(পর্ব-১৬)
এই দেশে কোনো সরকার আছে? ছিল? তোমার কি মনে হয়? দেখো, বাংলাদেশের ক্যাপিটাল সিটি ঢাকা। সেই ঢাকার পেট বরাবর চলে গেছে প্রাচীন একটা নদী, বুড়িগঙ্গা। সেই নদীটা কলকারখানার বর্জ্যে মারা যাচ্ছে, স্বচ্ছ টলটলে পানি ময়লায় একেবারে ঘন আলুভর্তা হয়ে গেছে, দুগর্ন্ধে বুড়িগঙ্গার তীরে এক মিনিট দাঁড়ানো যায় না, ভেসে যাচ্ছে পানির বোতল, বিচিত্র ধরনের পলিথিন নামক মৃত্যুদূত, এই নদীর তীরে ক্যাপিটাল সিটিতে বাস করেন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, ডজনে ডজনে মন্ত্রী, সচিব তো গুনে শেষ করা যাবে না। অথচ বাংলাদেশের হৃদপিণ্ড বুড়িগঙ্গাটা মনে যাচ্ছে কেউ দেখছে না, কেউ কোনো দায় পালন করছে না।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে অধ্যাপক মোবারক হোসেনকে কম্পিউটার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখেছেন জয়িতা রহমান। চোখ কম্পিউটারের পর্দায়। কিন্তু পর্দায় কিছু নেই। হালকা নীল রঙের দিকে চেয়ারে মাথা রেখে তাকিয়ে আছেন মোবারক হোসেন। জয়িতা রহমান দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে মানুষটাকে দেখে আসছেন, চব্বিশ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন, এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেন না। ঘুমের মধ্যেও কাজের প্রসঙ্গ নিয়ে বলেন, ওই মইনুল ফাইলটা দিলে না? তাড়াতাড়ি দাও।
সেই লোক চুপচাপ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কান খুব সজাগও মানুষটার। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন মিনিট খানেক কিন্তু ফিরে তাকাচ্ছেন না মোবারক হোসেন। তিনি রুমে আছেন। কেউ প্রবেশ করেছে অথচ অধ্যাপক মোবারক হোসেনের চোখে পড়েনি, এমনটা হওয়ার যো নেই। সেই মানুষ এত নির্লিপ্ত চোখে কম্পিউটারের নীল স্কিনের ওপর দৃষ্টি রেখে কী করছেন?
-তুমি কী করছ? লিখছ না কেন?
জয়িতা রহমানের কথায় চট করে নিজের মধ্যে ফিরে আসেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। স্ত্রী জয়িতা রহমানকে দরজায় দেখে কম্পিউটার থেকে চোখ ফিরিয়ে, এক ঝলক দেখে চেয়ারে শরীর ছেড়ে জিজ্ঞেস করেন, এই দেশে কোনো সরকার আছে? ছিল কোনো দিন?
কী অবাক প্রশ্ন! জয়িতা রহমান টেবিলের ওপর চায়ের প্লেট রাখতে রাখতে বলেন, কেন? কী হয়েছে? এতদিন পরে মনে হয় ঘুম থেকে জেগে উঠলে?
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দাঁড়ান বুয়েটের অধ্যাপক মোবারক হোসেন। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখে বলেন, অনেক স্বগোক্তির মতো করে, আজ সাত আট দিন ধরে আমি পনিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, যুগ্ম সচিব, মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অধিদপ্তর বিআইডাব্লিউটিএর দপ্তরে ঘুরলাম কিন্তু। থেমে গেলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
-থামলে কেন?
-কেউ দিতে পারলো না।
-কী দিতে পারলো না?
-ঢাকার সদঘাটের ইতিহাসটা।
-তুমি আবার ঢাকার ইতিহাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন?
বিরক্তি প্রকাশ করেন মোবারক হোসেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন থাকতে আমি ঢাকার ইতিহাস নিয়ে ব্যস্ত হবো কেন?
-বললে যে!
-তোমার সমস্যা কী, জানো? বলি একটা আমি, তুমি শোনো আর একটা। আমি সদরঘাটের ইতিহাস জানতে গিয়েছিলাম। তুমি সদরঘাটের সঙ্গে পুরো ঢাকার ইতিহাস নিয়ে এসেছ জয়িতা। সদরঘাট আর ঢাকা শহর কি এক হলো?
-কিন্তু তুমি হঠাৎ সদরঘাট নিয়ে পড়লে কেন?
আমার মনে অনেক দিনের একটা সুপ্ত বাসনা ছিল, সদরঘাট নিয়ে গবেষণা করার।
কপাল কুঁচকে যায় জয়িতা রহমানের, সদরঘাট নিয়ে গবেষণা করার কী আছে? রিটায়ার্ড করার পর মাথায় এক একটা ভূত চাপে আর ঠেলা সামলাতে হয় আমাকে। বাসায় একটা উটকো মানুষ আসবে তো আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। কাজের মানুষ নাই, এক কাপ চাও আমাকে বানাতে হয়, আর তিনি এখন গবেষণা করছেন সদরঘাট নিয়ে। তাই তো বলি, গত কয়েক দিন ধরে বাবু সকালে উঠে যায় কোথায়? বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান জয়িতা রহমান, সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে মারলে, নিজের মনে কর্কশ গলায় বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন জয়িতা রহমান।
যখন যাত্রীদের দেখে, তখনই বলে। যখন সেই যাত্রীদের মধ্যে মহিলা বা মেয়েদের দেখে, তখন আরও উৎসাহ নিয়ে বলে, আগে গেলে সামাদে, আগে গেলে সামাদে, বলছে না?
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের ওপর রেখে ড্রয়ার টেনে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রেখে, দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। লম্বা একটা টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ভেতরে টেনে নিতে নিতে বারান্দায় দাঁড়ালেন। বারান্দায় অনেক ফুলের টপ। অনেক ফুলও ফুটেছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে, অনেক আগেই। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। সিগারটে লম্বা টান দিয়ে অধ্যাপক মোবারক হোসেন আপন মনে হাসেন, জয়িতা এখন বেডরুমে গিয়ে যে কাজটা করবেন, তিনি জানেন। প্রথম কাজটা হবে চট্টগ্রামে বড় মেয়ে নিলীমাকে ফোন করে কয়েক মিনিট অধ্যাপকের নতুন ফ্রন্ট, সদরঘাট গবেষণা নিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়ে বলবেন। সেই সূত্রে চট্টগ্রাম থেকে নীলিমা ফোন করবে বাবাকে।
শেষে ফোন করবে জয়িতা রহমান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছেলে কাননকে। কানন মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনবে এবং বলবে, মা চিন্তা করো না। আমি এখনই বাবাকে ফোন করছি। কিন্তু কানন ফোন করবে আরও দু একদিন পরে।
সদরঘাট সর্ম্পকে গবেষণার বিষয়টা মাথায় আসে গত মাসে, একটা পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে। বলা হয়েছে, এই সদরঘাট থেকে প্রতিদিন লঞ্চ যোগে প্রায় এক লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এই লাখ যাত্রীর যাতায়াতের একমাত্র বাহন লঞ্চ। বিচিত্র প্রকারের লঞ্চ চলাচল করে সদরঘাট থেকে। যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সর্বত্র। এখনো সস্তায় নিরাপদ যাত্রা বলতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে সদরঘাট থেকে লঞ্চে যাওয়া আসাই প্রিয়। যদিও মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু মানুষের প্রযোজনে যাত্রা রোখার কোনো বিকল্প পথ এখনো গড়ে ওঠেনি। বরং এখন দোতলার জায়গায় তিনতলা বিলাশবহুল লঞ্চ বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে ঢাকা টু বরিশাল, লালমোহন, ভোলা, ভানডারিয়া, বাগেরহাটের পথে চলাচলকারী লঞ্চগুলো অনেক আধুনিক হয়েছে। কয়েকটি লঞ্চে লিফটও ব্যবহার করা হচ্ছে।
