পৌষের রাত। এদিকটায় নদী পথ ছাড়া কবরেজের বাড়ি যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। ঘন কুয়াশায় হাতখানেক দূরেই কিছু দেখা যাচ্ছে না। বরকত মাঝি ঘাটে বাঁধা নাওয়ের দড়ি খুঁটি থেকে খুলছে। ওদিকে তৈয়ব আলী তার বউ আর ভাতিজা আলমগীরকে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসেছে। তৈয়ব আলীর বউয়ের আচরণ অদ্ভুত রকমের। জোরে চিৎকার করে হাসছে আবার কখনো কাঁদছে। মাঝে মাঝে জিহ্বা বের করছে। চোখদুটো বিশালাকার আর আগুনের মতো জ্বলছিল মনে হয় কপাল থেকে বেরিয়ে আসবে। তৈয়ব আলী আর তার ভাতিজার মুখে দোয়া ইউনুস আর আয়াতুল কুরসির রব। এমন অবস্থা দেখে বরকত মাঝি তড়িঘড়ি করে নাও ঠেলে উঠে বসলো। তারপর দ্রুত বৈঠা নদীর জলে ফেলে উত্তর দিকে ভাসতে শুরু করলো।
গাঁও-গেরামে মানুষ সন্ধ্যের খানেক বাদে ঘুমিয়ে যায়। প্রবল শীত পড়লে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকেই বেরোয় না। এরমধ্যে বরকত মাঝিকে বাড়ি থেকে ডেকে তোলা হয়েছে। বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরে টিমটিমে কুপি বাতি জ্বালিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমে বিভোর ছিল বরকত মাঝি। তৈয়ব আলী ও তার ভাতিজা আলমগীরের ডাকাডাকিতে বরকত মাঝির স্ত্রী পারুলের ঘুম ভেঙে যায়। বারবার ডাকাডাকির কারণে পারুল ঘর থেকে বলে ওঠে, কে? কী কন? ও মিল্লাতের বাপ দেখেন দেখি কে ডাকাডাকি করে! তখন বরকত মাঝি বিছানা ছেড়ে হাতে কুপি বাতি নিয়ে ঘরের কপাট খুলে বের হয়। তৈয়ব আলীকে দেখে বলে, কী কন? বউটার ওপর মনে হয় জ্বিনের আছর হইছে। তাড়াতাড়ি কবরেজের বাড়ি নেওয়া লাগবি। তুমি তাড়াতাড়ি লও বরকত। তৈয়ব আলী গেরামের বড় ব্যাপারী। পয়সাওয়ালা লোক। মাঝির সঙ্গে তৈয়বের সম্পর্ক ভালো থাকায় বরকত মোটা সোয়েটার আর চাদর গায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। পৌষের সময় এমনিতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। এমন সময় রাতে বাতাসকে ঠাণ্ডা জলীয় বাষ্প আরও বেশি ঠাণ্ডা করে তোলে।
নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে যেতে সময় লাগে মিনিট পনেরোর মতো। তৈয়ব আলী তার বউকে শক্ত ধরে রেখেছে আর মাঝে মাঝে বলছে ও বরকত তাড়াতাড়ি নাও বাও, আবার ফিরতে হবে যে। বরকত মাঝি হাত নেড়ে বৈঠা ঠেলছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ওপাশে চলে গেলো। নৌকা থেকে নামার পর বরকত মাঝি খুঁটি গেঁথে নাও বাঁধছিল। তৈয়ব আলী তার বউকে ধরেই নৌকা থেকে নামলো। আলমগীর খানেক বাদে। চাচা বরকত মাঝিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই তৈয়ব আলীর উদ্দেশে আলমগীর বললো, ও এখানেই থাকুক তুই সাথে আয়। এরপর দ্রুত হাঁটতে থাকে তৈয়ব। খুঁটিতে দড়ি পেঁচাতে পেঁচাতে বরকত বললো, সাথে আমিও যাই চাচা, কখন কী দরকার লাগে। তৈয়ব এবার কোন কথা বলে না। বরকত মাঝি তাদের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে।
