গত আট দিন ধরে বিশেষায়িত হাসপাতালটির আইসিইউর সামনের ওয়েটিং রুম, বারান্দা আর সিঁড়িতেই ঘরবাড়ি শফিকের। বড় বোন নাসরিন হকও নিজের সংসার সামলে অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে হাসপাতালে। মা জেবুন্নেছা খাতুন লাইফ সাপোর্টে হাসপাতালের পঞ্চম তলায় আইসিইউয়ের পাঁচশ সাত নম্বর বেডে।
জেবুন্নেছা খাতুনের তিন ছেলে, এক মেয়ে। শফিক সবার ছোট, অন্য ভাই-বোনদের মধ্যে নাসরিন হক মেজো। বাকি দু’ভাই প্রবাসী। বড় ভাই জামিল দুবাই আর মেজবাহ আমেরিকা। গত শুক্রবার দুপুরে গোসলের সময় বাথরুমে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জেবুন্নেছা খাতুন। সঙ্গে-সঙ্গেই শহরের বিশেষায়িত এই হাসপাতালে তাকে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে প্রায় অচেতন তিনি। বারবার ডেকেও সাড়া মিলছে না। ডাক্তার জানিয়েছেন মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ততই কষ্ট হচ্ছে। প্রথম দিকে অবজারভেশনে রাখলেও পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হওয়ায় গত পাঁচদিন থেকে তিনি লাইফ সাপোর্টে। গত শুক্রবার থেকে আজ শুক্রবার পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আজ সবার অপেক্ষা একটি রিপোর্টের, হয়তো এটিই জেবুন্নেছা খাতুনের জীবনে শেষ মেডিক্যাল রিপোর্ট।
চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আইসিইউর সামনে অপেক্ষা করছে জেবুন্নেছা খাতুনের আত্মীয়-স্বজন। ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই আসতে শুরু করেছে অনেকে। হাওয়ায় তাদের মৃদু ফিসফাস শোনা যায়, ‘বাথরুমে পড়ে যাবার সাথে সাথে মামিকে হাসপাতালে আনতে পারলে মনে হয় রক্তক্ষরণ কিছুটা কম হতো’, ‘উনার তো শুনলাম হাই ব্লাড প্রেশার, শফিক একটা বাউণ্ডুলে জীবন কাটাচ্ছে, ওসব নিয়ে তো চাচির টেনশন কম ছিল না’, ‘নাসরিনের বড়ছেলেকে তো দেখা যাচ্ছে না’, ‘আজ তার এ লেভেলের পরীক্ষা। তাই আসতে পারছে না’, ‘উনার বয়স কত চলছে?’, ‘শুনলাম তেষট্টির মতো’, ‘হুম, জন্ম-মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে, যেদিন ডাক আসবে কোনো চিকিৎসাই তাকে আটকে রাখতে পারবে না, আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই’, ‘হুম, আজ একটা সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়া যাবে’।
সকাল দশটার দিকে ডাক্তার জেবুন্নেছা খাতুনের এটেনডেন্সকে ডাকলেন। শফিক তখন হাসপাতালে অনুপস্থিত। অনেক রাতের টানা নিদ্রাহীনতায় চোখ অবশ হয়ে আসছিল, শরীর আর মানছিল না, একটু না ঘুমালে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল শফিকের। আজ অনেকে আছে বলে তাকে ভোরের দিকে বাসায় পাঠানো হয়েছিল ঘুমানোর জন্য। অগত্যা নাসরিক হক আর তার স্বামী দেলোয়ার মৃধা যায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। কথা শেষে ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে তারা ফোন করে শফিককে। অসংখ্যবার ফোন করেও শফিককে পাওয়া যায় না। শফিকের চোখে তখন এক সমুদ্র ঘুম। ফোনের অগণিত রিং-ও ঘুম ভাঙাতে পারে না তার! ঘরে কাজের লোক বুবলির মা ছিল। অতপর তার মোবাইলফোনে কল করে শফিককে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়।
কী রে? সেই কবে থেকে ফোন করে যাচ্ছি! দেলোয়ার মৃধার উত্তেজিত কণ্ঠ।
বলেন দুলাভাই, হাই তুলতে তুলতে বলে শফিক। তার কণ্ঠে একরাশ ক্লান্তি।
আম্মার রিপোর্টটা পাওয়া গেছে। ডাক্তারের সাথে কথা হলো। তুই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়! দ্রুত কথাগুলো বলে যায় মৃধা।
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে শফিক, কী বললো ডাক্তার? খারাপ কিছু!
