দোলনা বিলের ভৈঁরো-৩২
চোখের ভিতর বিল, মীনের কারসাজি—কাকজল
স্পর্শ করলে জল, জলের সংসার বড় টলমল।
গড়িয়ে পড়ে রাত, রাতের নির্জনতা ধু-ধু চরাচর
ঘনায়মান সন্ধ্যার ছায়া বিলোড়িত সচারাচর।
চোখের কার্নিশে স্মৃতি, সে বড় মায়াময়
পীড়িত জীবন শুধু আষাঢ় শ্রাবণময়।
বলে কথা চোখপাখি দিগন্ত দিক বলয়
শূন্য খা-খা মাঠ জলশূন্য, চৈত্রে রচিত দুঃখবলয়।
একটি সন্ধ্যা ঢুকে যায় চোখে, চোখে নিহত হয়
তবে পূর্ণিমা আর কৃষ্ণপক্ষে জ্যোৎস্নার কী অর্থ হয়?
এত যে লবণকাতর স্নায়ুর বিকার মেঘ ও সমুদ্র জল
দগ্ধরোদে তেতে উঠে সমূহপ্রেম দোলনার জলখলবল
দোলনা বিলের ভৈঁরো-৩৩
আমাদের বাড়িগুলি সঙ্গপ্রিয় বয়ে যায় দোলনা বিলের কার্নিশ ঘিরে। বিড়ালঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে নিরীহ নিরুপদ্রব চাহনির ভেতর ভর করে জলের শান্ত কায়া। চোখের ভেতর মাছ লোভ, কাটার স্বাদে মজে রোদে বসে ঝিমোয়। রোদ রুপালি তরবারির ক্ষিপ্র ধার নিয়ে বাড়ি আর বিলকে ফালাফালা করে—ঝিকিমিকি রোদে দূর থেকে মনে হয় বিল, বিলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বাড়িগুলি সাদা সাদা বক হাঁসের পালক পুচ্ছে বিভ্রমের মায়া জাগায়—বিলের জলখলবল ধ্বনি রাতের নির্জনতা খান খান করে শীৎকার ঢেউ তুলে ঘুমের ভেতর, বাড়িগুলি নেচে উঠে বিলের কলহাস্যে, মাছের কলহ প্রলাপে—প্রেমে মত্ত হলে ঠোঁটে ঠোঁট, চঞ্চুতে বড় মায়া—বিলের কায়া।
সেই থেকে আমি বুকের গহীনে দোলনা বিল ভাঁজ করে রাখি। কেউ প্রিয়তমার কথা জানতে চাইলে চোখের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা একটি বিল দেখিয়ে দেই।
ঘোড়া ও ট্যাংক
ঘোড়া প্রতিক মাত্র
ধুলো ও কুয়াশার আস্তরণের পর
কেন নড়ে চড়ে ওঠে মানুষের দেখার বিভ্রম?
বহু দূর থেকে শোনা যায় নদীর গর্জন
মাছের কলহ-বিবাদ, সাঁতারের কৌশল প্রতিভা।
ঘোড়া ছুটে আসে দিকচক্রবাল কাঁপিয়ে
ভাঁটফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে…মাতাল পদশব্দে
ইতিহাসের আল্পনা—পলেস্তরার আড়ালে শোনা যায়
আর্তের বেদনা বিলাপ, নুপুরের নিক্বণ ধ্বনি
ঘোড়া প্রতীক মাত্র
আজও পাখি ভীত পলায়নপর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে
ট্যাঙ্কের কচ্ছপ সাদৃশ্যে ধুলোর কুয়াশা আস্তরণ
বিভ্রমে ঠেলে দেয় একটি নেশার ঘোর জগতে।
রক্ত ও ধ্বংসস্তূপের পরে যে পতাকা উড়ে
সেই বিজয় নিশান কার?
কেন আজও ঘোড়া ও ট্যাংক? কেন সাপের ছোবল?
ইশারার প্রহেলিকা
ইশারা, ঘোর প্রহেলিকার ঘোর
বাতাস জানে, জানে বিকালের রোদ
সেই রোদ আজও বেঁকে—ভেঙেচুরে যায়
কলেজ ঘিরে হা-হুতাশের গোপন মেঘ…
কাল বৈশাখে যে সব কিছু ভেঙে চুরে
বুনো মহিষের মতো তছনছ করে রাজ্যপাট
সে হলো ক্ষোভের সমুদ্র অনল
ডুবাতে পারে, জ্বালাতেও পারে গৃহস্থঘর।
পাখি ঠোঁটের খড়কুটোর উপমা এঁকেছিল
রাফখাতার সাদা পৃষ্ঠাজুড়ে গণিত প্রতিভার ছলে…
ইশারায় অনুক্ত ভাব, বাক ভাষা বড়ো ছলনাময়
. অনুরক্ত তুমি জানো কুশল রহস্য?
কুঠার ও কাঠুরের গল্প
কুঠার মানে উৎকর্ণ ভয়। গাছের আদল-বাকল-হাড়-মাংস নয়। কুঠার কাটে বহু দূর থেকে হেঁটে আসা ক্লান্ত পথিকের পথের ছায়া—ভবঘুরের আশ্রয় মায়া, খোঁপায় ফুলের দৃশ্যকাম, বৃষ্টির আঁতুড়ঘর, মীনের বিড়ালপ্রাণ, ক্ষুধার্তের সঞ্জীবনী সুধা। পাখির প্রণয় সংসার ভেঙে গেলে তার কুজনে বিমোহিত হয় যে জনপদ, তা কুঠার মালিকের অগম্য—আর বৃষ্টিকণিকা নিঃশেষ হয় বলে এক কাঠুরে ঘুমঘোরে দেখে সে শুয়ে আছে জলশূন্য ভিনগ্রহে, জলমগ্ন মাটিঘর খেজুর পাতার মর্মরিত প্রাসাদ হয়ে গেছে। তার সন্তান মায়ের স্তন থেকে দুগ্ধশষ্য নয়, জলসংশ্লেষণের জল নয়, আকণ্ঠ পান করে সমুদ্র নুন, খাবার পাত্রে পাথর কণা।