[পর্ব-৫ ॥ মাদ্রাসা পর্ব]
কপাল ফেটে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন বিছানায় ছিলাম। ক্ষত কিছুটা শুকিয়ে এলো। একটু একটু ভালো লাগছে। মাদ্রাসায় যেতে হয় না। দুপুরে বাবা বাজার থেকে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তার ভাষায় তিনি জিরান। তাও ঘরের পেছনে পুকুর পাড়ে, আম গাছের তলায়। হোগলা পাতার দাড়ি বিছিয়ে। বালিশ ছাড়া, উপুড় হয়ে শুয়ে বিষাদসিন্ধু পড়েন।
বাবাকে পড়তে দেখলে আমিও তার পাশে গিয়ে বসি। বাবা পড়তে পড়তে ক্লান্তি বোধ করেন। কিন্তু কাহিনী জানতে তার আগ্রহে ভাটা পড়ে না। তাই যেখানে তিনি শেষ করেছেন, সেখান থেকে আমাকে পড়তে বলেন। আমিও জোরে জোরে পড়ি। পড়তে পড়তে সিমারের নিষ্ঠুরতায় শিহরে উঠি। এজিদকে কাফের বলে গালি দেই। পড়তে পড়তে আমার গলা ধরে আসে। বাবা আমার কপালে চুমো খান। বাজার থেকে নিয়ে আসা পপুলার বিস্কুট (আট আনার কয়েনের সমান ছোট দুধ-চিনিযুক্ত বিস্কুট) খেতে দেন। সঙ্গে আমার ভাইকেও। তার হাতে ৫ প্যাকেট। প্রতি প্যাকেটে চারখানা করে। আমার হাতে এক প্যাকেট, তাতেই বিশখানা বিস্কুট। আমাকে যা দেবেন, বাবা তাকে দেবেন তার ৫ গুণ। নাহলে সে তুলকালাম করে ফেলবে।
এর পেছনে একটি দুর্ঘটনার ইতিহাস আছে। সেবার বাবা আমাদের জন্য মার্বেলের মতো দেখতে গোল গোল কমলা স্বাদের লজেন্স আনলেন। আমরা ছোট বেলায় ওই লজেন্সগুলোকে বলতাম বারো মিঠাই। তো বাবা আমাদের দুজনকে দুই প্যাকেট দিলেন। প্রতিটি প্যাকেটে ১০টি করে।
কিন্তু ওই সিমারের বাচ্চা সিমার কই? আমার পোলারে এই খুন করলো যে সিমার, সেটা কই?
দুজনের সমান কেন—আমার ভাই ইসমাইল নেবে না। এই নিয়ে তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু। আমার প্যাকেট থেকে কেড়ে নিতে চায়, আমিও নাছোড় বান্দা। কিছুতেই দেবো না তাকে। সেও জেদি। হাতের কাছে ছিল দরোজা থেকে খুলেপড়া, মরচেধরা ব্যাং (কাঠের দরোজার চৌকাঠের ওপর থেকে দুই কপাটের মাঝখানে ঝুলতে থাকা একধরনের ছিটকিনি, তাতে দরজা বন্ধ থাকে। বাইরে থেকে কেউ খুলতে পারে না) আমার কপালে ছুড়ে মারে। অমনি ব্যাংয়ের পেরেক ঢুকে যায় আমার কপালে। ব্যাংটিও দরজায় যেভাবে ঝুলতো, সেভাবে আমার নাকের ওপর ঝুলছে। আমি দুই চোখে কিছুই দেখছি না। মাথাটা কেমন যেন ভনভন করে উঠলো। অমনি প্রাণপণে দিলাম চিৎকার। তাতেই ছুটে এলেন মা, বাবা, পাশের বাড়ির লালি-কালি দুই বোন। পেছনের বাড়ির ইউসুফ।
লালি-কালিদের মধ্যে কেউ একজন হেঁচকা টানে ব্যাংটা খুলে নিলো। মাকে বললো, হোগলা পাতা পোড়াতে। মা পোড়ালেন। সেই ছাইয়ের সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে কপালে চেপে ধরা হলো। যেই আমার কপালে হাত রাখছে, সেই-ই রঙিন হয়ে উঠছে। বাজার অনেক দূর। ডাক্তার আনতে কে যাবে? বাবা যাবেন যাবেন করছেন। এমন সময় ইউসুফ বললো, কাকা ‘আঁই যামু। দুই কিলোমিটার দূরে বাংলাবাজার। সেখানে বড় ডাক্তার কিরণ ডাক্তার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে হাজির তিনি। আমাকে দেখে মাথায় হাত রাখলেন। হোগলা পাতার ছাই কেন দেওয়া হলো, জানতে চাইলেন না। ডেটল দিয়ে ক্ষতস্থান মুছে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিলেন। এরপর একটা ইনজেকশান দিলেন। বললেন, আল্লাহ ভরসা। কিচ্ছু হবে না। কিন্তু ওই সিমারের বাচ্চা সিমার কই? আমার পোলারে এই খুন করলো যে সিমার, সেটা কই?
