শৈশব-কৈশোরের যে দৃশ্যটা আমার স্মৃতির ভেতর চিরস্থায়ী হয়ে গেঁথে আছে, তা হলো একটি পরিবারের ছয় জন সদস্য; যে যার মতো করে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। আমি যে পরিবারে জন্ম নিয়েছি, বেড়ে উঠেছি সেখানে বই ছাড়া আর কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। শো-পিস দিয়ে যে ঘর সাজাতে হ্য় সেটা আমি প্রথম বুঝতে পারি বিয়ের পর ক্যান্টনমেন্টে থাকতে গিয়ে। অবশ্য স্কুলে থাকতে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে আব্বার কলিগদের বাসায় গিয়েও খুব অবাক হতাম। একইভাবে অবাক হতাম আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুবান্ধবের বাসায় গিয়েও।
ওদের বাসাগুলো কী সাজানো-গোছানো ঝা-ঝকঝকে থাকতো। ওসব বাসার সুন্দর সুন্দর ঘর সাজানোর শো-পিস আর দেয়ালে টাঙানো পারিবারিক ছবি আর পেইন্টিংস দেখে আমার কষ্টে বুক ভেঙে যেতো। আমার মা ছিলেন সিভিয়ার ডিপ্রেশনের রুগী। তিনি সারারাত জেগে বই পড়তেন আর দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকতেন। একই দৃশ্য দেখেছি আব্বার ক্ষেত্রেও। সারারাত জেগে বই পড়া আর সারাদিন অফিস করা। এটাই ছিল আব্বার রুটিন। এখন মাঝেমাঝে ভাবি যে আব্বা কত কম ঘুমিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। সারাজীবন ধরে আব্বা সেই একই রুটিন মেনে এসেছিলেন। সারারাত বই পড়ে ভোরে একটু ঘুমিয়ে অফিসে চলে যেতেন আব্বা। অফিস থেকে এসে প্রায় কখনোই কোনো রান্না খাবার পেতেন না। আমরা দুই বোনের কেউ হয়তো শুধু ভাত টুকুই রান্না করে রাখতাম। ছোট ছিলাম তখন রান্নাবান্না শেখা হয়নি। আম্মার ঘুম ভাঙা মানেই আতঙ্ক।
বাসার মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যেতো। তবে মনমেজাজ ভালো থাকলে মাঝেমাঝে এক হাঁড়ি গরুর মাংস রান্না করে রেখে দিতেন। মাংস আর ভাত বা একটা ডিম ভাজি করে খেয়ে নিয়েই একটা ঢাউস সাইজের বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতেন। কী রান্না হচ্ছে, কী খাওয়া হচ্ছে সেসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ব্যাগ ভরে ভরে বাজার নিয়ে আসতেন আব্বা। সেগুলো ব্যাগের ভেতর বা ফ্রিজের ভেতর পচে যেতো। তারপর ফেলে দেওয়া হতো। মা অসুস্থ ফলে সবকিছুই বিশৃঙ্খল শুধু বই পড়া ছাড়া। প্রতিটি মানুষই বইয়ের পোকা। সবার একটাই যেন কাজ শুধু বই পড়া। আব্বার কথা মনে পড়লেই স্মৃতিতে স্পষ্ট ভেসে ওঠে যে, আব্বা সোফায় হেলান দিয়ে বা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন, এই দৃশ্যটি।
সেই প্রথম বুঝতে পারলাম আমার কথাগুলো শোনার মতো সময় আসলে কারও নেই। অথচ আমি বলতে চাই। একদিন এসব ভাবতে ভাবতেই আমার বোনের কাছে একটা নতুন খাতা আর পেন্সিল চাইলাম। আর তারপরই শুরু হলো আমার ডায়েরি লেখা।
মাত্র ৫৭ বছর বয়সে এলপিআরে যাওয়ার আগের দিন অর্থাৎ চাকরির শেষ দিন আব্বা মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত চাকরি করা আর সারা দিনরাত বইয়ে ভেতর ডুবে থাকা এটাই ছিল আব্বার একমাত্র কাজ। এদিকে আম্মা দিনদিন মানসিকভাবে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলেন। বেশিরভাগ সময় দরজা-জানালা আটকে রুম অন্ধকার করে শুয়ে থাকেন। আম্মার ঘুম ভাঙলে কী হবে, ভেবে আমরা চার ভাইবোন সারাক্ষণ আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকি। আমরা স্কুলে গেলাম কী গেলাম