[পর্ব-১]
বাড়িটার চারদিক দুপুরের রোদ ছেয়ে আছে। গাছের ছায়ায় রোদটাকে ঠিক রোদ মনে হয় না। বিশাল বাগান। বাগানের ভেতর দোতলা একটা বাড়ি। সুন্দর ডিজাইনের বাড়িটা সহজেই চোখ কেড়ে নেয়। একটু দূর থেকে মনে হবে এটা শুধুই একটা বাগান। ফলের বাগান। আমা কাঠাল সহ নানারকমের ফলের গাছ। পাখিরা সব সময় গাছে গাছে খেলা করে। গেটের ভেতর ঢোকার পর বোঝা যায় কী সুন্দর একটা বাড়ি আছে এখানে। মাত্র তিনজন লোকের বাস এ বাড়িতে।
নিচতলাতে থাকেন শাহিদা বেগম। দোতলায় থাকে আবু নাসের ও তার স্ত্রী সোমা। শাহিদা বেগম আবু নাসেরের বড় ভাবি। বয়সে প্রায় দশ বছরের বড়। সাত আট বছর আগে হঠাৎ হার্টঅ্যাটার্কে শাহিদা বেগমের স্বামী মারা গেছে। আবু নাসের তাকে অনেকবার দোতালায় থাকতে অনুরোধ করলেও তিনি স্বামীর ঘর ছেড়ে আর উপরে থাকতে রাজি হননি। স্বামীর স্মৃতিকে ধরে নিচতলাতেই থাকেন। শাহিদা বেগম আর সোমার সম্পর্ক আপন বোনের মতো। সোমাকে নিজের ছোটবোনের মতো স্নেহ করেন তিনি। সোমাও সেভাবেই তাকে মান্য করে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই সম্পর্কের মধ্যে নিরব একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। উপর থেকে তা বোঝার উপায় থাকে না। শাহিদা বেগমের মেয়ে তুলিকে প্রাইভেট পড়াতো কাফি। ছেলেটা দেখতে সুন্দর। তখন বাড়িটার পুরো নির্মাণ কাজ চলছিল। কাফির নাস্তা-পানি প্রায় সময় সোমাই দিতো। দুজনের বয়সও কাছাকাছি।
সময়ের ছায়া ধরে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে। কিন্তু তা অপ্রকাশ্যই থাকে দুজনের। শরীরিভঙ্গি আর চোখের ভাষাতে তা প্রকাশ পেতো। শাহিদা বেগম স্বপ্ন দেখতে থাকতে কাফি আর তুলিকে নিয়ে। এত সুন্দর একটা ছেলে! চোখে ধরার মতো। কাফির আদর দুদিক থেকেই বাড়তে থাকে। সোমা কাফিকে বেশি বেশি আদর-যত্ন করতে থাকে এতে শাহিদা বেগম প্রথম প্রথম খুশিই হন। কিন্তু একসময় সোমা বুঝতে পারে কাফিকে তুলির সাথে বিয়ে দেয়ার জন্যই এত খাতির করেন শাহিদা বগম। একসময় শাহিদা বেগম ব্যাপারটা সোমাকে জানান। সোমা নিজের কিছুই বুঝতে না দিয়ে বলে, ভালোই তো। সোমার এমন কথায় খুশি হন শাহিদা বেগম। কাফিকে আরো বেশি করে যত্নআত্তি করতে থাকে সোমা।এতে সোমা আর কাফি আরো কাছাকাছি হতে থাকে।ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। কাফির ভালো লাগে।
সোমার মিষ্টি আচরণ আর রূপ লাবণ্য যে কাউকেই এক পলকেই মুগ্ধ করার মতো। কাফিও সোমার প্রতি মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু কাফি তা ভুলেও বলে সাহস পায় না। কারণ তার মনে হয় সোমা তাকে ভালোবাসে, কিন্তু মুখ ফুটে তো সে তাকে বলেনি। এ ধারণা যদি ভুল হয়! এই দ্বিধা তার মধ্যে কাজ করে। ফলে সে সোমাকে বলে সাহস পায় না। যদি ধারণা ভুল হয়- চোখের ভাষা যদি ভুল হয়! সোমা যদি ভালোভাবে গ্রহণ না করে, তাতে তার টিউশনিটাই চলে যেতে পারে। কিন্তু কাফি এতটুকু বুঝতে পারে, তার প্রতি সোমার একটা বিশেষ টান আছে। টানটা কিসের তা সে বুঝতে পারে না। এটা কি তুলির জন্য না নিজের জন্য! আবার এটাও সে খুব ভালো করে অনুভব করে তুলির আম্মু তাকে পছন্দ করে। তা কি এমনি এমনি না কি অন্য কোনো কারণে—কাফি তা অনুধাবন করতে পারে না। তবে আদরযত্ন যে বেশ বেড়ে গেছে তা সে বুঝতে পারে। আবার ভাবে, আমি হয়তো অনেক যত্ন নিয়ে পড়াই সেকারণে খাতির করে।
