(পর্ব: ২৩)
জীবনের নামতায়, সেই পথচলায়, ঢাকা শহরে আবার লজিং?
লজিং? এই প্রথা কবে কিভাবে চালু হয়েছিল? কেউ জানে? আছে কোনো ইতিহাস? লজিং থাকা মানে এক ধরনের দাসত্ব তো বটেই। আড়ালে থাকে পড়ালেখা। লজিং বাড়ির দাসত্ব মেনে কত লজিং থেকে কত মানুষ বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শেষ নেই। শফিক হায়দার ভেবেছিল, মেট্রিক পাস শেষে ঢাকায় আসার পর আর লজিং থাকতে হবে না। মোড়েলগঞ্জের জহির ব্যাপারীর মেয়ে লীমা আর দক্ষিণ সূতালড়ি হাই স্কুলের হোসনে আরার আবছা স্মৃতির সঙ্গে লজিংয়ের ইতিহাসও শেষ করে ঢাকার সদরঘাটে পা রেখেছে। কিন্তু সরদঘাটের রাস্তা এমনই পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত যে, হারিয়ে ফেলা লজিং জীবনে আবার প্রবেশ করতে হলো।
কবে যাবি? মাহমুদ প্রশ্ন করে।
লজিং আমার ভালো লাগে না, আপন মনে বলে শফিক হায়দার। কাঙাল কাঙাল লাগে।
ফুটানি কইরো না চান্দু, মাহমুদ হাসান একেবারে বরিশালের ভাষায় ঢুকে যায়। রেডিওতে পাও সাড়ে সাতশো টাহা। বাড়িতে টাহা পাডাইয়া পকেট খরচের কিচু থাহে? হের ওপর লেহালেহির দুই টাহার ব্যাগ লইয়া ঘোরো। লজিং থাকলে তিন বেলার খাওয়া বাঁচবে। বোঝলা মনু?
মাহমুদের যুক্তি মেনে না নেওয়ার উপায় থাকে না শফিকের। অতীত অভিজ্ঞতার ওপর চোখে রেখে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ঠিক আছে।
পরের দিন লেবার পার্টির মাওলানা মতিনের অফিস ছেড়ে রামপুরা উলন রোডের মাথায় গিয়ে হাজির শফিক, সঙ্গে মাহমুদ হাসান। মাহমুদ উলনে চলে এসেছে আরও তিন চারদিন আগে। উলন ক্রমবর্ধিষ্ণু এলাকা। রাস্তার মাথায় একটা দোতলা বাড়ি। বয়স্ক হাবিব মিয়া জীবনের সঞ্চয় দিয়ে চার ছেলে আর তিন মেয়ের জন্য বাড়িটা করেছিলেন। তিনি বছর খানেক আগে মারা গেছেন। হাবিব মিয়ার দুই ছেলে। বড় আর মেঝো থাকে দোতলায়। দুজনেই বিবাহিত। বড়জন টিপু, একটা বেসকারি ব্যাংকের মাঝারি মানের কর্মকর্তা। টিপু খুব ভদ্র মানুষ। স্ত্রী হোমায়রাও সুন্দরী। সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায়। একটা ছেলে মিরাজ। দুটি মেয়ে ফরজানা, ফারহানা। মিরাজ পড়ে ফাইভে। ফারহানা ও ফারজানা পড়ে ক্লাস টু এবং ওয়ানে।
মাহমুদের সঙ্গে এসে পরিচিত হয় শফিক, টিপুর পরিবার এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। পরের দিন থেকে পড়াতে আসবে। সকালে নাস্তা খেয়ে অফিসে যাবে শফিক, বিকেলে অফিস থেকে এসে খেয়ে যাবে। সন্ধ্যার পরে এসে রাত নটা পর্যন্ত পড়াবে। কিন্তু সমস্যা হলো থাকার জায়গা নিয়ে। মাহমুদ ইতোমধ্যে একটা চৌচালা ঘরের পেছনের বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেই ব্যবস্থায় এসে সব কিছু দেখার পর হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারছে না শফিক।
ঘরটা টিনের তৈরি। সরু রাস্তার পাশে বাসাটা। বাসার ভেতরে মেঝেটা পাকা হলেও পুরনো, ময়লায় ঠাসা। রুমের মধ্যে মাঝারি আকারের কম দামের খাট। খাটের ওপর মাহমুদের বিছনা, খাটের লাগোয় চটের দেয়ালে ঝুলছে কয়েকটা জামা, প্যান্ট।
কী, পছন্দ হয়নি? প্রশ্ন করে মাহমুদ।
কী বলবে শফিক? পছন্দ না হলেও তো থাকতে হবে। কারণ পুরানা পল্টনের আস্তানা ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় সুখ, একটা বাসায় পড়ানোর বিনিময়ে তিন বেলা খাবার পাওয়া যাবে। এই ন্যাংটো ঢাকা শহরে কোন শালার পুতে তিনবেলা খেতে দেয়? সুতরাং মুখ বুঝে ঘাড় নাড়ায় শফিক, উপায় তো নাই।