না, কিছু খেলাম কী খেলাম না, আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, না কি গাছের ওপর চড়ে বসে আছি, না কি হাত-পা কেটে ফেলেছি, না কি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মারামারি বা ঝগড়া করেছি, কারও কোনো খবর নেই। আব্বা ভীষণ ব্যস্ত। আম্মার কাছে ঘেঁষা যায় না। একটা মেয়ে বড় হতে হতে কত রকমের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়। কতরকম প্রলোভন, কতরকম নোংরামি, কত বিচিত্র অনুভূতি, এসব কথা সে কার কাছে বলবে মাকে ছাড়া? অথচ আমার তো সেই সুযোগ ছিল না। তাই ছাদে গিয়ে একা একা বসে থাকি আর বই পড়তাম।
হান্স খ্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারশন, হ্যান্ড্রি রাইডারস হ্যাগারড, জিম করবেট, হ্যামিংওয়ে, দস্যু বনহুর আরও কত কত বই চারদিকে ছড়ানো ছিটানো। সেবা প্রকাশনী থেকে একের পর এক ছোটদের অনুবাদ বের হচ্ছে আর আমরা গিয়ে কিনে আনছি আর পড়ছি। স্কুল থেকে এসেই শুধু কোনোমতে জুতো মোজাটাই খুলতাম হয়তো। বেশিরভাগ সময় স্কুল ড্রেস পরেই যেকোনো একটা গল্পের বই নিয়েই সোজা চলে যেতাম বাসার পেছনের পেয়ারা গাছের কাছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের ডালের ওপর বসে বসেই সেবা প্রকাশনীর কোনো একটা অনুবাদ বই একেবারে শেষ করে তারপর নিচে নেমে আসতাম। এ রকমই একদিন কী চিন্তা করে পেয়ারা গাছে না উঠে বড়ুই গাছের একেবারে মগডালে ওঠার চেষ্টা করলাম। ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। অনেক উঁচুতে উঠে গেছি। সারাগাছে বড়ুই ঝুলছে। হাত বাড়িয়েছি বড়ুই পারবো বলে। হঠাৎ ধপাস করে নিচে গিয়ে একেবারে মাটির ওপর আছাড় খেয়ে পড়লাম। ডাক্তার এসে কয়েকদিনের জন্য বিছানা বন্দি থাকার পরামর্শ দিয়ে চলে গেলেন।
আমার পক্ষে একদিনের জন্যও বিছানায় শুয়ে থাকা অসম্ভব মনে হতে লাগলো। কিন্তু কোমরে এতই ব্যথা করছিল যে, চাইলেও উঠতে পারছিলাম না। সারাদিন শুয়ে শুয়ে শুধু বই পড়ি। সমস্ত ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তূপে স্তূপে নানা ধরনের বই। আগেও তো বই পড়তাম সময় পেলেই কিন্ত এবার পড়ছি একরকম বাধ্য হয়েই কারণ এছাড়া তো আর কিছুই করার নেই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, বিভূতিভূষণ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নিহারঞ্জন, কামিনী রায়, রামায়ণ, মহাভারত, কোরআন-বাইবেল-গিতার বাংলা অনুবাদ আর কতসব ইংরেজি বই, সায়েন্সের বই। শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়া। এরপর শরৎসমগ্র শেষ করে ফেললাম। একেকটা গল্প পড়ি আর কী বুঝি না বুঝি, জানি না। কিন্তু কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলি। আমার কান্নাকাটি দেখে ভাই-বোনরা সবাই হাসাহাসি করে ফলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে হয়। মনের মধ্যে নানা দুঃখবোধ দুধ ফোঁটার মতো করে বলকাতে থাকে, আর সেই দুঃখগুলো উপচে-উপচে পরতে থাকে দুচোখ বেয়ে। কাউকে কিছুই বলতে পারি না। নিজের ভেতরের এত এত বিচিত্র অনুভূতির কথা আসলে কাউকেই বলা সম্ভব নয়। সেই প্রথম বুঝতে পারলাম আমার কথাগুলো শোনার মতো সময় আসলে কারও নেই। অথচ আমি বলতে চাই। একদিন এসব ভাবতে ভাবতেই আমার বোনের কাছে একটা নতুন খাতা আর পেন্সিল চাইলাম। আর তারপরই শুরু হলো আমার ডায়েরি লেখা।
