পর্ব-॥৬॥
সোমা যখন ভোরের স্নান সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, তখন সকালের কাঁচা রোদ তাকে ছুঁয়ে দেয়। এই এক অন্যরকম অনুভূতি। জীবনে এরকম অনুভূতি এই তার প্রথম হলো। পরিপূর্ণ এক তৃপ্ততা তার চোখেমুখে জোছনার মতো উছলে ওঠে। এত পরিতৃপ্ত ও এত সুখী সুখী চেহারা তার আর কখনো মনে হয়নি। রুমে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজের ভেতরে সে কাফিকেই দেখে। কাফির মুখটা আয়নায় যেন ভেসে ওঠে। তাঁতের লাল শাড়ি তার খুব পছন্দ। নিজেকে কেন যেন হুট করে একটু সাজতে ইচ্ছে করে। কোনো সকালে তার এমন বাসনা জাগেনি। সে নিজেও তা ভাবে। নিজেকে অচেনা মনে হয়। নিজের ভেতরের এক অচেনা সোমা যেন বের হয়ে এসে তার সামনে ঘুরছে ফিরছে—সে তাতে মুগ্ধ হয়ে বলে—এই আমি এতদিন কোথায় ছিলাম! ভাবতে ভাবতেই কখন যে সে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে ফেলেছে, তাও সে বুঝতে পারে না। লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ আর লাল টিপে সে যেন সকালের তরতাজা লাল গোলাপের আদুরি পাঁপড়ির মতো ফুটে উঠেছে। আকাশের ছড়ানো মেঘের মতো চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে, যেন কবিতার উপমা হয়ে। এক অদ্ভুত লাবণ্যভরা সোমা—যেন এতদিনের সোমার কাছে নতুন প্রাণ হয়ে জেগে ওঠে। যা সবকিছু মরে যেতে বসেছিল, যা ক্রমশ প্রাণহীন হয়ে পড়ছিল, যা বিবর্ণ ও রসহীন হয়ে জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে, নিজেকে নিজের কাছেই পরিত্যক্ত ও মূল্যহীন মনে হচ্ছিল—আজ যেন তার সবকিছু ধুয়েমুছে জোয়ারভর্তি নদীর মতো নতুন জীবন ও স্বপ্ন বুকফলা ঢেউ হয়ে জেগে ওঠে। এই জীবনের জন্য তার কত কালের অপেক্ষা ছিল। যে অপেক্ষার কোনো শেষ আছে বলেও সে ভাবেনি। ভেবেছিল, তুষের আগুনের মতো পুড়ে পুড়ে অপেক্ষার চাতকপাখির মতোই জীবন পার হয়ে যাবে। কিন্তু আজ তার কাছে এসবই মিথ্যে লাগছে। মনে হচ্ছে, সব অপেক্ষারই শেষ আছে, আমারও অপেক্ষা শেষে বৃষ্টি নেমেছে। মরুর বুকেও ফুল ফুটেছে।
আবু নাসেরের ফোনের শব্দে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। সম্বিৎ ফিরে পায়। ফোনটা রিসিভ করে। আবু নাসের বললো, কী করছো?
আবু নাসেরের প্রশ্নের উত্তরে সোমা ঘুমঘুম কণ্ঠ বানিয়ে বললো, এখন কয়টা বাজে দেখেছ? রাতে বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি?
কয়টা বাজে দেখিনি। উঠলাম রেডি হচ্ছি। মিটিং আছে। মিটিং শেষ করেই রওয়ানা দেবো। আসলে ঠিকই বলেছো, রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তোমার মতো সুন্দরী বউ রেখে কি একা একা ঘুম হয়!
ঢং তো ভালোই জানো। কাছে থাকলে তখন টাকার পেছনে পাগলা ঘোড়ার মতো বেঁহুশ হয়ে দৌড়াও। আর বিছানায় এসে তো একমিনিটেই নাক ডাকা শুরু করো। এখন দেখছি প্রেম ঢেউ হয়ে ফুলে উঠছে তোমার!
আরে দূরে থাকলে মন শরীর সবই টানে। তা যাক, তোমার ভাই কি করে? ঘুমুচ্ছে নাকি এখনো?
মনে হয়। সাড়া শব্দ দেখছি নে তো।
কী আর করবে! কাজ না থাকলে যা হয় আর কি! আসি আগে। দেখি কী করা যায়। কোথাও লাগিয়ে দেবো। হাজার হলেও এখন তো শ্যালক মশাই।
এসে দেখো কী করা যায়! কিছু করে দিতে পারলে তো ভালোই। তোমার বিশ্বস্ত একজন লোক হবে।
আমিও তা ভাবিছি। আসিই একটা কিছু করি দেবোনে। এখন রাখি। বেরুবো।
সোমা মোবাইলটা অমনি ধরে অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকে। ভাবে, আবু নাসেরের কথার ভেতর অন্য কিছু আছে নাকি! কাফিকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবেনি তো! না ভাবার লোকও তো সে না। আবার আমার কথা তো মেনেছেও। কাফিকে তো সেভাবেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু হাজার হলেও তো পুরুষ মানুষ! কখন কী ভেবে নেয়—কে জানে! সকালের মিষ্টি রোদে মনটা যে ভরে উঠেছিল, কাফির বাহুবন্ধনে বাঁধা মুগ্ধরাতের ঘ্রাণ—সবকিছু মুহূর্তে খানিকটা ম্লান হয়ে ওঠে। আবু নাসেরের কলটা এসেই সকালের কাঁচা ভালোলাগাটা কেমন যেন পানসে করে দিলো। রাগই হয় তার ওপর। রাগতস্বরে বিড়বিড় করে বলে, ব্যাটা তোমার তো টাকা হলেই সব হয়, এই বিহানবেলা বউকে কল করার কী দরকার! আনন্দভরা মুডটাই নষ্ট করে দিলো। মাথার ভেতর হাজারটা চিন্তা ঢুকিয়ে দিলো।
হঠাৎ কাফি রুমে ঢোকে। সোমা একটু অবাক হয়। কাফি কখনো এ রুমে আসেনি। যে রাতটা পাগলা ঢেউযের মতো কাটলো তাও তো ওর রুমেই। অবাকের রেশটা মুহূর্তেই কেটে যায়। চোখেমুখে খুশির আলেঅ মেখে বললো, সাহেব, ঘুম ভাঙলো তাহলে!
