কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী নেই। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী আর নেই।
‘সাহিত্য সংযোগ’থেকে গভীর শোক ও বেদনার সঙ্গে সিরাজী ভাইয়ের একটা ছবিসহ শোকার্ত এই সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে হয়তো অনেক আগেই। আমি এইমাত্র ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো নিদারুণ সংবাদটি।
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জানি বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। যোরার বাড়িটি মৃত্যুপুরী। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আমাদের অনেকের প্রিয় সিরাজী ভাই সবার আগে তার নামটি পরিত্যাগ করে ইতোমধ্যেই লাশ হয়েছেন। তিনি অনন্ত ঘুমে কাতর। শত ডেকেও তার সাড়া পাওয়া যাবে না। একটি কাব্যচরণ আর নিজ মুখে শোনাবেন না আমাদের।
চারদিকে সুনসান ঘোরতর শোকের গভীরতর রাত এখন। ধানমন্ডিতে আমি তার প্রতিবেশী ছিলাম, এই মুহূর্তে টরন্টোর ডাউনটাউনের ৪৫ তলায় বসেও অনুভব করছি আমার বন্ধু যোরার বুকভাঙা হাহাকার, তার সন্তানদের আহাজারি শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি মৃত্যু বাড়িটিকে ঘিরে কবিদের কিছু কোলাহল জেগে আছে এখনো।
বাকিরা কেউ জেগে নেই।
এ রকম অসহায় বোধের মুহূর্তে কাকে কল দেবো? টরন্টোতে আছেন কবি আসাদ চৌধুরী। তার বয়স ও শরীরের কথা না ভেবেই নিজেকে সামলাতে তাকেই মেসেঞ্জারে কল দিলাম প্রথম। অনলাইনে নেই তিনি। পরে সাহানা ভাবিকে কল দিয়ে পেলাম। ওপার থেকে সাহানা ভাবির কণ্ঠ শোনা মাত্রই নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠেই দুঃসংবাদটি বলে যেন নিজেকে খানিকটা হালকা করতে চাইলাম।
দীর্ঘকালের বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের কাব্যজগতের সমূহ-আনন্দ-বেদনা সারিবদ্ধ হয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো যেন। কবিদের যাপিতজীবন তার রোমান্সকর পরিবেশ, পরিমণ্ডল, কবিদের পাগলামি—ভালোবাসা, মান-অভিমান, খুঁনসুটি—সব—সব কিছুই মুহূর্তে প্যানোরমা এক ফটোগ্রাফিতে উঠে আসছিল দৃষ্টির সমুখে। কিন্তু তবু মন বারবার অস্বীকার করতে চাইছে এই দুঃসংবাদের দুঃসহ সত্যতা।
কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। রফিক আজাদের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন এই সিরাজী ভাই আর শিহাব সরকার। জানি না শিহাব ভাই কী করছেন এখন।
এরপর তবু নিশ্চিত হতে ম্যাসেঞ্জার সার্চ করলাম—বাংলাদেশে কেউ জেগে আছে কিনা। কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের কাছে নিশ্চিত হলাম বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন।
কবি রফিক আজাদ-দিলারা হাফিজের নাতি অহমের জন্মদিনে দিলারা হাফিজের ডানে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, বামে কবি রবিউল হুসাইন
তার কোলোন ক্যান্সার অপারেশনের পরপরই লাইফ সাপোর্টে চলে গিয়েছিলেন। এই সংবাদ পাওযার পরেই আমার বন্ধু মিসেস জোহরা সিরাজী যোরাকে ফোন দিয়ে খবরাখবর জেনেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোরা আমার এমএ ক্লাসের সহপাঠী ছিল। প্রথম ওর হাত থেকেই সিরাজী ভাইয়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মোম শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’বইটি কিনেছিলাম। তখন সিরাজী ভাইকে দেখিনি, তার কবিতাও আগে পড়িনি।
রফিক আজাদের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে দেখতে পেলাম কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সহধর্মিণী আমারই বন্ধু যোরা। রফিক আজাদের পরিবারের সঙ্গে সে খুবই ঘণিষ্ঠ। যোরাকে ছোট বোনের স্নেহে পারলে মাথায় করে রাখে। ইতোমধ্যে রফিক আজাদ তাদের দুজনকে একটি বই উৎসর্গ করেছে।
অনন্তে শান্তিতে থাকুন সিরাজী ভাই। নিশ্চয় আপনার প্রিয় কবি ও প্রিয় ভাই (যেভাবে ডাকতেন আপনি, ভা-ই, ভা-ই-ই) তার সঙ্গে দেখা হবে।
যোরার শরীর ভালো না, দীর্ঘদিনের হার্টের পেশেন্ট সে। এই ক’দিন ওকে ফোন করে আর বেদনার ভার বাড়াইনি। নানা সূত্র থেকে খবর রেখেছি। প্রার্থনায় দু’হাত তুলে রেখেছিলাম, সিরাজী ভাই যেন ফিরে আসেন আবার আমাদের মধ্যে। কত মিরাকল ঘটে!
কিন্তু সর্বশেষ এই আশালতাটি উপড়ে ফেলে এভাবে যে তিনি এত দ্রুত চলে যাবেন—সব স্পর্শের বাইরে—কে ভাবতে পেরেছিল? অনন্ত পথের এই কবিযাত্রীকে নিয়ে তাৎক্ষণিক অণুভূতি লেখার দায় ও দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন প্রিয় কবি ও চিন্তাসূত্রের সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল হক। অপার এই বেদনার ভার যতই অসহ হোকম তবু যে লিখতেই হলো—কবিতার ঋণ, কবিদের ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয় বলে।
কিন্তু সুগভীর ও সুতীব্র দুঃখের কণা যখন ছড়িয়ে পড়ে চার পাশে, তখন সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। কিছুই লিখতে পারছি না সেভাবে। এই একটি প্রসঙ্গ টেনে শেষ করবো আজকের লেখাটি। পরে বিশদভাবে তাকে নিয়ে লিখবো—যেখানে রফিক আজাদও মিশে আছেন অরণ্য জ্যোৎস্নার মতো। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক’ প্রকাশ পেলো ১৯৮৩ সালে। গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসবে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা ভাষার কাব্য জগতে আমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে চমৎকার গঠনমূলক একটি আলোচনা লিখেছিলেন। চমৎকার বক্তব্যও রেখেছিলেন সেদিন।
সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে রফিক আজাদের প্রয়ান দিবসে উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানেও চমৎকার স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। সেই শেষ দেখা এবং শেষ শোনা তাকে। এইসব স্মৃতিতাড়িত দিনরাত্রিই এখন সম্পদ। আমারও কাব্যজীবনের সম্পদ।
এবার যখন অনন্যা প্রকাশনী থেকে আমার কাব্যসমগ্র প্রকাশ পেলো, আমি আটকে রইলাম টরন্টোতে। ভ্যাকসিন পাইনি বলে অভিন্ন যেতে দিলো না। বইমেলা চলার সময় পিয়াসকে একদিন ফোন করে বললাম, পিয়াস, আমার বইয়ের দুটো কপির একটি তুমি সিরাজী ভাইকে দেবে আর একটা কপি দেবে আমার পরম আত্মীয় বাংলা একাডেমির সভাপতি ড. শামসুজ্জামান খান ভাইকে।
পিয়াস বললো, আপা, আপনি মনির ভাইকে বলবেন আমার এখানে বই দুটি পাঠিয়ে দিতে। আমি আমার প্রকাশক মুনির ভাইকেও বলেছিলাম কথাটি। করোনার বাড়াবাড়িতে তখন মেলাও তথৈবচ, পরে জানতে পারিনি তারা দুজনে আমার কাব্যসমগ্র পেয়েছিলেন কি না। এখন সবই তো অনন্ত নদীর এপার-ওপারের অথৈ জলের তীব্র দহন।
অনন্তে শান্তিতে থাকুন সিরাজী ভাই। নিশ্চয় আপনার প্রিয় কবি ও প্রিয় ভাই (যেভাবে ডাকতেন আপনি, ভা-ই, ভা-ই-ই) তার সঙ্গে দেখা হবে। আনন্দ-যাপন করুন দু’জনে মিলে।