বয়স্ক ভাতার কার্ড হাতে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কলিমদ্দি। চোখ রগড়ে দেখে বারবার। ভীষণ আফসোস জাগে। ময়না বেগম, বয়স পঁচাশি। কার্ডে বড় বড় করে লেখা কালো অক্ষরগুলো চোখের সামনে নাচে। ধাঁধা লাগিয়ে দেয় চোখে। সেই সাতসকালে কমিশনারের চেলা জামাল মুন্সির ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি এসেছিল কলিম। জরুরি তলব। কী বিষয়, জানতে চাইলে কণ্ঠে রহস্য ঢেলে মুন্সি বলেছিল, আরে তুমি আইসো তো আগে! তারপরে কবোনে! অত তাড়া কিসির তুমার! সুখবর আচে। আইসো তুমি!
অতপর পড়ি-মরি তৈরি হয়ে কমিশনারের অফিসে এসেছিল কলিমদ্দি। জগতে কে আছে এমন নির্মোহজন যে সুখবর জানার মোক্ষম সুযোগ উপেক্ষা করে বসে থাকে ঘরের কোণে! কলিমদ্দি অন্তত তেমন কাউকে চেনেনি আজতক। সুখবর জানার অদম্য উৎসাহ তাকে তাই টেনে এনেছিল মুন্সির ডেরায়। মুন্সি রহস্য করছিল প্রথমটায়। সুখবরটা কিছুতেই বলে না সে। মিষ্টি খাওয়ানোর পুনঃপুনঃ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে তাকে বাগে আনতে পেরেছিল কলিমদ্দি। মুন্সি তখনো মুখে বলে না কিছু। পকেটে হাত দিয়ে পাকা জাদুকরী দক্ষতায় আচমকা কার্ডটা বের করে আনে সে। বের করেই হাতে দেয় কলিমদ্দির। যাত্রাদলের সঙের মতো মুখ করে বলে, খালি মিষ্টিত হবিনানে কলাম! নগদ দিতি হবি!
কার্ডটা হাতে বেকুব তাকিয়ে থাকে কলিমদ্দি। মুন্সির পকেটের উষ্ণতা লাগা কার্ডটা উষ্ণ তখনো। শৈশবের অক্ষরজ্ঞানটা আবার ঝালাই করার সুযোগ সহসা মেলে না আজকাল। তেমন সুযোগ মিললে সে তাই খুশি হয়ে ওঠে দারুণ। কিন্তু আজ সে খুশি হতে পারে না মোটেই। কার্ডে লেগে থাকা ছবিটায় চোখ আটকে যায় তার। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা নামটা পড়ে চোখ জ্বলে। ময়না বেগম। বয়স পঁচাশি। মুহূর্তে স্মৃতিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে মনে। গিলে ফেলতে চায় তার সমগ্র চেতনা ও বোধ।
আঁচলের গিঁটে বাঁধা সবেধন নীলমণি দশটাকার নোটটা কলিমদ্দির হাতে গুঁজে দিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে, আমি টাহা পাবো কোনে, ও বাজান? কাডডা যেবা পারো হইরে আইনে দেও আমাক। কাড অলি পরে সেহুন বেশি হরে টাহা দেবোনে তুমাক।
কতবার ঘুরেছে তার কাছে ময়না বেগম? মনে করতে পারে না ঠিকঠাক। মুন্সির কাছে অবশ্য কলিমদ্দিকে ঘুরতে হয়নি মোটেই। সরাসরি কমিশনারের কাছে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনি ময়না বেগম। ঠিক সাহসের অভাবও নয় আসলে। কমিশনারের অফিসে বারবার ধর্ণা দিয়েও ময়না কিছুতেই নাগাল পায়নি তার। অতবড় রাঘববোয়ালেরা নাকি ময়নার মতো ফালতু লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে না। তাদের অত সময় নেই। তাদের আছে দেশোদ্ধারের মহান ব্রত। ময়না বেগমদের মতো মানুষদের বয়স্ক ভাতার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাবা নাকি তাদের কাজ নয়। মুন্সির কাছেও সে পাত্তা পায়নি মোটেই। বাধ্য হয়েই ময়না কলিমদ্দির দারস্হ হয়েছিল অতপর। কলিমদ্দিও নাকি সেদিনই ছুটেছিল মুন্সির কাছে।
মুন্সি কলিমদ্দির পেয়ারের লোক, তাক বললি পরেএকদিনির মদ্যিই হয়া যাবি তুমার কাড। হাতে তুড়ি মেরে ময়না বেগমকে কথাগুলো বলেছিল কলিমদ্দি। শুনে ময়না বেগমের ঘোলা, প্রায়ান্ধকার চোখেও সহসা জ্বলে উঠেছিল আলো। খুশিতে ভরে উঠেছিল তার বলিরেখা ভরা, খেতে না পাওয়া শুকনো মুখ। তখনই তুরুপের তাসটা ছেড়েছিল কলিমদ্দি। মুখটা ময়না বেগমের কানের কাছে নিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, অপিস-আদালতের ব্যাপার তো, কিচু টাহাপয়সা খরচ করা লাগবিনি, বোচ্চ?