চৌকির ওপর বসে পায়ের জুতো আর মুজা খুলতে খুলতে আশ্বাস দেয় মাহমুদ, চিন্তা করিস না। আমরা বেশি দিন এই বাসায় থাকবো না। মাত্র এই মাসের কয়েকটা দিন। জুতোর মোজা কবে ধুয়েছে, হিসাব করা মুশকিল কিন্তু গন্ধে টেকা দায়। কিন্তু মাহমুদ নির্বিকার, বেশ কয়েকদিন পরলে গন্ধ আসে। একটু সহ্য কর, সয়ে যাবে।
শফিক হায়দার কী করবে, বুঝতে পারে না। মাথার ওপর গনগনে সূর্যের তাপ। ওপরের চিনের গরম আর আটকা ঘরের মধ্যে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দুজনে। দর দর ঘামছে দুজনে। কিন্তু মাহমুদ বরাবরের নির্বিকারত্ব নিয়ে চৌকির তলা থেকে ট্যাংক বের করে লুঙ্গি গামছা নিয়ে প্রস্তুত হয় গোছলে যাওয়ার জন্য। শফিকের মনে পড়ে, গোছল করা দরকার। দ্রুত পরনের প্যান্ট শার্ট খুলে ব্যাগ থেকে লুঙ্গি গেঞ্জি বের করে মাহমুদের পিছু নেয় শফিক। নিজেদের রুমটার দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে বড় ঘরের পূর্ব দিকে যায় দুজনে। সামনে মাহমুদ হাসান। পেছনে শফিক। মাহমুদ দাঁড়ায় ঘরের লাগোয়া একটা মাটির ইঁদারার সামনে। দড়ি দিয়ে একটা বালতি বাঁধা। চারপাশে থকথকে কাদা আর ময়লার ছোট ছোট স্তূপ। পরিস্থিতি দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না শফিক। হ্যাঁ ঢাকা শহরে কিছু নেই, কেউ নাই কিন্তু ইঁদারার নোংরা পানির পরিমণ্ডলে গোসল করতে হবে!
মাহমুদ নির্বিকারভাবে ইঁদারা থেকে বালতি থেকে পানি তুলে গোসল করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে চারপাশটা, হ্যাঁ ইহাকে বলে বস্তি। টিনের বাড়িটার চারপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর, সেই ঘরের আরও ছোট দরজায় বিচিত্র ধরনের নারী পুরুষ শিশু দাঁড়িয়ে বসে কাজ করছে, আড্ডা দিচ্ছে, কোনো কোনো মহিলা অন্য মহিলার চুলের উঁকুন বাছতেছে।
এই আপনার বন্ধু?
পেছনের বস্তির দরগা থেকে ফিরে তাকায় শফিক হায়দার। মাহমুদের সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী। কোলে একটা মেয়ে বাচ্চা। মহিলার মাথায় জংলি ছাপার শাড়ি। মাথায় এলোমেলো ঝলমলে চুলের বাহার। শরীরের রঙ অবাক সুন্দর। টিকলো নাক, হাতে কয়েক গাছি কাঁচের চুড়ি। চোখ দুটো টলটলে স্বচ্ছ পুকুরের জলের মতো।
মাহমুদ গোছল শেষে গেঞ্জি পরতে পরতে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনাকে ওর গল্পই করেছিলাম। শফিক, রেহানা ভাবি। এই বাসায় থাকে। অনেক বই পড়ে। তুই লেখক শুনে বললো আমাকে, জীবনে লেখক দেখেনি। তোকে প্রথম দেখলো।
শফিক অবাক চোখে মহিলা, মানে রেহানা ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকে। রেহানা ভাবি লজ্জা পায়, আপনার এইখানে থাকতে কষ্ট হবে।
বুঝতে পারছি, মাহমুদ বালতি ধরিয়ে দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি গোসল করে আয় শফিক। দেখার সময় আরও পাবি।
রেহানা ভাবি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় মুখে অবাক হাসির সঙ্গে। উপায় নাই গোলাম হোসেন, সেই ইঁদারার পানিতে গোসল করে রুমে ফিরে আসে শফিক। রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলে মাহমুদ, তুই চোগলখোরের চোখে রেহানা ভাবির দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?