লঞ্চে লিফট ব্যবহার করা হচ্ছে! নিজের মনেই চঞ্চল হয়ে উঠলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। দেখা দরকার তো! সত্যি, স্বাধীনতা বাঙালিদের অনেক দূর নিয়ে গেছে। যদিও ঢাকার রাস্তাঘাটে চলাচলের সময়ে এই শহরটাকে বড় এলোমেলো, অনিয়ন্ত্রিত বিশাল একটা বস্তি ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
সকালে পত্রিকার খবরটা পড়েই বেরিয়ে পড়লেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। গাড়ি নিলেন না। ড্রাইভারও আসেনি। ছুটির দিন। অনেক দিন যাওয়া হয় না সদরঘাটে। সেই পনেরো ষোলো বছর আগে একবার বরিশাল গিয়েছিলেন লঞ্চে, সে ভয়ংকর তিক্ত অভিজ্ঞতা। বরিশাল শহরের প্রিয় ছাত্র অমলেন্দু ঘোষের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। ওর বাবা বরিশাল শহরের নাম করা উকিল। মেইন রোডে নিজেদের বাড়ি। অমলেন্দু ঘোষ মেধাবী ছাত্রও। চাকরি না করে একটা ফার্ম খুলে বসেছে। বুয়েটের শিক্ষক, ওর বন্ধু-বান্ধব মিলিয়ে ত্রিশ জনের একটা দল। যেহেতু সিনিয়র অধ্যাপক, নেতৃত্ব পড়লো অধ্যাপক মোবারকের ওপর। তিনি ভাবলেন বড় বড় ছাত্র, শিক্ষকেরা দায়িত্বশীল। নিশ্চয়ই পথে কোনো সমস্যা হবে না। আর অমলেন্দুর বাবা শীর্ষেন্দু ঘোষ ঢাকা টু বরিশালের বিরাট একটা লঞ্চের অর্ধেকটাই রিজার্ভ করে দিলেন। ছেলের বন্ধু আর পরম শিক্ষকেরা আসবে বিয়েতে তিনি টাকা ব্যয় করতে কার্পণ্য করেননি।
দুপুরের পর খেয়ে-দেয়ে একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জামা কাপড় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। পনেরো ষোলো বছর আগে ঢাকা শহরে ভিড় ছিল ঠিকই কিন্তু এতটা ছিল না। ঢাকা শহরের নাম এখন হওয়া উচিদ শ্রেফ জ্যামঢাকা। গাড়ি এসে সদরঘাটে থামলে তিনি ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলেন সদরঘাটে। গাড়ি ফিরে যায় বাসায়। দুই টাকার টিকিট কেটে ঢুকলেন সদরঘাটে। আগে কখনো ঢোকেননি। লঞ্চেও ওঠেননি। দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডা গেছেন বিমানে। কিন্তু কোথাও জলপেথ যাওয়ার প্রযোজন হয়নি। জীবনে প্রথম জলপথে ভ্রমণ! একটু রোমাঞ্চও অনুভব করছেন। প্রবেশ করলেন টার্মিনালে। প্রচুর লোক দেখতে পাচ্ছেন তিনি। পোষাক দেখে এবং চিৎকার শুনে বুঝেছেন, এরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষ, যাদের হাতে শ্রমে গড়ে উঠছে ঢাকা, সচল থাকছে ঢাকা।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বড় টার্মিনালের ওপর দাঁড়াতেই দেখলেন, আগে থেকেই টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস জয়নাল আর অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। আরও আছেন অধ্যাপক গোবিন্দ হালাদার, গোবিন্দ হালদারের স্ত্রী, মেয়ে সুকন্যা। আর অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন। কয়েকজন ছাত্র দূরে দাঁড়িয়ে বাদাম খুঁটছে। অধ্যাপক মোবারক হোসেনকে দেখে ছাত্রদের মধ্যে থেকে জসিমউদ্দিন এগিয়ে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নেয়, স্যার! চলুন।
-কোথায় যাবো?
-লঞ্চে স্যার।
-আমাদের জন্য লঞ্চ কোনটা?
-এই তো সামনে স্যার। সব চেয়ে বড় লঞ্চ এমভি সামাদ।
তাকিয়ে দেখেন বিরাট একটা লঞ্চ সদরঘাটের টার্মিনালের দাঁড়িয়ে অনেক লঞ্চ ছাড়িয়ে। লঞ্চটা তেলটানা ট্যাংকার। তেল বহনের পাইপ আর যন্ত্রপাতি তুলে ট্যাংকারটাকে যাত্রীবাহী লঞ্চে পরিণত করেছে মালিক। জয়নাল আবেদীন এগিয়ে এসে বলেন, বুঝলেন মোবারক ভাই আমি কোনোদিন লঞ্চে যাতায়াত করিনি। পানির পথে আমার বড় ভয়। কিন্তু বিরাট এই জাহাজ দেখে আর ভয় নেই। আমি ভেতরে উঠে সব দেখে এসেছি। রুমগুলোও বেশ বড়। ঢাকা শহরের বাড়ির ড্রয়িংরুমের মতো এক একটা রুম।
-তাই নাকি?