তুলির বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। সোমা তুলির বিয়ে দেয়ার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে। আবু নাসেরকে যেভাবে সোমা বোঝায়, সেভাবেই সে বোঝে। স্ত্রীর প্রতি আবু নাসেরের বিশেষ দুর্বলতা আছে। স্ত্রী অনেক সুন্দরী। আবু নাসের ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশি মনোযোগী হওয়ায় বেশি দূর পড়ালেখা করেনি। টাকা-পয়সার জোরেই বড়লোকের সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছে। আজকাল তো টাকাপয়সা হলেই মানুষ সম্মানিত হয়ে যায়— ক্ষমতাশালী হয়ে যায়। টাকা না থাকলে শুধু বড় বড় পাশ দিয়ে কী হয়! টাকা না থাকলে সমাজে কি দাম আছে! এমপি মন্ত্রী সবই তো এখন টাকাতে হয়। টাকাতে চলে। টাকা হচ্ছে তাদের জন্য গাড়ির চাকার মতো। যেদিকে চালানো যায়, সেদিকেই চলে। আবু নাসেরের ছোটবেলা থেকেই এরকম ভাবনা। বাস্তবে সে করেছেও তাই। তার স্ত্রীর মতো সুন্দরী মেয়ে এই শহরে আর একটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার শ্বশুরের মতো প্রভাবশালী লোকই বা কয়জন আছে! আবু নাসেরের ধ্যানেজ্ঞানে অর্থই সব। অর্থ দিয়েই সব কিছু পেতে চায় সে। সে তা বিশ্বাসও করে টাকায় সব হয়। অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
স্বামীর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়ে শাহিদা বেগম। কাফির কথা বলতেই সোমা বলে, ছেলেটা তো ভালো। সবকিছুতেই ভালো। কিন্তু কিছু করে নাতো! বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে তুলির ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়া ঠিক হবে না আপা।
শাহিদা বেগম কিছু বলার আগেই আবু নাসেরও স্ত্রীর কথায় সায় দেয়। আবু নাসের বললো, ভাই বেঁচে থাকলে তিনি নিজের মেয়েকে যেখানে খুশি সেখানে বিয়ে দিলেও আপত্তি থাকতো না। কিন্তু এখন তো ভাই নেই। দায়িত্ব তো আমারই। আমি তো যার-তার হাতে তুলিকে দিতে পারি না।
শাহিদা বেগম শক্তভাবে কোনো আপত্তি তোলে না। একটু আমতা আমতা করলেন। বললেন, ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালো। আচার ব্যবহার ভালো। পড়ালেখা শেষে একটা ভালো চাকরি-বাকরি হলেই তো হতো। তাই ওরকম ভাবিছিলাম। যাকগে। ওর বাবা নেই। এখন চাচা হলেও তুমি, বাবা হলেও তুমি। তুমি আর সোমা যা ভালো মনে কর, আমার তাতেই মত আছে।
আবু নাসের ও সোমা বেশ টাকা-পয়সা খরচ করে ধুমধামের সাথে তুলির বিয়ে দেয়। পাত্র সরকারি কলেজের শিক্ষক। শাহিদা বেগম খুশি হন। পাত্র-বিচারে কাফির চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ছেলের সাথেই তুলির বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কথা ছিল মেয়ের লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। ততদিনে কাফি তাকে পড়িয়ে যোগ্য করে গড়ে তুলবে। ছেলেপক্ষ পরে কথা পরিবর্তন করে ফেলে। তুলির আপাতত লেখাপড়ার দরকার নেই। কিছুদিন স্বামীর কাছে গিয়ে সংসার করুক। প্রয়োজন হলে পরে আবার পড়বে।
এতে কাফি মন খারাপ করে। সোমা খোঁচা দিয়ে কাফিকে বলে, তোমার নিজের যে এত ইচ্ছে ছিল? আগে তো কিছু কওনি! সূর্য ডোবার পর আকাশে সূর্য খুঁজে কোনো লাভ আছে! সোমা ভাবে, আমি পছন্দ করি তোমাকে, আর তুমি ডুবে আছো তুলির টানের ভেতর!। হায়রে মানুষ! হায়রে ভালোবাসা!