নিজেকে কোনোভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে কাশতে কাশতে উত্তর দেয় শফিক, এত সুন্দর মহিলা এইখানে কী করে?
ঘাম মাখে? কিন্তু তুই আর কোনো দিন শুয়ারের চোখে তাকাবি না। ও বিবাহিত। বুঝতে পারছিস না, এত নোংরা জায়গায় আমি কেন আসছি?
শফিক হায়দার হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদকে চিনতে পারছে না, শেষ পর্যন্ত একটা বিবাহিত মেয়ের প্রেমে পড়েছে? তাও এই নোংরা বস্তির ভেতরে থাকে।
তাকায় মাহমুদ, উনি রেহানা ভাবির হাসবেন্ড তরিকুল ইসলাম। সচিবালয়ে এক উপসচিবের গাড়ি চালায়। চোখের মধ্যে সমুদ্রের বিস্ময় নিয়ে শফিক আর আমীর হোসেন তাকিয়ে থাকে আলো আর অন্ধকারের সহবাস্তানের দিকে। আশ্চর্য, রেহানা ভাবির মুখে সুখী হাসি উপচে পড়ছে।
গোসলের শেষে জামা প্যান্ট পরে লজিং বাড়ি যায় দুজনে। শফিকের লজিং বাড়ির পেছনেই মাহমুদের লজিং বাড়ি। একেবারে খাপে খাপ। লজিং বাড়িতে খেয়ে দুজনে যায় উলনের পশ্চিম দিকে, খোলা জায়গায়। বুক সমান পানি কাদার মধ্যে লোহার গোল পাইপে রামপুরা টিভির দিক থেকে বালি এনে ফেলছে একটা কোম্পানি। বালু ফেলতে ফেলতে বুক সমান পানি, ধানক্ষেতের মধ্যে অনেক জায়গা উঁচু হয়ে গেছে। সাদা বালি আর বালি। সেই বালির মধ্যে এলাকার ছেলেমেয়েরা খেলছে ক্রিকেট। উড়াচ্ছে ঘুড়ি। কেউ কেউ খেলছে হা ডু ডু। মাহমুদ হাসান আর শফিক হায়দার উদাষস শরীরের পাইপের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। পশ্চিম আকাশে ঝুলে পড়েছে বিকেলের ক্লান্ত সূর্য। হলুদ আলোর মিহি জাল ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
মাহমুদ?
তাকায় শফিকের দিকে, কী?
এই হালারা কি পাগল?
কোন হালারা?
এই যে কোমর সমান পানি আর ধানক্ষেতের মধ্যে কত দূর থেকে বালি এনে ফেলছে? কী করবে ইস্টার্ন কোম্পানি?
বাড়ি ঘর বানাবে।
এইখানে?
মাহমুদের কোনো নেশা নেই। মাঝে মধ্যে স্টার সিগারেট টানে। হু হু বাতাসের মধ্যে দুই হাতের তালুতে বাতাস আটকে একটা সিগারেট ধরায়। খুব আয়েশ করে ধোয়া ছাঁড়ে, তুইতো আছো তিন টাকার ব্যাগ আর লেখা নিয়ে। দুনিয়ায় যার কাছে টাকা থাকে, তার কাছে ব্যবসা থাকে, বুদ্ধি থাকে। এই যে ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানি দেখছো, জানো এটা কার কোম্পানি?
দুই দিকে মাথা নাড়ায় শফিক, জানি না।
তুই জানোস আমার বালডা। শোন, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনী জহিরুল ইসলাম। সেই জহিরুল ইসলামের কোম্পানি হলো ইস্টার্ন হাউজিং সোসাইটি। ইস্টার্ন হাউজিং সোসাইটি সারা ঢাকা শহর ঘিরে হাউজিং সোসাইটি গতে তুলছে। এরা দেশ বিদেশে যায়, দেখে অনেক কিছু। বিদেশে তো হাউজিং ব্যবসা অনেক আগে থেকে চলছে। তো তারা সেই কাজটাই করছে।
বুঝলাম, কিন্তু এই পানির মধ্যে, কিভাবে?
হালার গাধা! মাটি ভরাট করে করে এই জায়গা উঁচু জায়গার সমান করে ফেললেই তো হলো। রোলার দিয়ে সমান করে মাটির সঙ্গে মাটি থেতলে দেবে। তখন মনে হবে আগে থেকেই এই জায়গা এই রকম উঁচু ছিল। সেই জায়গা প্লট করে বিক্রি করবে।
মানুষ কিনবে?