হুম। ডাক্তার বলছেন আম্মার ব্রেইন ক্লিনিক্যালি ডেড। তারা আর কোনো আশা দেখছেন না। এখন আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লাইফ সাপোর্ট রাখব না কি খুলে ফেলবো। বুঝতে পারছিস?
ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বলা মৃধার একেকটি শব্দ আগুনের গোলার মতো শফিকের কানে প্রবেশ করে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ছড়াতে থাকে সারা শরীরে। নিথর হয়ে উঠতে চায় সর্বাঙ্গ।
মৃধা আবার বলতে থাকে, কী রে! চুপ হয়ে গেলি যে! তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়। যা করার দ্রুত করতে হবে।
আপু কই? খুব কান্না করছে, না? শফিকের কণ্ঠ করুণ হয়ে ওঠে।
হুম, ডাক্তারের কথাগুলো শোনার পর কান্না শুরু করেছে। শোন, বিদেশে সবাইকে জানিয়েছি। তারাও জানার জন্য অপেক্ষা করছে যে, আমরা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
মৃধার কণ্ঠে অস্থিরতা।
আমি আসছি। বলেই ফোনটা কাটে শফিক।
স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল ওঠে। ছোট মামা এক পাশে বসে গুমরে ওঠা কান্না চেপে রাখতে চান প্রাণপণে। নাসরিনকে বলেন, বোনটা আমার জীবনে আর সুখ পেলো না। তোর বাবা যখন মারা যায়, তখন তোর মার কতই আর বয়স! তেত্রিশের মতো। সেই থেকে সংগ্রাম করে তোদের এতদূর নিয়ে এরো। জীবনে কত ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করতে হলো তাকে। শেষ সময়ে এসেও সুখটা আর পেলো না। কাল থেকে এ মুখ আর হয়তো দেখবি না তোরা। কথাগুলো বলতে বলতে অঝর ধারায় অশ্রু ঝরে তার চোখ বেয়ে।
ততক্ষণে ফোনে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শফিকও ছুটে আসে হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিতে। আইসিইউর সামনের ওয়েটিং রুমে ছোট মামা, বড় চাচি, মেসবাহের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, মৃধা, শফিকসহ অনেকে অধীর অপেক্ষায়। তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হলে জেবুন্নেছা খাতুনের বড় ছেলে জামিল দুবাই থেকে রওনা দেওয়ার কথা জানায়। ফ্লাইটের টিকিট বুকিং দিয়ে রাখা হয়। মেজো ছেলে মেজবাহ আমেরিকা থেকে এত অল্প সময়ে আসতে পারবে না। সে হয়তো আর মায়ের মুখটা দেখতেই পাবে না এ জীবনে। ফোনে ভাই-বোনের কান্নার সংলাপ দীর্ঘ হয়।
সিদ্ধান্ত হয় লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার। শফিকের মৃদু আপত্তি থাকলেও বাস্তবতাটা তাকেও মেনে নিতেই হয়। সিদ্ধান্তের সময়ে সবার বলা কথাগুলো তার মস্তিষ্কে কুণ্ডুলি পাকিয়ে যায়। বমি বমি পায়।
ডাক্তার তো আর কোনো আশা দেখছেন না, বলেই তো দিলো!
আমরা কি আরেকটা হাসপাতালে ট্রাই করতে পারি না?
ঢাকা শহরের বেস্ট হাসপাতালেই তো উনি আছেন, অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে গেলে কি আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে! মনে হয় না।
প্রতিদিনই লাখের মতো বিল আসছে। এ ক’দিনে প্রায় ছয় লাখ টাকার ওপর বিল হয়েছে। যদি তেমন আশা থাকতো তাহলে হয়তো দেখা যেত আরও কয়েকদিন।
উনার ছেলেরা তো টাকা নিয়ে ভাবছে না। সমস্যা কোথায়?
সমস্যাটা টাকার নয়, বাস্তবতার।
কথাগুলো মাথার ভেতর দলা পাকাতে থাকে শফিকের। মায়ের লাইফ সাপোর্ট খোলার সম্মতিতে স্বাক্ষর করতে সে হাসপাতালের অফিস রুমের দিকে যায়। মন সায় দেয় না। মনে মনে নিজের ভেতরে এক আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় তার, মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না!