ময়না বেগমের বয়সের ভারে চুপসানো মুখ এই কথায় চুপসে গেছিল আরো। কপালে জমা চিন্তার রেখা দ্বিগুণ হয়েছিল মুহূর্তে। অবাক কণ্ঠ বলেছিল, কী কইস, ও কলিমদ্দি? কাড হরতি টাহা হ্যা লাগবি? আমি টাহা কোনে পাব? আমার টাহাই যদি থাকপি তালি পরে আমি কাড বানায়া বাতা খাওয়ার লেগি দৌইরোবো হ্যা?
ময়না বেগমের কথায় পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসে কলিমদ্দি। বলে, ওসপ তুমি বুজবানানে খালা। দিনকাল কি আর আগের মতো আচে? প্রশ্নটা করে উত্তরের অপেক্ষা করে না কলিমদ্দি, বিজ্ঞের মতো নিজের মাথাটা ঘন ঘন দুদিকে আন্দোলিত করে বলে, নাই। জমানা আর আগের মতো নাই রে খালা। পয়সা ছাড়া কেউ কতা কয় না এহন। অপিস আদালতের কামকাইজ এহন পয়সা ছাড়া হওয়া বিরাট কটিন!
বেকুবের মতো ফ্যালফেলিয়ে কলিমদ্দির রঙজ্বলা তামাটে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ময়না বেগম। যে মুন্সি কলিমদ্দির এত ঘনিষ্ঠজন, কলিমের ভাষায় ‘খুপ পিয়ারের লোক’, যাক বললিই কাড হয়া যাবি একদিনির মদ্যি, তাকে দিয়ে কার্ড করাতে কেন পয়সা লাগবে, ময়না বেগমের মোটা মাথায় সেটা কিছুতেই ধরে না। মুখ ফস্কে প্রশ্নটা করেও ফেলে সে হুট করে। বিরক্ত কলিমদ্দি মুখে জিব দিয়ে চকাস শব্দ করে জোরে। কপাল কুঁচকে বলে, এইতো বেবুজির মতো এটা কতা কয়া বইসলে তুমি খালা! মুন্সি আমার পিয়ারের লোক হলিউ কমিশনারের অপিসসুইদ্দ লোক তো আর পিয়ারের লোক না আমার। কাড তো করবি তারাই। মুন্সি বইলে-কয়া তারে দিয়ে তাড়াতাড়ি কাড করা দিতি পারবি, কিন্তুক পয়সা তো আর সে নিজির পকেটেত্তে দিবি না, সে যতই পিয়ারের লোক হোক আমার!
