বাড়িটা নিঝুম। সম্ভবত আসন্ন ভোরের প্রস্তুতি নিতে ঝিমুচ্ছে। খানিক আগেও জেগে ছিল। অতিরিক্ত সজাগ ছিল চারপাশ। বিলাপে করুণ হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। এখন কেমন থম ধরানো নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। দম বন্ধ করা এক নৈঃশব্দ্য ঝুলে আছে বাড়িটার কণ্ঠায়। আহা জীবন! আপাত অমানবিক কাজগুলোও মানুষকে দিয়ে করিয়ে নেয় অম্লান চিত্তে। জীবন মানেই স্বার্থপরতা, বাঁচার জন্য যুদ্ধ অবিরাম, ভেবে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে রিহানের।
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি আসতে চায় তারও। শীত কাঁপিয়ে দিতে চায় ঠকঠক। বাসেতের দিকে তাকায় চোরাচোখে। তখন তখনই বাসেতও তাকায় তার দিকে। চোখে চোখে কথা হয়। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে দুঃখিত, মনমরা ভঙ্গিতে। গায়ের চাদর, মাফলার, ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে দুজনই চোখ ফিরিয়ে নেয় আবার। সামনে তাকায়। ঋজু শুয়ে আছে চুপচাপ, সটান। একশ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতিটা অন্ধকার তাড়িয়েছে অনেকটাই, সঙ্গে সঙ্গে একপোঁচ বিষণ্নতাও ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরটায়। আতর, লোবান, আর আগরবাতি যেন বিষণ্নতার সলতেটাকে উসকে দিতে চাইছে আরও। রিহানের খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে হঠাৎ। ঘুরে আবার বাসেতের দিকে তাকায় সে। বাসেতের চোখ বন্ধ। বাসেত কি আজ সন্ধ্যায়ও গাঁজা টেনেছে? প্রশ্নটা রিহানের মনের ভেতর আলতো খোঁচা দিয়েই সরে যায়। ঋজুর পাশে থাকার জন্য কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন স্বেচ্ছায়ই এসেছে বাসেত। রিহানকে অভয় দিয়ে বলেছে, ভয় নাই মামু, আমি আছি।
বাসেতকে পাশে পেয়ে বুকের ভেতর থেকে বড় একটা পাথর নেমে গেছে, সন্দেহ নেই। শীতের রাত বড় দীর্ঘ হয়। এই দীর্ঘ রাত ঋজুর সঙ্গে একা কাটানো অসম্ভব ছিল সত্যিই। বাসেত যেন আশীর্বাদ হয়েই এলো। তখন প্রশ্নটা একবারও মাথায় আসেনি কেন? প্রশ্নটা মনে মনে নাড়াচাড়া করল রিহান। দেখল উল্টেপাল্টে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে সম্ভবত তার স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি কাজ করেনি তখন। নইলে গাঁজাখোর বাসেতের লাল চোখই বলে দিতো, গাঁজা টেনেছে সে আজও, নিত্যদিনের মতোই। টানুক। জগতের কী-ই বা বিশেষ ক্ষতি তাতে! ঋজুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো রিহান, আবার। না, ক্ষতি নেই কিছুই। ঋজুর নিশ্চিন্ত, নির্লিপ্ত ঘুম জানিয়ে দিচ্ছে, কে গাঁজা নিয়েছে আজ সন্ধ্যায় অথবা তার পাশে ভোরের অপেক্ষারত কারই বা সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে জোর, তাতে সে কিছুই মনে করে না আর। কষ্টে তবু সিগারেটের নেশাটা দমন করলো রিহান। হাই উঠছে। তীব্র শীত শরীরটাকে অবশ, অসাড় করে দিতে চাইছে। একটু বুঝি ঝিমুনি মতো এসেছিল তার। তন্দ্রামতো একটা ঘোর-ঘোর ভাব লেপ্টে বসেছিল চোখে। আচমকা বাসেতের ভারী, মোটা গলার কিছু একটা কথায় চমকে তাকালো রিহান। বাসেত ঘুম-ঘুম লাল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কী হইছে মামু? প্রশ্নটা করেই ঋজুর দিকে তাকালো রিহান, অকারণেই। কোনো ছন্দপতন নেই সেখানে, হওয়ার প্রশ্নও নেই।
রাত তো এম্নে কাটে না রে মামু। কয়ডা বাজে দেহোদিনি।
বিমূর্ত দুপুর ॥ শিল্পী নাজনীন
পোনে একটা বাজে মামু। সহাল অওয়ার এহনও মেলা দেরি। দুয়া-কালাম পইড়বের লাগো। আল্লাবিল্লে করো।
হ মামু। তুমু পড়। বলে আবার চোখ বন্ধ করে বাসেত। ঝিমোয়।
চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে রিহান, দোয়া-দরুদ বলতে যা বোঝায়, আদৌ সে সেসব কিছু জানে কি না। তেমন কিছু মনে পড়ে না তার, আওড়ানোর মতো। তবু, যেটুকু সে শিখেছিল শৈশবে, স্কুলের ধর্মশিক্ষা ক্লাসে কিংবা তার হুজুগে বাপের চাপে, সেটুকুই ঝালাই করার চেষ্টা করে এখন, মনে মনে। আর সবিস্ময়ে সে আবিষ্কার করে এই ফাঁকে যে, জগতে সত্যিই বিফলে যায় না কিছুই। ঋজুর পাশে বসে, এইমুহূর্তে শৈশবে নিতান্ত অনিচ্ছায় শেখা, ভুলে যাওয়া দোয়া-দরুদে সুর তোলা ছাড়া এই দীর্ঘ শীতের রাতে সে বা তারা, ঋজুর জন্য কী-ই করতে পারতো আর! এসব মুহূর্তে আদতে মুরুব্বিরা ভূমিকা নেয়, তারাই সঙ্গ দেয় ঋজুর মতো ঘুমন্ত, ভোরের অপেক্ষারতদের। কিন্তু এমনই প্রচণ্ড শীত পড়েছে যে, রিহানদের মতো তাগড়া জোয়ানদেরই হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে এবার, সেখানে বুড়োরা ঋজুকে পাহারা দেওয়ার কথা শুনেই শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে চলে গেছে যে যার বাড়ি। ঋজুর আপনার জন যারা, কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে যারা, সত্যিই হৃৎপিণ্ডে ছুরি ঢুকে গেছে যাদের, তারাও সাহস করেনি কেউ রাতটা তার পাশে জাগার। আড়চোখে বাসেতকে দেখে রিহান। গাঁজার ঘোরে, শীতের প্রকোপে, সর্বোপরি ঘটনার আকস্মিকতায় অদ্ভুত, অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে।
একটু অন্যমনস্কতা জাপটে ধরেছিল রিহানকে হঠাৎ। অন্যমন তাকে শীতরাতের এই উটকো বিপদ ভুলিয়ে অন্য কিছু একটা ভাবতে প্রলুব্ধ করেছিল সম্ভবত। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সে গতদিনে বিধুর সঙ্গে হয়ে যাওয়া কথা-কাটাকাটিতে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। মনে মনে উল্টেপাল্টে দেখছিল, ঝালাই করছিল তার আর বিধুর মধ্যে হওয়া বাকবিতণ্ডা, কথোপকথন। বিধুর অযৌক্তিক কথাগুলো তীরের ফলার মতো কানে এসে বিঁধছিল তার, আর সে-ও, তেতে উঠছিল ভরা চৈত্রের মতো। হারামজাদা! কতাবাত্তারা যা কচ্চিস, মাইপে কইস কলাম! তা না অলি দাঁত কলাম এটাও জাগামতো থাকপিনানে, বুচ্চিস?
