(পর্ব-৪)
সোমা কাফিকে নিয়ে ছেঁউড়িয়া যায়। লালন সাঁইয়ের মাজারে। সোমার এই জায়গাটা অনেক পছন্দের। লালনের গান তাকে খুব টানে। মাঝেমধ্যে এখানে আসে। কখনো আবু নাসেরও সাথে থাকে। আবু নাসেরের অবশ্য এসবে আগ্রহ নেই। বউকে খুশি রাখার জন্য কখনো-সখনো আসে। লালন সাঁইয়ের মাজার ঘিরে এখন তো বিশাল এলাকা লালন নগর গড়ে উঠেছে। এখানে সেখানে লালনের গান বাজে। কতো লোকের আসা-যাওয়া। লালনকে নিয়ে কতো কতো প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। লোকটার ধর্ম কী ছিল? জাত কী ছিল? না কি লালন নিজেই একটা ধর্ম বানিয়ে গেছেন! লোকের মুখে মুখে এসব প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়। গান গানে তার উত্তরও ভেসে বেড়ায়। লালন নিজেই তো এসবের উত্তর দিয়ে গেছেন। সোমা বলে, দেখো লালনকে মানুষ কত ভালোবাসে। কত আগে কী সব কথা বলে গেছেন, কত দামি দামি কথা। এসব চিন্তা করলে আর ঘর-সংসারে টান থাকে না।
সেই আর কী? জীবনকে যে যেভাবে দেখে। তবে লালনের জন্য এলাকাটা জমজমাট হয়ে গেছে। একসময় কতো সংগ্রাম করে- কতো মার খেয়ে এখানে আসন গাড়তে হয়েছিল তাকে।
যেকোনো কিছুর শুরু কিন্তু বাধা-বিপত্তির ভেতর দিয়েই হয়। সব কিছুই সুন্দরভাবে হয় না। লালন যদি এত কষ্ট না করতেন, আজকের এই লালনকে খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল।
তা তো অবশ্যই। তবে এখন কিন্তু লালনকে ঘিরে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই জমে উঠেছে। লোকজনের আয়-রোজগারের একটা উপায় হয়েছে। লালনের একতারা থেকে শুরু করে কত কিছু যে এখানে বিক্রি হয়। এগুলোই তো আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য।
তুমি কী এখানে মাঝেমধ্যে আসো?
আসি তো। কখনো কখনো নাসেরকেও সাথে আনি। আর ও তো এসব পছন্দ করে না। বউয়ের মন রক্ষার্থে আসে। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে।
একেক মানুষের একেক নেশা। কারও টাকার নেশা—কারও খ্যাতির নেশা—কারও ক্ষমতার নেশা—কারও প্রেমের নেশা—কারও গান-বাজনার নেশা, কতরকমের যে নেশা আছে!
ঠিকই বলেছ। আচ্ছা কাফি, তোমার আসল বাড়ি কোথায়?
কেন?
না। এমনিই। তুমি তো কুমারখালিতে মামার বাসায় থাকতে।
হ্যাঁ। মামা চাকরি করতেন এখানে। উপজেলা অফিসে। মামার কাছেই থাকতাম। উনি বদলি হয়ে ঢাকায় চলে গেলেন, আমিও চলে গেলাম। তবে ঢাকা গিয়ে মামার সঙ্গে থাকতাম না। একটা মেসে উঠেছিলাম।
আমিও তাই-ই জানতাম। অনেকেই কিন্তু মনে করতো তুমি কুমারখালীর ছেলে।
এখানে তো অনেকদিন থেকেছি। মামার কাছেই বড় হয়েছি। সে কারণে ওরকম একটা ধারণা ছিল। আমার নিজের বাড়ি খুলনায়।শহরেই। বাবা-মা এখনো ওখানেই থাকেন।
হঠাৎ ঘর-বাড়ি নিয়ে কথা বলছো?
না, ওরকম কিছু নয়। অনেক আগে একদিন তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন একেকজন একেক রকম বলছিল।
কী বলছিল?
কাফি বাউলার কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে একটু বিব্রতবোধ করে। সোমার দিকে তাকাতে সংকোচ হয়।
কেউ বলছিল তোমার বাড়ি এখানে। আবার কেউ বলছিল তোমার বাড়ি এখানে না। এসব আর কি। তবে সবাই তোমাকে বেশ পছন্দ করে। আমিও তো তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতাম না। ওভাবে তো তোমার সাথে তখনকথা বলার সুযোগ হয়নি। তুমি যখন আসতে তখনতো তুলিকে পড়াতে। আর বড় আপা বড় বড় চোখ করে চোখ ভরে তোমাকে দেখতো। যেন মন ভরে হবু জামাতাকে দেখছে ভাবটা ছিল এরকম! আমার জায়গা কোথায়! তোমার নাস্তাটাই আনতাম কতো নাটক করে। বড় আপা চাইতো না আমি তোমার সামনে আসি। কারণ আমার বেশি সুন্দর চেহারা।
আমি তখন এত কিছু বুঝিনি! চাকর-বাকর দিয়ে নাস্তা পাঠালেই তো পারতে। তোমাকে দেখে চোখ যদি তুলির ওপর থেকে তোমার ওপর এসে পড়ে! ভয় তো একটা থাকেই। একটু রস মিশিয়ে বললো কাফি।
সোমা একটু লজ্জা পেলো। বিষয়টা হাল্কা করে নিয়ে সে আবার বললো, আরে সবার সেবা কি চাকর-বাকর দিয়ে হয় না কি! একে তো তুমি তখন শিক্ষক মশায়, তারপর আবার বাড়ির জামাই হওয়া হওয়া অবস্থা—তার সেবা কি আর যাকে-তাকে দিয়ে চলে!