কচি মাইয়া, খালি বাপের বাড়ি যাবার চায়, বায়না ধরে। কয় দিন ধরে রাতে কান্নাকাটি করে, হাসে, আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। আইজ আর সহ্য করতে পারছি না।
এপাশে ঘাট থেকে নামার পর আরও বেশ কিছু পথ হাঁটতে হয়। নদীর এপাশের গ্রামের নাম মাঝগ্রাম। মাটি, টিন আর বেড়া দিয়ে যে যার সাধ্যমতো বাড়ি করে মাথার গোজার ঠাঁই করেছে। প্রতি মঙ্গলবার এই গ্রামে হাটের দিন। একটা পাকুড় গাছের নিচে টিনের তৈরি ঘরে হাটের দিন নুরুল কবরেজ বসে রোগীদের ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ, পলিতা দেয়। একদিন হঠাৎ করেই নুরুল কবরেজের নাম ফুটিয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। মাঝগ্রাম ও নদীর ওপাশের গ্রামের লোকজন ছাড়াও আরও দূর থেকে মানুষ কবরেজের কাছে চিকিৎসা নিতে আসে। নুরুল কবরেজ গ্রামের মহিলাদের কাছে বিখ্যাত হয়েছিলেন মূলত স্বামীকে বশ করা, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান, বাঞ্জা রমণীদের পোয়াতি করা, প্রেমে ব্যর্থদের জন্য জিন দিয়ে তদবির করে। এসবের চিকিৎসাগুলোও কেমন কেমন!
স্বামীকে বশিভূত করতে হলে স্বামীর বালিশে তাবিজ রাখতে হবে, শোবার ঘরের এক কোণায় তাবিজ পুঁতে রাখতে হবে। তেলপড়া দেবে, চিনি পড়া, পানি পড়া, লবণ পড়া দেবে। সেগুলো গোপনে স্বামীকে খাওয়াতে হবে। আবার মাঝে মাঝে স্ত্রীকে তার রজঃস্রাবের রক্ত, পেশাব অথবা শরীরের গোপন স্থানের চুল নিয়ে যেতে বলা হয়, সেগুলোতে ঝাড়ফুক দিয়ে দেয় নুরুল করবেজ। মহিলারা তেলপড়া, চিনিপড়ার চাইতে এসব পড়িয়ে নিয়ে যেতে বেশি পছন্দ করে। তাদের বিশ্বাস অন্যগুলোর চেয়ে এসবে কাজ বেশি হয়। আর শাশুড়িকে বশ করার জন্য শাশুড়ির মাথা বা ঘাড়ের চুল সংগ্রহ করে কবরেজের কাছে যেতে হয়, শাশুড়ি যে বঁটিতে তরকারি কাটে সেই বটি নিয়ে গিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। আর টাকি মাছের বুক চিরে তার ভেতরে প্রেমিক বা প্রেমিকার নামে তৈরি তাবিজ আটকে দিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার বাড়ির আশপাশে যে পুকুর আছে সেই পুকুরে মাছটি ছেড়ে দিতে হয়। আবার অনেক সময় গভীর রাতে পুরনো কবরেও তাবিজ পুঁতে রাখতে হয়। তাহলে প্রেমিকাকে হাছিল করা যায়, এটা মানুষের মুখে মুখে রটনা আছে। এই কাজটা শুধুমাত্র প্রেমিকরাই করে থাকে। প্রকৃত প্রেমিক ছাড়া গভীর রাতে গোরস্থানে গিয়ে তাবিজ পুঁতে রেখে আসার মতো সাহস আর কয়জনা’র আছে?