রিহানের এই তড়পানিতে বিধু তেতেছিল দ্বিগুণ। তার দিকে আরও দু-পা এগিয়ে এসেছিল বিধু উত্তেজনায়, ক্রোধে। উরে আমার মাইপে কতা কওয়ালা রে! তুই মাইপে কতা ক সুমন্দির ছাওয়াল! আমার বাপেক আমি খাতি দিই চাই না দিই, মারি চাই ধরি, তাতে তোর বাপের কী রে শালার বেটা শালা? তুই তা নিয়ে কতা কওয়ার কিডা? বিরাট নেতা অয়া গেচো, তেয় না? নেতাগিরি ফলাবের আয়চো হেনে? যাও নিজির বাইত নেতাগিরি ফলাওগা যেয়া, বোচ্চ?
সারোয়ারকে চিনতিস তো? সেই যে রে আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে? পরের বছর মেডিকেলে চান্স পেয়ে চলে গেছিল, মনে আছে?
হাত-মুখ নেড়ে বিধুর তার দিকে তেড়ে আসাতে আগুন ধরে গেছিল রিহানের মাথায়। জুৎসই একটা গালি সবে ঠোঁটের কাছে এসে বিধুর ওপর ছিটকে পড়ার পাঁয়তারা করছিল, ঠিক তখন, হঠাৎ সটান শুয়ে থাকা ঋজুর দিকে চোখ পড়ে রিহানের। বিস্ময়ে চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায় তার। রিহানের বিস্মিত, ভীত, ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত, মিষ্টি করে মুখ টিপে হাসে ঋজু। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। রিহানকে আশস্ত করার ভঙ্গিতে হাই তোলে আলস্যে। তারপর কেমন, অপরিচিত, অচেনা গলায় বলে, ধূর! আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। তোরা এমন শুকনো মুখে বসে আছিস কেন? আয় গল্প করি!
হাতে যেন স্বর্গ পায় বাসেত। নড়েচড়ে বসে সে। গাঁজার ঘোর তাকে জেগে থাকতে বড্ড বাধা দিচ্ছিল এতক্ষণ। ঋজুর এই প্রস্তাব তার কাছে একটুও অস্বাভাবিক ঠেকে না। মাথা দুলিয়ে বিজ্ঞের মতো সে বলে, হ মামু। জব্বর কতা কইচো। এম্মা শুদো মুহি বইসে থাকতি আর বালো লাইগতেচে না। গল্প করি, আইসো। তুমি কী কও, ও মামু? বলে রিহানের দিকে ঘুরে তাকায় সে। রিহান বিস্ময়ে থ হয়ে বসে থাকে নির্বাক। হঠাৎ মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে বাসেত মুহূর্তেই রিহানকে ছেড়ে আবার ঋজুর দিকে তাকায়। তারপর উৎফুল্ল গলা খানিকটা নামিয়ে ঋজুকে লক্ষ্য করে বলে, তুমার কাচে জিনিস আচে মামু? আইজ সাঁজবেলা যিডা টানিচি উডা তেমুন জুতির ছিলে না মামু। নিশা তেমুন জমে নাই।
শুনে ঋজু আবার হাসে। আগের মতোই। রিহানের দিকে তাকায়, আবার বাসেতের দিকে। তারপর বাসেতের কথা যেন শুনতে পায়নি, কিংবা উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই নাই কোনো, তেমন ভাবে মাথা নাড়ে। রিহানকে বলে, কী রে? বিধুর সাথে কী সমস্যা তোর?