না ভেঙে উপায় কী! ঘরে লাল টকটকে গোলাপ যেভাবে ফুটেছে, তার লাবণ্যও ঘ্রাণে ঘুম কি টিকতে পারে!
তাই বুঝি! কথা তো ভালোই শিখেছো?
তা সত্য তাই বললাম। শেখার কিছু নেই। বলেই সোমাকে বুকের ভেতর টেনে নেয় কাফি। বললো, সত্যি তুমি দারুণ গোলাপ। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
পরের বাগানের গোলাপের সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ নেওয়া তো অন্যায়। নিজের বাগানের গোলাপ করে নাও।
নেবো।
সত্যি নিবা?
নেবো।
কাফি, আমি সত্যি তোমার সাথে চলে যেতে চাই। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে চলো, তোমার বুকে আমি সারাজীবন থাকতে চাই।
আমি তোমাকে আমার জীবনে বেঁধে নেবো, সোমা। কেউ জানুক না জানুক তুমি তো আমার বউ হয়েই গেছো। আমাদের মন-শরীর— সবকিছুর মিলন হয়ে গেছে। ধর্ম জানে না—সমাজ জানে না—কিন্তু রাতের বাতাস তো জেনেছে, আমাদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে যাওয়া মুহূর্তটুকু তো জেনেছে—আমাদের শরীরের শিরা-ধমনির রক্তপ্রবাহ তো জেনেছে—তুমি আর আমি এক হয়ে গেছি।
কাফি, আমিও সত্যি তোমাকে মন থেকে স্বামী মেনে নিয়েছি। না হলে ওভাবে আমি নিজেকে তোমার বুকে বিলীন করতাম না। আর আবু নাসের একসময় হয়তো এটা ঠিকই বুঝে ফেলবে। এসব সম্পর্ক বেশিদিন গোপন থাকে না। তখন অনেক ঝামেলা হবে। আমি চাই তুমি তার আগেই আমাকে নিয়ে যাও।
তুমি আমাকে যতখানি চাও, আমি তোমাকে তার চেয়েও বেশি করে চাই। তুমি একটুও ভেবো না। আমি তোমাকে এখান থেকে ঠিক নিয়ে যাবো।
সত্যি পারবা তো! আমার কিন্তু ভয় হয়! ও বুঝতে পারলে কী যে করবে তার ঠিক নেই। ও আমাকে ওর জান দিয়ে ভালোবাসে।
চিন্তা করো না তার আগেই আমি একটা কিছু করে ফেলবো।
আমি যে তা খুব করে চাই কাফি।
তুমি যা চাও—এখন তো আমিও তাই চাই—বলেই সোমাকে আদর করে দুবাহুর ভেতর বেঁধে নিতেই কলিং বেল বেজে ওঠে।
বুয়া—বলেই তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সোমা। কাফি দ্রুত নিজের রুমে যায়।
দরোজা খুলেই অনেকটা হতভম্ব হয়ে যায় সোমা। দরোজায় তুলি সন্তান ও স্বামীসহ দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় সোমা। একটু খুশি একটু দুশ্চিন্তার মিশ্রিত এক রূপ মুখে ফুটিয়ে বললো, তোমরা না বলে-কয়ে এত সকালে! কোনো সমস্যা না তো! সব ঠিক আছো তো!
কাফি যদি তোমাকে ভালোবাসে, তুমিও যদি বাসো, তোমরা সবকিছু উপেক্ষা করে জীবন বাঁধতে চাও, আমি তোমার জন্য সে ত্যাগটুকু করবো।
না ছোট মা, কোনো সমস্যা না। সব ঠিক আছে। গতকাল কুষ্টিয়া এসেছিলাম। ওর বন্ধুর বাসায় একটা অনুষ্ঠান ছিল। এদিক দিয়েই আজ আবার ঢাকা যাবে। আমি বললাম, আমাকে বাড়িতে রেখে যাও। ও অমত করলো না। বেশ চলে এলাম।
খুব ভালো করেছ। বসো। ফ্রেশ হও। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি। সোমা দ্রুত নিজের রুমে ফিরে এসে ভাবে, এই সাত-সকালে আমাকে এরকম পরিপাটি দেখে তুলি অন্য কিছু ভাববে না তো! কাফিও বাসায়। একটু পর তো ও সবই জেনে যাবে। কি না কি মনে করে! যা মনে করে করুক। একসময় তো বুঝবেই। আগে থেকেই একআধটু করে বুঝতে থাকুক। ভাবনা থেকে সেসব ফেলে দিয়ে নাস্তার আয়োজন করতে থাকে। এর মধ্যে বুয়াও চলে আসে।
তুলি ভেতরের রুমে যেতেই সোমা বললো, ও রুমে তো কাফি ঘুমোচ্ছে। তুমি জামাই আর বাবুকে নিয়ে পাশের রুমে যাও।
কাফি নামটা শুনেই তুলি একটু বিস্মিত হয়ে বললো, কাফি ভাই, এই বাসায়! কবে এসেছেন?