শুনে হতাশ হয় ময়না বেগম। মুখে জ্বলা আলোটুকু নিভে যায় দপ করে। আঁচলের গিঁটে বাঁধা সবেধন নীলমণি দশটাকার নোটটা কলিমদ্দির হাতে গুঁজে দিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে, আমি টাহা পাবো কোনে, ও বাজান? কাডডা যেবা পারো হইরে আইনে দেও আমাক। কাড অলি পরে সেহুন বেশি হরে টাহা দেবোনে তুমাক।
ময়না বেগমের না খেতে পাওয়া রোগা শরীর থরথর কাঁপে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে চায়। সেদিকে তাকিয়ে রাগে গা জ্বলে যায় কলিমদ্দির। ময়না বেগমের দেয়া দশ টাকার নোটটা সে রাগের চোটে ছুড়ে দেয় দূরে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তুমাক আর তালি বাঁইচে থাকতি কাড চোহি দেহা লাগবিনানে, বোচ্চ? বাইত যায়া খ্যেঁতা মুড়ি দে ঘুমোওগা আর স্বপন দেহোগা যে বয়স্ক বাতা পাইতেচ মাসকে মাস, যাও।
শুনে ময়না বেগম হাউমাউ কাঁদে। কলিমদ্দির হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ও কলিমদ্দি! বাজান রে! তুই আমার প্যাটের ছাওয়ালের লেহান। আমার এইটুক সাহায্য তুই হরবিনে বাজান? তোর আতে দরি ও বাজান! পায় দরি তোর! কাডডা বানা আইনে দে তুই আমাক। খিদের জ্বালা সহ্য অয় না আর।
ভেবে লম্বা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কলিমদ্দির। ভাগ্যটা বরাবরই এমন হারামিপনা করে তার সঙ্গে। মিলতে মিলতেও শেষ পর্যন্ত মোক্ষ মেলে না তার।
কলিমদ্দি কান করে না এসব অনুনয়ে। ময়না বেগম সোনার ডিম পাড়া হাঁস, জানে সে। ময়না বেগমের আত্মীয়-স্বজন সবাই হোমড়াচোমড়া। দুই ছেলে সরকারি চাকুরে। তাকে একটু ঝাঁকুনি দিলেই টাকা ঝরবে ঝুরঝুর। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না কলিমদ্দির। এত যে রুই-কাতলা আপনজন ময়না বেগমের, ছোট পদে হোক তবু দু দুটো ছেলে যার সরকারি চাকরি করে, সে কেন এমন খিদে পেটে ঘোরে রাতদিন? কেন তার দরকার হয় বয়স্ক ভাতার কার্ড করার? অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। না মিলুক। সহজে টাকা কামানোর এমন মওকা ছাড়ার মতো বেকুব নয় সে মোটেই। সে তাই সাফ জানিয়ে দেয় পয়সা ছাড়া সম্ভব নয় এসব। ফেলো কড়ি মাখো তেলের জমানা এখন। পয়সা ছাড়া এ জমানায় কেউ কারো নয়। শুনে সেদিনের মতো চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নেয় ময়না বেগম। মনে মনে পরের কয়েকটা দিন অধীর অপেক্ষায় থাকে কলিমদ্দি। মনের ভেতর এমন একটা ক্ষীণ সন্দেহও উঁকি দেয় তার মনে যে, ময়না বেগম হয়তো এতদিনে অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। সন্দেহ যখন প্রায় বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয় কলিমদ্দির, তখন একদিন হুট করে আবার এসে কেঁদে পড়ে ময়না বেগম। এতদূর হেঁটে আসার পরিশ্রমে হাঁপায়। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উদগ্রীব কলিমদ্দি মুখে নিস্পৃহতার মুখোশ এঁটে বসে থাকে চুপচাপ।
হাতের বিড়িতে লম্বা সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে মুখ সরু করে। তারপর ময়না বেগমের দিকে নিতান্তই উপেক্ষার দৃষ্টি ফেলে বলে, কী ব্যাফার খালা? তুমি হটাশ কী মনে হরে?
