প্রিয় অথবা অপ্রিয় কবিতা বিষয়ে কিছু কথা
প্রকৃতই কি কোনো কিছু প্রিয় হয় কিংবা থাকে? সময় বদলে গেলে ভ্রম উড়ে অন্য কোনো স্বাদে গিয়ে বসে, তখন সকল প্রপাতের জলকণার সুরভী বদলায়—আমি জানি। বিশাল নদীর অনেক ওপরে ভেসে থাকা মেঘেদের মতো অন্ধকার সব রাতে ফোটে। জোছনার রুপালি আলেয়া মেঘ কেটে কেটে যেসব রাত্রিতে দূর পাহাড়ের জনহীন ভৌতিক উপত্যাকায় কুহক চাঁদনীরাত আনে, সেসব রাতকে মায়া ছাড়া আর কী-বা বলা যেতে পারে?
নিরুৎসব জীবন আমার, পাহাড়দের শরীর ঘেঁষে চন্দ্রনীল হয়ে থাকে সব উপত্যাকা। কিন্তু সাধ্য কার, আলেয়ার দাগে হাত রাখে? আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি না। দীর্ঘতম আলোকরেখা আরও বেড়ে যায়, তবু ছুঁয়ে দেখা হয় না কখনো। কাকে বলে প্রিয় কিংবা ভালোবাসি—জানা যায় না, অথবা কখনো সুযোগ নেই। কেবলই স্বাদ পেতে বার বার ফিরে আসা সুরভিত কিছু রাতে।
ঘর ভরে থাকা অন্ধকার, ছায়ার ভেতর বেজে ওঠা শব্দ-রাত, অথবা সমুদ্র সুরভিত বালিহাঁস, কিংবা আলোকিত হলঘরে বসন্তের রতিবিলাস রোদ চকচকে জলের মতো পুরাতন আমলের ভেদরেখা পেরিয়ে করোটির মাঝখানে মৃদু হাসি রাখে। শুধু টের পাই হাসিগুলো যাবতীয় প্রেমের মতন শুচি—ঘাসের ভেতরে ঘাস হয়ে জন্মানোর আকাঙ্ক্ষার মতো কিছু যেন দেহের গহিনে জন্ম দেয় এক উজ্জ্বল প্রান্তর। যেখানে বৃক্ষেরা হেঁটে যায়, প্রাণিরা রহস্যময়। যার চারপাশে ঝকঝকে কালো আবলুশের মতন প্রলম্বিত ছায়া।
এই ছায়ার ভেতর শূন্য থেকে মহাশূন্যে, ইথার থেকে ইথারে, আলোতে, আঁধারে, হেলাঞ্চির কুয়াশামাখা প্রান্তরে, শিলা হয়ে খসে পড়া মেঘেদের মতো হাওয়াদের বুকে ভেসে তারাদের মতন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সুখ সব কবিতাই এনে দেয়। তাই স্বরচিত শয্যার ভেতরে যারা আসে তাদের সবাই পিলসুজ—পাখিদের সমস্ত বিলাপ শুধু জোছনার গান।
অবিরাম নুয়ে পড়া
নীল গাড় স্বাদে
সারারাত ধরে শুধু মাস্তুলের চারপাশে বহু পাখিদের ওড়াউড়ি
আর সারবাঁধা ডানা কুয়াশার মতো শব্দ করে—দূরে যেন ধীরশিখা
শূন্য থেকে ভূমি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শতশত পাখি দ্রুত কোলাহলে যেন
প্রতিধ্বনি তুলে ফের আমাকে কাঁপাচ্ছে অনিঃশেষ। যেখানে কিছুই নেই
সেই রকম শুকনো—উঁচু জায়গায় আলো জ্বলে—হয়তো পায়রা ছিল—
পাশ কাটিয়ে সেখানে এখন নামছে পাখিগুলো—আর আমি ছায়া খুলে
তাদের দেখছি যেন। হরিণের মতো স্নেহ-শব্দ আমার নিশ্চল বুকে
কুয়াশা অর্জন করে—বেঁচে থাকার রহস্য যেন সাদা চিন্তা খেয়ে ফ্যালে।
সন্ধ্যা চুরমার করে বৃষ্টিরা এখন টানা তারে সারাক্ষণ সুরহীন,
প্রাণীর জীবন ছেঁচে বানানো কার্পেটে হেঁটে হেঁটে অবিরাম নুয়ে পড়ি
ক্ষত হওয়ার মতো কমলালেবুর পরিশ্রমে—ভরে থাকা গাঢ় স্বাদে।
চারপাশে ফেনাভরা নদী-রাত-শব্দ-গাছ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে
কালো ছায়ার শরীরে। পাখিরা কেবল উদাসীন পাখিদের মতো যেন