এই তো কয়েকদিন হলো।
তুলি আর একটা কথাও না বলে স্বাভাবিকভঙ্গিতে পাশের রুমে যায়। তার স্বামী সোফাতেই গা এলিয়ে বসে থাকে। তুলি তাতে একরকম স্বস্তিবোধ করে। ভাবে, ছোট মা এই কাঁচা সকালে সাজগোজ করে আছে! ছোট চাচা তো বাসায় নেই। গত রাতেও তো চাচার সাথে কথা বললাম। কাফির কথা তো কিছু বললো না। কাফির প্রতি তার নিজেরও যে দুর্বলতা ছিল, তা যে একটুও কমেনি, ভেতরে সময়ের স্তূপে পড়ে থাকা আগুনটা আবার সময়ই যেন জাগিয়ে দেয়। সে অনুভব করলো, এতদিনেও সে দুর্বলতা কিছুমাত্র কমেনি। ভেতরে ভেতরে তুলি যতই ঠিক থাকার চেষ্টা করে, ঠিকই তা সোমার চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু তা সে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যায়। তুলিকে কিছুই বুঝতে দেয় না।
তুলি ভাবে, ছোট মা আর কাফির ঠিকই একটা কোনো সম্পর্ক আছে। তখুনি তো একটা কিছু মনে হতো। সম্পর্ক না থাকলে ছোট মা এই সাত-সকালে গোসল করে এত সুন্দর পরিপাটি হয় কিভাবে! কার জন্যে—কিসের সুখে সেজেছে! তার ভেতরে প্রশ্ন ক্রমশ ঘনতর হতে থাকে। কাফির প্রতিও তার একরকম মোহ ও দুর্বলতা থাকলেও একটা ঘৃণাও জাগে তার প্রতি। নাম শুনেই তাকে দেখার যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়েছিল, তা আবার স্তিমিত হয়ে যায়। কাফি তো এক সময় আমাকে ভালোবাসতো, সেই কাফিই আবার আমারই ছোটমাকে ভালোবাসে! এটা তার রুচিতে কী করে সম্ভব হলো! ছোট চাচা বাসাতে নেই। এত বড় বাসাতে শুধু তারা দুজনে! সম্পর্কটা কি তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত গড়াইছে!
এসময় কাফি রুম থেকে বাইরে আসতেই তুলি রুমের ভেতর থেকেই তাকে দেখে ফেলে। কিন্তু সে রুমের ভেতরেই থেকে গেলো। বাড়তি কোনো আগ্রহ দেখালো না। কেন যেন একটা ক্ষোভই তার ওপর অদৃশ্যভাবে আছড়ে পড়লো।
সোমা কাফির কাছে এগিয়ে যেয়ে আস্তে আস্তে কিছু একটা বলে। তুলির চোখে এটাও ভালো লাগে না। কিন্তু সে তার এসবের কোনো কিছুই প্রকাশ করে না।
কাফি ফ্রেশ হয়ে সোফায় এসে বসে। সোমা এসে তুলির বর তৌহিদের সাথে তার পরিচয় করে দেয়, তুলির একসময়ের শিক্ষক হিসেবেই। তৌহিদ উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে কাফিকে সম্মান দেখায়। কাফিও তার সাথে হাতের মিলন ঘটিয়ে যথাসাধ্য সম্মান করে। এসবের কোনো কিছুই তুলির চোখ এড়ায় না। একরকম শঙ্কাও লাগে, কাফি আবার আমার সম্পর্কে অন্যকিছু বলবে না তো! তৌহিদ আবার কোনো কিছু সন্দেহের চোখে নেবে না তো! ওর এমনিতেই সবকিছুতে বাড়তি সন্দেহ। একসময় যে সে আমাকে পছন্দ করতো, তা আবার বলে ফেলবে না তো! তৌহিদ তো আবার কানকথা শোনারও ওস্তাদ! এসব চিন্তা করতে করতে তুলি নিজেই রুম থেকে বের হয়ে এসে তৌহিদের পাশে বসে বললো, তোমাকে একবার কাফি ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। মনে আছে? আমাকে পড়াতেন।
এ সময় সোমাও একটু কাছে এগিয়ে এসে বললো, তুলি, কাফিকে তো আমি ভাই বানিয়ে নিয়েছি। তোমার ছোটচাচাও এতে খুশি হয়েছেন।
তুলি সাথে সাথে একটু তীর্যকভাবে বললো, ছোটমা তাহলে সম্পর্ক তো উল্টাপাল্টা হয়ে গেলো! কাফি ভাই তো ভাই থেকে আমার মামা হয়ে গেলো!
ব্যাপারটা কাফির কাছে বিব্রত লাগে। কিন্তু তা কাউকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে সবাই এক সাথে নাস্তা করে। কাফিকে অল্প সময়ের পরিচয়েই তৌহিদের বেশ পছন্দ হয়। নাস্তার পরপরই তৌহিদ ঢাকার উদ্দেশে বের হয়ে যায়।
কাফি রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবে, দিনটাই মাটি হয়ে গেলো! আবার ভাবে, তুলি—এ কি সেই তুলি! ওর মধ্যে এত পরিবর্তন! আমার ওপর ওর বেশ রাগ মনে হলো! কী যে একটা বাজে অবস্থা তৈরি হলো! ভাবতে থাকে কাফি। একদিকে পুরনো প্রেম এসে উপস্থিত, আর একদিকে সদ্য তরতাজা প্রেম—হিসাবটা বড় বেশি জটিল অঙ্কের মতো হয়ে ওঠে। মেলানোর কোনো সূত্র সে খুঁজে পায় না।
সোমা ওপরে ওপরে খুশির ভাব দেখালেও ভেতরে তুলির ওপর যারপর নাই বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে, আসার আর দিন পেলো না!