অধ্যাপক মোবারকের প্রশ্নের জবাবে বলেন জয়নাল আবেদীন, হ্যাঁ। আপনার ভাবি অবশ্য যাচ্ছে অন্য কারণে। ক্যাম্পাসে অবশ্য কানাঘুষা আছে, হাইড্রোলিক ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন বৌয়ের আদেশ নিষেধ ছাড়া কোথাও একপা বাড়ান না।
-অন্যকারণটা কী?
কানের কাছে মুখ এনে বলেন জয়নাল আবেদীন, আপনারা জানেন না একটা ঘটনা। অবশ্য আপনার ভাবিই না করেছিল। আপনার ভাবি মানে রিজিয়া পারভীন কবিতা লেখে।
চোখ বড় বড় করে তাকান মোবারক হোসেন, বলেন কী? ভাবি কবিতা লেখেন?
-হ্যাঁ। কিন্তু খুব গোপনে। রাত জেগে খাতার পর খাতা কবিতা লেখেন রিজিয়া। আবার কবি জীবনানন্দ দাশ ওর ভীষণ প্রিয়। বরিশাল যাবো শুনে আমার সঙ্গে যাবার জন্য বায়না ধরেছে, আমার সঙ্গে যাবে। উদ্দেশ্য, কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়িটা দেখা। দশটা না পাঁচটা না, একটা মাত্র বৌ, না করি কী করে? তাছাড়া জলের ওপর বিহার, বললাম চলো। দুজনে চলে এলাম।
-বেশ করেছেন। চলুন, এবার লঞ্চে ওঠা যাক। জসিমউদ্দিন ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অধ্যাপক মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে একটা হয়ে লঞ্চে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। দোতলায় উঠে ভালোই লাগে। প্রতিটি রুম সাজানো গোছানো। বড় একটা রুমে তিন জনের থাকার জন্য বেড পাতা, বেডের সঙ্গে চেয়ার টেবিল রাখা। রুমে ছোট্ট একটা ফ্রিজও আছে। রুম নম্বর একাত্তর। রুমে ঢুকে অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন আর মোবারক হোসেন দুটি সিট দখল করে কেবল বসেছেন, হৈ চৈ করে ঢুকলেন অধ্যাপক মতিন বৈরাগী। মতিন অধ্যাপক মোবারকের ছাত্র। রেজাল্ট ভালো করায়, অনেকটা মোবারকের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় বছর পাঁচেক আগে। মতিনের বাড়ি বরিশালের পিরোজপুর শহরে। মতিন দিলখোলা টাইপের মানুষ। রুমে ঢুকে বাকি বেডটায় হাতের ব্যাগটা রেখে বলে, চলুন স্যারেরা বাইরে যাই। আপনারা তো লঞ্চে প্রথম চড়লেন। দেখুন, কেমন করে লঞ্চ ব্যাগার দেয়।
-ব্যাগার দেয় মানে কী? চোখ তুলে তাকান অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন।
সদরঘাটের টার্মিনালের সঙ্গে সোজা নাক লাগিয়ে থাকা এম ভি সামাদ কিভাবে সদরঘাট থেকে পিছনে যায়, এই পিছনে যাওয়াটাকেই ব্যাগার বলে। চলুন, দেখবেন। লঞ্চে উঠে রুমে আটকে থাকতে আমার ভালো লাগে না। চলুন বাইরে যাই।
-চলো, আমারও ভালো লাগে না রুমের মধ্যে থাকতে, মতিনের সঙ্গে দাঁড়ায় মোজাফফর হোসেন। তাকায় অধ্যাপক মোবারকের দিকে, আপনি কী করবেন?