ধুশ শালা, তোর সঙ্গে কথা বলাই বৃথা। তুই একটা নোংরা কিছিমের বোকাচোদা। যাদের টাকা আছে তারা এই জমির বায়না করে রেখেছে।
মাহমুদ, আমি কম বুঝি সেটা ঠিক। কিন্তু তুই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে গুল মারিস না। টাকা থাকলেই মানুষ এই কোমর পানির জমি কিনবে?
কিনবে, কারণ এখনই ডিজাইন করে রেখেছে ওরা। সেই ডিজাইন দেখে দেখে টাকাঅলারা জমির পরিবর্তে ডিজাইন কিনছে। ভরাট হয়ে গেলে যারা ডিজাইন কিনেছে, তারা জায়গা পেয়ে যাবে খুব সস্তায়। তোর আমার কাছে টাকা নেই, আমরা কিনবার স্বপ্নও দেখি না। দেখিস, কয়েক বছর পর এই জায়গার কী পরিবর্তন ঘটে। চল, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পড়াতে যাই।
মাহমুদ লাফ দিয়ে নামে পাইপের ওপর থেকে। ওর সঙ্গে নামে শফিকও। দুনিয়াটা টাকার একটা বান্ডিলের মধ্যে আটকে আছে, অনেকটা টেবিলে রাখা গোলাকার ভূ-মানচিত্রের মতো। টাকা! কয়েকটা টাকা আর বেঁচে থাকার জন্য পথে পথে ঘুরছে মানুষ। সেইসব মানুষের মিছিলে আমি, মাহমুদ হাসান, আলী আনোয়ার, হোসন আলী, গোতম রায়, শায়লা রহমান, তীর্থ আহমেদ, সজীব মুকুল, হিংমাশু পোদ্দার, ফারজানা আখতার… প্রতিদিন শত শত মানুষ, হাজার হাজার মানুষ, লাখ লাখ মানুষ ঢাকার রাস্তায় দৌড়ায় আর দৌড়ায় কয়েকটা টাকা, বেঁচে থাকার আকুতিতে। সবাই কি বাঁচে? নাকি পরাজয়ের কলস গলায় বেঁধে ডুবে যায় জীবনের অথই সমুদ্রে? আমিও কি হারিয়ে যাবো গোল্লাছুটের গোল্লার মতো?
কী ভাবতেছিস? বালু পার হয়ে উলনের শক্ত রাস্তায় ওঠার সময়ে নিঃশব্দ শফিকের গায়ে ধাক্কা দেয় মাহমুদ।
প্রতিদির ঢাকা শহরের রাস্তায় যে মানুষগুলো দেখি, কুত্তা দৌড়ের ওপর, খালি দৌড়াইতেছে, দৌড়াইতেছে, দৌড়াইয়া এই হালারা কই যায়? সন্ধ্যার পর মতিঝিল, পুরানা পল্টন, রামপুরা, মিরপুর, আগারগাও, ফার্মগেট, নিউমার্কেট; কোথাও একটা মানুষ থাকে না, কুকুর ছাড়া, ভেবে দেখেছিস, কুত্তা দৌড়ানো মানুষগুলো যায় কই? খায় কী?
খায় গু…তোর কোনো সমস্যা আছে? দুজনে হেঁটে লজিং বাড়ির সামনে দাঁড়ায়, তুই যা তোর লজিং বাড়ি। আমি যাই আমার লজিং বাড়ি। আর নটায় বের হয়ে আসিস।
আচ্ছা, বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় শফিক হায়দার।
অনেক দিন পরে ছাত্র পড়িয়ে ভালোই লাগে। মিরাজ ছেলেটা মাঝারি মেধার। ফারহানা আর ফারজানা পড়ার প্রতি তেমন আকর্ষণ নেই। ফারজানা পড়ার চেষ্টা করলেও ফারহানা কেবল অবাক চোখে বইয়ের অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়ানো শেষ করে রাত সাড়ে আটটায় খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পায়, পাশের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে মাহমুদ।
বেশিদিন এই বাড়িতে পড়ানো যাবে বলে মনে হয় না, মাহমুদের গলায় ঠাণ্ডা সংলাপ।
কেন? টিনশেটের বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে শফিক হায়দার।
মেয়েটা বড় ফাজিল!
কোন মেয়েটা?
