প্রত্যয় হামিদের জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি নওগাঁ জেলার রাণীনগর থানায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর তিনি এখন বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বাউয়েট)-এর ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘হাইফেন’। সম্পাদনার পাশাপাশি ছোটগল্প, কবিতা ও ছড়া লেখেন। এছাড়া অনুবাদ নিয়েও কাজ করছেন। এই পর্যন্ত তার দশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো: ‘আলোময় অথৈ আঁধার’, ‘চোখের উঠান’, ‘তৃষ্ণা ও অন্যান্য’, ‘স্পর্শ ও প্রেমের পদাবলি’, ‘ফুল পাখি আর শিশু’, ‘ছড়ায় ছন্দে খেলা সারাবেলা’, ‘অন্তরালের গল্প’, ‘বুদ্ধিমান মোরগ ও বোকা কাকের গল্প’, ‘আলো দেখানো বন্ধুরা’ ও অনুবাদগ্রন্থ ‘দ্য ইম্পর্টেন্স অব বিইং আর্নেস্ট’ ।
সম্পাদনা ও লেখালেখিতে তিনি বেশ কিছু পরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অপরাজিত লিটলম্যাগ সম্মাননা, সমকালীন সাহিত্য সম্মাননা, জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য সংসদ সম্মাননা (পশ্চিমবঙ্গ), হংসমিথুন সাহিত্য পুরস্কার, সুবচন সাহিত্য সম্মাননা, শিরোনাম সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, আলোঘর পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, দেশজ জাতীয় পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, বাবুই শিশুসাহিত্য পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, কবি আবুল ক্বাছিম কেশরী (কাব্য-বিনোদ) সাহিত্য পুরস্কার, দৈনিক বাঙ্গালীর কণ্ঠ লেখক পুরস্কার, অক্ষরবৃত্ত পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ইত্যাদি। ছোটকাগজ সম্পাদনার জন্য এবার পেয়েছেন দোনাগাজী পদক। লেখালেখি, ছোটকাগজ সম্পাদনা ও পদকপ্রাপ্তি নিয়ে সম্প্রতি চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন।
চিন্তাসূত্র: এবার ছোটকাগজ সম্পাদনায় দোনাগাজী পদক পেলেন। কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
প্রত্যয় হামিদ: আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি মনে করি, যেকোনো পুরস্কারই কাজের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি কাজের জন্য বড় একটা অনুপ্রেরণা; আরও ভালো কিছু করার তাগিদ। একটা পুরস্কার কেবল অতীতকেই মূল্যায়ন করে না, ভবিষ্যতকেও নির্মাণ করতে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
এই পুরস্কার আমার কাজকে আরও বেগবান করবে, সন্দেহ নেই। আর হ্যাঁ, আমি এটাও স্বীকার করতে চাই, যারা লেখা দিয়ে ‘হাইফেন’কে সমৃদ্ধ করেছেন, যারা হাইফেন নিয়মিত পাঠ করে তাকে জীবন্ত রেখেছেন, এই পুরস্কার তাদের সবার সম্মিলিত অর্জন। তাই পুরস্কারটি আমি তাদের সবাইকেই উৎসর্গ করছি।
চিন্তাসূত্র: আমাদের ছোটকাগজ আন্দোলন সাহিত্য নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
প্রত্যয় হামিদ: আমি বলবো, ছোটকাগজ তার আগের সর্বজনগ্রাহ্য ও তেজদীপ্ত ঐতিহ্য কিছুটা হলেও হারিয়েছে। এখন ছোটকাগজ পরিমাণে যতটা বাড়ছে, মানে ততটা নয়। অনেক নতুন কাগজ হচ্ছে, যেগুলোকে বুঝে বা না বুঝে ছোটকাগজ লোকে তকমা লাগাচ্ছে। এই আয়োজনগুলোকে ম্যাগাজিন নাম দিলেই শুদ্ধতা বজায় থাকতো। তবে, ব্যতিক্রম তো আছেই। সেগুলো বেশ শক্তিশালী এবং করপোরেট সাহিত্যের উজানে দাঁড়িয়ে সেগুলো প্রকৃত অর্থেই ছোটকাগজের চরিত্র ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, অর্থসংকট এসব কাগজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
চিন্তাসূত্র: ছোটকাগজ সম্পাদনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
প্রত্যয় হামিদ: এটা খুব যৌক্তিক প্রশ্ন। প্রথমত বলতে চাই, একটা দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেছি, কী বিপুল পরিমাণ লেখা আসে একজন সম্পাদকের কাছে। এগুলো সবটাই সাহিত্যমান বিচারে উঁচু দরের না। কিন্তু নবীন সে লেখাগুলোতে অসীম সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন কারণেই সেইসব লেখাকে পাতায় স্থান দেওয়া সম্ভব হতো না। সেটা বলতে পারেন, হাইফেন সৃষ্টির একটা অনুঘটক। দ্বিতীয়ত, রাজশাহী অঞ্চলে বেশ কিছু অনিয়মিত ছোটকাগজ আছে। যেমনটি বলছিলাম, অর্থের সঙ্গে যুঝতে না পেরে অনেক কাগজ আর বেরই হয় না। তাই একটা কাগজ নিয়মিতভাবে করবো, এই ইচ্ছে থেকেই ‘হাইফেন’ করা। তৃতীয়ত নেশা। সম্পাদনা আমার কাছে একটা নেশার মতো। সম্পাদনা করতে গিয়ে অনেক কিছু শেখা যায়, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