লেখক হয়ে উঠতে পেরেছি কী পারিনি সেটা তো পাঠকই বলবেন। তবে আমার কাছে লেখালেখি একধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। আর যতদিন বেঁচে আছি এই নেশাতেই ডুবে থাকতে চাই।
সেইযে দশ-এগারো বছর বয়সে বিছানাবন্দি হয়ে ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিলাম, সেই অভ্যেস আজও আছে। জীবনের প্রায় প্রতিটি কথা, প্রতিটি খুঁটিনাটি লিখে রাখতাম ডায়েরিতে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে কষ্টের কথা, সুখের কথা, গোপন কথা সবই লিখতে শুরু করলাম। এভাবে ডায়েরি লিখতে লিখতেই একসময় উপন্যাস লেখার ইচ্ছে হলো। এরই মধ্যে অনেক উপন্যাসও পড়া হয়ে গেছে তাই মনে হলো আমিও এরকম একটা উপন্যাস লিখতে পারি। কিন্তু কী নিয়ে লিখবো? একদিন ঘটনাচক্রে এক বান্ধবীর সঙ্গে বাসে করে ফার্মগেট গেলাম ওর এক প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে। ক্লাস টেনে পড়ি তখন। বান্ধবীর সঙ্গে কোনো একটি বিষয় নিয়ে মনে হয় মনোমালিন্য চলছিল তার প্রেমিক প্রবরের।
দেখলাম কয়েকদিন পর সেই ছেলেটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে প্রপোজ করছে। আমার মনে হলো এটি একটি ত্রিভূজ প্রেমের খুব ভালো প্লট। আবারও একটি নতুন খাতা নিয়ে বসে গেলাম উপন্যাস লিখতে। এবার অঙ্কের নিউজপ্রিন্টের রাফ খাতাকে বেছে নিলাম। বহুবছর আগের লেখা সেই উপন্যাস এখনো আমার কাছে রয়ে গেছে। এরপর জীবনে একের পর এক নান অধ্যায় আসতে লাগলো। গল্প বা কবিতা লেখার চেষ্টা যে আর করিনি তা নয়। তবে জীবনের গতিবিধি বদলে গেলো। নানা বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। লেখালেখির আর সময় পাই না। ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা যদিও সবসময়ই ছিল আর এখনো আছে। কিন্তু অন্যকিছু লেখা আর হয়ে ওঠেনি। এইচএসসির পর বিয়ে হয়ে গেলো। তারপর পরই ছেলের জন্ম হলো।
একদিকে সংসার, সন্তান আরেকদিকে নিজের লেখাপড়া। তারপর চাকরি, ঘোরাঘুরি, দাওয়াত-পার্টি; এসব করতে করতে, লেখালেখি তো দূরের কথা কখন যে পড়তেই ভুলে গেলাম মনে নেই। এরমধ্যে ২০ বছর কেটে গেছে। মাঝে ৯৭/৯৮-এর দিকে ভোরের কাগজের অফিসে যেতাম হঠাৎ হঠাৎ। পরে ‘প্রথম আলো’ দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হলে বন্ধু সভা’র অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করলাম। ওখানে মাঝেমাঝে লেখা পাঠাতাম। বন্ধু সভার পাতাটা তখন গিয়াস আহমেদ ভাই দেখতেন। তিনি আমার লেখা দেখলে প্রকাশ করতেন। তারপর আবারও সব লেখালেখি বন্ধ হয়ে গেলো। ২০১০ সালে এসে ফেসবুকে এটা সেটা লেখা পোস্ট করা শুরু করলাম। লিখতে লিখতেই অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলো। কবিতা, গল্প, গদ্য সবই লিখতে শুরু করলাম। ২০১৬ সালে এসে প্রথম কবিতার একটি বই প্রকাশিত হলো। এরপর একে একে চারটি কবিতার, ছোটগল্পের, সিনামার ওপর লেখা গদ্যের বই বের হলো। অনেক লেখা দৈনিক পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে লাগলো। এভাবেই পুরোপুরি লেখালেখির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম। এখন তো একটি দিনও লেখালেখি ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারি না। লেখক হয়ে উঠতে পেরেছি কী পারিনি সেটা তো পাঠকই বলবেন। তবে আমার কাছে লেখালেখি একধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। আর যতদিন বেঁচে আছি এই নেশাতেই ডুবে থাকতে চাই।