কাফি কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য কিছু ভাবে। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়ার চেষ্টা করে।
সোমা ভাবে, কাফি, আমি তোমাকে তুলির হতে তুলে দেবো, এটা কি করে ভাবতে পারো! তুলির রেখাটা তাই তোমার জীবন থেকে মুছে দিলাম। তোমাকে আমি ভালোবাসি তা তুমি বুঝতে পারো না! সব মুখ ফুটে বলে দিতে হয়! তুমি তুলিকে পছন্দ করলেও আমার প্রতিও যে তোমার দুর্বলতা আছে, তা আমি বুঝি। আমি পরস্ত্রী বলে হয়তো ধরা দিতে চাও না। গভীর জলের মাছ হয়ে থাকো। কিন্তু প্রেম তো প্রেমই—এত হিসাব নিকাশের ধার কে ধারে! তুলিতে তোমার মোহ জন্মেছিল তা ভেঙে দিলাম। আমি জীবনভর এমন একজন মানুষের ছবি মনের ভেতর এঁকেছি, তোমাকে দেখামাত্রই আমার ভেতরের সেই ছবিটা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল—সেই ছবিটার মানুষ তুমি। আমার ভেতর এক নতুন প্রাণ জেগে উঠেছে। এ প্রাণ তুমিই জাগিয়ে দিয়েছ। এ প্রাণ জাগার সাথে সাথে অন্যসব আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছে। কোটিপতি স্বামী—রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি—গা-ভর্তি সোনা-দানা-হিরে সব কেমন যেন মন থেকে ভেসে গেছে। ও সব আমার দরকার নেই। তোমাকে পেলেই সব পাওয়া হবে আমার।
সোমার ভাবনা সোমার ভেতরেই থাকে। কাফি কিছুই বুঝতে পারে না। সোমা উঠে অন্য ঘরে যায়। তুলি একটু পরেই এলো। কাফিকে বললো, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে ওরা একবারেই তুলে নিয়ে যাবে। আর পড়াবে না। আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না। আচ্ছা, আপনি খুব ভীতু তাই না!
এ কথা কেন বলছো বলোতো।
আপনি তো আমাকে বিয়ে করতে পারতেন। পারতেন না?
কাফি কোনো উত্তর দেয় না। এরকমভাবে তুলি তাকে বলবে এ তার কল্পনারও অতীত।একটু অপ্রস্তুত হয় কাফি। মুহূর্তে উঠার মতো শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলে সে। এমন পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি তার। এটা অপমান না অসম্মান নাকি কাপুরুষতা—নিজের বোধে তা অনুভূত হয় না। যেন বোধহীন এক মানুষ! তার মাথায় কোনো কিছু কাজ করে না। কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তুলিকে তো সে কখনো মুখ ফুটে প্রেমের কোনো কথা বলেনি। তাহলে নিজের থেকে এতটা সাহস কি করে হয় তুলির! নাকি তার ভেতরে প্রেম একটু একটু করে জমে অগ্নিবারুদে রূপ নিয়ে বিস্ফোরিত হলো! এতদিনে তো একবার হলেও বলতে পারতো। তাও তো বলেনি। কিন্তু আজ যা বললো যে অগ্নিবাক্য বর্ষিত হলো—এর উত্তর কি! কাফি ঘামতে থাকে। ভেতরটা অসার হয়ে আসতে থাকে। পড়ানোর শক্তিটা হারিয়ে ফেলে। অনেকটা বৃদ্ধ মানুষের মতো বিবর্ণভাবে বের হয়ে যায় কাফি।
কাফি চায়ে চুমুক না দিয়ে তাকাতেই দেখে আবু নাসের। আশেপাশের সব লোক তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। আবু নাসেরের সম্মান যে এই চার বছরে বহুগুন বেড়ে গেছে তা সে মুহূর্তেই অনুমান করে নেয়।
কোনো উত্তর না দিয়ে ভীরুর মতো কাফির চলে যাওয়া দেখে তুলি মন খারাপ করে। প্রশ্নের কোনো উত্তর সে পায় না। ভাবে, দুপুরের প্রথম রোদের মতো এমন একটা ছেলে এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে যায় কিভাবে! আমি মেয়ে হয়ে যে কথা মুখ ফুটে বলতে পারলাম, প্রবল শক্তিতে শক্তভাবে সে আমার হাত ধরে উত্তর দিতে পারলো না!
সোমা এসময় নাস্তা নিয়ে রুমে ঢোকে। কাফিকে না দেখে তুলিকে বলে কাফি কই?
