বছর কুড়ি পর এই শহরে এলাম।
আমার একজনমের একটা অতীত এই জায়গার ধূলোবালি-বাতাসে মিশে আছে।
এইসব গাছ যখন শৈশবে, তখন তাদের সিঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ন্ত আমারও কচিমন। সেই সবুজ মনে নানান রঙে রাঙিয়েছিল এই শহরের একটা গলি। সেই সব রঙ গলির হাত ধরে ছুটে বেড়িয়েছে শহরময়। রঙিন করেছে এই সব রাস্তা। নদীর জলস্পর্শী কিনারা। বালুচর। থিয়েটার-হল।
চিড়িয়াখানা থেকে ফেরার পথে ভেতরটা মোচড় খেলে গেলো। রুহী আর তার মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বললাম, আসছি। মা-মেয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝলো, বুঝতে পারলাম না। রুহীর মা ড্রাইভারকে ইশারা করলো। গাড়ি গড়ালো মোটেলের দিকে।
আমার বুকে নিয়ন্ত্রণচ্যুত ঢিপঢিপ শব্দ। সে অতিমাত্রায় বাড়তে লাগলো! রাস্তার সবাই তা শুনতে পাচ্ছে, আমি নিশ্চিত। তারা সবাই কি তাকিয়ে আছে আমার দিকে? আছে হয়তো। আমি চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না।
গলিটার কাছাকাছি হতেই আমার সব নিয়ন্ত্রণ কে যেন লুফে নিলো। মুহূর্তে কত কী ভিড় জমালো স্মৃতিতে। সেসব ঠেলে একটা ইচ্ছা প্রবল হলো। আবার একবার দাঁড়াই ওই দরজাটার সামনে!
রিথির মা দরজা খুলে দেবেন।
-কে আপনি?
অনেক দিন পরে দেখা। সেজন্যই, অথবা মাস্ক পরে থাকার কারণে, আমাকে তিনি চিনতে পারবেন না।
-আন্টি, রিথি আছে?
-রিথি? না তো। সে তো শ্বশুর বাড়ি।
কিন্তু আমি জানি, রিথি বিয়ে করেনি। কিন্তু তার করা উচিত। বেশিরভাগ মেয়েই করে। মেয়েদের সত্যিকারের প্রেম সামাজিক আবরণে ঢাকা নয়। সমাজের কারণেই তাই তারা বিয়ে করে। ছেলেদের প্রেম সামাজিক। তাই তারা বিয়ে করে না। বিয়ে না করে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছিল!
রিথির প্রেম সত্যি ছিল। সেটাকে মিথ্যে প্রতীয়মান করতেই হয়তো বিয়ে করেছে।
-কোথায়?
-আপনি কে?
-আমি রাজন।
-ওহ, রাজন? এসো বাবা, ভেতরে এসো।
কিন্তু আমি জানি, আমাকে তিনি ভেতরে ডাকবেন না। কেন ডাকবেন! মেয়ের প্রেমিক আমি। তাকে কাঁদিয়ে দূরে সরে এসেছি। আজ, এই কুড়ি বছর পরে, আমাকে কেন ক্ষমা করবেন তিনি!
-না আন্টি, থাক্। অন্য একদিন আসবো। রিথি কেমন আছে?
-ভালো নেই বাবা। খুব বেশি ভালো নেই।
কিন্তু আমি জানি, রিথি ভালো আছে। হয়তো খুব বেশি ভালো নেই। আমাদের মেয়েরা খুব বেশি ভালো থাকার স্বপ্ন দেখে না। মোটামুটি ভালো থাকলেই খুশি। চারপাশের অনেকেই যখন অসুখি, তখন নিজের মোটামুটিকেই তুলনায় অনেক উঁচু দেখায়।
-এই ছবিটা কার?
-রিথির ছেলের। ছোট বেলার ছবি।
এটাও জানি, সম্ভব না। শেষবার যখন রিথির অপারেশন হয়, তখন ওর জরায়ুটা কেটে ফেলতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, ও কোনোদিন মা হতে পারবে না। আমার বুকে মাথা রেখে অনেক কেঁদেছিল সেদিন। এখনো এখানে হাত দিলে আমার হাতটা ভিজে ওঠে। এখনো, খুব মন খারাপের সময়, ওর চোখ থেকে ধেয়ে আসা গরম জল ঝরে পড়ার শব্দ শুনি।
অসহায় আমি কতকাল নিশ্চুপ ছিলাম। বহুযুগ পর জেগে উঠে মনে হলো, আমার কিছু বলা উচিত অবশ্যই। চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে বলেছিলাম, অথবা বলার চেষ্টা করেছিলাম, চিন্তা করো না, রিথু। আমার তোমাকে পেলেই হবে।
কিন্তু ওর কান্না থামেনি। বহুক্ষণ কেঁদেছে। বহু বছর। মনে হয় কয়েক শতক।
সেদিনই বুঝেছি, একটা মেয়ের স্বপ্নের ভেতর তার সন্তানও থাকে। সন্তান ছাড়া স্বপ্ন অসম্পূর্ণ। এখন আমিও জানি, সন্তানের কষ্টপ্রসূত মিষ্টি, নিষ্পাপ মুখ একটা মেয়েকে পূর্ণ করে। একটা পূর্ণ মেয়েকেই সমাজ মা স্বীকৃতি দেয়।
-চিন্তা করো না। কত কত অসহায় বাচ্চা আছে সমাজে। তাদের একটাকে আমরা কোলে তুলে নেবো!
এ জায়গাটায় তুমি বেশ একরোখা ছিলে। তোমার চাহনি দেখেই বুঝেছি। তুমি হঠাৎই চিৎকার করে কেঁদে উঠলে। কেন, জানি না। হয়তো তুমি আমার চোখেমুখে কোনো নিরাপদ উত্তর খুঁজে পাওনি। সেই আর্তশব্দে আরও অস্থির হয়ে উঠলাম। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। ভেতরে রক্তপ্লাবণ নিয়ে বাইরে নির্বিকার হওয়ার কী চেষ্টাটাই না করে চললাম। আমাকে নির্বাক দেখেই হয়তো তুমি অনেক সময় নিয়ে কান্না করলে। আমি আর বাধা দেইনি। কান্না মানুষের ভেতরের ভারকে লাঘব করে।
দুই.
রিথির এই বিষয়টা জানাজানি হলে পরিবার পিছিয়ে গেলো। আমি পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা-বাবা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তারা চাননি এমন মেয়ে আমার বউ হোক, যে মা হতে পারবে না। আমি ছাড়া তাদের বংশরক্ষার আর কেউ নেই। এই বংশচিন্তা আমার সব আবেগের ঊর্ধ্বে। শুধু আবেগের ঊর্ধ্বে কেন বলছি, সব চাওয়া, সব বিশ্বাস ও বাস্তবতারও ঊর্ধ্বে। কোনোভাবেই বোঝাতে পারিনি মা-বাবাকে। কিছুতেই তারা বুঝবেন না যে, রিথি খুব ভালো মেয়ে। তাকে ছাড়া আমার চলে না। সেও বাঁচবে না আমাকে না পেলে।
একটা সন্তান দত্তক নিলেই তো হয়। সেটা শুনে কয়েকদিন বাবা-মা প্রায় না খেয়েই থাকলেন!
ওর গাল বেয়ে ধেয়ে আসছে গলিত অশ্রু। দুই-দুটো লাভাপ্রবাহ। আমি তাদের মিলিতপ্রবাহে ক্রমাগত ডুবে যেতে থাকলাম!
একদিন, ঠিক মাঝরাতে, বৃদ্ধ মা-বাবা এসে হাত চেপে ধরলেন। আমি মরমে মরে গেলাম। আমি পিছিয়ে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই। চোখ ফেটে জল আসছিল। আমার কান্নাচোখ ঝাপসা দেখলো, বাবার গাল বেয়ে নামছে অবুঝ জল। মায়ের চোখ ভাষাহীন। সেখানে ঢেউ, মস্ত মস্ত ঝড়ো ঢেউ।
আমি নীরব হলাম। নীরবতা কোন্ শব্দে অনূদিত হলো কে জানে!ঠিক দুদিন পরে ঘরে বউ এলো। পরের বছরের এক বছরের মাথায় রুহী।
রুহীর কচিমুখ আমার কষ্ট অনেকটাই কমিয়ে দিলো। মেয়ে আমার যত বড় হয়, কষ্ট তত কমে।
তিন.
