এক: প্রিয় চিঠি
প্রিয় চিঠি,
আজ তুই উড়ে যা, গিয়ে বল তারে, সে যেন ভুলে না আমারে। সে যেন ভুলে না গোরের উত্থান, আনচান করা বেহুলার বাগান, তারে ডেকে তুলে আনা বিনাকার ফেনা, চিরদিন চেনা যত চুমুর গন্ধ, বন্ধ থাকা ঘুমরাতে আঁটা কামনার খিলান, বুকের বাতাস, সময়ের ঘড়ি, ভুলে না রে যেন সে সবুজ দুপুরে এক প্রজাপতির ওড়াউড়ি, বলিস তারে নির্জনে যাবে বলে বলেছিল সে যে কথা, শুনে ছুতোর মিস্ত্রি হয়ে আসবে প্রজাপতি প্রকৃতির ললাটে। নির্জন কপাটে বসে কথা হবে যার সঙ্গে, সেখানে যে ধ্যানমগ্ন এক মুনি শীতল শরাবে লেপ্টে থাকে।
সেখানে প্রকৃতির মলাট খুলে কবিতা পড়ে ঝাপসা চোখের এক নারী, সেখানে বসে সে নির্জনের বুড়বুড়ি বুকে তুলে আনে, সেখানে সে বোলতার ডানা কেটে ইতিহাস লেখে, সেখানে সে নদীর কপালে চুমু খেয়ে মরে যেতে জানে, কী করে হলুদ চাঁদ কপালে ঠেকাতে হয়, তাও সে জানে, কী করে অন্ধকারে ত্রিভুজ নামাতে হয়, কী করে অতল ত্রিভূজে নীরবতা পোড়াতে হয়, ধ্যানীর চোখ খোলাতে হয় ওই ঝাপসা চোখের নারী সব জানে।
বলে দিও চিঠি, নারীকে বাদ দিয়ে নির্জনতা খোঁজে যে ধ্যানী তারও নিঃশ্বাসের শব্দে নির্জনতা ভাঙে। সেই নিঃশ্বাসের টানে উতরোয় লাল জল ভাদরের গাঙে। বলে দিও চিঠি, ত্রিভূজা রমণী যাকে নিয়েছে, ডেকে গোরের উত্থান থেকে, বিনাকার ফেনা থেকে সে নারীরও ইতিহাস দীর্ঘশ্বাসের বেনাল জলে ডুবে মরে।
ইতি নির্জনতা
বুকপোড়া গ্রাম থেকে
দুই: ব্যথার কাছে চিঠি
আহা ব্যথারে!
আমার বিশুদ্ধ বুকে তোর অবাধ হুল্লোড়! সেই কবে ষোড়শী বাগানে বেগবান করেছিস তোর দুরন্ত গলি! আহারে কেন তুই শৈশবের মনভোলা ঝাপটা নদীতে শিমুল ফোটাতে গেলি! এরপর পারুল চোখে কত ঝোঁপ-ঝাড়, বনবাদাড় উজাড় করে হু-হু বাতাস আমাকে চেনালি, চেনালিরে তুই তারাদের ঘুমপথ জোনাকির রাজপথ আলোর ফণা মায়াবি কণার লাল-নীল-দিপালী। তখন বালিকা মন আমার উরু-উরু, ভীরু-ভীরু কখন যে হয়ে গেছে গল্পের সারেং, উল্লাসের অল্প পারদে ডুবে হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির খেদ, মেঘের মতো এই কালো, এই বুঝি রোদ এলো আলো-ছায়ার খেলায় কিছুটা আবেগ আহা ব্যথা এত কথা কত বলি রে!
আমি যে স্বপ্নে ভস্ম হয়ে গেছি রে! তোরই দহন আমারে করেছে দাহন, জেনে গেছি আমি প্রেমের মুকুলে তোর ফুটে থাকা ফুলের রুমাল, বুকের সাতকাহনে ছিলো রে আড়াল, আজ তাকে খুলতে গিয়ে দেখি, জীবন হয়ে গেছে কখন ধূসর বাদামি, হায়রে ব্যথা তুই আমার বুকে তুফান জ্বালা, শৈশবের পালা আর বর্তমানের এক দাগি আসামি। আহা ব্যথা, জীবন স্তবকে তোকে একাকী পাঠ করে চলি, আমার ষোড়শী বাগানের ঝাপটা নদীতে থাকা তুই সেই গোধূলি যার জন্যে, এই খাঁ খাঁ বুকে আর ফাগুন আসে না, রাতের মসনদে এখন একা বসে থাকি আকাশ হাসে না!
ইতি
যাকে পোড়াতে তোর ভালো লাগে,
ব্যথার হাট থেকে
তিন: বসন্ত বন্দনা
জীবনের বহু বেদনা ছিঁড়েফুঁড়ে চলে যায় কোথায় যেন রোজ, তবু খবরের কাগজের মতো বসন্তের পাতা খোঁজ করে নিয়ে আসে ফুলের বন্দনা, পাখির গান, শুভ হালখাতা।
আমিও তোমার নামে বসন্তের গোলাপ ঘ্রাণে আনমনে বিহ্বল হই, বসন্ত এসেছে তাই পাতার ভাঁজে প্রিয়ফুল হয়ে রই। স্বপ্নগ্রন্থে লিখে চলি পুষ্পবন্দনা। চারু ললিতের ডালপালা খুলবো না ভেবে খুলে ফেলি সমস্ত ঋতু, তার ভেতর ভীতু শীতের গা-ঘেঁষে উল্টো রোদের রথে চড়ে আসে শিশিরের মুক্তো। সেখানে সব সুন্দর দেখি তোমার মতো, যেন অবিরত পুঁথির পৃথিবীতে সুরেলা টান ভেসে আসে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরতে বসন্তে। যদি জানতে সেসব সুর তোমাকে ভেবে গেয়েছে কোকিল, দোয়েল শ্যামা ময়না, তাহলে ফুলের গহনা হয়ে হাজির হতে আমার গলে।
আমার গলের তলে সোনালি তিল বসে আছে চাঁদের মতো, তার ভেতর চুপেচাপে লিখে রাখি তোমার উদ্দেশে আমার লেখা যত। কবিতার পাণ্ডুলিপি জানে পাগলামির ভার সইতে না পেরে আজ চিবুকের তিলে বসন্তের কারুকাজ, সব ফুল এক হয়ে নির্জন কবির সমস্ত লাজ ভেঙে বদলে দেবে বলে এক হয়ে ওরা আজ বলছে সমস্বরে, ফুলেরা ফুটেছে, বসন্ত এসেছে, চাঁদছাড়া কে এখন হবে আলোর ফসল এই রাতের আঁধারে? এসো হে তুমি বসন্ত পিরাণ পরে এই প্রকৃতির মাজারে।
ইতি বসন্তবালিকা
সবুজপল্লব থেকে