আজ তাকে মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। তার এই বাউণ্ডুলে জীবনে মা একমাত্র আশ্রয় হয়ে তাকে ছায়া দিয়ে গেছেন, ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আগলে রেখেছেন এতদিন। আজ থেকে সে হয়ে যাবে ছায়াহীন। তার এই খরতপ্ত জীবনে এখনো যে এই ছায়াটুকুর বড় প্রয়োজন, বড় প্রয়োজন এই শীতল অবলম্বনটুকুর! নইলে যে নিজেরই পরিচয় মুছে যাবে তার! সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরের সময় নিজেকেই ঘাতক মনে হয় শফিকের। মনে হয় ছুরি দিয়ে মায়ের শরীর চিরে রুহুটা বের করে দিচ্ছে সে নিজেই। মায়ের গলা টিপে সে চিরতরে বন্ধ করে দিচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস। মায়ের কোনো সাড়া নেই, নেই সামান্য প্রতিবাদও। শান্ত, স্থির মা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। শফিকের শরীর অবশ হয়ে আসে। বন্ধুরা তাকে হাসপাতালের অফিস রুম থেকে এনে ওয়েটিং রুমে বসায়। ঠাণ্ডা পানি খেয়ে সেখানেই একটু বিশ্রাম নেয় শফিক।
অপরাধবোধে ছেয়ে যায় মন। হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। ঝড় ওঠে কোথাও ভীষণ। ঠোঁট কাঁপে শফিকের। দায়টা বইতে হবে আমাকেই! আনমনে বলে ওঠে সে।
জেবুন্নেছা খাতুনের মেজো ছেলে মেজবাহ যখন প্রথম দুঃসংবাদটা শোনে তখন নিউইয়র্কে রাত তিনটা। ফোনটা পেয়ে মুহূর্তে চোখ থেকে উধাও হয়ে যায় ঘুম। বিছানায় আর শুয়ে থাকতে পারে না সে। ফ্রিজ খুলে হুইস্কির বোতল বের করে। খানিকটা গ্লাসে ঢেলে বসার রুমের জানালার কাছে যায়। বাইরে হিমশীতল রাত। হালকা তুষার পড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় নিজের নিঃশ্বাসকেই আরও ভারী আর ঘন মনে হয় তার। এক চুমুক হুইস্কি মুখে নিয়ে ঘোলাটে হয়ে আসা জানালার কাচ দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে বাইরে রাস্তার দিকে। রাস্তার ওপর ট্রামের সমান্তরাল লাইন তাকে নিয়ে যায় শৈশবে।
বৃষ্টির দিনে বাবা জাল নিয়ে মাছ ধরতে বের হলে মাছের ডুলো নিয়ে বাবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য সে কী কান্নাকাটি তার! মা যত বারণ করে সে তত কাঁদে। আর বাবা লুঙ্গির গোছা আর জাল ঠিক করতে করতে হাসে। মেজবাহ কাঁদে আর ভাবে, বৃষ্টিতে ভিজে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতে পারলে মাকে বুঝিয়ে দিতো, বাবার মতো সে-ও বেটা ছেলে! মা যে কেন কোনো কাজেই পাত্তা দেয় না তাকে! স্মৃতিটা মেজবাহকে মুহূর্তের জন্য বড় নিঃসঙ্গ করে দেয়। হঠাৎ একটি স্পর্শ তার ধ্যান ভাঙে। ঘুরে তাকায়। আধো আলোতে তার কাঁধে রাখা হাতটি আত্মিকার। আত্মিকা তার পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে। স্ত্রী তাহেরা কখন আত্মিকাকে কোলে নিয়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি সে। পেছন ফিরে আত্মিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মেজবাহ নিজেকে সামলাতে পারে না আর। কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। শিশুর মতো কাঁদে। বাবার এমন রূপ আত্মিকা দেখেনি কখনো। ঘুম চোখে বলে, আব্বু তুমি কাঁদছ কেন? সন্তানের প্রশ্ন বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। এক পরম শান্তির খোঁজে কান্নায় ডুবে যায় মেজবাহ।