রিহান ভুলে যায়। বিধুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া বাকবিতণ্ডা ঋজুর জানার কথা নয় একদম। কিন্তু সে কথা মনেই পড়ে না তার। সহজ, স্বাভাবিক সুরে কথা শুরু করে সে। বাসেত ভুলে যায় হঠাৎই গাঁজার তেষ্টা পেয়েছিল তারও, খানিক আগেই। সব ভুলে গল্পে মশগুল হয় সেও। ঋজু হাঁটু মুড়ে বসে। অদূরে পুরনো, রঙজ্বলা ওভারকোট, তার ওপরে চাদর চাপানো রিহান, চোখ-মুখ বের হয়ে আছে শুধু, মাথা কালো মাফলারে ঢাকা। তার থেকে হাত কয়েক দূরত্বে বাসেত। বাসেতের গায়ে পাতলা উলের লাল সোয়েটার. ছাইরঙা চাদরটা সে কোনোরকমে ফেলে রেখেছে গায়ের ওপর। দেখলেই বোঝা যায়, শীতের ওপর তার তেমন একটা শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই। ঋজুর গায়ে কিছু নেই। পরনে আছে কি না, ঠিক বোঝা যায় না। সটান শুয়ে থাকা তার শরীরটা ঢাকা ছিল যে চাদরটায়, সেটা কোমর পর্যন্ত নামানো এখন। লোমশ বুক উদোম। মুখে খোঁচা খোঁচা কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। বিছানো খেজুর পাটিটায় গ্যাঁট হয়ে বসে সে গল্প জমিয়ে তোলে দারুণ। রিহান আর বাসেতও সমানে তাল মিলিয়ে জমিয়ে তোলে তুমুল আড্ডা। একসঙ্গে কাটিয়ে আসা শৈশব আর কৈশোরটা যেন হঠাৎ জীবন্তরূপে ফিরে আসে আবার।
মনে আছে রিহান? সেই যে, সেবার চৈতালি মাঠে খেসারির ভুঁইতে গিয়ে কেমন দাবড়ানি খেয়েছিলাম চৌকিদার ব্যাটার? তোর আর আমার সে কী পড়িমরি দৌড়! হাহাহা!
ঘর কাঁপিয়ে হাসে ঋজু। খুশিতে চকচক করে চোখ। হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যায় তার। হাতের উল্টোপিঠে জল মুছে আবার গল্পে ফেরে সে। ভাগ্যিস, মাঠের মদ্যিখানে কুঁড়েটা ছিল! আমি দৌড়ে গিয়ে লুকোলাম সেখানে! আর তুই শালা হাঁদারাম! হাহাহা! হোঁচট খেয়ে পড়লি শেষে মাঠের ভেতর! আর বুড়ো চৌকিদারটা তোকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল তার বাড়িতে! আমি কুঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে সবটা দেখে হাসতে হাসতে মরি প্রায়! হাহাহা!
ঋজুর হাসি থামতেই চায় না আর। বাসেত হাসে আরও বেশি। গাঁজার ঘোরে সে শরীর দুলিয়ে, হাত-পা নাড়িয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে প্রায়। ঘোরগ্রস্তের মতো রিহানও হাসে। ঋজুর কথা আর হাসিতে সে লজ্জা পায় খানিক। ছেলেবেলায় সে বেশ লাজুক, ভীতু প্রকৃতির ছিল। ঋজু ছিল ডাকাবুকো গোছের। কাউকে ভয়-ডর ছিল না তার। দুরন্ত ছিল খুব। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে ঋজু। তার অচেনা, অপরিচিত কণ্ঠে কেমন একটু রহস্য এসে মেশে সহসা। একটু ধীর, নরম সুরে সে বলে, তোর জুঁইকে মনে পড়ে রিহান? সেই যে, ঝাঁকড়া চুলের পাগলি মেয়েটা, আমাদের সাথে পড়ত? মনে আছে?
তৎক্ষণাৎ মাথা কাত করে জানিয়ে দেয় রিহান, মনে আছে! খুব মনে আছে তার!
মেয়েটা খুব মিষ্টি ছিল, না রে?
হুঁ। অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় রিহান।
হাহা! তুই ওর প্রেমে পড়েছিলি, আমি জানি! হাহা! তুই শালা আস্ত গাড়ল ছিলি একটা! ওকে বলতে পারলি না পর্যন্ত! ও কিন্তু তোকে ভালোবাসতো মনে মনে, জানিস?
ধূর! কী বাজে বকিস! অবিশ্বাসে, উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসে রিহান।
হুঁ। সত্যি। আমি জানি। জুঁই এখন অস্ট্রেলিয়ায়, মেলবোর্নে। এখনও মাঝে মাঝে তোর জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাহাহা!
তোকে কে বলেছে? ফালতু বকিস না তো!