গতকাল মঙ্গলবার চলে গেছে। হাটের দিন কবরেজের দোকান রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জিনে কালকে আছর করলেই আজ আর এত ঝক্কি পোহাতে হয় না। হাট পেরিয়ে যেতে যেতে তৈয়ব আলীর আফসোস মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল। শীতের রাতে এমনি দিন বাড়ি ছেড়ে কেউ বের হয় না। হাটের দিন এই সময় কিছু লোককে জটলা বেঁধে গুনগুন করে গল্প করতে দেখা যায়। উপায় নেই। তাই তৈয়ব হনহনিয়ে হেঁটে চলছিল।
-ও বরকত মাঝি, তুমি এলে যে? নাওটা ঠিকঠাক মতো থাকবে তো? নাওটার কিছু হলে বিপদে পড়ে যাবো যে! তোমারে বললাম তোমার এসে কাজ নেই। তুমি তারপরেও পিছু হাঁটা নিলে?
-নাও ঠিকমতো বেঁধে আসছি চাচা, কিছু হবি না। আপনারা নিজেরই লোক, বিপদে যদি সাথে না যাই কেমন লাগে?
-তৈয়ব আলী আর কিছু বললো না।
-বুঝলেন চাচা, সেদিন এক জিনে ধরা রোগীকে নুরুল কবরেজ যে পিডানটাই না দিলো। বেচারার তো জ্বর ৫ দিনেও যায় না। শেষে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগছে। পিডান দেওয়ার পর তা জিন ছাড়ছে, তয় মাইয়াডার শরীরে খুব ব্যথা লাগছে। ৩ দিন তো জ্বরে ঠিকমতো কথা কইতে পারে না। ওর বাপ মা খালি মাথায় পানি ঢালে। পরে যখন শরীরটা কেমন সাদা হয়ে গেলো, তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করছে।
-কোন গেরামের, কার মাইয়া?
-ওই পূবপাড়ার হাফিজ দোকানির মাইয়া! তা এখন ভালো আছে।
-জিনে ধরার পর কী রকম করতেছিল?
-শুনছি, সারাদিন মনমরা হইয়া বইসা থাকতো। কারো লগে ঠিকঠাক মতন কথা কইতো না। মাঝে মাঝে রাত্রি বাইরে যাইতো। মাঝে মাঝে একা একা জানালার পাশে গিয়া কথা কইতো।
-জানালার পাশে কথা কইতো? কার লগে?
-শুনছি, ওর জানলার পাশে ওর দাদির কবর। কবরের পাশে একটা বড়ই গাছ আছে নাকি। ওর দাদি নাকি ওরে খুব ভালবাসতো। দাদি মরে গেছে শুনছি মেলা দিন আগে। ওপরে আল্লাহ আর নিচে নুরুল কবরেজ মিলে মাইয়াডারে বাঁচাইছে। মানুষ মরে গেলে কথা কয় কেমনে? তয় চাচা, একদিন একটা পোলাকে সন্ধ্যের পর বরই গাছতলায় লোকজন দেখে কে কে কইতেই পোলাডা পালায় গেছে।
-ভালোই খবর রাখো তো বরকত। তাড়াতাড়ি পা চালাও আলমগীর। আর বেশিদূর পথ নাই। শীতের রাইত কষ্ট হইতাছে জানি। কিন্তু কবরেজের কাছে না নিয়ে গেলে হইতো না।
গল্প করতে করতে তারা কবরেজের বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। পথিমধ্যেও তৈয়ব আলীর স্ত্রী উচ্চস্বরে হাসছিল আর কান্না করছিল। কবরেজের বাড়ির কাছে আসতেই তৈয়ব আলীর স্ত্রী একদম ঝিমিয়ে গেলো। মুখে কোনো কথাবার্তা নেই। চুপচাপ একদিকে তাকিয়ে আছে। কবরেজের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে তৈয়ব বললো, কবরেজ কি বাড়িতে আছ? আবার কড়া নাড়লো। খানেক বাদে কবরেজ দরজা খুলে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো, কার অসুখ? আজ না এলে হইতো না?
-না কবরেজ আজ না এলে হইতো না। বউডা সকাল থেকেই খুব কান্নাকাটি আর চিৎকার করছিল। খালি বাপের বাড়ি যাওয়ার চায়। মাইয়া দুটোক বিয়ে দেওয়ার পর আগের বউ মারা গেলো। এরে বিয়া করছি ৮ মাস হলো! কচি মাইয়া, খালি বাপের বাড়ি যাবার চায়, বায়না ধরে। কয় দিন ধরে রাতে কান্নাকাটি করে, হাসে, আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। আইজ আর সহ্য করতে পারছি না। সন্ধ্যার আগে থেকে খুব চিৎকার করে কাঁদুনি দিচ্ছে আর হাসছে। বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। বউডারে একটু দেখবে, কী হলো!