আবার বাবা বললেন হেতে কি আর এই মুল্লুকে আছে দাদা? সন্ধ্যার পর ঘরে ঢুকবো আরকি। এরপর কিরণ ডাক্তার জানতে চাইলেন, কী কারণে এই রক্তাক্তি? বাবার জবাব শুনে কিরণ ডাক্তার সমাধান বাতলে দিলেন। বললেন, ‘হকরে দিবি এক প্যাকেট। ইসমাইলকে দিবি ৫ প্যাকেট। বিস্কুট বা লজেন্স, সংখ্যায় কিন্তু সমান থাকবে। শুধু প্যাকেট হবে কম-বেশি। দেখবি আর ঝামেলা হবে না।
সেই থেকে এই পদ্ধতি। তার ৫ প্যাকেট। আমার এক। যে যার মতো খুশি। কোনো ঝগড়া হয় না। তো সেদিনও বিষাদসিন্ধু পড়ছিলাম। বাবা শুনছিলেন। এমন সময় রাস্তা থেকে ভেসে এলো, ‘আমারভাই, তোমার ভাই/ কালাম ভাই কালাম ভাই।’ ‘কালাম ভাইয়ের মার্কা কী? হারিকেন ছাড়া আবার কী?’ (কালাম, ইনি আমার একমাত্র চাচা। পূর্ণ নাম আবুল কালাম আজাদ। লোকে কালাম নেতা হিসেবে চেনে) সাল মাস তারিখ মনে নেই। ওই মিছিল শুনে আমার পড়া বন্ধ। কিছু ক্ষণের মধ্যে আমার বয়সী সাত আট জন ছেলেমেয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। তারাও বলছে, ‘আমার ভাই তোমার ভাই/ কালাম ভাই কালাম ভাই।’ তাদের দেখাদেখি আমরা দুই ভাইও বলছি, ‘আমার ভাই তোমার ভাই/ কালাম ভাই কালাম ভাই।’ বাবা শুনে দিলেন ধমক—কী কস তোরা? চাচারে কেউ ভাই কয়? মা এসে আস্তে করে বললেন, থাকনা। ওরা কি আর অতশত বুঝে?
নির্বাচন, ধর্মঘট, মিছিল, সিনেমা, রাজ্জাক-শাবানা, আলমগীর-কবরী এসব মরিয়মের নখদর্পণে।
আসরের আজান পড়েছে। মা নামাজে গেছেন। বাবা গেলেন বাজারে। আমরা সাত-আট জন পুকুর পাড়ে বসলাম। ইউসুফ প্রস্তাব দিলো, আমরা নির্বাচন করবো। শুধু চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন। প্রার্থী কারা কারা তাও ঠিক করা হয়ে গেলো। ইউসুফ আর জাফর। দুজনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা কেউ কাউকে ফেলে কোথাও যাই না। আমি মাদ্রাসা থেকে বাড়ি আসায় তারা দুজনেই বেজায় খুশি। কিন্তু তাদের দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় আমি কোনদিকে যাবো? শেষে মরিয়ম নামে আমাদের এক চাচাতো বোন আমাকে পরামর্শ দিলো, তুই নির্বাচন কমিশনার হ। বললাম, সেটা আবার কী জিনিস?