সুউচ্চ গিরিতে শুধু অবাধে গড়িয়ে যাচ্ছে এক বেদখল দীর্ঘশ্বাস।
ফুলদের যাতায়াত
গোলাপ কিভাবে ফোটে কিংবা ঝরে যায়
সেসব জেনেছে যারা অথবা জানেনি
সরু-গোল দুটি চোখে কখনো দ্যাখেনি
অথবা অনেকবার গহীন সকালে
যখন ডুবেছে চাঁদ গাছের আড়ালে—
ফোটা ফুলগুলো দেখে সুবাসিত চোখে
অনায়াসে গাঢ় হেসে নিজের নিকটে
বারবার ভেঙে গিয়ে খুশি হয়ে গেছে—
তারা কিংবা মানুষেরা, পৃথিবীর সব
দলছুট মানুষেরা, হলুদ ঈর্ষায়
বেমালুম ভুলে যায়—নিবিড় সন্ধ্যায়
ফুলের যাতায়াতের ঘন এক শব্দ
সহজে পাওয়া যায়—ফেলে আসা সব
ফর্সা লোকদের গতকালের মতন।
অনায়াসে বেঁকে গেছে যারা
আজ রাতে চারদিকে জলের ধারার দেহ নিয়ে
বাতাসের আওয়াজ ফাটল রেখেছে অন্ধকারে,
মনোরম সাদা মানুষেরা সব ঘুমে অচেতন।
পৃথিবীতে এতদিন ধরে ভেবেছি ঈশ্বর যাকে
শরীরে নয়ন রেখে কিছুটা নিজের দিকে নুয়ে
নিজ স্বাদে তাকে ভাবি আজ এই ঘন অবসরে।
ভালোবাসায় কে কাকে ভাবে অথবা ছিড়তে পারে
তা কেবল সে-ই জানে, নাকি ভাসে দূরাগত শব্দে?
মানুষের মতো পরিশ্রমে অনেক বছর ধরে
সে দারুণ দাঁতহীন, ভয়াল আলোর মতো একা
অনাহত শূন্যতার দিকে নিহিত অভ্যাসে ডুবে
ধরে থাকে সীমানার শেষ, বেঁচে থাকে তামাসায়
কিংবা হতাশার রক্তে ঘিরে থাকা সব ব্যবসায়।
বহুকাল আগে থেকে মানুষেরা দুর্বল রয়েছে,
নিজস্ব নজরে ভেবে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে ধীরে।
কেননা মানুষ তারা—আর-সব প্রাণের মতন
পাহাড়ের মতো অন্ধকারে তারা কেবল মানুষ,
সাদা করোটির হলঘরে কয়েদির মতো পোষা।
মগজের তীব্র আঁচে পুড়ে পশুগন্ধ ভুলে গেছে
অথচ তাদের বসবাস সীমাবদ্ধতার কাছে।
তারা সূর্য অথবা পৃথিবী কোনোটি চেনে না চোখে
অথবা প্রাচীরে ঢলে পড়া গাছেদের দীর্ঘ ছায়া
তারা বোঝে গোলাকার—যেভাবে শিশুরা বাদ্য করে,
যেভাবে হলুদ ঈর্ষা ভোলে বিভোর বাতাসে একা।
তারা জানে চোখগুলো কেবল দেখছে সবকিছু
আর নরম হাতেরা যা কিছু সহজে স্পর্শ করে
তাকেই পৃথিবী বলে—শূন্য যাকে কুসুমিত রাখে।
আছে চাঁদ, ভাটির ভেতরে যাকে ভেসে যেতে দেখে
আর অসংখ্য তারার রাতে নদীতীরে গাছগুলো
অনিদ্রায় চুপ হয়ে যায়, বা এভাবে তারা ভাবে।
তারা রাত্রিতে পুড়তে পারে—শ্বাস নিতে চারদিকে
চাঁদের পেছন দিকে ঘন হতে পারে অনায়াসে।
তারা একটি মুখের ভাষা আলাদা ধ্বনিতে ভেঙে
সহজে ধারালো করে। তারা প্রভু আঁকে কৌতূহলে
থোকা থোকা আঙুরের মতো রোদে যেন ভ্রান্তি গড়ে।
তাদের নিকটে যেন ঈশ্বর কেবল গোলাকার
কেননা সেটাই সর্বোত্তম—সেটাই ঐশীর দেহ
যার কেন্দ্র সবখানে—অথচ পরিধি নেই যেন।
রোদে পোড়া খেলুড়ে মানুষ তাকে সীমানা করে না
দেহ যেন সবদিকে—ছায়া পড়ে আছে সীমাহীন।
অলৌকিক বাতাসে অথচ নিজেকে আলাদা ভেবে
এক পশলা বৃষ্টির পর ডুবে যায় গাঢ় ঘুমে।
কিভাবে দূরত্ব আসে—ভ্রমণেরা রেশমি কাপড়
কিংবা শারদ অরণ্যে ফালি ফালি কাটা চোখ রাখে,
জানালার সারা দেহ হাওয়ায় কটকট করে,
বিপজ্জনক অন্ধকারে সেসব রাতের পাশে
খসে পড়ে থাকে। আর মানুষ-শরীর কেবলই