তুলি সংসার করার আগে যতটা সহজসরল ছিল, এখন আর সেই তুলি যে নেই সোমাও তা বোঝে। তুলি বাসাতে পা দিয়েই বাসার ভেতরের গোপন ভাষাটা ঠিকই পড়ে ফেলেছে। সোমা আর কাফির ভাইবোনের সম্পর্কের আড়ালের সম্পর্কটা তার চোখে ঠিকই ধরা পড়ে। কিন্তু সে কিছুই না জানার না বোঝার মতো করে থাকে। তবে বুকের ভেতর কাফি যে এখনো তার নিঃশ্বাসে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, তা কাফির নামটা শোনার সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছে। তুলি নিজেও হয়তো এতদিনে ভেবেছিল কাফি নামের যাকে তার ভালো লাগতো, নীরবে ভালোও বাসতো, সে হয়তো তার মন থেকে হারিয়ে গেছে। স্বামী-সন্তান-সংসারই তার মনের পুরোটা দখল করে আছে। কিন্তু আজ সে অনুভব করলো নিজের ভেতরের সবকিছুই তার চেনা নয়। কাফি তার মনের কোণে এতগুলো দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও, তাকে দেখামাত্রই যে সে নতুন জীবন নিয়ে উঠলো তার মনের ভেতর তুলির নিজের কাছেই তা বিস্ময় লাগে। এ যেন নিজের কাছেই নিজের অচেনা এক রূপ।
তুলি নিজেই কাফির রুমে গিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন?
কাফি একটু থতমতই খায়। কী বলবে না বলবে তালগোল যেন হারিয়ে ফেলে। কিসের এক চিন্তা তার ভেতর অন্যমনস্কতা তৈরি করে দেয়।
তুলি আবার বললো, বললেন না তো কেমন আছেন?
ও তাই তো! বলা হয়নি। ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
আমিও ভালো আছি। তো অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো। ভালোই লাগছে। কী মনে করে যে আজ আসাটা হয়ে গেলো। না এলে তো দেখাটাই হতো না।
সেই আর কী।
আচ্ছা কাফি ভাই, তখন তো আমাকে পড়াতে আসতেন। এখন কি ছোটমার লজিং মাস্টার হয়ে এসেছেন? একটু রসাশ্রিতভাবে বললো তুলি।
কাফি কথার অর্থটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারলেও উত্তরটা দিতে পারলো না। কারণ তুলি যা ইঙ্গিত করে বলেছে, তার অর্থ মোটেই ভালো নয়। কিন্তু তা সত্য। অস্বীকার করার শক্তি কাফির নেই।
প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করে কাফি বললো, তোমার সংসার কেমন চলছে?
সংসার আর করতে দিলেন কই আপনি!
আমি আবার তোমার সংসারে কী করলাম!
যা করার তা তো তখুনি করে দিয়েছেন। ভালোবাসলেন ঠিকই। কিন্তু ধরে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটাও করলেন না। বিয়ের কথা শুনেই মাথা নিচু করে ওই যে বেরিয়ে গেলেন তো গেলেনই। তারপর আজ দেখা! এর মাঝে কোনোদিন ভুল করেও দেখতে গেলেন না। আপনারা পুরুষ মানুষ সবই পারেন। পুরুষ মানুষ তো প্রেমে পোড়ে না। পোড়ে তো নারী। কারণ নারী তো তার প্রেমকে সাধনা মনে করে। পুরুষ মনে করে খেলা। আপনি তো আমার সাথে খেলেছেন। আপনি তো আর পোড়েননি। পোড়ার যন্ত্রণা আপনি জানবেন না। আমি জানি। আপনি তো ছোটমার শান্তির মলমটা নিজের গায়ে এখন ভালো করেই লাগাচ্ছেন। এই তো পুরুষ মানুষের রূপ!
কাফি কোনো উত্তর না দিয়ে তুলির দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এই তুলি তো সেই তুলি নয়। যে কখনো আমার চোখের দিকে তাকাতে পারতো না, সে আজ আমার চোখে শুধু তাকানো নয়, আগুন ঢেলে দিয়ে কথা বলছে। কিন্তু এরপরও তুলিকে কিছু বলার শক্তিটা সে নিজের ভেতর পায় না। শক্তিটা সে হারিয়ে ফেলেছে। ভাবে, সোমার সাথে সম্পর্কটা না ঘটলে, তুলিকে হয়তো জবাবটা যুতসই করে দেওয়া যেতো। কিন্তু তাকে যে আর কোনোদিনই জবাবটা দেওয়া সম্ভব হবে না, তাও সে জানে।
দুজনের জন্যই চা নিয়ে সোমা আসে। খালি খালি আসাটা কেমন লাগে, সে কারণে চা নিয়ে ঢোকে সে। তাকে দেখেই দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে কথা বলে।
সোমাও পরিবেশটাকে সহজ রাখার জন্য ওদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশে যায়। হাসিমুখে তুলিকে বললো, কতদিন পরে কাফির সাথে তোমার দেখা হলো! প্রায় চার বছর। আমার সাথেও একই অবস্থা। সপ্তাহখানেক আগে হুট করে এসেছে। এসেই যাওয়া যাওয়া করছিল। তোমার ছোট চাচা আর আমি একরকম জোর করেই ধরে রেখেছি। বলতে পারো ধরে নয়, একরকম বেঁধে রেখেছি। তোমার ছোটচাচা ঢাকায় যাবার সময় একেবারে আদেশ জারি করে গেছে, ও যেন চলে না যায়।
তুলি বললো, তুমি যে ওকে বেঁধে রেখেছ, তা বুঝতে পেরেছি ছোটমা। এমনভাবে বাঁধো যেন আর গিরা খুলতে না পারে। আমার জন্যেও ভালোই হলো আমিও কিছুদিন থেকে যাবো। একসঙ্গে গল্প করা যাবে। ঘুরে বেড়ানো যাবে। সময়টা ভালোই কাটবে।
সোমা বুঝতে পারে তুলির কথার ভেতর একটা সূক্ষ্ম খোঁচা আছে। সেও জবাবটা মিহিনভাবে দেয়, পুরনো দিনের স্মৃতি কিন্তু অনেক দামি। নতুন করে জেগে ওঠার ভেতর আলাদা একটা শান্তি আছে।
সোমার কথাটা শেষ হতে না হতেই চট করে তুলি বললো, তা আছে ছোটমা। নতুন-পুরনো মিলেই তো জীবন। কারো স্মৃতি পুরনো, কারো হয়তো নতুন।
সোমা বুঝেও না বোঝার ভান করে বললো, তোমরা গল্প করো। আমি আসছি। বের হয়ে যায় সে।
সোমা বের হয়ে যাবার পরে তুলি মুহূর্তকাল কি যেন ভাবলো। তারপর সেও বের হয়ে যেতে পা বাড়াতেই কাফি ডাকে, তুলি!