আমাদের সাত আটজনের মধ্যে মরিয়ম অনেক বিষয়ে বেশি ধারণা রাখে। তার বাবা খুলনা বন্দরে চাকরি করতেন। তারও আগে নাকি রেঙ্গুনে ছিলেন্। বেশি সৌখিন মানুষ। রসিকও। কথা বলতেন মেপে মেপে। খুলনার চাকরি শেষে কদিন আগে বাড়ি করেছেন আমাদের বাড়ির পেছনে। নির্বাচন, ধর্মঘট, মিছিল, সিনেমা, রাজ্জাক-শাবানা, আলমগীর-কবরী এসব মরিয়মের নখদর্পণে।
আমরা যখন সাত-আটজন গল্প করতে বসি, সেই আসরের প্রধান কথক মরিয়ম। কত গল্প যে সে বলে যায়, কখনো গরিবের বউ শাবানার কষ্টের কথা, কখনো সুভাষ দত্ত-কবরীর কথা। সে মাঝে মাঝে লজ্জায় মুখ লুকাতো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনতাম। সে বলে, বিশাল আকারের নাকি সিনেমা হল আছে। একটাই ছাদ। কিন্তু তিন-চার তলা উঁচু। নিচ থেকে ওপরের দিকে সারিসারি সিঁড়ি। সেখানে ২ টাকা ৩ টাকার টিকিট কেটে মানুষ বই দেখতে যায়। সেও নাকি তার ছোট ভাইয়ার সঙ্গে গেছে বহুদিন। আমরা বলি, বই তো পড়ে। সেটা আবার হলে গিয়ে দেখে ক্যামনে? মরিয়ম আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ির মতো মুখের একটা ঝামটা মারে। তারপর বলে, হুম। এজন্য তোদের কাছে কিছু বলতে চাই না। তোরা কিচ্ছুই চিনছ না। একধরেন বই হলো কাগজের বই। যেগুলো আমার স্কুলে পড়ি। আরেক ধরনের বই আলোর। বিশাল দেয়ালে সে আলো পড়ে, কিন্তু আলো কে ফেলে, তা জানি না। কিন্তু সেই আলোতে নায়ক-নায়িকারা কথা বলেন। বিয়ে করে। সংসার করে। তবে বেশিরভাগ সময়ই বিয়ের আগেই তাদের মধ্যে ভাবভালোবাসা হয়। একজন আরেকজনের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত থাকে। ওই যে লাইলী-মজনুর কাহিনী শুনছস না? ওইরকম আর কি!
তোর তো কোনো কাজ নাই। সবাই ভোট দিবো। তুই ভোট গুনে খালি ঘোষণা করবি, কে জিতলো, বুঝলি বুদ্ধু?
মরিয়ম একটানে কথাগুলো বলে দম নেয়। ইসমাইল তখন খেজুরপাতার পাংখা বানিয়ে কাঁটার মাথায় বিশেষ কায়দায় গেঁথে দক্ষিণমুখী ধরে রেখেছে। তাতে ওই পাংখা ভোঁভোঁ করে ঘুরছে। এদিকে ঘরের চালার বাঁশের কোটরে ঢুকে পড়েছে একটি কালো ভ্রমর। আমি আর যাই কই, দ্রুত ম্যাচের খালিবাক্স বাঁশের কোটরে মুখে চেপে ধরলাম। আরেক মাথায় দিয়ে নারকেলের শলা দিয়ে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাতেই ভ্রমরাটি ঢুকে পড়লো ম্যাচবাক্সে। সঙ্গে সঙ্গ বন্ধ করে দিলাম মুখ। তারপর সাধারণ চিকন তারকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ল্যান্ডফোনের তারের মতো করে একমাথা ঢুকিয়ে দিলাম ম্যাচ বাক্সে। অন্যপ্রান্ত নারকেলের মালার সঙ্গে গেঁথে দিলাম। এরপর মালাটি আম গাছের ডালে দিলাম বেঁধে। এবার ম্যাচের ভেতর খেজুর কাঁটা ঢুকিয়ে মাঝেমাঝে নাড়া দিলেই ভ্রমর গুনগুন শুরু করে ওঠে। আর সেটি হয়ে ওঠে আমাদের গ্রামোফোন।
মরিয়মের কাছে বিষয়টি নতুন। সে সবস্মিয়ে বিষয়টি দেখলো বটে। কিন্তু তার গল্পের মাঝখানে আমরা দুই ভাই দুই কাণ্ড ঘটানোয় সে বেশ বিরক্ত হলো। বললো, যা তোরা চরুয়া। গ্রাম্য। সিনেমা-টিনেমা বুঝছ না কিছু। তোদের লগে আর কথা নাই। বলতে বলতে উঠতে যাবে, অমনি লালি-কালি দুই বোনা হাত চেপে ধরে বলে, তুই আঙ্গো সই, আঙ্গোরে ক।
এবার বেঁকে বসলো মরিয়ম। বললো, বাদ দে। কাজের কথা কই। চল আমার নির্বাচন করি। হকসাবরে করি নির্বাচন কমিশনার, ইউসুফ আর জাফর হবে চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার প্রস্তাবে সবাই রাজি। কেবল আমি শঙ্কিত। আমার কাজ কী? আমি কী করবো? বুঝতে পারছি না। আমার মনোভাব সম্ভবত মরিয়র বুঝতে পেরেছে। সে এসে বললো, তুই আসলেই বোকা। তোর তো কোনো কাজ নাই। সবাই ভোট দিবো। তুই ভোট গুনে খালি ঘোষণা করবি, কে জিতলো, বুঝলি বুদ্ধু?
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৪॥ মোহাম্মদ নূরুল হক