জাঁকালো ভ্রান্তিতে নুয়ে থাকে কিংবা থাকে না কখনো
কিংবা এগুলো তাদের অংশ—গোলাপি তালুতে যেন
কোনো প্রাচীন শব্দের দিকে আঁকা থাকে অমলিন।
প্রতিটি বসন্ত এলে তারা ভাবে মৃত্যুর নিকটে
এগিয়ে যাওয়া হয়—উৎসব শরীরে আসে শুধু
ডোরাকাটা সময় পেরিয়ে। যারা ভাঙে ফুলদানি
অথচ তারাই হাসে সুবাসিত ফুলের অভ্যাসে।
অসীম সংখ্যক সহস্রাব্দ নীল সমুদ্রের মতো
কেবল একটি ঘ্রাণ আর নোনা স্বাদের আকার
পৃথিবীর মানুষেরা গলিয়ে রেখেছে ভাবনায়।
তারা অনায়াসে ভাবে মানুষেরা মুকুরিত হয়,
তারা ভাবে: তারা ছিলো অথবা ভাসছে কোনো এক
জলের ওপরে সারাক্ষণ, আর কিছু পরে পরে
সহসা আটকে যাচ্ছে কোমর অবধি জল-ঘাসে।
এভাবে জলের কাছে থেকে তারা ভাবে কোনো কালে
কোনো এক আয়ুর ভেতর তারা ছিল বোবা মাছ—
সাগরে লাফিয়ে ক্রমাগত একদিন বুনো দেহ
বাদামি হরিণ হয়ে গেছে—অথবা গাছের ডালে
নরম ঘুমন্ত গায়ে পাখিদের মিছিলে উড়ছে।
অথচ তাদের আর্দ্রতায় ঘন শরীরের কাছে
এক মহাকাল ধরে মানুষের পশম রয়েছে।
একে তারা বলে: শরীরে সূর্যাস্ত আসে অতঃপর
সবকিছু পুনরায় জন্ম নেয় কিছু অন্ধকারে
ভিন্ন ঘরে ঘুমানোর মতো ধীরে জীবন পেরিয়ে
ঢুকে যায় অন্য কোনো অবিরাম সবুজ জীবনে।
কিন্তু হাওয়ার কাছে এই সব কিছু (পুনর্জন্ম)—
কেবলই সমতল, কবিতার মতো অভিব্যক্তি,
এ শুধু নিজেকে অন্তহীন, গাঢ় ভাবার প্রচেষ্টা
সব নদীতে চুমুক দিয়ে মধ্যরাতে ডুবে থাকা।
আর ব্যক্তিগত প্রভুদের বিছানার চারপাশে
গড়ে রাখা প্রাচীরের কাছে মিনার খচিত শব্দে
ভাঁজ করা ছুরির মতন শেষ বিনত হওয়া—
যেন কোনো মরীচিকা, বহুকাল কাঁপছে হাওয়া।
নির্জনতা আনে যারা
শেষকৃত্য হয়ে গেলে সব গাছপালা
পাতাঝরা শহরেরা, কিংবা মানুষেরা—
চারপাশে দূরে, যতগুলো পাখি থাকে,
ওড়ে যত সারসেরা—বা আরও পরে
রোদেরা যখন সাদা আর ঝকঝকে
অথবা রাতের নরম বাতাসে ডুবে
ক্রমাগত যারা ইশারায় হাত নাড়ে
আর নির্জনতা আনে বিভোর বাতাসে—
তারা অথবা কুয়াশা—নিচু গাছে ঢাকা
থমথমে সব ছায়া—যেন বা ঘটনা
সাধারণ কোনো দেহে আঁচিলের মতো
কোনো এক গতিপথে হীম বেঁচে থাকা—
ধারালো হাওয়া বা বৃষ্টির দিক এলে
পাতাদের মতো কেঁপে যাওয়া কখনো।
বিনিময় ছাড়া ম্লান হয়ে
আমাদের যা-কিছু অর্জন, সেসবের বেশিভাগ—অতীতের মতো খোসাহীন
কিংবা মাছেদের চোখে জলের অভাব যেন।
আগেকার সব দৃশ্য নির্লজ্জের মতো আমাদের আবর্তন করে—
তবুও ভবিষ্যৎ সারাকাল আলো মরে গিয়ে নীল অন্ধকারে
ঝকঝকে কোনো আওয়াজে মৃদু দৃশ্যমান।
অনেক চেয়েছি ভুলে যেতে—শারীরিক কিংবা ভাবনায়—
তবু স্মৃতি শুয়ে থাকে মগজের এককোণে—
বৃষ্টি যেভাবে নিঃশব্দে খুন করে আমাদের,
ঠিক সেরকম ফ্রিস্টাইলে তোমাকে গহিন ভেবে,
ভালোবাসা আর প্রলোভনে শত্রু হয়েছি নিজের—
কার সাথে রাত থাকা যায়—বিনিময় ছাড়া ম্লান হয়ে
দাবানলে জ্বলে নিকোনা হৃদয়—সেসবের ইতিহাস প্রেমে পড়ে
বহু আগে স্নিগ্ধ হয়ে গেছে।
এখন দরজা থেকে দূরে হেঁটে গিয়ে দেখি:
স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের পর কিছু চাঁদ জ্বলে আছে।