আমার কাছে চাঁদরাত কথাটাই খুব মিষ্টি। মায়ের ভালোবাসার মতন মিষ্টি। চাঁদ রাত মানেই খুশীর জোয়ার, আনন্দঘন একটি দিনকে বরণ করে নেওয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি। চাঁদরাত মানে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাওয়া। শেষ রোজার ইফতারির ঠিক পরপরই এক ছুটে বাহিরে বের হয়ে যেতাম চাঁদ দেখার জন্য। চৌরাস্তা মোড়ে দাঁড়িয়ে আকাশটাতে তন্নতন্ন করে খুঁজতাম সরু ফালির সাদা দাগটিকে।
আর এখন টিভির সামনে বসে থাকি শিরোনামে যদি চাঁদ দেখা যায়। আমাদের বাড়িটা রাস্তালাগোয়া। বাড়ি থেকে একটু সামনে গেলোই একটা বাজার। সেখানে দোকানে দোকানে মানুষের ভিড়। কোথাও কোথাও ঝাড়বাতিতে সাজানো হয়েছে। সেলুনের সামনে লম্বা সিরিয়াল নিয়ে গল্পে মজে উঠেছে তরুণরা।
চাঁদরাত ছিল আমাদের বন্ধুমহলে উৎসবের রাত। আমিও বের হয়ে পড়ি চাঁদরাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আড্ডা চলে দীর্ঘ সময়। বাড়ি ফিরি অনেক রাতে। তখনো মা জেগে আছেন। ছোটো ছোটো পা ফেলে রান্না ঘরে মার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা তখন চালের গুড়া, গুড়, সেমাই, লাচ্ছা, বাদাম, কিসমিস সব রেডি করে রাখছে। খুব ভোরে উঠে সেমাই বানাবে, তেলের পিঠা ভাঁজবে।
বোয়াম থেকে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা চাকসেউ আর ফুলপিঠাগুলো আলাদা আলাদা করে রাখছে। সকালে ডোবা তেলে ভাজবে বলে। চাকসেউ আর ফুলপিঠা চালের আটা দিয়ে বানানো হয়। ছোটবেলা এই ফুলপিঠা আমিও বানিয়েছি। ওষুধের দোকান থেকে নতুন সিরিঞ্জ কিনে এনে চালের আটা গোলা সিরিঞ্জে ভরে তারপর সিরিঞ্জে চাপ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা ফুলের আকৃতি দিতাম। সেই নরম ফুলগুলো প্রথমে গরম পানির ভাপে সেদ্ধ করে রোদে শুকাতে দিতো।
শুকানো হয়ে গেলেই পিঠার প্রাথমিক কাজ শেষ। এরপর ঈদের দিন সকালে গরম তেলে ছেড়ে দিলেই মুড়মুড়ে চাকসেউ আর ফুলপিঠা রেডি। সেমাইয়ের সাথে ফুলপিঠা, চাকসেউ খেতে ভারি মজা।
চাঁদরাতে ভাবীরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে জেগে থাকতো গভীর রাত অব্দি। সবাই মেহেদি লাগানো নিয়ে ব্যস্ত। আমি এই সুযোগে বাচ্চাদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠি। তাদের হাত বন্দি থাকায় আমি একটু বেশিই দুষ্টুমি করতাম। এ সবই এখন সুদূর স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আগামীকাল ঈদ। এবারের ঈদ নিয়ে অবশ্য আলাদা কোনো অনুভূতি নেই আমার। এ বছর ঈদটা মার সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে করতে পারছি না! এটা ভাবতেই মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
মনে রাখুন, পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যু হারের চেয়ে একাকিত্বের মৃত্যুর হার ঢের বেশি। আসুন না এই দুর্দিনে, চেনা বৃত্তের বাইরে গিয়ে অকারণেই সহমর্মী হই, নিছক অকারণেই ভালোবেসে ফেলি মানুষকে।