-হুম! মনে হয় জিনে ধরেছে। ঘরে গিয়া বসো। আমি আইতেছি।
-দেখছেন চাচা, কবরেজকে দেইখাই চাচির জিন পালাইছে, ফিসফিস করে বললো আলমগীর।
নুরুল কবরেজের দাওয়াখানা বেশ বড়সড়ো। রাত্রিবেলার জন্য বেশি আলোর ব্যবস্থা নেই। তৈয়ব আলী তার বউ ও ভাতিজাকে নিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করছিল নুরুল কবরেজের জন্য। বরকত মাঝিও চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে বসেছিল। খানেক বাদে নুরুল কবরেজ ঘরে প্রবেশ করলো। গায়ে মোটা শাল, লুঙ্গি পরিহিত নুরুল কবরেজের এক হাতে লম্বা বাঁশের বেত আর এক হাতে হারিকেন। এবার ঘর একটু বেশি আলোকিত হলো। কবরেজ চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রেখে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। বড় বড় চোখ করে তাকালো তৈয়বের বউয়ের দিকে। তারপর বললো কী হইছে তোর? কই থেকে আইছিস? তৈয়বের বউ কোনো কথা বললো না। বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞেস করার পরেও তৈয়বের বউয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কবরেজ রাগে গরগর করতে শুরু করলো। এবার ধমকে উঠলো কবরেজ। ঠিকঠাক জবাব দে কইতাছি না হইলে শুকনো মরিচ পোড়া নাকে ধরলে এমনি এমনি সব বাড়ায়া আসবি।
তৈয়ব আলীর বউ তারপরেও নড়ে না, কথা কয় না। নুরুল কবরেজ নিচ থেকে একটা থলে বের করে তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিল। হঠাৎ চোখ খুলেই কবরেজ তৈয়ব আলীর বউয়ের হাত খপ করে ধরে ফেললো। তৈয়ব আলীর বউ চিৎকার করে বলে উঠলো, ছাড়েন, ছাড়েন আমারে। আমারে মাইরেন না। দোহাই লাগে। ১৫ কী ১৬ বছর বয়সী হবে তৈয়ব আলীর বউ। কণ্ঠটাও বাচ্চাদের মতন। নাম রোখসানা। বাবার বাড়িতে খুব আদুরে আর জেদি ছিল রোকসানা। ইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। বাপের সহায় সম্পত্তি বেশ ভালো। নিজের জমিতে ধান চাষ করে রোজগার করে দিনযাপন করে রোখসানার বাবা ময়েন মিয়া। মেয়ের আবদার ছোটবেলা থেকে কোন দিন অবহেলা করেনি।
আমি পিডায়ে মারলে জেল হবো, জরিমানা হবো, আর কেউ বিয়ের জন্য মাইয়া দেবো না। কাজটা তোমাকেই করতে হবে কবরেজ।
একদিন গ্রামের সফি নামের এক বৃদ্ধ খবর দিয়ে গেলো, ‘ময়েন তোর কপাল পুড়িছে, তোর মাইয়া দেখ কি কাণ্ড ঘটালো, ছি! ছি! ছি! অমন বেয়াহা মাইয়া এই গেরামে আর নাই। আমাগো মাইয়া হইলে মুখে বিষ ঢাইলা মাইরা ফেলাইতাম। তোর মাইয়াডাক বিয়া করবি কেডা?’