ময়না বেগম কথা বলে না প্রথমটায়। হাঁপায়। খানিক জিরিয়ে নিয়ে আচমকা আঁচলের গিঁট খুলে বের চকচকে পাঁচশ টাকার একটা নোট। কলিমদ্দির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ও সুনা! এই টাহাডা লাহো। আমার কাডডা বানা আইনে দেও ইবার।
কলিমদ্দি অবহেলায় চোখ সরিয়ে নেয়। মনের ভেতরের আনন্দ ঘূর্ণি সংবরণ করে বলে, ওই পাঁচশোও টাহার কাম না খালা। এত অল্পে এ কাম হবিনানে।
আচ্চা তুমি লাহো তো! আমি দেবোনে আরো আস্তে আস্তে। আশ্বস্ত করে ময়না বেগম। নোটটা প্রায় জোর করেই গুঁজে দেয় কলিমদ্দির হাতে। যেন নিতান্তই অনিচ্ছুক কলিমদ্দি, নেহাত জোর করে দায়িত্বটা দিতে চাইছে ময়না বেগম; তাই সে নিচ্ছে বাধ্য হয়ে, তেমন ভঙ্গিতে নোটটা অতপর পকেটে পোরে সে। দরকারি সব কাগজপত্র, ছবি তৈরি করে তার কাছে দিয়ে যাবার পুনঃপুনঃ তাগাদা দিয়ে সেদিনের মতো সে বিদায় করে ময়না বেগমকে। তারপর থেকে নিয়মিত হয় ময়না বেগমের ধর্ণা দেওয়া। নিয়মিত হয় কলিমদ্দির হাতে একটা দুটো ছোট-বড় নোট গুঁজে দেওয়াও। কলিমদ্দি নোটের পর নোট নেয়, বয়স্ক ভাতার কার্ডটা তবু মেলে না ময়না বেগমের। একসময় কলিমদ্দির কাছে আসার শক্তি বা উৎসাহ কিছুই আর নিজের ভেতর খুঁজে পায় না সে। নোটও সে আর জোগাড় করতে পারে না কারও কাছ থেকে যে কলিমদ্দিকে দেবে এনে। অতঃপর কলিমদ্দির কাছে আসা বন্ধ করে দেয় ময়না বেগম।
প্রথম কালবৈশাখ ॥ আরিফা ইয়াসমিন
অপেক্ষায় থেকে থেকে কলিমদ্দি খোঁজ লাগায় বুড়ির। ময়না বেগম অসুস্থ হয়ে শয্যাগত, জেনে কেমন একটু খারাপ লাগে তার। ঘরে ঢুকে বুড়ির রেখে যাওয়া ছবি আর কাগজপত্র খুঁজে বের করে সে বহুদিন বাদে। সেদিনই সেগুলো তার পিয়ারের লোক মুন্সির কাছে সে দিয়ে আসে অতঃপর। অনুরোধ করে যেন সে চেষ্টা করে ময়না বেগমকে বয়স্ক ভাতার একটা কার্ড পাইয়ে দিতে। তারপর নিজেই সে ব্যাপারটা ভুলে যায় একসময়।
এতদিন বাদে মুন্সির ফোন পেয়ে এসে বেকুব বনে যায় কলিমদ্দি। ময়না বেগমের কার্ডে লাগানো ছবিটা অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কলিমদ্দি চোখ সরিয়ে নেয়। মুন্সি যে সেই কবেকার ফেলে যাওয়া কাগজপত্রের কথা মনে রেখে এমন নিখরচায় আস্ত একটা কার্ড বানিয়ে দেবে, কে জানতো! বিস্ময় কাটতেই চায় না কলিমদ্দির। কিন্তু এই কার্ড দিয়ে সে এখন করবেটা কী? বুড়ি তো সেই কবেই মরে ভূত হয়েছে, খবর পেয়েছে সে! আহা রে! সোনার ডিম পাড়া হাঁস ছিল ময়না বেগম। কার্ডটা দিয়ে বুড়ির কাছ থেকে আরও কিছু নোট হাতানো যেতো! ভেবে লম্বা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কলিমদ্দির। ভাগ্যটা বরাবরই এমন হারামিপনা করে তার সঙ্গে। মিলতে মিলতেও শেষ পর্যন্ত মোক্ষ মেলে না তার।