এমিরেটসের ফ্লাইটে দুবাই থেকে রওনা দেয় জামিল। বাংলাদেশ সময় রাত দশটা নাগাদ ঢাকা পৌঁছানোর কথা তার। বিমানের জানালা দিয়ে অপলক বাইরে তাকিয়ে থাকে জামিল। আকাশ খোঁজে। খোঁজে আশ্রয়। কেবল মেঘের ভেতর দিয়ে যাওয়া আঠারো বছর আগের কোনো একটি দিনের স্মৃতি ভাসে মনে। ছোটবেলায় আব্বা মারা যাওয়ার পর মামাদের ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা তাদের। পরিবারের বড় ছেলে, অনেক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ছাব্বিশ বছর বয়সে শুরু হয় তার প্রবাস জীবন। বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট, বিমান ভাড়ার টাকা যোগাড় করতে জেবুন্নেসা শেষ সম্বল সোনার সীতাহার বিক্রি করেন সেদিন। তারপরের দীর্ঘ সময়টাতে ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করতে পিতার ভূমিকাই পালন করেছে জামিল। সেদিন মাকে সে কথা দিয়েছিল মায়ের সোনার সীতাহার একদিন আবার গড়িয়ে দেবে। সে কথা আর রাখা হয়নি তার। ভুলেই গেছিল সে মাকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি। আজ মেঘেদের কাছে সে উজাড় করতে চায় নিজের অক্ষমতা। চোখের কোণ বেয়ে ঝরা অশ্রু হাতের তালুতে মোছে জামিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
জুমার নামাজের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকেল চারটা নাগাদ লাইফ সাপোর্ট খুলে জেবুন্নেছা খাতুনের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবে বলে জানায়। সে সময়ের মধ্যে হাসপাতালের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয় শফিকদের। দাফনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে কাজে লেগে পড়ে স্বজনেরা। জেবুন্নেছা খাতুনের পরিবার এ শহরে স্থানীয় নয়, অভিবাসী। শ্বশুরবাড়ির পুরনো ভিটে দেখেননি জেবুন্নেছা খাতুন। মেঘনা নদীর পাড়ে ছিল স্বামী বরকত বেপারীর বাড়ি। মেঘনার ভাঙনে ভিটে-মাটি হারিয়ে সদরে আবার নতুন করে বাড়ি করেন বরকত বেপারী। সে বাড়িতে আর মন টেকেনি বেপারীর। ছেলেদের মনও তাদের বাপের মতোই উড়ুক্কু। জামিলের বিদেশ যাওয়ার পর ছোট ভাই-বোনেরা একে একে লেখাপড়ার জন্য আসতে থাকে এ শহরে। অগত্যা সর্বশেষ জেবুন্নেছা খাতুন গ্রামের বাড়ি ছাড়েন প্রায় দশ বছর। এখন কয়েক বছরেও যাওয়া হয় না গ্রামের দিকে। আর কে-ই বা যাবে! দুই ছেলে প্রবাসী। শফিক বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তাকে ভাইয়েরা বিদেশ নিয়ে যেতে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু তার বাউণ্ডুলে মনই তাকে মায়ের কাছে রেখেছে জেবুন্নেছা খাতুনের জীবনের এই অন্তিম সময়টুকুতে। আজ শফিকের কাছে এটাই পরম স্বস্তি।
জামিল দুবাই থেকে এসে পৌঁছাতে আরও ঘণ্টাসাতেক লাগবে। বিকেলের দিকে মৃতদেহ দিলে ততক্ষণ রাখতে হবে ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সে। অ্যাম্বুলেন্সও দ্রুত ভাড়া করা হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য জায়গায়। নিজেদের গণ্ডির ভেতর এতটা সময় অ্যাম্বুলেন্স রাখার জায়গা মেলে না। কারও বাসা সড়কের পাশেই ফুটপাত-লাগোয়া ফ্ল্যাটে, কারও বাসা সরু গলির ভেতরে, কেউ বা থাকে নব্য গড়ে ওঠা সোসাইটির ভেতর। কোথাও এই সময়টুকুতে অ্যাম্বুলেন্স রাখার মতো ছোট একটি জায়গা মেলে না। শেষে সিদ্ধান্ত হয়, শফিকদের পাশের পাড়ায় বন্ধু জুবায়েরদের ওখানে যুব সংঘের অফিসের পরিত্যক্ত