সত্যি রে! এখন আর মিথ্যে বলা যায় না! আমি ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেসময়, তখন ও বলেছিল, তোকে ভালোবাসে, জানাতেও বলেছিল তোকে। আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, জানিস? হিংসা হয়েছিল খুব! তাই তোকে জানাইনি তখন আর। ইচ্ছে করেনি।
উহ!-ভারী একটা আফসোসের শব্দ করে রিহান। গলায় উষ্মা ঢেলে বলে, খুব অন্যায় করেছিলি এটা ঋজু! খুব অন্যায়!
মুখে চুকচুক আফসোসের শব্দ তুলে বাসেতও সরব হয় এতক্ষণে। বলে, হ মামু। ইডা কলাম উচিত কাম অয় নাই একদম। রিহান মামুরে তুমার কতাডা জানানে উচিত ছিলে খুপ।
ঋজু হাসে। রহস্যের হাসি। স্বগতোক্তির মতো বলে, যা ঘটা উচিত তাই-ই ঘটে রে বোকার দল। শুধু আমরা বুঝি না, এই যা বিপদ। যদি জানাতাম, তোরা দুজনেই কষ্ট পেতিস, কেউ একজন সেটা চায়নি, তাই আমার বলা হয়ে ওঠেনি। নইলে আমি না চাইলেও তোরা জেনে যেতিস যে তোরা দুজন দুজনকে চাস। এই চাওয়াটুকু, পাওয়ার আকাক্সক্ষাটুকু, জীবনে এটুকুই সুন্দর। বাকি সব পানসে, আটপৌরে। যদি জানাতাম সেদিন, এই সুন্দরের আকাঙ্ক্ষাটুকুর আস্বাদ তো আর পেতিস না তোরা কেউই!
দর্শন কপচাবি না শালা! তেতে ওঠে রিহান। দুঃখিত, বিমর্ষভাবে বাসেতও মাথা নাড়ে। নির্বিকার ঋজু ঠোঁটে রহস্যের একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকে। বিদ্যুতের আলো তার ফর্সা, খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে ঠিকরে পড়ে হেসে ওঠে। কেমন অপার্থিব, অলৌকিক লাগে তাকে। তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রিহানের মাথার ভেতর যৌবন উঁকি দেয়।
তুই কেন মহুয়াকে বিয়ে করেছিলি ঋজু? ডিভোর্সই বা হলো কেন তোদের? অনেকদিন মনের ভেতর বিঁধে থাকা প্রশ্নের কাঁটাটা আজ উপড়ে ফেলে রিহান। প্রশ্নটা করে আগ্রহ নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে ঋজুর ভরাট, ফোলা মুখে। ঋজু মৃদু হাসে। নিরাসক্ত হাসিতে মুখটা ভরিয়ে রাখে সে। তারপর, যেন অনেক দূর থেকে, হাওয়ায় ভর দিয়ে ভেসে আসে তার জবাব।
মহুয়াকে আমি ভালোবাসিনি কোনোদিন। বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু মেয়েটা এত পাগলামি শুরু করল! আর আমিও তো মানুষই ছিলাম, বল! মেয়েটা একদিন, এক অসতর্ক মুহূর্তে আমাকে দূর্বল করে দিল। আমি পা পিছলে পড়লাম। যখন আবার আমার সামনে এলো তখন সে তিনমাসের প্রেগন্যান্ট! আমাকে সে ব্লাকমেইল করল রীতিমতো! তখন কী-ই বা করার ছিল আমার আর! বিয়ে করে নিলাম। কিন্তু অল্পদিনেই ওর মুগ্ধতা কেটে গেল। বুঝে গেল, আসলে ওকে কোনোদিন ভালোবাসিনি আমি। মহুয়া তখন অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ল। সারোয়ারকে চিনতিস তো? সেই যে রে আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে? পরের বছর মেডিকেলে চান্স পেয়ে চলে গেছিল, মনে আছে?