এখন চারিদিকে লকডাউনের বিধি-নিষেধ আর অচেনা অনিশ্চয়তার বাতাসে অবাধ্য মাছির মতো উড়ছে ভাইরাস। ঢাকা শহর থেকে ভাইরাসের জীবাণু নিজের এলাকায় বহন করার সাহস হয়নি। তাই লকডাউনের মনখারাপ নিয়ে দিব্যি পড়ে আছি এই শহরে। যেখানে আমার চাঁদরাত ধরা দেবে না আগের মতো।
জানি এ শহরে একাকিত্বের যন্ত্রণা নতুন কিছু না। অনেক আগে থেকেই একপ্রকার স্বেচ্ছা বন্দিত্ব মেনে নিয়েছে নগরনাগরিক। এখানে মুখোমুখি বাসার মানুষগুলোও তেমন মুখর নয় প্রতিবেশীর সঙ্গে। অথচ আমরা আটপৌরে মানুষেরা গ্রামে থাকতে কখনো বুঝতেই পারিনি একাকিত্বের অসহায়তা। আমাদের গোটা পাড়াটাই ছিল স্বজনে ভরা। সেখানে অপার আনন্দের আলাদা একটা স্বাদ লেগে থাকতো।
প্রতিটি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় এরকম অজস্র মানব হৃদয়ের মেলবন্ধন লুকিয়ে থাকে, কোনো রকম থিওরিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। এইসব সামাজিক সংযোগ একা থাকা মানুষদেরও অফুরান আত্মবিশ্বাসের যোগান দিতো। এ যেন হাজার বছরের সামাজিক পরিকাঠামোয় এক অনন্য বিশিষ্টতা। অথচ এই শহরে প্রচণ্ড হতাশায় ডুবে থাকা মানুষদের আশার বাণীও শোনাতে চায়না কেউ। করোনা ভাইরাস এসে এই সবে আবার হাওয়া লাগিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। এখন মানুষ কারো বাসায় যেতেও বিষম ভয় পাচ্ছে।
দয়া করে বিশ্বাস করুন, করোনা ভাইরাস আপনার শ্বাসযন্ত্র বিকল করে দিতে পারে কিন্তু আপনার হৃদয় সংকুচিত করতে পারেনা। এই দুঃসময়ে নিশ্চয়ই সংক্রমণ প্রতিরোধ করুন কিন্তু অনর্থক ভয়ের চাদরে হৃদয়কে মুড়ে রাখবেন না। সময়টা বসন্ত অন্তিম হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা, সহমর্মিতা এখনো বাতাসে টিকে আছে। অন্য বাড়ি যেতে ভয় করছে, বা উনি আমার পরিবারের কেউ নয় বা এখন নেটফ্লিক্সে ভালো থ্রিলার দেখছি বা স্রেফ বাসায় বানানো হালিম খাচ্ছি। এইসব ছুঁতোগুলো থেকে সাময়িক অব্যাহতি নিয়ে বাড়ির বারান্দা থেকেই না হয় হাঁক ছাড়ুন, ‘আন্টি কী খবর, কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন।’ অথবা মোবাইল তুলে একটা মেসেজ করুন সেই আটকে পড়া একলা সহকর্মীকে,‘সব ঠিক তো?’ প্রত্যাশা ছাড়াই হৃদয়ের যোগাযোগ বাড়ান।
হতে পারে এসবে আপনার কোনো যায় আসেনা; রক্তের সম্পর্ক তো নেই তাদের সাথে। কিন্তু ঘরবন্দি একলা মানুষটির কাছে আপনার একটুকরো কথা বা এক চিলতে ফোনালাপই অনেক বড় আশ্বাসের হতে পারে। না হয় আজ আমরা বাঁধা গতের বাইরেই ভালোবাসলাম, না হয় অনাত্মীয় একলা মানুষটির মন খারাপ নিজের দিকে একটু টেনেই নিলাম তাতে হৃদয়ে কোথাও কিচ্ছু কম পড়বেনা আপনার। মনে রাখুন, পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যু হারের চেয়ে একাকিত্বের মৃত্যুর হার ঢের বেশি। আসুন না এই দুর্দিনে, চেনা বৃত্তের বাইরে গিয়ে অকারণেই সহমর্মী হই, নিছক অকারণেই ভালোবেসে ফেলি মানুষকে।