তুলি ঘাড়টা বাঁকা করে তাকায় কাফির দিকে। ভাবে, কতোকাল পর মধুর এই ডাকটি শুনলাম! নিজেকে মুহূর্তে আবার স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো, কিছু বলবেন?
তুমি আমাকে এতটা ভালোবাসতে তখন তো বলোনি। বুঝতেও তো দাওনি। এখনো সেই আগুনটা মনে হচ্ছে পুষে আছো! খোঁচামারা কথায় তা বেশ ঝাড়ছো!
ঠিকই ধরেছেন এটা আগুন। তবে এ আগুন ঘৃণার আগুন। একসাথে দুজন মেয়েকে ভালোবাসা যায় না । কোনো মেয়েই তা মানে না। আমি জানতাম আপনি ছোটমাকেও ভালোবাসতেন। আর ছোটমা আমার থেকেও অনেক সুন্দরী—পুরুষ মানুষের চোখ ওখানে বেশি আটকায়— ওটুকু আমি বুঝতাম। আর আপনিও তো পুরুষ মানুষই! আপনার চোখও ওখানেই আটকে ছিল।
তুমি এসব কী বলছো?
আমি সব বুঝি। একটা কথাও বলবেন না। আমি যা বলতে চাইছি তা আপনিও বোঝেন, ছোটমাও বোঝেন। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি কাকে ভালোবাসতেন— আমাকে না ছোটমাকে! জানি বলার শক্তি আপনার নেই। আপনি ছোটমার সাথে একটা সম্পর্কের আড়ালে অন্য একটা সম্পর্ক গড়েছেন, একটা মেয়ে হিসেবে ওটুকুও ধরতে পারি। আপনাকে আমিও কম ভালোবাসতাম না। কিন্তু তার কী মূল্য আছে আপনার কাছে! একটা কথা বলবো?
বলো।
আমাকে আপনি এখনো ভালোবাসেন?
কাফি কোনো উত্তর দিলো না।
জানি উত্তর দিতে পারবেন না। শুনুন আমার স্বামী সরকারি কলেজের শিক্ষক। আপনার থেকে অনেক বেশি যোগ্য ও দামি। এটা বোঝেন?
কাফির নিজের কাছে কথাটা অনেক অপমান লাগে। তা সত্ত্বেও বললো, বুঝি।
কিন্তু একটা কথা আপনি এখনো কিছুই বোঝেন না।
কী কথা?
আমি আপনাকে এখনো ভালোবাসি। আপনি বললে, আমি আপনার সাথে চলে যেতে পারি। নেবেন আমাকে? আমি কিন্তু সত্যি যেতে চাই। ভরা গড়াই নদীর প্রবল স্রোত দেখেছেন? আমি সেই প্রবল স্রোতের মতোই আপনার সাথে ভেসে যেতে চাই।
কাফি একটা কথাও বলতে পারলো না। তার ভেতর থেকে কে যেন পুরো শক্তিটা শেকল দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। শুধু ভাবলো, সোমার সাথে সম্পর্কটা না ঘটলে উত্তরটা সহজই ছিল। কিন্তু এখন যে উত্তরটা ভারী কঠিন—পাথরের মতো শক্ত।
আপনার কোনো শক্তি নেই। শক্তিটা আপনি ছোটমার কাছে হারিয়ে ফেলেছেন। বলেই তুলি ঘর থেকে ম্লানমুখে বের হয়ে যায়।
কাফি নীরবে তুলির ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া দেখলো। একটা শব্দও করলো না। শুধু ভাবলো, কখন কী ঘটে, কেউ জানে না তুলি। আমি যে এখানে আবার ফিরে আসবো, তাও যেমন জানতাম না, এও জানতাম না এসেই সোমাকে এত সহজেই নিজের করে পেয়ে যাবো। আর ভুল করেও ভাবিনি তোমার সাথে এ বাড়িতে দেখা হবে! আর তুমি অকপটে স্বামীকে ত্যাগ করে আমার সাথে চলে যেতে চাইবে! জীবনের হিসাব যে এত এলোমেলো—এত ভুলে ভরা! হয়তো তোমার চাওয়াটাও সত্যি হয়ে যেতে পারে !