প্রশ্নটা অকারণেই করে ঋজু। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে যায় আবার, মহুয়ার সাথে সারোয়ারের কী করে যোগাযোগ হয়েছিল সে প্রসঙ্গ থাক। ওরা একটা কমিটমেন্টে এসে গেছিল। সারোয়ার সম্ভবত মহুয়াকে বিয়ে করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। আর আমার তো এমনিতেই মহুয়ার প্রতি কোনো আসক্তি ছিল না। ফলে ডিভোর্সটা হয়ে গেছিল খুব নির্বিঘ্নে। পরে সারোয়ার কথা রাখেনি শুনেছি। মহুয়া এখন কষ্টে আছে। আমার মেয়েটাও কষ্টে আছে রে। আরও কষ্ট বাড়বে মেয়েটার। মা ছিল না এতদিন। আর এখনতো…
লোকজন আসতে শুরু করে এদিকটায়। রোদ উঠলেই শেষকৃত্যের জোর আয়োজন শুরু হবে। ঋজুর সব অপরাধ ধুয়ে যাবে খানিক বাদেই।
বলতে গিয়ে হঠাৎ কী ভেবে থেমে যায় ঋজু। রিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। তারপর হঠাৎই বলে বসে, তোর ভাবনাটা ঠিক নয় রে! শওকতকে আমি খুন করিনি সে রাতে!
ছেলেটার নাম শওকত ছিল তাহলে? অবাক প্রশ্ন করে রিহান।
হুঁ। সংক্ষেপে উত্তর দেয় ঋজু। স্বগতোক্তির মতো বলে, অন্য অনেকের মতো ওর মৃত্যুটা আমাকেও অবাক করেছিল। আমিও জানতাম না কী করে মারা গেছিল শওকত। সকালে উঠে ওকে আমি রুমের মধ্যে প্রাণহীন পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, ওরই বিছানায়। তোর মতো অন্য অনেকেই আমাকে সন্দেহ করেছিল। পুলিশও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল আমাকে। কিন্তু আমি এখন জানি, ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। তাছাড়া, আমি কেন শওকতকে খুন করতে যাব বলতো! ওর সাথে তো কোনো শত্রুতা ছিল না আমার! বরং আমার বন্ধু, রুমমেট ছিল সে!
চুপচাপ শুনছিল রিহান। হঠাৎ বহুদিন আগের একটা রাত এসে আলো ফেলে তার ভুলে যাওয়া মনের অ›ধকারে। ঋজু, রিহানের মন পড়ে ফেলে লহমায়। অনুতপ্ত, অপরাধীর গলায় বলে, খুব বৃষ্টি ছিল সে রাতে, না রে রিহান?
কোন রাতে? -চমকে জানতে চায় রিহান।
ঐ যে, যে রাতের কথা ভাবছিস তুই!
হুঁ। ছিল। ওটা তুই ছিলি, তাই না?
আমিই!
কেন ঋজু? কণা কী ক্ষতি করেছিল তোর? কেন ওকে অমন শাস্তি দিতে চেয়েছিলি তুই? কণা আমার বোন, তোরও তো বোনই ছিল সে, ছিল না?
না না। তুই ভুল করছিস! কণাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে অপমান করেছিল। ভয়ানক অবজ্ঞা দেখিয়েছিল। তাই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। আর কিছু নয়!
ভালোবেসেছিলি? ফাজলামি করিস? ভালোবাসলে সেখানে কী করে প্রতিশোধের ভাবনা আসে!
ম্লান হাসে ঋজু। এখান থেকে ফাজলামি করা যায় না রে। এখন তো বুঝতে পারি, ভুল করেছিলাম।
সে রাতে খুব বৃষ্টি ছিল ঋজু। তুই রেপ করতে গেছিলি আমার একমাত্র বোনটাকে! তোর হাতে ছুরিও ছিল সে রাতে! তুই ওকে খুনও করতে চেয়েছিলি, তাই না ঋজু?
