ডাক্তার-নার্সের ছোটাছুটি দেখে যা বোঝার, তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল তৃণা। এই দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে এই ক’দিনে। এখন কী কী ঘটবে, তার সবই সে জানে। এপ্রন পরা ডাক্তারেরা বিছানা ঘিরে দাঁড়াবেন। গুরু-গম্ভীর মুখে রোগীর ফাইল উল্টাবেন। হাতের ট্রে-তে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে নিচুগলায় কিছু বলবেন। সবাই ব্যতিব্যস্ত হবেন। শিক্ষানবিশ ডাক্তারেরা দুঃখিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকবেন। নির্দেশিত কিছু ইঞ্জেকশন পুশ করা হবে শিরায় যুক্ত ক্যানুলায়, স্যালাইনে।
কপালে ভাঁজ তুলে মনিটরের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকবেন ডাক্তারেরা। মনিটরের বিপ বিপ শব্দে গা-ছমছম পরিবেশ তৈরি হবে। এর মধ্যেই একজন ডাক্তার এগিয়ে যাবেন রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে হৃৎপিণ্ড বরাবর বুকের পাঁজরে চাপ দিতে। এক…দুই…তিন…চলতে থাকবে কিছু সময়। হাতের পালস দেখবেন। গলার পাশে পালস দেখবেন। স্টেথোস্কোপ বসিয়ে হৃদয়ের কম্পন শোনার চেষ্টা করবেন। নার্সের ট্রে থেকে তুলে টর্চটা জ্বেলে চোখের তারার সংবেদনশীলতা দেখবেন। তারপর, স্টেথোটা অবহেলায় ঘাড়ের উপর ফেলে হাত গুটিয়ে নিবেন। সব শেষ…।
সাদা চাদর দিয়ে মুখটা ঢেকে দেওয়া হবে। আস্তে আস্তে খুলে নেওয়া হবে শরীরে লাগানো এতদিনের নানান নল আর তারের প্রান্তভাগগুলো। আপনজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়বেন। যেন এতক্ষণ কোনো হৃদয়বিদারক নাটকের মহড়া চলছিল। আর কদিন পরেই মঞ্চে প্রদর্শনী হবে! দরজার এপারে কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাবে আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা ট্রলি বের করে আনা হচ্ছে।
আজ ছয়দিন বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে। গতকাল ডাক্তার বলে দিয়েছেন, বাবার আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে। এখানে কবে নাগাদ আইসিইউ বেড খালি হবে তার নিশ্চয়তা নেই। সম্ভব হলে ওরা যেন প্রাইভেট কোনো ক্লিনিকে আইসিইউ’র ব্যবস্থা করে। আসলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তৃণাদের। প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়ার সামর্থ্য ওদের নেই।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা, যমের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন আজ প্রায় এক সপ্তাহ। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর প্রথম দুইদিন বাবা রুমে একা ছিলেন। কাউকে তার ধারে ঘেঁষতে দেননি। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। প্রথম প্রথম দিনে দুই-তিন লিটার অক্সিজেনেই হয়ে যেতো। তারপর থেকে দিন দিন চাহিদা বেড়েছে অক্সিজেনের। প্রতিদিনই এই টেস্ট, সেই টেস্ট করাতে হচ্ছে। ফুসফুস অনেকখানি আক্রান্ত। এখানকার ডাক্তাররা খুব আন্তরিক। তৃণার মা ছোট দুই বোনকে নিয়ে বাসাতেই থাকছে। ভার্সিটি পড়ুয়া তৃণা নিজেই সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাসায় যা টাকাপয়সা ছিল সব শেষ। বড়মামা কিছু টাকা দিয়ে গেছেন। খুব সাবধানে সেখান থেকে খরচ করছে। বাবাকে যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ করে বাড়ি নিতে না পারে, তাহলে আরও কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।
আর একটা দিন বেঁচে থাকো বাবা! আর একটামাত্র দিন। রাত গভীর হলে আমি আবারও নিবিড়ভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে অন্য কারও মৃত্যু কামনা করবো তোমাকে বাঁচাতে!
বাবার আইসিইউ লাগবে শুনে কাল থেকেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি তৃণা। এমনকি বাসার কাউকেও বলেনি। মায়ের প্রেশারটা সবসময় বেশি থাকে। ওষুধেও কন্ট্রোল হয় না ঠিকঠাক। মাকে তাই ধীরেসুস্থে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে গেলে এইচডিইউ থেকে আইসিইউ-তে শিফট করা হয়।
গত ছয় দিনে আইসিইউ থেকে একজনকে জীবনে ফিরতে দেখেছে তৃণা। বাবাও সেই দলে থাকবে বলে তৃণার দৃঢ় বিশ্বাস। দুপুর থেকে শুরু করে সারারাত আইসিইউ’র রোগীদের পাহারা দিয়েছে তৃণা। যাদের দেখে বা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে অবস্থাপন্ন পরিবারের, তাদের মৃত্যু কামনা করেছে। হ্যাঁ, মৃত্যুই চেয়েছে তৃণা। তারা মরে গেলে ওদের পরিবার অন্তত বাঁচবে। বাবা মরে গেলে তৃণারা যে বাঁচতে পারবে না কিছুতে! মা আর দুই বোনকে নিয়ে পথে বসতে হবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে কখনো এমন আকুল করে কিছু চায়নি তৃণা। শুধু চেয়েছে এদের কারও মৃত্যু হোক! মৃত্যু হয়ে একটা আইসিইউ বেড খালি হোক। এছাড়া বাবাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় জানা ছিল না তৃণার।
মাঝরাতে কোনো রোগীর অবস্থা খারাপ হলে নার্সরা বেডের দিকে দৌড়ে গেলে খুশি লাগতো তৃণার। এই বুঝি খালি হলো একটা বেড। মনে মনে ভেবে রেখেছে তৃণা কোন বেডটা হলে সুবিধা হয়। আগামীকাল বিকেলে মামা আরো কিছু টাকা দেবে বলেছে। তাছাড়া বাবার কলিগেরাও কিছু সহযোগিতা করবে বলেছে। এরপরেও ঠেকে গেলে মায়ের অল্পকিছু গয়না আছে শেষ সম্বল হিসেবে। ব্যবস্থা কিছু হবেই। এখন শুধু দরকার একটা আইসিইউ বেড। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ওরা সবাই।
নার্স আর ডাক্তারদের হঠাৎ ছোটাছুটি তাই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত তৃণার ভেতর প্রাণ-সঞ্চার করলো। সৃষ্টিকর্তা শুনেছেন! তৃণার প্রার্থনা শুনেছেন! সম্ভবত মারা গেছেন সেই ভদ্রলোক। আল্লাহ তার ভালো করুন। তৃণার বাবা বেডটি পাবেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। ওদের টানাটানির সংসারে আবার হাসি-আনন্দের জোয়ার বয়ে যাবে। অফিস থেকে ফিরলে বাবার মাথার পাকাচুল বেছে দিবে তৃণা। বাবা বাধা দিলেও শুনবে না। ওদের তিনবোনের চোখে বাবা রাজপুত্রের মতো সুন্দর। বাবাকে কেউ বুড়ো বললে মেনে নিবে না ওরা। অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে যখন চাকরি করবে, বাবাকে আর কাজ করতে দিবে না তৃণা। উদয়াস্ত পরিশ্রম করা মানুষটাকে বিশ্রাম দিবে কিছু সময়। একসময় গিটার বাজানোর শখ ছিল বাবার। একটা গিটারও কিনে দেবে, ভাবলো।
বাবার অক্সিজেন-স্যাচ্যুয়েশন ফল করছে দ্রুত। গতকালও ৯৪/৯৫-তে ওঠানামা করছিল। আজ ৯২/৯৩-এর নিচে নেমে যাচ্ছে। একটু ধৈর্য ধরো বাবা। এই তো আরেকটু। আর একটুখানি প্লিজ। চারপাশে এত অক্সিজেন অথচ বাবার ফুসফুসে ঢুকছে না। অক্সিজেন কেন, কারও সঙ্গেই তো শত্রুতা নেই বাবার! বাবা একজন অজাতশত্রু মানুষ! এত ভালো মানুষের এত কষ্ট কেন মাবুদ!
গতকাল থেকে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় কথাও বলেনি বাবা। মা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। তৃণাকে ডেকেছে। এখন যাওয়ার বা শোনার সময় নেই। নিবিড় পাহারায় আছে তৃণা। বেডটা ধরে আছে হাতে। যেন বা ছেড়ে দিলেই ফসকে যাবে হাত থেকে। সাদা চাদরে ঢাকা রোগীকে ট্রলিতে তোলার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যায় তৃণা। অল্পবয়সী মায়া মায়া চোখের ছেলে-ডাক্তারটির পাশে নার্স আর ওয়ার্ড বয় দাঁড়িয়ে। তাদের সঙ্গে এই কদিনে ভাব হয়েছে তৃণার। বিশেষ করে ছেলে ডাক্তারটিকে খুব ভালো লেগে গেছে। রোগীদের প্রতি খুব যত্নশীল আর সহমর্মীও। আসলে তাদের সবাইকে ভালো লেগে গেছে তৃণার। প্রত্যেকেই যথেষ্ট সহযোগী মনোভাবের। দূর থেকে এতদিন সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা ছিল, এখানে আসার পর সব ভেঙে গেছে।
দুঃখিত ম্যাম, সিটটা এই মুহূর্তে আপনাদের দেওয়া যাচ্ছে না। একজন ভিভিআইপি’র কল এসেছে। বেডটি তার আত্মীয়ের জন্য বুকড হয়ে গেছে। নেক্সট খালি হলে আশা করি আপনারা পাবেন।
মায়া মায়া চোখের ছেলে-ডাক্তারটি মমতাভরে তাকালো তৃণার দিকে। একটু কি পানিও দেখলো সেই চোখে? সব উপেক্ষা করে তৃণা দৌড়ে গেলো বাবার দিকে। আর একটা দিন বেঁচে থাকো বাবা! আর একটামাত্র দিন। রাত গভীর হলে আমি আবারও নিবিড়ভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে অন্য কারও মৃত্যু কামনা করবো তোমাকে বাঁচাতে!