কাফি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, সে এখন কী করবে! তুলি যেভাবে অধিকারের বাষ্প হৃদয়ে ছড়াচ্ছে, তা যেমন অস্বীকারের নয়, আবার সোমার সাথে প্রেমের গভীর বন্ধন-শরীর-মন একাত্ম হয়ে যে পথ তৈরি হয়েছে, তাকেও সরিয়ে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। একটা কাঁটাযুক্ত জটিল জীবনের ভেতর সে যে দাঁড়িয়ে গেছে, তা থেকে বেরুনো যে মোটেও সহজ নয়, কাফি তা বুঝতে পারে। সোমা ও তুলির ভেতর এ নিয়ে যে অনেক আগেই নীরবে একটা শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, আকস্মিকভাবে তা প্রকাশ হয়ে উঠলো। অনেকটা বিরান ভ’মিতে সবুজের উৎসবের মতো। তুলি খুব ভালো করেই বুঝে নিয়েছে সোমা ও কাফির সম্পর্ক সাধারণ পর্যায়ে নেই। নাসেরের অনুপস্থিতিতে যে তারা দুজনে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছে, সোমার সকালের সাজগোজে তা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। এরপরও সে কাফিকে নিজের করে পেতে চায়। তাতে সংসার যেখানে ভাসে ভাসুক, যেখানে ডোবে ডুবুক। সমাজ যা বলে বলুক। উঠতিযৌবনা তুলির মনে লেগে থাকা কাফি আজো তার মনে উজ্জ্বল হয়ে গেঁথে আছে, যেখানে তৌহিদ বিন্দুমাত্র জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন, কাফি কাকে বেশি ভালোবাসে আমাকে না ছোটমাকে! আমাকে কি আদৌ ভালোবাসে! কখনো কি ভালোবেসেছিল আমাকে! যদি ভালোইবাসতো তাহলে আমার বিয়ের সময় সে তো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। কোনো কথাই তো বললো না।মাথা নিচু করে কিভাবে যে চলে গেলো তখন! আমি যেটুকু বলেছিলাম, সেটুকুরও তো কোনো উত্তর দিতে পারেনি। এ আমার একতরফা প্রেম নয় তো! আমিই বেশি বাড়াবাড়ি করছিনে তো! চার বছর আমি তো দিব্যি ছিলাম। অন্তরে পুড়লেও বাইরে তো কাউকে দেখতে দিইনি। আর ও তো চার বছরে চারবার তো দূরের কথা, একবারও তো আমার খোঁজ নেয়নি। কী করে এতটা পারলো! আমিও তো একরকম ছিলাম। এখানে এসে হুট করে ওকে দেখেই আমার মাথার ভেতর পুরনো আগুন আবার নতুন করে জ্বলে উঠলো! এসব কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! কেন করছি এরকম! এ সময় সোমা রুমে ঢুকতেই তুলি কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সোমা বললো, তোমাকে এরকম লাগছে কেন? কিছু ভাবছো? কোনো কিছু নিয়ে বেশি টেনশন করছো? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসে সোমা।
তুলি কোনো উত্তর না দিয়ে পলকহীন চোখে সোমাকে দেখে। সোমা আবার বললো, তুমি কোনো কথা না বলে আমাকে ওরকম করে কী দেখছো?
তুলি বললো, আচ্ছা ছোটমা, আমার একটা কথার উত্তর দেবে?
বলো।
কাফিকে তুমি ভালোবাসো?
সোমা একটু অবাক হয়। এতটা সরাসরি কথাটা বলবে তুলি, সোমার কল্পনাতেও ছিল না। মুহূর্তে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললো, হ্যাঁ, বাসি তো। কিন্তু তুমি একথা কেন জানতে চাইছো? বলো তো।
ভাবছি, ছোট চাচা যদি এ কথা জানতে পারেন, তখন কী হবে!
এসব ভাবনা নিয়েই আছ তুমি? তুমিই কি ভেবেছ, তৌহিদ যদি কখনো জানতে পারে তুমিও কাফিকে পাছন্দ করো, তখন কী হবে?
জানি খুব খারাপ হবে। কিন্তু আমি তো তোমার মতো অত ভালোবাসিনি কাফিকে। আমার ভালোবাসা তো তোমার মতো অতদূর না।
তাই? ভালোবাসলে পুরোটাই বাসতে হয় তুলি, আধাআধি বেসে লাভ কী!
তুলি এ কথা এড়িয়ে সোমাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, তুমি তো ছোট চাচাকে বলেছ, কাফিকে তুমি ভাই বানিয়েছ।
তা বলেছি। ভালোবাসার জন্য তো কতজন কত কিছুই করে, কত কিছুই তো বলে। যেমন তুমি যে আমাকে এত কথা বলছো, তাও তো ভালোবাসার জন্যই। তুমি তো কিছুতেই মেনে নিতে পারছো না আমার সাথে কাফির সম্পর্ক। ভুল বললাম? দেখো তুলি, তুমি কী বলতে চাও, কতদূর বলতে চাও, কেন বলতে চাও, আমি বুঝি। তুমি এটাকে ঘিরে তোমার ছোট চাচাকে বলে অনেক বাজে ঘটনা ঘটাতে পারো—তাও জানি। কিন্তু একটা কথা তো জানো ভালোবাসা জোরাজুরির জিনিস নয়। জোর করে ভালোবাসা করা যায় না। ভালোবাসা হয়ে যায়। সেটাকে লালন করতে হয়, যত্ন করতে হয়। অনেক ত্যাগ করতে হয়। ধর্ম সমাজ সম্মান খ্যাতি অর্থ-প্রাচুর্য কত কিছুই তো কতজন ত্যাগ করে। কাফি যদি তোমাকে ভালোবাসে, তুমিও যদি বাসো, তোমরা সবকিছু উপেক্ষা করে জীবন বাঁধতে চাও, আমি তোমার জন্য সে ত্যাগটুকু করবো। আর ও যদি আমাকে সারাজীবনের জন্য করে নেয়, আমি তাতেও একপায়ে দাঁড়িয়ে আছি। সে জন্য আমার যা কিছু করার দরকার হবে, করবো।
কিন্তু তুমি যা করছো, তা তো ভালোবাসা নয়, নষ্টামি। বাসাতে পা দিয়েই তা বুঝেছি।
ঠিকই বুঝেছ। তবে তোমার কাছে যা নষ্টামি, আমার কাছে তা বন্দেগি।
আমি ছোট চাচাকে তোমার এই বন্দেগির কথা সব বলে দেবো।
তাতে কি তুমি কাফিকে পাবে?