মাঝখানে বাসেত গাঁজার ঘোর ভুলে উত্তেজিতভাবে কথা বলে ওঠে আবার।
প্রেম আছে, প্রেম নাই ॥ শিল্পী নাজনীন
সেই বর্ষারাত্তিরির কতা কচ্চ মামু? সেই রাত্তিরি যে বিরাট দেওয়া নাবিচিলে মামু, কী কবো! আমি না পাইরে গাঁজাটানায় ইস্তফা দিয়ে গঞ্জেত্তে বাইত আসতিচি, হটাৎমারি দেহি ঋজু মামু পড়িমরি করে দৌড়োচ্চে। গুটগুটে আঁদার ছিলে, দেহা যায় না কিচু, শব্দ শুনে আমি আতে থাহা টর্চ মাইরে দেহি ঋজু মামু দৌড়োচ্চে, আতে বড় একখ্যান চকচকে ছুরি। আমি এতো চেঁচালাম, ও মামু! কোনে যাও? দৈড়ো ক্যা? খালের বিন মাছ মাত্তিচিলে লেকত কাহারা, তারা সপ কত চেঁচালে, কীডা রে? দৌড়ো যায় কীডা? তা কীডা শোনে কার কতা! ঋজু মামু এক দৌড়ে পগার পার। তালি পরে এই ছিলে গটনা, ও মামু? এই কি এটা কাম ছিলে নাহি তুমার! ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!
ঋজু নির্বিকার বসে থাকে। একটু ম্লান লাগে। কিংবা রিহানের চোখের ভুল। ঋজু একমনে বলে যায়। ভুল স্বীকার করে যেন পাদ্রীর কাছে। রিহানের তেমনই মনে হয়।
হ্যাঁ। কণা আমাকে রিফিউজ করায় ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম আমি। আমি কণাকে ধর্ষণ শেষে খুন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকে, ঘুমন্ত কণার মুখের ওপর পড়া আলোয় ওকে দেখে হঠাৎ ভীষণ মন কেমন করল আমার। ইচ্ছে হলো ওর পাশে একটু শুই, গন্ধ নিই ওর শরীরের। আমি চুপচাপ শুয়েছিলাম। কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ পাশ ফিরল কণা। আমার গায়ে একটা হাত পড়ল ওর। কণা জেগে উঠলো। ভীষণ চমকে কে, কে, বলে চিৎকার করে উঠল সে। বাইরের প্রবল বৃষ্টি ওর চিৎকারকে গিলে নিল মুহূর্তেই। সহসা কী যে হলো আমার! ভীষণ ভয় পেলাম আমি। কিসের ভয়, কেন ভয়, জানি না। গায়ের সবগুলো লোমকূপ শিউরে উঠল আমার। একটা হাত তখনও কণার হাতের মুঠোয় আলগা করে ধরা। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে দিলাম দৌড়। ওর চোখে তখনও ঘুমের ঘোর। আমাকে চিনতে পারেনি তখনও।
রিহানের গা ঘিনঘিন করে সবটা শুনে। অস্ফুটে বলে, ছিঃ ঋজু! তুই না বন্ধু আমার! কণা না ভাই ডাকতো তোকে!
বাসেতও ধিক্কার দিয়ে ওঠে। ছিঃ মামু! ছিঃ! এই লেহাপড়া শেহোচো তুমরা!
ঋজু মাথা হেঁট করে বসে থাকে। দুঃখিত, অপরাধী মুখ। যেন পাদ্রীর সামনে বসেছে সে হাঁটুমুড়ে। পাপস্বীকার পর্ব শেষে অপেক্ষা করছে পুরোহিতের সান্ত্বনা বাণীর।
নিদ্রার ঘোর টুটে যায় রিহানের। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম…মসজিদ থেকে আজানের শেষ বাক্যটা ভেসে আসে সুরে। চমকে চোখ কচলে তাকায় রিহান। ঋজু তেমনি সটান শুয়ে। সাদা চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা। হাত কয়েক দূরে বাসেত গাঁজার ঘোরে ঢোলে। পায়ের শব্দ পাওয়া যায় সহসা। আসে। লোকজন আসতে শুরু করে এদিকটায়। রোদ উঠলেই শেষকৃত্যের জোর আয়োজন শুরু হবে। ঋজুর সব অপরাধ ধুয়ে যাবে খানিক বাদেই।