এতসব কথা শোনার পর ময়েন মিয়া জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধকে কী হইছে চাচা? কী করছে রোখসানা? ‘তোর মুখে চুলকালি মারিছে, যা গিয়া দেখ, আফজালের পোলার লগে কী রঙ-তামাশা করিছে। দিনের বেলায় পোলাডার মুখের সাথে মুখ লাগায়া চুমা খাইছে। কোন লজ্জা নাই! ছি! ছি! ছি! হামি যাই মাতব্বরেক খবরডা দিয়া আসি।’ সফিকে ময়েন বার বার হাতে পায়ে ধরার পরেও সফি মাতব্বরকে বিষয়টা জানায়। পরে গ্রাম্য শালিশে ময়েনের পরিবারকে একঘোরে করে রাখা হয়। সঙ্গে শোনানো হয়, রোখসানাকে এই গ্রামের কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যাবে না। সে যে অপরাধ করেছে তাতে করে অন্য গ্রামের কোনো বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দিলেই তাদের একঘোরে থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। বিয়ের আগ পর্যন্ত রোখসানার প্রেমিককে গ্রাম ছাড়া করা হবে। তারপর একদিন রোখসানার বিয়ে হয় তৈয়ব আলীর সঙ্গে।
কবরেজ রোখসানার হাত শক্ত করে ধরে মুচড়ে দিচ্ছিল। ব্যথায় চিৎকার করে রোখসানা কিন্তু কবরেজ তার হাত ছাড়ে না।
-তুই কে, কই থেইকা আইছিস এসব প্রশ্ন করেই যায়।
-কইতাছি কইতাছি হাতটা ছাড়েন, ব্যথা লাগতাছে। আগে সবাইকে বাইরে যাইবার কন, আমি কইতাছি।
কবরেজ সবাইকে বাইরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলে তৈয়ব আলী সবাইকে নিয়ে বাইরে যায়। ঘর ফাঁকা হলে কবরেজ প্রশ্ন করে, এবার ক কে তুই, কই থেইকা আইছিস শুনি?
-কবরেজ, আপনি আমার চাচার মতন। আমারে মাইরেন না। আমারে জিনে ধরে নাই। আমি একটা পোলাকে ভালোবাসি। সেই পোলাও আমারে ভালোবাসে। আমরা একে অন্যকে ভালবাসি জন্যে গেরামের মাতব্বর আর লোকজন আমার পরিবারকে একঘরে করে রাখছিল। ওই পোলাডাক আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত গ্রাম ছাড়া করছিল। পোলাডা এখনো আমাকে ভালোবাসে। আমিও ভালোবাসি। আমরা বিয়ে করার চাই। গেরামের লোকজনের ভয়ে ডরে আব্বা এই বুড়ো লোকটার সাথে বিয়ে দিছে। আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসে। বাপের বাড়িত গেলে বাপ খুব কান্দে। চাচা আমি কথা দিছি ওকে ওর সাথে পালায়া যামু। আমাক মাইরেন না। পোলাডা কালকে আমাদের গেরামে আসবি। আমি বাপের বাড়ি যামু। আমাক মাইরেন না। বুড়োডা বাপের বয়সী জন্য সব খুলা কইছি। তারপর থেকে আর বাপের বাড়ি যাবার দেয় না। ওই পোলার বন্ধু কাল আমাকে জানায় গেছে ও কালকে আমার জন্য অপেক্ষা করবি। আমাকে মাইরেন না কবরেজ। ওরে ছাড়া আমি বাঁচুম না।
দরজার পাশ থেকে তৈয়ব আলী গলা খাকারি দিলো। শুনতে পেরে নুরুল কবরেজ বললো ভেতরে এসো তৈয়ব। ভেতরে এসে তৈয়ব রোখসানার পাশে বসলো। নুরুল কবরেজ ঘটনা বলতে যেতেই তৈয়ব বলে উঠলো, আমি সব শুনছি। ওরে কেমন জিনে ধরছে সেইডাও বোবার পারছি। কবরেজ যতটাকা লাগে দিমু। ওরে জ্ঞান হারানোর পর্যন্ত পিডাও। আমি পিডায়ে মারলে জেল হবো, জরিমানা হবো, আর কেউ বিয়ের জন্য মাইয়া দেবো না। কাজটা তোমাকেই করতে হবে কবরেজ।