-কিন্তু আন্টি…
আন্টি থামিয়ে দেবেন। বলবেন, খোদা চাইলে অনেক কিছুই হয়। কিন্তু খোদা সাধারণ মানুষের জন্য কেন অযৌক্তিক কিছু চাইবেন! রিথি কি মা মেরি! আমি দেরি না করে বের হয়ে চলে আসবো। ফেরার পথেই রিথির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। গলির মাথায়। এখান থেকেই সে একদিন জোর করে টেনে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। একলা বাসা। একটা রক্তলাল দিন। রিথি হয়তো চিনতে পারবে না। আমি পারব।
-রিথু।
রিথি দাঁড়াবে না। তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। বাচ্চার গলায় আমাদের কেনা সেই লকেটটা। সেই লকেটটা মানে, মেলায় কেনা। কোনো এক বাণিজ্যমেলায়। ঘুরতে ঘুরতে দুজন তখন একটা গয়নার দোকানে। দুজনেরই চোখ আটকে গিয়েছিল লকেটটায়। ছোট্ট একটা লকেট। মাঝখানে চোখধাঁধানো নীল মুক্তা। কোসো কিছু না ভেবেই কিনে ফেললাম। আমাদের সন্তানের জন্য কেনা প্রথম কোনো কিছু! আমাদের সন্তানের জন্য কেনা লকেট! কেন তার সন্তানের গলায়? কেন? রাগ হচ্ছিল। চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
-রিথু, থামো। থামো বলছি।
পাশেই একটা দরজা দড়াম করে খুলে গেলো। তাকালাম।
রিথু! রিথুই তো! রিথি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। যেমনটি সে থেকেছে বহুদিন। এই দরজা কত কত হাসিমুখের সাক্ষী, কত কত অভিমান লেগে আছে এই দরজার হাতলে-চৌকাঠে!
চোখ সরিয়ে তাকালাম রাস্তায়। মানুষশূন্য রাস্তা। কয়েকটা শালিক কোনো কারণ ছাড়াই উড়ে গেলো টিনের চালে।
তাহলে যার পেছনে পেছনে এলাম, সে কি কোনো মায়া? যাকে চিৎকার করে ডাকলাম, সে কেমন ভ্রম? কোথায় গেলো সে?
কই, কাউকে দেখছি না তো!
রিথির দিকে তাকালাম। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, সোজা আমার দিকে। বড় বড়, অবাক-সুন্দর চোখ। আস্তে আস্তে ভালোবাসা জমা হচ্ছে সেখানে। অথচ ঘৃণা জমলেই খুশি হতাম।
নাকি ঘৃণাই জমেছিল, আমি ভেবেছি ভালোবাসা? আমি আবার ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। তাকালামই বোধ হয়। সেখানে কী লেখা, পড়ার চেষ্টা করলাম। পড়তে পারলাম কি? পারলাম বোধ হয়। মনে হলো, চোখ দিয়ে ও আমাকে ডাকলো! ভেতরে যেতে বলল কি?
আধখোলা দরজা ঠেলে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বহুদিন এভাবে তাকে ঠেলে ঢুকেছি ভেতরে। অভিমানের দিনগুলোতে। ঠেলেই ঢুকতে হতো; তবু প্রাণ থাকতো সেইসব প্রবেশে।
আজ যেন চাবি দেওয়া যন্ত্র আমি। আমার অভ্যস্ত হাত। অভ্যস্ত চোখ। অভ্যস্ত পা। প্রবেশটাও অভ্যস্ত। শুধু সেখানে কোনো প্রাণ নেই!
কুড়ি বছরের আগের সেই ঘর।
একই রকম। সেই একই রঙ। অনেক মলিন।
সেই একই চৌকি। অনেকটা রঙহীন।
সেই সোফা। কিছুটা বুড়ো, ক্লান্ত বেশ!
সেই দেয়াল। দেয়ালে ঝোলানো সেই লোকজন। জীর্ণ হয়ে গেছে, তবু কজন মিলে মাছধরা বন্ধ করেনি। রিথির প্রথম জন্মদিনে লোকগুলোকে এক টকুরো খাল আর কিছু কচুরিপানাসহ গিফ্ট করেছিলাম।
রঙহীন কচুরিপানা থেকে সামনে এগুতেই চমকে উঠলাম!
এসব কী!
দেয়ালভর্তি রুহীর ছবি। হ্যাঁ, রুহীরই তো। এগুলো তো সবই রুহীর ছবি। এইটা, ওইটা, ওই তো, ওগুলো; সব, সব। এটা রুহীর এক দিনের ছবি। এটা এক বছরের। এটা আর একটু বড় হলে…ওর শিশুকাল থেকে শুরু করে আজ দশ বছরের, অসংখ্য ছবি! এই যে, এটা, এটা তো এই সপ্তাহের নতুন ছবি! ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম।
পুরোটা বুঝতে কয়েকটা সেকেন্ড সময় লাগলো।
সব ছবিই ফেসবুক থেকে নেওয়া!
-রিথু!
মনে হয় ফ্যাসফেসে, ভেজা গলায় ডেকে উঠলাম।
রিথি কিছু বলছে না।
ওর গাল বেয়ে ধেয়ে আসছে গলিত অশ্রু। দুই-দুটো লাভাপ্রবাহ। আমি তাদের মিলিতপ্রবাহে ক্রমাগত ডুবে যেতে থাকলাম!