-আপনারা রুমে না থাকলে আমি একলা থাকবো না কি! হাসতে হাসতে রুমের দরজার দিকে এগিয়ে যায় মোবারক হোসেন।
তিন জনে রুম থেকে বের হয়ে লঞ্চের সামনে দাঁড়ায়, দোতলায়। দোতলায় দাঁড়িয়ে গোটা সদরঘাটের একটা মানচিত্র চোখে ধরা পড়ে। আশেপাশে আরও কয়েকটা লঞ্চ দাঁড়ানো। ঢাকা টু হুলারহাটের একটা লঞ্চ জলকাপোত ব্যাগার দিয়ে সদরঘাটের টার্মিনাল ছেড়ে পিছনে চলে যায়। এই প্রথম অধ্যাপক মোজাফফর আর অধ্যাপক মোবারক কোনো লঞ্চের ব্যাগার দেখলেন।
দুজনে জলকাপোতের ব্যাগার দেখে সামনের দিকে তাকান। সিঁড়ি বেয়ে পিপড়ার সারির মতো লোক মানে লঞ্চের যাত্রীরা আসছে। লঞ্চের সামনের খালাসিরা চিৎকার করে যাত্রী ডাকছে। অধ্যাপক মোজাফফর তাকিয়ে দেখেন মিটি মিটি হাসছে মতিন।
-তুমি হাসছ কেন?
-এমনি স্যার!
-এমনি এমনি কেউ কেউ হাসে না কি? বলো, কিসের জন্য হাসছ?
-স্যার আপনি নিচের দিকে তাকান এবং সামাদ লঞ্চের খালাসিরা কী বলছে, মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
মতিনের কথায় অধ্যাপক মোজাফফর এবং অধ্যাপক মোবারক হোসেন নিচের দিকে তাকান। ইতোমধ্যে লঞ্চটায় যাত্রীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। এমভি সামাদ লঞ্চের ৩ জন খালাসি লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে শরীর বাঁকা করে দুই হাতে আগত যাত্রীদের সামাদ লঞ্চে ওঠার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ওরা সুর করে একই তালে বলছে, আগে গেলে সামাদে, আগে গেলে সামাদে।
-ওরা ভুল কিছু বলছে? মতিনকে প্রশ্ন করেন মোবারক হোসেন।
-না, ওরা ঠিকই বলছে কিন্তু সূক্ষ্মভাবে শুনলে অন্যরকম একটা ঘটনার বা মজার স্বাদ পাওয়া যায় স্যার।
-তোমার কথা বুঝতে পারছি না, বলেন মোজাফফর হোসেন, যা বলবে ক্লিয়ার করে বলো।
-হ্যাঁ, ক্লিয়ার করো, অনেকটা আদেশের সুরে বলেন মোবারক হোসেন।
-হ্যাঁ বলাই যায়, আমরা তো প্রত্যেকে অ্যাডাল্ট এবং বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে জানি। স্যার, আপনারা লক্ষ করুণ, সামাদ লঞ্চের খালাসিরা কখন বলে, আগে গেলে সামাদে! যখন যাত্রীদের দেখে, তখনই বলে। যখন সেই যাত্রীদের মধ্যে মহিলা বা মেয়েদের দেখে, তখন আরও উৎসাহ নিয়ে বলে, আগে গেলে সামাদে, আগে গেলে সামাদে, বলছে না?
ছাদে উঠে চার দিকে তাকিয়ে সবাই ভীষণ উৎফুল্ল। বুড়িগঙ্গার দুই পার দেখছেন, দেখছেন দুই পারের মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা।
দুই অধ্যাপক কয়েক মিনিট মতিনের কথানুসারে লক্ষ করে বুঝতে পারে, মতিনের কথা অনেকটাই সত্য। কিন্তু দুজনে এই ঘটনার মধ্যে হাসির কোনো উপাধান খুঁজে পেলেন না। তাকায় মতিনের দিকে অধ্যাপক মোবারক, কিন্তু হাসির কোনো সূত্র খুঁজে পেলাম না মতিন।
-স্যার, কিছু মনে করবেন না, বরিশাল অঞ্চলের মানুষের নারীর যৌনাঙ্গকে ছামা বলে।
মোজাফফর হোসেন বলেন, হতেই পারে। একেক অঞ্চলের ভাষা শব্দ। বলতে বলতে তিনি থেমে যান এবং উচুঁ পেট ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে শুরু করেন। সঙ্গে হাসতে থাকেন অধ্যাপক মোবারকও। ওদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় মতিন।
হাসতে হাসতে তিন জনে প্রায় কাহিল। সামনে এসে দাঁড়ান অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার, কী ঘটনা? এত হাসির কি হলো? গোবিন্দ হালদারকে দেখে মতিন লঞ্চের পেছনের দিকে সরে দাঁড়ায়। গোবিন্দ হালদার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। একটু রাশভারী।
-দুই অধ্যাপক মিলে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলেন ঘটনাটা। আগে গেলে সামাদে। সামাদ লঞ্চের সাম শব্দটাকে ছামা উচ্চারণ করলেই। তিনিও হাসতে শুরু করেন। তিন অধ্যাপকের হাসি যখন শেষের দিকে, মুড়িঅলা এসে দাঁড়ায় সামনে, স্যার মুড়ি খাবেন কে কে?
-মুড়ি? খাওয়া যায়। একটুঝাল দিয়ে বানাও। বলেন মোজাফফর হোসেন। তাকান গোবিন্দ হালদারের দিকে, খাবেন আপনি?
-না দাদা, পেটটা ভালো না। অধ্যাপক মোবারককে দিন। উনি ঝাল মুড়ি পছন্দ করেন।
দুই অধ্যাপক মিলে যখন ঝালমুড়ি চিবোচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে বিকেল সাড়ে সাড়ে পাঁচটায় ঢং ঢং ঢং শব্দ তুলে বিরাট সামাদ লঞ্চটা সদরঘাটের টার্মিনাল ছেড়ে ব্যাগার দিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে। তিন জনে লঞ্চের রেলিংঘিরে লঞ্চের পেছনে যাওয়াটা দেখছেন আর মুড়ি চিবাচ্ছেন। মুড়িঅলা মুড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে ডাকেন অধ্যাপক গোবিন্দ, এই মুড়িঅলা! টাকা নিয়ে যাও।
-স্যার, আমি দিয়ে দিয়েছি, সামনে এসে দাঁড়ায় মতিন।
ছাত্র মুড়ির দাম দিলে তো আর কিছু বলার থাকে না। ৪ জনে মিলে বিশাল সামাদ লঞ্চটার যাত্রা শুরুর মুহূর্তটা উপভোগ করছেন। মিনিট খানেক পেছনের দিকে গিয়ে বিকট শব্দের সঙ্গে লঞ্চটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় বুড়িগঙ্গার জলের ওপর, কয়েক মুহূর্ত লঞ্চটা নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করে দৈত্যর গতিতে। লঞ্চের সামনে প্রচুর যাত্রীদের আনাগোনা। বিচিত্র ধরনের যাত্রী। কয়েকজন যাত্রী রুমের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার এনে বসে। একজোড়া তরুণ তরুণী এসে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটা মেয়েটা বুকে যখন-তখন হাত দিচ্ছে। মেয়েটা হেসে হেসে প্রশয় দিচ্ছে। অধ্যাপকেরা দেখলেন, এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। মুড়ির ঠোঙ্গা পানিতে ফেলে মোজাফফর বলেন, অনেক দেখেছি। চলুন রুমে যাওয়া যাক।
-হ্যাঁ, রুমে চলুন। সমর্থন করেন অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার।
-কিন্তু স্যার রুমের চেয়ে ছাদে চলুন, সন্ধ্যার এই মুহূর্তটা ভালো লাগবে। প্রস্তাব দেয় আবদুল মতিন।
-চলো যাই, যখন জার্নিতে বের হলাম, সবটুকুই উপভোগ করা দরকার, বলেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন। মতিন, তুমিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও। তুমি বরিশালের ছেলে, লঞ্চে আসা যাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা।
-জি স্যার চলুন, আবদুল মতিন তিন অধ্যাপককে পথ দেখিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে নিয়ে যায়। ছাদে উঠে চার দিকে তাকিয়ে সবাই ভীষণ উৎফুল্ল। বুড়িগঙ্গার দুই পার দেখছেন, দেখছেন দুই পারের মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা।
-হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, মতিন আকাশটা মেঘলা মনে হচ্ছে না?
স্যার এই সময়ে আকাশে একটু আধটু মেঘ থাকে, ভয়ের কিছু নেই।
চলবে…