মেয়েটির নাম রুবি। বয়স কত আর? নয় বা দশ।
জগতে রুবির কেউ আছে কি-না তা জানে না। জানার ইচ্ছাও হয়নি কখনো। জন্ম থেকেই পথে-ঘাটে। কাকেই বা জিজ্ঞাসা করবে? কেই বা উত্তর দেবে?
তবে বন্ধু জুটে গেল পথ চলতে চলতে। এটা-ওটা কুড়ায় রাস্তায়। চেয়ে-চিন্তে খায়। কখনো না খেয়ে থাকে। তবুও দিন শেষে শান্তিতে ঘুমায়। কোথায় আর ঘুমাবে? রাস্তার পাশে, পার্কের বেঞ্চে বা ভবনের সিঁড়ির নিচে।
রুবি ছিন্নমূল শিশু। কিশোরী হয়তো বলা যায়। কেননা মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে মাতাল কিংবা লম্পটের হাত পড়ে বুকে ও নিতম্বে। রুবি টের পায়। চিৎকার করে গালাগালি দেয়। লম্পট দৌড়ে পালায়।
রুবির আশেপাশের বন্ধুরা জেগে ওঠে। তারা জানতে চায়-
‘কী অইছে রে রুবি?’
‘কুত্তার বাচ্চাডায় পায়ের ওপর পাড়া দিছে। মাতাল এট্টা। দেইখা হাঁটতে পারে না।’
রুবি চেপে যায়। চেপে যেতে শিখেছে। মা-দাদিরা শেখায়নি। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই হয়তো নিজে নিজে শিখে গেছে। তাই মিথ্যা বলেছে বন্ধুদের। কিংবা প্রতিবাদের ইচ্ছা থাকলেও সাহস হয় না। তাই চেপে যায়।
বেশ কিছুদিন ধরে সুজনের সঙ্গে কিছুটা ভাব হচ্ছে। সেটার নাম ভালোবাসা কি-না রুবি বোঝে না। তবে এটুকু বোঝে, সুজন খুব কেয়ার করে রুবির। মাঝে মাঝে এটা-ওটা এনে খাওয়ায়। কোথাও ভালো কোনো খাবার পেলে নিজে না খেয়ে রুবির জন্য নিয়ে আসে।
আজও টিএসসিতে এক প্যাকেট খিচুড়ি পেয়ে রুবিকে খুঁজতে থাকে সুজন। একসময় খুঁজে পায় দোয়েল চত্বরের পাশে। তারপর দু’জনে হাত ধরে হেঁটে আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তখন পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হয় রুবির কাছে। অনুভব করে, এভাবে হাত ধরে হাঁটার জন্য একজন মানুষ দরকার।
হেঁটে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেঞ্চে বসে ভাগাভাগি করে খায় দু’জন। রুবির চোখে-মুখে পরিতৃপ্তির আভা। সলাজ দৃষ্টিতে তাকায় সুজনের দিকে।
‘কী দেহোছ? খাছ না ক্যান?’
‘কিছু দেহি না। খাইতাছি তো।’
বলে মাথা নিচু করে আবার প্যাকেট থেকে এক লোকমা তুলে মুখে দেয় রুবি। চিবুতে চিবুতে সুজনের দিকে তাকিয়ে বলে-
‘হ্যারে সুজন? তুই আমারে এত আদর করোস ক্যান?
‘সর, কই আদর করলাম?’
‘এই যে আমারে ছাড়া কিছুই খাস না।’
‘এমনেই। তোরও কেউ নাই। আমারও কেউ নাই। আমাগো তো কেউ আদর করে না। তাই আমার ইচ্ছা অইলো, তোরে কিছু খাওয়াই। তোর যদি ইচ্ছা অয় মাঝে মইধ্যে আমারেও খাওয়াইছ।’
‘আমি দেখছি, টিএসসিতে দাদারা আপা গো কত কিছু খাওয়ায়। আপারা দাদাগো মুখে খাওন তুইলা দেয়।’
‘তুই কি আমার মুখে তুইলা দিবি?’
‘ইস, শখ কত? যা, ভাগ।’
সুজন রাগ করে। কষ্টও পায়। প্যাকেট রেখেই উঠে চলে যায়। রুবি অভিমান কিছুটা বোঝে। টিএসসি বা পার্কে মাঝে মাঝে এমন দৃশ্য দেখে। রুবি মনে মনে হাসে।
‘ওই সুজন, কই যাস? খাওন শেষ অয় নাই তো। ওই সুজইন্যা?’
‘আমি আর খামু না। তুই খা। আমি আর কোনোদিন তোন সামনে আহুম না।’
পেছনে না তাকিয়েই কথাগুলো বলতে বলতে চলে যায় সুজন। রুবি একা একাই হাসে। মনে মনে বলে-
‘পাগল এট্টা। দুষ্টামিও বোঝে না।’
সন্ধ্যার পর সুজনকে আর দেখতে পায় না রুবি। দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনে, চার নেতার মাজারে, টিএসসিতে, হাকিম চত্বরে বা শাহবাগেও না। ওদের দলেরই একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে রুবি। কেউ বলতেও পারে না সুজনের কথা। রুবির মন আস্তে আস্তে খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে, ‘সুজন কি তাইলে সত্যি সত্যি রাগ করছে? আমি তো হাচাহাছি কিছু কই নাই। দুষ্টামি করছি খালি।’
মন খারাপ নিয়েই হাঁটতে থাকে রুবি। হাঁটা উদ্দেশ্যহীন বলা যায়। ডাচ থেকে এগিয়ে তারেক মাসুদের ভাঙা গাড়িটার পাশে দাঁড়ায়। ‘আহারে লোকটা মনে অয় শ্যাষ।’ মনে মনে বলে রুবি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মানুষ মইরা যায় ক্যান? মইরা কই যায়?’ জবাব পায় না। কপাল কুচকায় একটু। আবার একটু হাসেও। ‘ভাঙা গাড়িডারে আবার রং করছে। সুন্দর কইরা সাজায়া রাখছে। মনে অয় বড়লোক কেউ আছিল। এই দেশে বড় মাইনষের কত দাম। আমাগো কেউ জিগায় না।’
ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। করোনার পরও এখানে মোটামুটি জমজমাট আড্ডা। নিম্নশ্রেণির কিছু মানুষের গল্প চলছে। চা-পান-বিড়ির আড্ডা। কারো কারো সঙ্গে মাস্ক নেই। যাদেরও আছে, থুতনির সঙ্গে লটকানো। শহীদ মিনারের আড়ালে পাগল-লম্পট-রিকশাওয়ালাদের ভিড়। রুবির নাকে গাজার উৎকট গন্ধ আসে। রুবি নাক চেপে চলে আসে।
কেউ সুজনের চিৎকারে কর্ণপাতও করে না। পথিক যে যার মতো হেঁটে যায়। কারোরই তো রুবিকে চেনার কথা নয়। রুবিরা এ সমাজের কেউ না। রুবির মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে সুজন। কেন সে রুবিকে ছেড়ে গিয়েছিল? নিজেকেই অপরাধী ভাবতে থাকে।
সামনের সিঁড়িতে বসে থাকে। এদিকেও সুজন নেই। সুজন তো এ এলাকার বা এর আশেপাশেই থাকে। বেশি দূরে যায় না কখনো। আজ কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে মন বেশি খারাপ হয় রুবির। এদিকে ধীরে ধীরে রাতও গভীর হয়ে আসে। জানুয়ারির শেষে এসে শীতটাও একটু বেড়েছে। রুবির গায়ে মোটা একটা সোয়েটার। কয়েক বছরের পুরোনো। নিচের দিকে কিছুটা ছোটও। তবুও শীত থেকে বাঁচতে পরতে হয়। ক’দিন আগে টিএসসিতে একটা দল কিছু শীতবস্ত্র দিয়েছে। সেদিন রুবি একটা চাদর পেয়েছিল।
গলা থেকে পেচানো সেই চাদরটা নামিয়ে পাশের বেঞ্চে পেতে নেয়। আজ আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বেঞ্চেই শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। তবুও শুয়ে থাকে। চারদিকটা শীতের দাপটে কেমন সুনসান হয়ে আসছে। সুজনের জন্য খারাপ লাগে। বড্ড খারাপ লাগে। আগে কখনো এমন হয়নি। আজ খুব একা লাগে নিজেকে। আজই কেবল মনে হলো, রুবির কেউ নেই।