চলে গেলো তো।
চলে গেলো! কোথায় গেলো? কখন গেলো? সোমা অবাককণ্ঠে প্রশ্নগুলো তুলিকে করে। আমাকে না বলেই চলে গেলো! তুমি কিছু বলেছ ওকে?
হ্যাঁ, বলেছি।
কী বলেছ?
বলতে পারবো না। তার চলে যেতে ইচ্ছে হয়েছে, চলে গেছে। এ নিয়েছোট মা তুমি আমাকে প্রশ্ন করছো কেন? উত্তরের অপেক্ষা না করেই তুলি মুহূর্তে একরকম প্রায় দৌঁড়ে নিজের ঘরে যায়।
তুলি কাফিকে কতোটা ভালোবেসেছিল তা হয়তো কাফি নিজেও আগে বোঝেনি। সোমাও অতোটা অনুভব করেনি। আজ আলোর মতো সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। কিন্তু কাফি তুলিকে কতোটা ভালোবেসেছিল, তার আর প্রকাশ ঘটলো না। সবই যেন পাথরচাপা দিয়ে কাফি বের হয়ে যায়। কাফি চায় না তার কারণে তুলির বিয়েটা ভেঙে যাক। কাফি হয়তো চেয়েছিল তার মতো করে যেদিন সময় আসবে, সেদিন তুলিকে বলবে, নিজের করে বুকে তুলে নেবে। কিন্তু সময় যে কারো হিসেবের নিয়ম মেনে চলে না, কাফি তা ভুল করেও ভাবেনি। সেদিনই কাফি কাউকে কিছু না বলে মামার বাসা ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়।
সোমা অনুমান করতো তুলির প্রতি কাফির একটা বিশেষ টান আছে। হয়তো তুলিরও আছে। কিন্তু তা যে এতটা প্রবল, তা সে কখনোই ভাবেনি। না হলে সেই চলে যাওয়া মানেই একটা দুটো দিন নয়, চার বছর কেটে গেছে। কাফি ভুল করেও আর কুমারখালীতে আসেনি। কিন্তু সোমার মনে সে একটুও পুরনো হয়নি। সোমা তাকে ঠিকই মনের ঘরে একান্ত আপন করে ধরে রেখেছে। আর তুলির সাথে সেই থেকে তৈরি হয় এক নদী দূরত্ব।
সোমা সময়ের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিজেকে অসংখ্যবার প্রশ্ন করে, কাফি কাকে ভালোবাসতো আমাকে না তুলিকে! নাকি দুজনকেই! আমাকে ভালোবাসলে এভাবে সে নিখোঁজ হয়ে যাবে কেন! নাকি তার পুরোটা জুড়েই ছিল তুলি! এই প্রশ্ন ভীষণ এক অন্ধকার তৈরি করে তার মনে। সেখানে কোনো আলো এসে তাকে কিছুই পরিষ্কার করে দেয় না। কিন্তু কাফির প্রতি তার যে অন্ধ ভালোলাগা, তা একটুও ম্লান হয় না। সময়ের রোদ্দুর ভেঙে শান্ত বিকেল নামে, তারপর সন্ধ্যা-রাত—যেভাবে প্রমত্ত গড়াই মাথা খারাপ করা ঢেউ ভেঙে একসময় শান্ত হয়ে যায়, দিন শেষে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়—কিন্তু অস্তিত্ব জুড়ে থাকে গড়াইয়ের স্রোত ঢেউ গভীরতা—এভাবে এক দুই করে চার বছর কেটে যায়—কাফি ঠিকই অস্তিত্ব জুড়ে থাকে। সোমার নিঃশ্বাসে দূরের কাফি ঠিকই প্রতি মুহূর্ত ভাবনার দোলাচলে নিঃশব্দ অদৃশ্য অন্ধকার ঢেউ হয়ে থাকে।
চার বছর পর হুট করে একদিন কাফি সোমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটা অনেকখানি অচেনা লাগে। বাড়িটার আভিজাত্য রূপ লাবণ্য অবিশ্বাস্যরকম বেড়েছে। দিব্যি যেন রাজপ্রাসাদ। অনেকক্ষণ বাড়িটা দেখে। ভাবে এই সে বাড়ি! যে বাড়িতে একদিন আমার স্বপ্ন মৌতাত যৌবনের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াতো। সোমা আমাকে পছন্দ করতো, আমিও করতাম, কিন্তু কোনদিন তা বুঝতে দেইনি। তুলিতেই আমাকে আঁকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুলি কোনদিনই তা বোঝেনি। বড় ভাইয়ের মতো জেনেছে আমাকে—বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করেছে। যা