মনের আগুন মনে বেঁধে, অন্যের সুখে নিজেকে ছাই করেছ তাই না! কি ভুল বললাম!
এত কথা বলো কেন? অত বোঝো তো। তখন মনে হয়নি কিছু বোঝো। তুলির কষ্টে তো তখন কুমারখালী ছেড়েই পালালে! তখন ছাই না হয়ে উপায় কী আমার!
একটু একটু বুঝেছিলাম, পুরোটা বুঝিনি তখন।
অত বুঝতে হবে না। চলো সাঁইজির দুই একটা গান শুনে বাসায় ফিরি।
লালন অডিটোরিয়ামে তখন গানের মজবা জমে উঠেছে। গোলাবদ্ধভাবে শ্রোতারা বসে গান শুনছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাউলেরা হেলে-দুলে-নেচে গান গাইছেন।
সোমা আর কাফিও বসে। মজবা যেন আরো প্রাণ পেয়ে ওঠে। সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। আর অই বসার ফাঁকেই চোরাচোখে সোমার রূপের আলো একটু হলেও চোখে তুলে নেয় শ্রোতারা। বাউলেরাও যেন কণ্ঠে নতুন শক্তি পায়। গানের ভেতরই একফাঁকে সোমাকে দু’হাত একসাথে করে ভক্তি জানায়। সোমাও ভক্তির উত্তর দেয় ভক্তি জানিয়ে। তাকে এখানকার শিল্পীরা সবাই চেনেন। সোমার উপস্থিতিতে একতারা হাতে নৃত্যভঙ্গিতে বাউলদের শরীর যেন প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো নেচে ওঠে।
দুটো গানের পরিবর্তে কখন যে পাঁচ ছ’টা গান শোনা হয়ে গেছে, সোমা তা টেরই পায়নি। মুগ্ধ হয়ে ডুবেছিল গানের ভেতর। বাউলশিল্পীদেও খুশি করে এক হাজার টাকা হাতে দিয়ে উঠতেই, শিল্পীরা খুশি হয়ে জল ছলছল চোখে কাঁপা গলায় বললো, মা রে ওপরের সাঁই তোরে রূপ দেছে, টাকা দেছে, মন দেছে—এমন সোনার মানুষ জগতে কয়জন আসে! মা তুই যখনি আসিস, আমাদের মনে আনন্দে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে।
সোমা এমন কিছু শুনবে বা তাকে নিয়ে এমন কিছু বলবে—সে ভাবেওনি। চট্ করে সে কোনো উত্তরও খুঁজে পায় না। আনন্দে তার মনটাও ভরে ওঠে।
সোমার কাছে এগিয়ে এসে কাফিকে দেখিয়ে বৃদ্ধা বাউলা বললো, অ্যাঁরে মা, এ তোর নাথ! আহা! কী সুন্দর! যেমন তুই দেখতে, তেমনি তোর নাথ! ঈশ্বর তার নিজের আত্মার রশ্মি দিয়ে তোদের তৈরি করেছে। চোখ দুটো জুড়ে যায়! মনটা শান্তিতে ভরে যায়। সাঁইজি দুজনেরে কি সুন্দর মিলাইয়া দেছে! এ ধরাতে এইতো আনন্দযজ্ঞ, মা। সারাজীবন মা তুই তোর নাথকে নিয়ে আনন্দেযজ্ঞে মেতে থাকিস।
বৃদ্ধা বাউলা আবার গান শুরু করে।
সোমা লজ্জাই পেলো। লালমুখ আরো লাল হয়ে উঠলো। একটা ভালো লাগাও যে মুহূর্তের ঘ্রাণ হয়ে ভেসে এলো বুকের ভেতর, সোমা সেটাও অনুভব করলো। এও ভাবলো, ভাগ্যিস নাসের এসে এখানে গানের আসরে আগে কখনো বসেনি। বসলে যে আজ আরেকজনকে সাথে দেখে কী ভাবতো! অবশ্য এদের কাছে তো মনের খেলাই আসল! মন চাইলেই সব।
কাফি বাউলার কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে একটু বিব্রতবোধ করে। সোমার দিকে তাকাতে সংকোচ হয়।
চলবে…
সম্পর্কের আড়ালে-৩॥ রকিবুল হাসান