মাঠটায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রাখা হবে। মাঠ ব্যবহারের জন্য সংঘে কিছু টাকা দিলেই হবে। হাসপাতালের পাশের মসজিদের মাইকে আজান দিলে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য স্বজনেরা একে একে বের হতে থাকে হাসপাতাল থেকে। যাওয়ার সময় বলে যায় তারা, আবার দেখা হবে জানাজার সময়। নাসরিনকে খুব বিধ্বস্ত দেখায়, ছোট মামার সঙ্গে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাসায়। আইসিইউর সামনের ওয়েটিং রুম ফাঁকা হয়ে আসে। শফিক অনুমতি নিয়ে ভেতরে যায়। নিঃশব্দ পায়ে জেবুন্নেছা খাতুনের পায়ের দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে চাদরের ভেতর দিয়ে মায়ের পা দুটি দু’হাতে আলতো স্পর্শ করে। আব্বার মুখ মনে করতে পারে না শফিক। পাঁচ বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে মা-ই তার সব। কখনো বাবা কখনো মা। সেই ছোটবেলায় মেজবাহের হাত ধরে মতির হাট-বাজারে মেলা দেখতে যাওয়ার সময় মা দশ টাকা দিতেন দু’ভাইকে। দু’ভাইয়ের মুখে সে কী হাসি! ছেলেদের এমন হাসি দেখার জন্য মা এই টাকাটা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন নিজের কাছে। ইলিশের ভরা মওসুমে মাকে বারবার জড়িয়ে ধরে নেওয়া মায়ের শরীরের গন্ধ আর ইলিশের গন্ধ মিলে নেশার ঘোর লাগা সেই গন্ধটা আজও ভোলেনি শফিক। মা যে কত বিরক্ত হতেন! মায়ের পায়ের কাছে মাথা রাখা শফিকের শব্দহীন কান্নার স্রোত ভিজিয়ে দেয় বেডের চাদর। আইসিইউর ভেতরে ওষুধের গন্ধে মায়ের শরীরের গন্ধটা সে খুঁজে পায় না আর। শফিকের পেছন থেকে তার এই নিঃশব্দ আর্তনাদ চোখে পড়ে সেখানে দায়িত্বরত নার্সের। অতপর তাকে বের হয়ে আসতে হয় আইসিইউ থেকে। মনে মনে আওড়ায়, মায়ের সঙ্গে এই তো শেষবারের মতো একান্ত মুহূর্ত আমার, এই বাউণ্ডুলে জীবনে এমন সুযোগ কি কখনো মিলবে না আর!
আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলে মৃধা তাকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যায়। সময় যেন থমকে যায় হঠাৎ। দুপুরটা স্থির। সকাল থেকে শফিকের কিছুই খাওয়া হয়নি। আরেকটু পর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলে আর খাওয়া হবে না কারও। এখনই কিছু একটা খেতে হবে তাকে। ক্যান্টিনে সকালের তৈরি সব খাবার শেষ। নুডুলস দিতে বলে তারা। হঠাৎ শফিকের মোবাইলে ডাক্তারের ফোন আসে। মৃধা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে আসা ডাক্তারের কথায় চমকে ওঠে মৃধা আর শফিক। জেবুন্নেছা খাতুনের মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে। ডাক্তারি সমস্ত রিপোর্টকে ভুল প্রমাণ করে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়তে শুরু করেছে। দ্রুত ক্যান্টিন থেকে বের হয় মৃধা। শফিক বসে থাকে টেবিলেই, মৃধাকে বলে, ভাই, আপনি যান, আমি একটু পর আসছি।
মৃধা চলে গেলে নির্বাক বসে থাকে শফিক। তার অবনত দৃষ্টি ক্যান্টিনের ফ্লোরে স্থির। মনে মনে ভাবে, পরিবারের টাকা বাঁচাতে বন্ডে স্বাক্ষর করেছে শফিক, মা সুস্থ হয়ে যখন এই কথাটা জানবেন, কেমন হবে তার মুখটা তখন? তখন শফিকই বা কোথায় লুকোবে তার মুখ!
অপরাধবোধে ছেয়ে যায় মন। হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। ঝড় ওঠে কোথাও ভীষণ। ঠোঁট কাঁপে শফিকের। দায়টা বইতে হবে আমাকেই! আনমনে বলে ওঠে সে।