আমি কখনো চাইনি। অথচ আমার এই ভাবনা কত বড় ভুল ছিল, যখন তুলিই আমার মুখের ‘পর ঠাস ঠাস করে বলে দিল তার মনের কথা—প্রেমের কথা—ইচ্ছের কথা! সেদিনই জেনেছিলাম ভাবনা আর বাস্তবতার কতো যোজন যোজন দূরত্ব। সেই বাড়ির সামনে আজ কতো বছর পর! তুলি এখন নিশ্চয় স্বামীর ঘরে সুখের ঘর করছে—সুখবিছানায় সুখের আদর খাচ্ছে! আর সোমা! সে কি এখনো আমাকে মনে রেখেছে! এখনো কি ভালোবাসে! না কি এ বাড়ি এখন আমার জন্য শুধুই শ্মশানভূমি! এখটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস অবচেতন মনে বের হয়ে আসে কাফির।
কাফি চেহারা-সুরতে অনেকখানি অচেনা হয়ে গেছে। মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি। মধুসূদন স্টাইলে গোঁফ ঝুলে গেছে দুপাশে। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে কাফি কতো কিছু ভাবে! আচ্ছা শাহিদা আন্টি কি এখনো এ বাড়িতেই থাকে! সোমা কি আমাকে দেখে এখন চিনতে পারবে! আগের মতো আন্টি বা সোমা কি আমাকে গুরুত্ব দেবে! আদও করবে! সোমার চোখভরা প্রেমের সেই চাহনি কি থাকবে! তুলিকে আমি ভেতরে ভেতরে পছন্দ করলেও তা তো অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিই থেকে গেলো। সোমা আমাকে অনেক পছন্দ করতো। আমি তো বুঝেও না বোঝার মতো কওে তখন থেকেছি। সোমাকে তো আমারও অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু অত বড় লোকের বউ, অত সুন্দরী! সবই নিজের ভেতরে অন্ধকূপে চাপা দিয়েছি। কিন্তু এতদিন পরে এসব ভাবনার কী মূল্য আছে! এ ফেরার কি দাম আছে! কিভাবে যে এক দুই করে চারটা বছর চলে গেলো। কী মনে করে আবার এখানেই ফিরে এলাম—কিসের টানে এলাম—কেউ তো আমাকে ডাকেনি—কেউ তো আসতে বলেনি—মনের সুতো দিয়ে কেউ তো টানও দেয়নি।
সোমার জন্য গোপন আগুন কি মনের ভেতর একটুও জ্বলে থাকেনি! না থাকলে কিভাবে এলাম! যদি না চেনার ভান করে অথবা চিনলেও দায়সারাভাব করে কোন রকমে একটু ভদ্রতা করে বিদেয় করে দেয়! অথবা ভদ্রতাটুকুও যদি না করে! আমাকে এত বছর মনে রাখার মতো কোন কারণও তো ঘটেনি। কাফি চিন্তা করে এর চেয়ে সোমার সাথে দেখা না করে ফিরে যাওয়াই ভালো। বাড়ির সামনে থেকে এক পা দুপা করে মূল রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু কোথায় যাবে তাও তো জানা নেই তার। মামাও বছরখানেক আগে বদলি হয়ে এখান থেকে চলে গেছে। ঠিকানাহীন পাখির মতো অবস্থা তার। চাকরি বাকরি হয়নি। মাঝেমধ্যে দুচারটে টিউশনি করে কোনভাবে চলেছে। জীবনের প্রতি কেমন যেন তার বিতৃষ্ণা জাগে।
মূল রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে দাঁড়ায় কাফি। ভাবে, চা খেতে খেতে একটু ভেবে নিই—কি করবো—কোথায় যাবো! চায়ে চুমুক দিতেই হঠাৎ একটা কণ্ঠ তাকে বিস্মিত করে, কাফি, তুমি!
কাফি চায়ে চুমুক না দিয়ে তাকাতেই দেখে আবু নাসের। আশেপাশের সব লোক তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। আবু নাসেরের সম্মান যে এই চার বছরে বহুগুন বেড়ে গেছে তা সে মুহূর্তেই অনুমান করে নেয়।
সোমা তো মাঝেমধ্যেই তোমার কথা কয়। ও তো তোমাকে দেখে এখন চিনতেই পারবে না।
কাফির কোনো উত্তর থাকে না। দুচোখে বিস্ময় ও ভীরুতা জেগে ওঠে।
চলবে…