তুলি চুপ হয়ে যায়। কী যেন ভাবে। সোমা বললো, উত্তর তুমি দিতে পারবে না। তবে আমি কিন্তু তৌহিদকে কিছুই বলবো না, তুমি কাফির জন্য কতটা পাগলিনী, কতটা বেহুঁশ। আর শোনো, তুমি তোমার ছোট চাচাকে যা যা বলতে মন চায়, সব বলবে। আমার কোনো আপত্তি নেই। সোমা রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যায়। খাটের ওপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবে। নাসের বাসায় আসার পরে তো তুলি তাকে কোনো কিছু বলতে বাদ রাখবে না। বলুক, পথটা তাতে আরও সহজ হয়ে যাবে।
সোমা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। তারপর রুমে ফিরে দুহাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। ভেতরে কেমন যেন একটা কান্না—এটা আনন্দের— না অপমানের—না পরাজয়ের—সে নিজেও বুঝতে পারে না।
সোমা আর তুলির কথা সবই শুনেছে কাফি। সেও ভাবতে থাকে তাকে নিয়ে বাসায় চরম একটা বাজে অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে। দুটো সংসারই ঝড়ের মতো উড়তে থাকবে। কোথায় কে কীভাবে ছিটকে পড়বে তা সে নিজেও অনুমান করতে পারে না। নিজে নিজেই ভাবতে থাকে, আমার কী করা উচিত! তুলি যে এত কিছু বলছে, তার সাথে যা কিছু হয়েছে তা তো একতরফা। সেও কখনো আমাকে বলেনি। আমিও বলিনি। অনুভবে হয়তো ছিল। সে তো বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে। এখন আমাকে দেখে প্রেমে বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মতো ফণা তুলছে। ফণাটা তো আরো চার বছর আগেই তুলতে পারতো! এখন সোমার সাথে আমার একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমি তো তা উপেক্ষা করে নীরবে চলে যেতে পারিনে। যদি সে নিজে উপেক্ষা করে সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আমাকে উপেক্ষা করার শক্তি কি তার আছে! সে তো আমাকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। আমিও তো তাই। না হলে আমরা এভাবে নদীর অবারিত স্রোতের মতো নিজেদের ভাসাতে পারতাম না, প্রবল ঢেউয়ে নদীর পাড় ভেঙে নদীর বুকে বিলীন হওয়ার মতো বিলীন হতে পারতাম না। আমি সোমাকে নিয়ে দূর কোথাও চলে যাবো। সোমা যাবে তো! এত সুন্দর নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে আমার সাথে অনিশ্চিত জীবনে সে কী যাবে! কাফির ভেতর অনেক ভাবনা স্রোতের মতো ঘুবপাক খায়।
তিনজনেরই মনের ভেতর প্রচণ্ড ঝড় বইয়ে যাচ্ছে। কালবৈশাখীর মাতাল ঝড়ে যেন নিজের ভেতরে নিজেই আছড়ে পড়ে। এক দুই করে কয়েকটা দিন এভাবেই উড়তে থাকে তাদের মনের গহিনে। উপরে উপরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, তা ঢাকা থাকে না। বোঝা যায় তারা একটা ঝড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কাজের চাপে আবু নাসেরও ঢাকায় ব্যস্ত। তুলির বড় বড় চোখে তাকানো উপেক্ষা করে সোমা কাফির সাথে ঠিকই কথা বলে, গল্প করে। গভীর রাতে নীরবে তার রুমে গিয়ে নিবিড় সময় কাটায়। তুলি তা জেনেও না না জানার মতো করে থাকে। সে বুঝতে পারে সোমা আর কাফির সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। এই জায়গা থেকে কাফিকে আমার করে নেয়া কঠিনের থেকেও কঠিন। কাফি এখন উন্মত্ততার সুখে ডুবে আছে। সেখান থেকে ওকে ফেরানোর কী সাধ্য আছে আমার! ছোটমাও যেভাবে ওকে আঁকড়ে ধরেছে, সেখান থেকে সে ইচ্ছে করলেও বেরুতে পারবে না। ছোটমার শরীরীসৌন্দর্য যে কাউকেই একপলকেই খুন করার জন্য যথেষ্ট। আর তারপর যদি সে নিজেই কারো অবাধ পলিমাটি জমিন হয়ে ওঠে! এসব ভাবার ভেতর দিয়েই তুলি অনেকটা ভাঙামন নিয়ে কাফির রুমে গিয়ে গল্প করার চেষ্টা করে। তুলির সাথে গল্প করতে কাফির মন টানে না। তুলিও নিজের মনে ওরকম শক্তি পায় না। কিন্তু তা প্রকাশও করে না। সোমা কাফিকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে তুলির সাথে তাল মিলে চলার। কোন ঝামেলা না বাঁধাতে। ও তো আর এখানে সারাজীবন থাকবে না। দুদিন পরে চলে গেলেই তো ঝামেলা চুকে গেলো। ভালো ব্যববহার করবে। আন্তরিকতা দেখাবে। প্রয়োজনে ওকে তুমিও ভালোবাসো এরকমই ভাব করবে। দুদিন পর তৌহিদ এসে ওকে তো নিয়েই যাবে। তখন তো সামনের উপর জ¦লতে পুড়তে পারবে না। ওর ছোটচাচাকে যা বলে বলবে, তখন দেখবো।
কাফি সোমার কথা মেনে তুলির সাথে সেভাবেই চলে- কথা বলে। তুলি বললো, আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমাকে আপনি ভালোবেসেও বিয়ে করেননি। ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারতেন।
তৌহিদ তো আমার থেকে অনেক দামি পাত্র। সরকারি কলেজের টিচার। আমি তো বেকার। আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারতাম না।
সরকারি কলেজের টিচার ধুয়ে কি আমি পানি খাবো। আমি তো মন থেকে আপনাকেই পছন্দ করতাম। আপনি আমাকে পছন্দ করবেন কী—আপনি তো ছোটমার কচি নাগর। তখন তো অত বুঝিনি। বুঝলে কি আর আমার কাঁচামন আপনার কাছে খুন হতো! জানেন আমি সত্যি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনি আমাকে নিয়ে যেতে পারেন? আমি আপনার সাথে চলে যেতে চাই।
কোথায়?
যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন, সেখানেই। নতুন করে আমাদের জীবন হবে।
তোমার স্বামী সে কী তোমাকে ছেড়ে দেবে?
ছেড়ে দেবে কেন! আমি নিজেই আপনার সাথে চলে যাবো।
লোকে তো ছিছি করবে। তৌহিদ মামলা ঠুকে দেবে।
কাপুরুষের মতো কথা বলেন কেন? আপনি নিয়ে যাবেন কিনা সেটা বলেন। আমি যেতে চাই। অবশ্য আপনি তা পারবেন না। কারণ আমার ছোটমা—আপনার সোমা—যিনি এখন আপনার রাধা—আপনাকে ঠিকই পুরো দখলে নিয়ে নিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে ঠিকই তো দুজন আগে থেকেই জিগার আটার মতো লেগে ছিলেন। আমি হুট করে না এলে তো কিছুই জানতে পারতাম না।
কী জেনেছ?
আমি তো একটা মেয়ে তাই না! ছোটমা আর আপনার সম্পর্ক কী ছোটচাচা না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝি। এই ছোটমার জন্য আপনি আমার হতে পারেননি। আমিও তাকে শান্তিতে থাকতে দেবো না। ভাবছে, একটা সম্পর্ক দেখায়ে তার আড়ালে রাধা-কৃষ্ণ হয়ে থাকবে। তা হবে না। যদি আপনি আমাকে নিয়ে গিয়ে জীবন কাটান, তাহলে সব চেপে রাখবো, নাহলে আপনার আর ছোটমার সম্পর্ক বাতাসে আগুন করে উড়াবো—সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
সোমা বাইরে থেকে কথাগুলো শুনছিল। কোনো উত্তর না করে নীরবে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে ভাবতে থাকে, তুলি সমস্যা যে একটা বাঁধাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি তো ওর ছোট চাচার ঘরও করবো না। কাফির সাথেই জীবন কাটাবো। কাফিকে নিয়ে আমি ঠিকই একদিন উধাও হয়ে যাবো। ওর স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। আলাভোলা শিক্ষক মহাশয়ের সাথেই তুলি তোমাকে জীবন কাটাতে হবে। কাফিকে পাবার সাধ কোনোদিন মিটবে না। ও আমার—শুধুই আমার।— সোমার ভাবনার কথাগুলো সোমাই শুনলো, আর কেউ নয়। নিজের কথাগুলো নিজের ভেতরেই ঢেউ খেলতে থাকে— নিজেকে ভাঙতে থাকে।
দুপুরের দিকে তৌহিদ বাসায় আসে। তুলি অবাক হয়ে বললো, তুমি! তোমার তো আরো তিনদিন পরে আসার কথা।
আব্বা খুব অসুস্থ। এখুনি বেরুতে হবে। দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।
তুলির একবার ইচ্ছে হলো বলি, তুমি যাও। আমি পরে যাবো। কাফিকে ছেড়ে যেতে তার একটুও মন নেই। কাফি যতই ছোটমাতে মজে থাকুক, তারপরও ওকে যে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। এভাবে হুট করে ওকে পাওয়া, সেই পাওয়াটাকে আরও যত দীর্ঘ বা সারাজীবনের করে নিতে পারলে, এর থেকে সুখের, এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতো না। কিন্তু পৃথিবীর কাউকে সে একথা বলতে পারবে না। পারলোও না।
তৌহিদের সঙ্গে বের হওয়ার আগে একবার ভাবলো কাফির সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু কী ভেবে তার রুমে না গিয়ে সোমার রুমে যায়। তুলির চোখ ভেজা। কণ্ঠ ভেজা। বললো, ছোটমা, আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। কিছু মনে করো না। প্রেমের খেলায় তুমিই জিতে গেছো। আমি সত্যি কাফিকে ভালোবাসতাম। হয়তো বাসবোও সারাজীবন। কিন্তু তা শুধু আমার ভেতর আমিই জানবো। আর কেউ জানবে না। এতবছর অন্যের ঘর করেও ওকে ভুলতে পারিনি। আর শোনো, আমি ছোট চাচাকে কিছুই বলবো না। কিচ্ছু বলবো না। কোনোদিন কিচ্ছু বলবো না। তোমার আর কাফির সম্পর্কটা সাজানো ভাই-বোনের সম্পর্কের আড়ালে একান্ত গভীর সম্পর্ক হয়েই থাকুক। আমি পাইনি বলে তোমাদের সম্পর্কটা পুড়িয়ে ছারখার করতে চাইনে। রাগে ক্ষোভে কষ্টে যা বলেছি, ভুলে যেয়ো। তুমি তো ছোট মা হলেও মা-ই।
সোমা মুহূর্তে পাথরের মতো যেন চুপ হয়ে যায়। তুলির ওপর থেকে সব রাগ অভিমান ক্ষোভ কোথায় যে উড়ে গেলো। কী এক গভীর আবেগে তুলিকে বুকের ভেতর টেনে নেয়। ভেজাকণ্ঠে বললো, তুমি যা পেরেছ আমি তা পারিনি। আমি সত্যি তোমার কাছে হেরে গেছি। আমাকে এভাবে হারিয়ে দিলে তুমি।
তুলি কিছুই না বলে রুম থেকে বের হয়ে তৌহিদের সঙ্গে চলে যায়। একবার পেছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মনকে শক্ত করে ধরে রাখে।
সোমা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। তারপর রুমে ফিরে দুহাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। ভেতরে কেমন যেন একটা কান্না—এটা আনন্দের— না অপমানের—না পরাজয়ের—সে নিজেও বুঝতে পারে না।
শেষ
সম্পর্কের আড়ালে-৫॥ রকিবুল হাসান