রুবির কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু কীসের জন্য? কার জন্য? তাও জানা নেই। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কনকনে শীতের রাতে শরীরে আপনজন কারো পরশ নেই। বাবা-মায়ের বুকে ঘুমানোর সৌভাগ্য নেই। বড় বৈষম্য এ জীবনে। সবাই ঘরে ফিরে গেছে। অথচ রুবির ঘর নেই।
সারাদিন এটা-ওটা কুড়িয়ে ভাঙারিতে দিলে মালিক কিছু টাকা দেয়। তাতেই দিন কেটে যায়। রাতে আর কোনো সঞ্চয় থাকে না। কাল কি খাবে তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। এসব ভাবতে ভাবতে কাঁদতে কাঁদতে প্রায় মাঝরাত। সামান্য একটু লেগে এসেছে চোখটা। রুবি একটু ঘুমাতে চায়। হঠাৎ একটি হাত এসে চেপে ধরে রুবির মুখ। দুটি হাত চেপে ধরে রুবির পা। চোখ খুলে রুবি দেখে তিনটি দানব তার সামনে। কিন্তু চিৎকার করার উপায় নেই। শক্তিতেও পারার সম্ভাবনা নেই।
দানব তিনটি রুবিকে পাজাকোলে করে নিয়ে যায় শহীদ মিনারের পেছনে। সেখানে অন্ধকার। সুনসান নীরবতা। করোনাকালীন কনকনে শীতের রাতে শহরের পথ-ঘাটও ফাঁকা। রুবির বুকে শুধু সুজনের জন্য হাহাকার। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা। কিন্তু পেরে ওঠে না। প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। চাপা মুখে শব্দও বের হয় না। আস্তে আস্তে ভুলে যায় সব। অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। ঘুম নেমে আসে দু’চোখজুড়ে। রুবির হাত নড়ে না। পা নড়ে না। চোখের পলকও পড়ে না। হৃদয় যেন উদ্ভ্রান্তের মতো সুজনকেই খোঁজে।
রোদওঠা সকালে ঘুম ভাঙার পর রাস্তায় বের হয় সুজন। সারারাত নীলক্ষেতের একটা দোকানের পেছনে ছিল। আড়মোড়া ভেঙে চায়ের দোকানের টেলিভিশনের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। দেখতে ঠিক রুবির মতোই। টিভির সামনেও প্রচুর ভিড়। চোখ কচলে দেখে সুজন। হ্যাঁ, রুবিই তো। শুধু মুখটা দেখা যায় রুবির। টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে বুম হাতে সাংবাদিক তখন বলে ওঠে, ‘আজ সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে অজ্ঞাতনামা একটি মেয়ের বিবস্ত্র মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মেয়েটির পরিচয় জানার চেষ্টা করছে শাহবাগ থানার পুলিশ।’
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সুজন। নিজের অজান্তেই তখন চিৎকার করে ওঠে, ‘আমি অরে চিনি। ওর নাম রুবি। অয় তো কোনো অপরাধ করে নাই। অরে মারছে কেডা? অরে মারছে কেডা?’ বলতে বলতে শহীদ মিনারের দিকে ছুটতে থাকে। সুজন জানে না, রুবির মৃতদেহ ততক্ষণে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।
কেউ সুজনের চিৎকারে কর্ণপাতও করে না। পথিক যে যার মতো হেঁটে যায়। কারোরই তো রুবিকে চেনার কথা নয়। রুবিরা এ সমাজের কেউ না। রুবির মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে সুজন। কেন সে রুবিকে ছেড়ে গিয়েছিল? নিজেকেই অপরাধী ভাবতে থাকে।