আমি পড়াই সেভেনের একটা মেয়ে, নাম সুমী। আর ক্লাস ভাইভের মেয়ে ননী, ক্লাস থ্রির ছেলে শশী। সুমী সুন্দরী। ঢাকায় জনআম বেড়ে ওঠা, বুকের সাইজও বড়। আমার দিকে বেল তাকিয়ে থাকে। আমি যখনই ওর দিকে তাকাই, দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পড়ায় মনোযোগ নেই।
বেশ তো, শফিক নিজের মতো করে মন্তব্য করে।
বেশ তো মানে কী?
তোরে যদি সুমীর মনে ধরে…
মনে ধরলে তো চলবে না। আগে ঢাকা শহরে বাঁচতে হবে, পরে মনের না দোনের ঘটনা দেখা যাবে। কিন্তু মেয়েটির কারণে লজিংই চলে যায়।
দুজনে আলাপের মধ্যে সেই টিনশেটের বিখ্যাত বাসার সামনে এসে অবাক শফিক আর মাহমুদ। কারণ, অপেক্ষা করছে আমীর হোসেন। আমীর হোসেনও ছিল মাওলানা আবদুল মতিনের লেবার পার্টির অফিসে কয়েক মাস। এসেছিল ভান্ডারিয়ার তেলিখালী গ্রাম থেকে। ওর বড় ভাই এজি অফিসে চাকরি করে। মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে বড় ভাইয়ের বাসা। সরকারী কোয়ার্টার। কিন্তু আমীর হোসেন যায় না বড় ভাইয়ের কাছে। বাসায় ভাইয়ের শালী থাকে। শালী নাকি দেখতে দারুন সুন্দরী। পড়ে ইডেন কলেজে। বড় ভাইয়ের বাসায় গেলেই ভাবি পেছনে জোঁকের মতো লেগে থাকে, আর দ্রুত সামান্য খাবার সামনে দিয়ে বলে, তুমি কখন যাইবা? শেলীর পরীক্ষা তো, পড়তে বসবে। কেউ বাসায় থাকলে শেলী পড়তে পারে না।
আমীর হোসেনের চোখ থেকে পানি পড়ে, জানোস আমার ভাই কিছু বলে না। এই ভাবিকে আমি পছন্দ করে বড় ভাইয়ের জন্য বিয়ে করিয়েছি। বড় ভাইয়ের জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। অথচ….আজ ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা নাই।
আমরা যে রামপুরার উলন রোড়ে এই বাড়িতে আছি, তুই কেমনে জানলি?
আমাকে দিয়ে গেছে হোসেন, মাহমুদের প্রশ্নের উত্তরে বলে আমীর হোসেন।
বুঝেছি, ওকে নিয়েই এই বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। তুই কি আমাদের সঙ্গে থাকবি?
মাথা ঝাঁকায় আমীর, থাকার জন্যই তো এসেছি।
এসেছিস ভালো করেছিস। কিন্তু থাকতে পারবি না।
কেন? অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় আমীর হোসেন।
হাত ধরে মাহমুদ, আয় দেখে যা।
ঘরটার সামনে থেকে ঘুরে পেছনে সেই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ঠাসা বারান্দার দরজার তালা খুলে দিলে, ভেতরে ঢুকে টিমটিমে পাওয়ারের একটা লাইট জ্বালায় মাহমুদ। ঘরের পরিস্থিতি দেখে মুখ শুকিয়ে যায় আমীর হোসেনের। কিন্তু বলে, আমার তো থাকার জায়গা নাই। যে জায়গায় ছিলাম ঝগড়া করে চলে এসেছি। এখন যাবো কোথায়? বড় আশা করে তোদের কাছে এসেছি।
ঠিক আছে, এসেছিস যখন থাক। তিন জনে গাদাগাধি করে থাকবো, আর কী করবো, বলে শফিক।
ওদের কথার শেষে দরজায় এসে দাঁড়ায় মাহমুদের রেহানা ভাবি। পাশে কালো মিশমিশে লম্বাটে মুখের দাড়িঅলা একজন পুরুষ। তিনজনে অবাক তাকিয়ে থাকে রেহানা আর পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। মাহমুদ ব্যস্ত হয়ে বলে, আমেন ভাই, ভিতরে আসেন।
লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ভিতরে যাবো না। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এলাম।
শফিক? তাকায় মাহমুদ, উনি রেহানা ভাবির হাসবেন্ড তরিকুল ইসলাম। সচিবালয়ে এক উপসচিবের গাড়ি চালায়। চোখের মধ্যে সমুদ্রের বিস্ময় নিয়ে শফিক আর আমীর হোসেন তাকিয়ে থাকে আলো আর অন্ধকারের সহবাস্তানের দিকে। আশ্চর্য, রেহানা ভাবির মুখে সুখী হাসি উপচে পড়ছে।
চলবে…