একটা মিলনমেলা হয়েছিল। ২০১৭ সালে। অনুষ্ঠানে আমি মিলি ও কাব্য ঢুকেই কবি নাসের মাহমুদকে খুঁজতে থাকি। তিনি সামনের সারিতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। সামনের দিকেই খুঁজি। পাই না। প্রফেসর ড. আনোয়ারুল করিম, আখতারুজ্জামান চিরু, বিলু কবীর, প্রফেসর ড. সরওয়ার মুর্শেদ, মাহমুদ হাফিজ, অখিল পোদ্দার, আদিত্য শাহিন সহ কুষ্টিয়ার প্রায় সব কবি-সাহিত্যিককেই দেখি, কথা বলি। কিন্তু নাসের মাহমুদকে না দেখে লিটন অঅব্বাসকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, ‘নাসের ভাই তো সবার আগে এসে সবার পেছনে বসে আছেন। সামনে বসাতেই পারলাম না।’ আমি মিলি কাব্য পেছনে নাসের মাহমুদের কাছে চলে যাই। সেখানে সনৎ নন্দী আহসান নবাব একসঙ্গে চুপ করে বসে আছেন। কাব্যকে দেখেই বললেন, ‘কাব্য, আসো আসো।’ কাব্যকে কাছে নিয়ে বসান। আমি ও মিলিও তার পাশে বসি। অনুষ্ঠান শেষে কবি নাসের মাহমুদ ও সরওয়ার মুর্শেদের সঙ্গে আমরা সপরিবারে ছবি উঠি। ছবি তোলার সময়ও কবি নাসের মাহমুদ বললেন, কাব্য, তুমি আমার পাশে আসো। বলেই একহাতে ওকে জড়িয়ে নেন। সেই তো তার হাতে আমাদের শেষ ছবি। এমন স্নেহ-মায়া আমরা চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের জীবনে একজন নাসের মাহমুদ-হয়ে আর কেউ কখনো আসবেন না। এই শূন্যতা কোনোদিন কোনো কিছুতেই পূর্ণ হওয়ার নয়।
নাসের মাহমুদ, তাকে না পেলে আমার লেখক হয়ে ওঠার পথটা হয়তো পথের মধ্যেই থেমে যেতো। তাকে কোন অভিধায় অভিহিত করলে তার প্রতি আমার যথাযথ যোগ্য সম্মান জানানো হবে, জানি না। তবে তাকে সব সময় যে সম্ভোধন করে এসেছি, সব সময় যা ডেকেছি, সেটিই আমার কাছে মহামূল্যবান, ‘ভাই’; তিনি আমার ভাই ছিলেন। আমি আমার ভাইকে শেষবেলায় শেষবারের মতো ছুঁতে পারিনি। এক অনুজের অক্ষমতার এই বেদনা এই অবর্ণনীয় কষ্ট চিরকালের।
৯.
কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদ। তিনি এদেশে নিজের মূল্যায়নের কথা ভাবেন নি। পুরস্কারের কথা ভাবেননি। এই দেশটাকে ভালোবেসেছিলেন। বন্ধুদের সাফল্যে নিজের সাফল্য অনুভব করেছেন। তা না হলে প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের বাংলা একোডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আনন্দে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাঁচা ভোরে কেন ফোন করে বলবেন, ‘আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তিতে মনে হচ্ছে পুরস্কারটা আমিই পেয়েছি’। এমন মাটির মানুষ—এমন সহৃদয় বন্ধু এই সময়কালে বিরল। কবি নাসের মাহমুদ সত্যিকার অর্থেই একজন বিরল মানুষ ছিলেন। তিনি পৃথিবীর অন্য কোথাও থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন নি।এই দেশেই থাকতে চেয়েছেন—এক অভিন্ন জাতি হয়ে—এক আকাশের পাখি হয়ে থাকতে চেয়েছেন, দুস্থ ও গরীব মানুষের দুঃখ মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন—যেখানে তিনি কবি-সত্তার ভেতর দিয়ে তারও অধিক উজ্জ্বল মানবতাবাদী নাসের মাহমুদ হয়ে ওঠেন। তার ব্যক্তিক জীবন থেকে সাহিত্যকর্ম-রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহ—সর্বক্ষেত্রে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত।কবি-ছড়াকার নাসের মাহমুদ আছেন তার সোনার বাংলাদেশেই—বাংলাদেশের মাটিতেই—এক জাতিতে—এক আকাশের পাখি হয়ে। তার ‘এক আকাশের পাখি’ ছড়া দিয়েই তাকে শ্রদ্ধা জানাই—
আমরা সবাই বাংলাদেশের
বাংলাদেশে থাকি,
আমরা সবাই সবার স্বজন
প্রীতির পরাগ মাখি।আমরা সবাই অন্যে একের
দুঃখ শোকে আছি,
আসুক বিপদ থাকবো সবাই
সবারকাছাকাছি।দুস্থ এবং গরিব যারা
এই দেশেরই লোক
আমরা সবাই চাইবো তাদের
দুঃখ মোচন হোক।সোনার বাংলা সুখের হোক
স্বপ্ন বুকে আঁকি
আমরা সবাই একই জাতি
এক আকাশের পাখি।