বিপরীতে সাহিত্য সংগঠনগুলো অনেকটাই দায়মুক্ত, যদি না সেখানে কোন ব্যক্তিপ্রভাব পড়ে। বেশ কিছু সংগঠন এরই মধ্যে সে স্বাক্ষর রেখেছে বলে সাহিত্যাঙ্গনে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত বলতে চাই, ‘হাইফেন’ তার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ছোটকাগজের চরিত্র ধারণ করে স্রোতের বিপরীতে কাজ না করে, বরং স্রোতের অনুকূলে থেকেই সাহিত্যের জন্য কাজ করবে হাইফেন। অর্থাৎ, নিছক আবেগের বশে নয়, ‘হাইফেন’ এসেছে মূলত নতুনদের অনুপ্রেরণা দিতে। ‘হাইফেন’-এর হাত ধরে অনেকেই লেখার জগতে পা ফেলেছেন- সফলতা হিসেবে এটাও একটা বড় পুরস্কার।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন প্রাবন্ধিকদের মধ্যে কার কার প্রবন্ধ আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
প্রত্যয় হামিদ: প্রবন্ধ বলতে যদি সাহিত্য প্রবন্ধ বলেন, তাহলে সুনির্দিষ্ট করে কারও নাম বলা মুশকিল। কারণ, প্রবন্ধের জগৎটা বিশাল। একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে বলে কাউকে বিশেষভাবে এগিয়ে রাখা মুশকিল। তবে সমসাময়িক সাহিত্যে শিবলী মোকতাদির, স্বকৃত নোমান, মোজাফফর হোসেন, ইলিয়াস বাবর-এর লেখা আমাকে টানে।
চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কবিতার আলোচনা করতে গেলে কাকে কাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?
প্রত্যয় হামিদ: আমি কবিতায়, ধৃষ্টতা নেবেন না, আলাদা করে কোনো স্বর পাই না। তবে ইমতিয়াজ মাহমুদ একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন। আরও অনেকের মধ্যে আনিফ রুবেদ, মাহী ফ্লোরা আর নুসরাত নুসিনকে সম্ভাবনার কাতারে, ভিন্ন স্বরের কারণেই, সবচে এগিয়ে রাখতে চাই।
চিন্তাসূত্র: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?
প্রত্যয় হামিদ: পুরস্কার যেকোনো বিচারে একটা অনুঘটক। তবে যারা দিচ্ছেন, যিনি নিচ্ছেন, তাদের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ মনস্তত্বটা বেশ বড় বিষয়। মানে, যেমনটি শোনা যায়, কেউ কেউ টাকা দিয়ে পুরস্কার নিচ্ছেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রাপ্তির যে মানসিক আত্মতৃপ্তি, সেটা কিন্তু কোনো পক্ষই পায় না। এটার তাই সামাজিক কিছু মূল্য থাকতে পারে, আত্মিক ও বিষয়গত কোনো তৃপ্তি থাকে না। অনুপ্রেরণা হিসেবেও তা কোনো প্রভাবক নয়। কিন্তু, যেমনটি ধরুন এই পুরস্কারটা, যার কথা আমার চিন্তার মধ্যেও ছিল না, যদিও ইচ্ছে তো সবারই থাকে, আমাকে চমকে দিয়েছে। ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই প্রাপ্তি নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। দাতা-গ্রহীতার এই মনস্তত্ব কিন্তু আমাকে আরও দায়িত্বশীল করবে, আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে।
চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কাকে কাকে গুরুত্ব দেবেন?
প্রত্যয় হামিদ: কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও আমি আগের কথাটাকেই বলতে চাই। একদম আলাদা বলতে যা বোঝায়, তা খুব বেশি চোখে পড়ে না। আমি নিজেও গল্প লিখি, কিন্তু আলাদা করে নিজেকে চেনাতে পারিনি এখনো। যাদের গল্প পড়া হয়, তারা খুব ভালো লেখেন, আনিফ রুবেদকেই আমি এগিয়ে রাখবো। এটা শুধু পাঠক হিসেবে বলছি না, সম্পাদনার টেবিল থেকেও আমার একই বক্তব্য। নিজেকে উপস্থাপন করার জন্যই তিনি একদমই আলাদা।
চিন্তাসূত্র: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, করপোরেট পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সাহিত্যসংগঠনগুলো থেকে দেওয়ার পুরস্কারের মধ্যে আপনি স্পষ্ট কোনো পার্থক্য দেখেন? কোন পুরস্কারকে আপনার নিরপেক্ষ ও বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়?
প্রত্যয় হামিদ: করপোরেট পুরস্কারগুলো একটা বৃহৎ পরিমণ্ডলে কাজ করে। সেখানে পুরস্কারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকে, যেগুলোর কিছু দৃশ্যমান, অদৃশ্য অনেক। সেখানটায় দাঁড়িয়ে একটা নিরপেক্ষ পুরস্কার দেওয়া খুব কঠিন। আমি তাই বলে সে পুরস্কার বা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ছোট করছি না। তারাও যোগ্য। আমি কেবল সীমাবদ্ধতার কথা বলছি। এর বিপরীতে সাহিত্য সংগঠনগুলো অনেকটাই দায়মুক্ত, যদি না সেখানে কোন ব্যক্তিপ্রভাব পড়ে। বেশ কিছু সংগঠন এরই মধ্যে সে স্বাক্ষর রেখেছে বলে সাহিত্যাঙ্গনে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়েছে।