ভাষার মানদণ্ডে একটি জাতিকে বিচার করতে হলে বাঙালি জাতি গৌরবের দাবিদার। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের পূর্বদিকের সবচেয়ে প্রান্তিক যে ভাষা নব্য ভারতীয় আর্যগোষ্ঠীর পথ ধরে আমাদের কাছে এসেছে, তা পৃথিবীর দশ-এগারোটি শ্রেষ্ঠ ভাষার একটি।
বাংলার মাধুর্য এতটা হৃদয়গ্রাহী, যার প্রমিত চর্চার কাছে বিশ্বের অন্যান্য ভাষা ম্রিয়মাণ। আমাদের মাতৃভাষা হওয়ার পরও এর চর্চা সর্বত্র সমাদৃত নয়। বাঙালির নিজের পরিচয়ের সবচেয়ে গৌরবের এই জায়গাটির প্রতি উদাসীন আমরা। এর অন্যতম কারণ হলো অন্যের আয়নায় নিজের মুখ দেখার প্রবল ইচ্ছে। আমরা কখনো কখনো ভুলে যাই, বাঙালি। কথাবার্তা সাজসজ্জায় পাশ্চাত্য ঢঙ না থাকলে যেন গেঁয়ো, আনকালচার্ড হয়ে যাই। তাই নিজেকে স্মার্ট ও পণ্ডিত হিসেবে জাহিরের জন্য বিদেশি সংস্কৃতির আশ্রয় নিচ্ছি। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য যে বাঙালি সংস্কৃতি, যে ভাষার আছে গৌরব করার মতো সুদীর্ঘ ইতিহাস, সে ভাষার চর্চা যেন নিছক অকাজের কাজ ছাড়া কিছুই নয়। আর এসব চিন্তার ফলে দেশের বিভিন্ন ছোট-বড় শহর এমনকী গ্রাম পর্যায়েও পৌঁছে গেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে যোগ্য করে তুলতে ইংরেজি শিখতে হবে। তাই বলে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু এসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাদের যা শেখানো হচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চর্চাই বেশি হচ্ছে।
বাংলা বর্ণের সঠিক উচ্চারণে শিশুদের বড় করে তোলার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেশে বড় অভাব। বাংলার সঠিক বা প্রমিত ব্যবহার যদি কেউ শিখতে চায়, তবে অনেকটাই তাকে নিজের গরজে শিখতে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার শিখছে না শিক্ষার্থীরা। আবার নিজের গরজে একজন শিক্ষার্থী বাংলার সঠিক চর্চা কেন শিখবে?
ভালো বাংলা জানে বলেই কারও ভালো চাকরি হবে, এটা তো নয়। ভালো বাংলা জানে বলেই কারও রুটিরুজির বন্দোবস্ত হয় না। অন্যদিকে, বাংলার পরিবর্তে ভালো ইংরেজি জানলে ভালো চাকরি হয়। রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়। তাহলে কেন আমরা বাংলার জন্য এমনটি চর্চা করতে যাবো—প্রশ্ন থেকে যায়। এক্ষেত্রে সরকার ও বুদ্ধিজীবী মহলকে ভূমিকা রাখতে হবে। অফিস-আদালত সর্বত্রই বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ভাষার ঐতিহ্য রক্ষায় মূল্যায়ন করতে হবে ভালো বাংলা জানা ব্যক্তিদের।
ভাষা আন্দোলনের এত পরে এসেও সর্বত্র বাংলা ভাষার চর্চা যেখানে নিশ্চিত সম্ভব হয়নি (নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়নি) সেখানে ভাষা দিবস নিয়ে এত লাফালাফির সবটাই বৃথা। আমরা প্রত্যেকে যদি বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপারে সচেতন হই, তবেই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব।
ভার্চুয়াল পৃথিবীর বাতাস যখন আমাদের গায়ে লাগছে, তখন আমরাও ডিজিটাল সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে তথ্য আদানপ্রদানে অংশ নিচ্ছি। আর সেখানে ইংরেজি লেটার দিয়ে বাংলা লেখার ছড়াছড়ি। সেখানে ‘বাড়ি’-র পরিবর্তে লেখা হচ্ছে Bari, ‘কথা’-র পরিবর্তে লেখা হচ্ছে Kota এমনি করে সব বিরক্তিকর চর্চা আমাদের হতাশ করে দিচ্ছে।
১৯৫২ সালে যে ভাষার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, পৃথিবীর সব মানুষ আজ সে ভাষার ইতিহাস জানে। সে ভাষার কল্যাণে সারাবিশ্বে আজ মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। প্রত্যেকের মাতৃভাষা আজ মর্যাদা পেয়েছে এই বাংলা ভাষার পথ ধরে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর সেই ভাষা কি এই? কেন আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম? সেদিন উর্দু হরফ দিয়ে বাংলা লিখলে তো চলতো। তা ছিল আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আর আজ ইংরেজি লেটার দিয়ে বাংলা লেখাকে চাপিয়ে দিলো কে?
আবার লক্ষ করলে দেখা যাবে—বেশ কয়েক বছর ধরে এফএম রোডিওগুলো তাদের সম্প্রচারে বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে বিরক্তিকর উপস্থাপন করছে, তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলার ধরন আমাদের হতাশ করে। এসব দেখাদেখি টেলিভশনে কিছু বিজ্ঞাপন, কিছু গান এমনভাবে দর্শক-শ্রোতার কানে ঢুকছে, সেটা যে বাংলা ভাষার, তা বুঝতে অনেক কষ্ট হয়। যাকে বলে ইংরেজি সুরে বাংলা গাওয়া। এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই কারও। আমরা যত কষ্ট করে ইংরেজি শিখি, ইংরেজিতে কথা বলে নিজেদের ভদ্র সমাজের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি, তারচেয়ে অল্প শ্রম দিয়ে যদি বাংলার প্রমিত ব্যবহারে নিবিষ্ট হই, তবে এ ভাষার মধু আস্বাদন করা সম্ভব।
শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গেয়ে দায় এড়ালে চলবে না। যে ভাষার জন্য এত রক্ত, এত ত্যাগ সে ভাষার সঠিক চর্চা করতে না পারলে শহীদমিনারে ফুল দেওয়া মানে শহীদদের অপমান করা। ভাষা আন্দোলনের এত পরে এসেও সর্বত্র বাংলা ভাষার চর্চা যেখানে নিশ্চিত সম্ভব হয়নি (নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়নি) সেখানে ভাষা দিবস নিয়ে এত লাফালাফির সবটাই বৃথা। আমরা প্রত্যেকে যদি বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপারে সচেতন হই, তবেই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব।